
31/05/2025
ভাবুন তো, দেশের মাটিতে যখন রাজনৈতিক মেঘ ঘনিয়ে আসছে, যখন আগামী দিনের অনিশ্চয়তা অনেকের কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলেছে, ঠিক তখনই হাজার হাজার মাইল দূরে প্রযুক্তির তীর্থ ভূমি জাপানে এক অবিশ্বাস্য সুসংবাদ। আগামী পাঁচ বছরে অন্তত এক লাখ বাংলাদেশী শ্রমিক জাপানে কাজ পাবেন। শুনতে রূপ কথার মত লাগছে তাই না? কিন্তু এটা স্বপ্ন নয় বরং এক অনবদ্ধ বাস্তবতার পথে বাংলাদেশের এক ঐতিহাসিক পদযাত্রা।
বৃহস্পতিবার জাপানের রাজধানী টোকিওতে হয়ে গেল এক বিশেষ সেমিনার। বাংলাদেশ সেমিনার অন হিউম্যান রিসোর্সেস। আর সেখানেই ঘোষণা দেওয়া হল এই যুগান্তকারী পরিকল্পনার। যেখানে জাপানের সরকার ও ব্যবসায়ী মহল একযোগে জানিয়ে দিল, বাংলাদেশের শ্রমিকদের জন্য খুলে যাচ্ছে জাপানের শ্রম বাজারের বিশাল দরজা। এটি কেবল একটি চাকরির সুযোগ নয়। এটি বাংলাদেশের মানুষের জন্য জাপানকে জানার এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে চলেছে। এমন এক সময়ে যখন দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে টানা পড়েন ও অস্থিরতা চরম। তখন এই ইতিবাচক সংবাদটি নিঃসন্দেহে এক ঝলমলে আলোর রেখা।
অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি ছিলেন শান্তিতে নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক মোহাম্মদ ইউনুস। তার আবেগ ঘন ভাষণ সকলের মন ছুঁয়ে যায়। তিনি বলেন এটা শুধু চাকরির সুযোগ নায় বরং বাংলাদেশের মানুষের জন্য জাপানকে জানার এক নতুন দ্বার। দেশের এমন কঠিন রাজনৈতিক পরিস্থিতিতেও তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে আশ্বাস দেন, যে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এই ঐতিহাসিক সুযোগকে কাজে লাগাতে সব ধরনের সহায়তা দেবে। যাতে এই প্রক্রিয়াটি সুষ্ঠু ও সফলভাবে সম্পূর্ণ হতে পারে। অধ্যাপক ইউনুসের এই উদ্যোগ যেন এক ম্যাজিক হাতে দেশের সম্ভাবনার এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে।
এই সেমিনারে স্বাক্ষরিত হয়েছে দুটি গুরুত্বপূর্ণ সমঝোতা স্মারক, যা এই উদ্যোগের বাস্তবায়ন রূপ দিতে সাহায্য করবে। একটি স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে বি এম ই টি এবং কাইকম ড্রিম স্ট্রিটের মধ্যে। অপরটি স্বাক্ষরিত হয়েছে বিএমইটি জাপানের ন্যাশনাল বিজনেস সাপোর্ট কম্বাইন্ড কো-অপারেটিভস এবং জেবিবিআরএ এর মধ্যে । এই সমঝোতা স্মারক গুলো জাপানে বাংলাদেশী শ্রমিক পাঠানোর প্রক্রিয়াকে আরও সুসংগঠিত ও মসৃণ করবে। জাপানের বিভিন্ন কোম্পানির প্রতিনিধিরা বাংলাদেশী তরুণদের মেধা ও দক্ষতার ভূয়ষি প্রশংসা করেছেন।
