01/05/2025
আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস: শুধুই আনুষ্ঠানিকতা নয়, একটি সংগ্রামের প্রতীক
শ্রমজীবী মানুষের অধিকার আদায়ের ইতিহাস ও তাৎপর্য আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস, যা সাধারণভাবে মে দিবস নামে পরিচিত। এটি বিশ্বের শ্রমজীবী মানুষের সংগ্রাম, অধিকার ও মর্যাদার প্রতীক। প্রতিবছর ১ মে দিবসটি পালিত হয়, যা শ্রমিকশ্রেণির ন্যায্য দাবি ও অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের একটি বৈশ্বিক প্রতীকী দিন। এটি শুধু ছুটির দিন নয়, বরং একটি ইতিহাসের সাক্ষ্য বহনকারী দিন, যেখানে শ্রমিকদের আত্মত্যাগ, লড়াই ও বিজয়ের গল্প জড়িয়ে আছে।
মে দিবসের সূচনা ১৮৮৬ সালের যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরে। সেই সময়ের শ্রমিকেরা দৈনিক ৮ ঘণ্টা কাজের দাবিতে আন্দোলনে নামেন। ১ মে হাজার হাজার শ্রমিক কাজ বন্ধ করে রাস্তায় নেমে আসেন। এই আন্দোলন শান্তিপূর্ণ হলেও ৪ মে হে মার্কেট স্কয়ারে এক বোমা বিস্ফোরণের ঘটনায় পুলিশ ও শ্রমিকদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। এতে অনেকেই নিহত হন। এ ঘটনার পর বেশ কয়েকজন শ্রমিকনেতাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়, যাঁদের পরবর্তী সময়ে শিকাগোর শহীদ হিসেবে স্মরণ করা হয়। এ রক্তাক্ত আন্দোলনই আজকের মে দিবসের ভিত্তি স্থাপন করে। ১৮৮৯ সালে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক শ্রমিক সম্মেলনে ১ মে দিনটিকে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
আধুনিক প্রেক্ষাপটে মে দিবসের তাৎপর্য ও বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট
বর্তমানে বিশ্বের ৮০টিরও বেশি দেশে মে দিবস জাতীয় ছুটির দিন হিসেবে পালিত হয়। অনেক দেশেই এটি বেসরকারিভাবে পালিত হলেও দিনটির গুরুত্ব কোন অংশে কম নয়। এদিনে শ্রমিক সংগঠন, ট্রেড ইউনিয়ন এবং বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক সংগঠন মিছিল, শোভাযাত্রা এবং সমাবেশের মাধ্যমে শ্রমিকদের অধিকার, ন্যায্য মজুরি, নিরাপদ কর্মপরিবেশ ও কর্মঘণ্টা নির্ধারণসহ বিভিন্ন দাবি আদায়ের লক্ষ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করে।
বাংলাদেশে মে দিবস সরকারি ছুটি হিসেবে পালিত হচ্ছে ১৯৭২ সাল থেকে। এ দিনে শ্রমিক সংগঠনগুলো র্যালি, আলোচনা সভা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানসহ নানা কর্মসূচি পালন করে। "শ্রমিক-মালিক ঐক্য গড়ি, উন্নয়নের শপথ করি"—এই ধরনের স্লোগান দিয়ে শ্রমিক স্বার্থে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানানো হয়।
মে দিবস কেবল একটি নির্দিষ্ট তারিখ নয়; এটি শ্রমজীবী মানুষের সংগ্রাম, আত্মত্যাগ, অধিকার সচেতনতা ও ঐক্যের প্রতীক। এটি আমাদের মনে করিয়ে দেয়, শ্রমিকরা কেবল উৎপাদন প্রক্রিয়ার অংশ নন, তারা একটি জাতির অগ্রগতির ভিত্তি। শ্রমিকদের অধিকার, নিরাপত্তা এবং মর্যাদা নিশ্চিত করা প্রতিটি রাষ্ট্রের নৈতিক ও সাংবিধানিক দায়িত্ব।
বাংলাদেশ সরকার শ্রমিকদের অধিকার রক্ষায় শ্রম আইন ২০০৬ প্রণয়ন করেছে, যা পরবর্তীকালে সংশোধনের মাধ্যমে আরও আধুনিক করা হয়েছে। সরকার ন্যূনতম মজুরি বোর্ড, শ্রম আদালত, পেনশন ও বিমা সুবিধা, কল্যাণ তহবিল এবং সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির মাধ্যমে শ্রমিকদের কল্যাণে নানা উদ্যোগ নিয়েছে। একই সঙ্গে, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও)-র একাধিক কনভেনশনে স্বাক্ষর করে বাংলাদেশ বৈশ্বিক শ্রম অধিকার বাস্তবায়নে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়েছে।
বিভিন্ন ট্রেড ইউনিয়ন, শ্রমিক ফেডারেশন ও নাগরিক সংগঠন মে দিবস উপলক্ষে মানববন্ধন, আলোচনা সভা ও মিছিলের মাধ্যমে শ্রমিক-মালিক সম্পর্ক উন্নয়ন, ন্যায্য মজুরি এবং শ্রমিক মর্যাদার বিষয়গুলো তুলে ধরে।
অতএব, মে দিবসকে কেবল আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে, কার্যকর পদক্ষেপ ও বাস্তবভিত্তিক কর্মসূচির মাধ্যমে শ্রমিকদের সম্মান, অধিকার ও কল্যাণকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া উচিত।