01/06/2025
বিষাদ বৃষ্টি
সাজিম হোসেন
সবকিছুই যেন থমকে আছে—শ্বাসরুদ্ধকর বৃষ্টিতে আমি ভিজছি, প্রিয়তমা রুহির সাথে।
প্রিয় মানুষের সাথে বৃষ্টিতে ভেজা তো আনন্দের হওয়ার কথা।
হওয়ার কথা ছিলো এক অপার্থিব সুখের মুহূর্ত।
কিন্তু আজ নয়।
কারণ আজ আমার রুহি, আমার হৃদয়ের রানী—নিশ্চল পড়ে আছে, নিথর।
সে আর বেঁচে নেই।
সাড়ে তিন ঘণ্টা হয়ে গেছে রুহি মৃত।
আমি এখনও তার নিঃশ্বাস খুঁজি, তার চোখের পলক পড়া দেখার চেষ্টা করি,
তবুও মেনে নিতে পারছি না—রুহি নেই।
বৃষ্টির প্রতিটি ফোঁটা যেন আমার হৃদয়ের কান্না হয়ে ঝরে পড়ছে।
আকাশের গর্জন যেন আমার বুক ফাটিয়ে দেয়, বাতাস কাঁদছে আমার মতোই।
আমি তার মৃতদেহের পাশে বসে আছি।
তাকে ছেড়ে যেতে পারছি না।
কল্পনায় দেখি, রুহি হঠাৎ উঠে বলছে,
“এই যে, আরেকটু ভিজি, এই বৃষ্টি তো এমন সহজে আসে না!”
তার হাতে একটুকরো কামিনী ফুল, চুলের খোঁপায় গুঁজে দেয় আমার জন্য।
সে হাসে, পায়ের নূপুর বৃষ্টির শব্দের সাথে একাকার হয়ে যায়।
তার সেই গন্ধ, সেই হাসি—সব এখন শুধুই স্মৃতি।
আজ রুহির গায়ে সেই কামিনী ফুলের ঘ্রাণও অন্যরকম।
ভেজা ফুলের পানি তার মৃত শরীর ছুঁয়ে যাচ্ছে, আমি অবাক হয়ে ভাবি,
যদি এখনই রুহির কানে আমার কণ্ঠস্বর পৌঁছে যায়,
সে কি উঠে বসবে না?
আবার বৃষ্টিতে আমার হাত ধরে হাঁটবে না?
আমি জানি, এটা সম্ভব না।
তবুও ভাবতে ভালো লাগে।
কল্পনা বড়ই সহজ, বড়ই নির্মল।
বাস্তব বড় নিষ্ঠুর।
আমি এখনও কাউকে কিছু জানাইনি।
এই বাড়িতে আজ আমি আর রুহি।
বৃষ্টিতে কেউ আসতেও পারছে না।
চারদিকে অন্ধকার, কাঁপুনি ধরা হাওয়া,
আর আমার নিঃসঙ্গতা।
হঠাৎ দূর থেকে কে যেন ডাক দেয়, “আদর, আদর! কথা বলিস না কেন?”
আমি জবাব দিতে চাইলাম।
কিন্তু গলা দিয়ে কোনো আওয়াজ বের হয় না।
আমার কণ্ঠ আটকে গেছে কান্নার গভীরে।
বৃষ্টি থেমে গেছে।
হয়তো রুহির বৃষ্টিভেজা শেষ।
এবার সে ঘুমাতে চায়।
চিরনিদ্রায়।
আকাশের পানি ফুরিয়েছে,
কিন্তু আমার চোখের পানি যেন শেষ হচ্ছে না।
পাঁচটা বাজে, আজান হচ্ছে।
ঠিক তখনই মা বাড়ি ফিরে এলেন।
আমাকে রুহির লাশের পাশে বসে দেখে,
একটা কান্নার চিৎকারে ভেঙে পড়লেন তিনি।
প্রশ্ন করলেন বারবার—“কি হয়েছে আদর? রুহি কীভাবে? কেন?”
আমার কোনো উত্তর নেই।
শুধু চোখে পানি।
মায়ের কান্না দেখে নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলাম না।
একসময় সবাই জেনে গেল—রুহি আর নেই।
বাড়ি কান্নার সুরে ভরে উঠলো।
মানুষ আসছে একে একে—প্রতিবেশী, বন্ধু, আত্মীয়।
রুহিকে দাফনের প্রস্তুতি নিচ্ছে তারা।
কেউ টেনে নিয়ে যাচ্ছে আমাকে ঘরের ভেতর।
কিন্তু আমি রুহিকে ছেড়ে যেতে চাই না।
তবুও বাধ্য হচ্ছি।
রাহাত ভাই টেনে নিয়ে যাচ্ছে গোসলখানায়।
আমার শরীরে শক্তি নেই।
কথা বলার মতো ভাষা নেই।
ভাঙা মগ দিয়ে আমাকে গোসল করানো হচ্ছে।
এই মগটাই আমি একদিন রাগ করে ভেঙেছিলাম—রুহির উপর অভিমান করে।
আজ সেই মগ দিয়েই চলছে বিদায়ের গোসল।
সব ভুলগুলো, রাগ, অবহেলা
এখন কাঁটার মতো বিঁধে যাচ্ছে মনে।
না করলেই হতো।
তাকে একটু বেশি ভালোবাসলেই হতো।
সাদা পাঞ্জাবি পরেছি
রুহি আমার জন্মদিনে এটা উপহার দিয়েছিল।
আজ সেটা পরে তার জানাজার নামাজে দাঁড়াবো।
রুহি দেখলে কি খুশি হতো?