সিজু ওয়াকার কর্মপরিবেশ উন্নয়ন সমবায়ের পরিচালক মিতসুরু মাসুশিতা বলেন, বাংলাদেশের প্রতিভা লালন করা আমাদের দায়িত্ব। আমরা তাদের ক্ষমতা বিকাশে এবং জাপানের কর্মপরিবেশে মানিয়ে নিতে সব ধরনের সহযোগিতা দিতে প্রস্তুত। তার এই মন্তব্য বাংলাদেশী শ্রমিকদের প্রতি জাপানি কোম্পানিগুলোর ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরে।
জাপানের বিখ্যাতি ওয়াতামি গ্রুপ প্রতিবছর বাংলাদেশের ১৫০০ শিক্ষার্থীকে প্রশিক্ষণ দেয় যা তারা বাড়িয়ে তিন হাজার করার পরিকল্পনা করছে। গ্রুপ প্রেসিডেন্ট মিকিওয়াতা নাবে বলেন, বাংলাদেশের কারিগরি শিক্ষার্থীরাই হবে জাপানের ভবিষ্যৎকর্মবাহিনী। তাদের নিষ্ঠা, শেখার আগ্রহ এবং কর্মদক্ষতা জাপানের শ্রম বাজারের জন্য অত্যন্ত মূল্যবান। এই পরিকল্পনা বাংলাদেশের কারিগরি শিক্ষাকে আরো গুরুত্ব দেবে এবং তরুণদের দক্ষ জনশক্তিতে রূপান্তরিত হতে সাহায্য করবে ।
তবে এই বিশাল কর্মযজ্ঞের পথে কিছু চ্যালেঞ্জ ও বিদ্যমান। ভাষা শিক্ষকদের ঘাটতি এবং সাংস্কৃতিক অভ্যাসে পার্থক্য উল্লেখযোগ্য। এই চ্যালেঞ্জগুলো কাটিয়ে ওঠা অত্যন্ত জরুরী। জেইটিসিও চেয়ারম্যান হেরুয়াকি ইয়াগি এসব বিষয়ে বাংলাদেশের প্রস্তুতি ও সম্ভাবনার দিকে তুলে ধরেছেন। তিনি বলেন সঠিক প্রশিক্ষণ এবং সাংস্কৃতিক অভিযোজন কর্মসূচির মাধ্যমে এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলা করা সম্ভব।
জাপানের শ্রম প্রতিমন্ত্রী নিকি হিরোভূমি বলেন, জাপানি জনসংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে আর সেই শূন্যস্থান পূরণে বাংলাদেশের শ্রমিকদের সহায়তা অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। তার এই বক্তব্য জাপানের শ্রমবাজারের চাহিদা এবং বাংলাদেশের শ্রমিকদের অপরিহার্যতা স্পষ্ট করে তোলে। জাপানের বয়স্ক জনগোষ্ঠী এবং কম জন্ম হারে কারণে সৃষ্ট শ্রমিকদের ঘাটতি পূরণে বাংলাদেশ একটি আদর্শ সমাধান হতে পারে।
জাপানে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মোঃ দাউদ আলী জানান, ২০৪০ সালের মধ্যে জাপানের শ্রমিক সংকট পৌঁছাতে পারে এক কোটি দশ লাখে । সেই শূন্যতা পূরণে বাংলাদেশী হতে পারে প্রধান উৎস। এই তথ্য বাংলাদেশের জন্য এক বিশাল সুযোগের ইঙ্গিত দেয়। যা দেশের অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। এবং রেমিটেন্স প্রবাহ বৃদ্ধি করবে।
সবশেষে বলা যায় দেশের রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা এবং অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের মুখে এই উদ্যোগটি বাংলাদেশের জন্য এক বিশাল আসার আলো। এটি শুধু কর্মসংস্থান নয়, এটি দুই দেশের সম্পর্ককে আরো গভীর করার, ভবিষ্যৎ গড়ার এবং তরুণ বাংলাদেশীদের জন্য আন্তর্জাতিক সফলতার পথে এক সাহসী যাত্রার হাতছানি। অধ্যাপক মোঃ ইউনূসের মতে ব্যক্তিত্বের এমন একটি ম্যাজিক পদক্ষেপ যা দেশের জন্য বিপুল সংখ্যক কর্মসংস্থান বয়ে এনেছে তা নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের জন্য এক বিশাল ইতিবাচক বার্তা ।