নাকি কাঁদতো?
জানি না,
তবে আমি শুধু অনুমান করে নিচ্ছি,
হয়তো সে চাইতো আমি শক্ত থাকি।
তবুও পারছি না।
আজ যে রুহিকে কেউ সহ্য করতে পারত না,
সেই মানুষটাও এসেছে তাকে দেখতে।
তার চোখেও পানি।
মানুষ কতো বদলায় মৃত্যু দেখে!
আর আমি এখনো দাঁড়িয়ে আছি…
চোখের জল আর বৃষ্টির ফোঁটার মাঝে পার্থক্য ভুলে গিয়ে।
রুহির পাশে, নিঃশব্দে।
সবাই জড়ো হলো জানাজার জন্য।
মসজিদের উঠানে সাদা কাফনের কাপড়ে মোড়া রুহিকে রাখা হলো।
তার সেই নিঃসাড় মুখ—যার দিকে তাকাতে পারি না, তবুও চোখ ফেরাতেও পারি না।
আমি দাঁড়িয়ে আছি ইমামের পেছনে, দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসছে।
কারণ আমি জানি, এই নামাজই শেষ,
এই প্রার্থনার পর আর কোনো “রুহি” থাকবে না আমার জীবনে।
আল্লাহু আকবার…
ইমামের কণ্ঠে ধ্বনিত হলো সেই চিরচেনা ডাক,
কিন্তু আজ যেন তা ছুরির মতো বিদ্ধ করছে আমার বুক।
প্রতিটি তাকবীরের মাঝে শুধু রুহির মুখ ভেসে উঠছে—
তার হাসি, তার অভিমান, তার ছোট ছোট আবদার।
জানাজা শেষ হলে সবাই এগিয়ে এলো রুহিকে কাঁধে তুলে নিতে।
আমি কিছুতেই ছাড়তে চাইছিলাম না তাকে।
একবার ছুঁয়ে দিলাম তার কাফনের কাপড়—
একটুখানি স্পর্শ, একটুখানি বিদায়।
তারপর ধীরে ধীরে চলে গেল রুহি কবরের দিকে।
আমি পিছনে পিছনে হাঁটছি, পা যেন জমে যাচ্ছে কাদায়।
বৃষ্টি থেমে গেছে, কিন্তু মাটিতে এখনো রুক্ষতা নেই—
কারণ আজ প্রকৃতি নিজেই কাঁদছে রুহির জন্য।
কবরের পাশে দাঁড়িয়ে আমি অসংখ্য মানুষের মধ্যে সবচেয়ে একা।
কারও চোখে পানি, কারও মুখে শোক,
কিন্তু আমার মনে হচ্ছে, আমি আমার পৃথিবীটাই হারিয়ে ফেলেছি।
রুহিকে শোয়ানো হলো মাটির গভীরে।
তারপর একে একে পড়ে যেতে লাগলো মাটি।
প্রথম মুঠোটা আমি নিজে ফেললাম—
হাত কাঁপছে, কিন্তু মন কাঁপছে আরও বেশি।
একটু আগে যে মুখটা দেখছিলাম,
সেই মুখটাই এখন চিরতরে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে।
একটা একটা মাটি ঢেকে দিচ্ছে আমার স্মৃতিকে, আমার ভালোবাসাকে।
সব শেষ।
মানুষজন ফিরে যাচ্ছে।
কেউ মাথায় গামছা বেঁধে, কেউ ছাতা মাথায় নিয়ে।
আমি দাঁড়িয়ে থাকি একা।
রুহির কবরের সামনে।
চোখে জল নেই, কারণ সব কেঁদে ফেলেছি আগেই।
শুধু বুকের গভীরে জমে আছে এক যন্ত্রণার পাহাড়।
মনে পড়ছে রুহির শেষ কথাটা—
“আদর, আমাকে কখনো ছেড়ে যাস না, কেমন?”
আমি বলেছিলাম, “তুই না থাকলে আমি তো থাকতেই পারবো না।”
কথাটা মিথ্যে ছিল না, কিন্তু ভাগ্য বুঝি কানে শোনে না।
রাত বাড়ে, বাতাসের ঠাণ্ডা হিম হয়ে কাঁপিয়ে তোলে আমাকে।
তারপর ধীরে ধীরে আমি হাঁটতে থাকি বাড়ির দিকে।
প্রতিটি পদক্ষেপে শুধু একটা কথাই ঘুরে ফিরে আসে—
রুহি আর নেই।
কিন্তু রুহির স্মৃতি, রুহির বৃষ্টি, রুহির গন্ধ—এই হৃদয়ে চিরজীবী।
সন্ধ্যায় আমি.........
চলবে........ অ'নু'ভু'তি