20/01/2022
‘আমি অগোছালো। উদাসীন না। উদাসীন হলে আর্টিস্ট হওয়া সম্ভব নয়।‘ – সাক্ষাৎকারে ধ্রুব এষ
ধ্রুব এষ মনে করেন, হুমায়ূন আহমেদ স্বাধীনতা না দিলে প্রচ্ছদশিল্পের এ পরিবর্তন তার হাতে সম্ভব হতো না। তিনি নিজেও একজন সাহিত্যিক, প্রতি বছর হুমায়ূন আহমেদকে বই উৎসর্গ করেন, সারাজীবন করবেন।
প্রচ্ছদকে ধ্রুব এষ স্বাধীন শিল্প মনে করেন না, তিনি বলেন পরাশ্রয়ী শিল্প। ফিকশন ফ্যাক্টরির সাথে সাক্ষাতকারে তিনি তার রহস্যময় ব্যক্তিজীবন ও নিবিড় শিল্পজীবন নিয়ে খোলামেলা আলাপ করেছেন।
ফিকশন ফ্যাক্টরির পক্ষ থেকে সাক্ষাতকারটি নিয়েছেন সিফাত বিনতে ওয়াহিদ।
ফিকশন ফ্যাক্টরি : প্রচ্ছদ আঁকার সিদ্ধান্ত কখন নিলেন?
ধ্রুব এষ : ছবি আঁকতাম শৈশব থেকেই। আমার মা প্রচুর বই পড়তেন, সেই সুবাদে আমারও বই পড়ার অভ্যাস গড়ে উঠে। বইয়ের প্রচ্ছদ দেখতে তখন থেকেই ভালো লাগতো। নাইন-টেনে যখন পড়ি, তখন থেকেই প্রচ্ছদ করার ইচ্ছে জন্মে। তখন থেকেই আমার মনে হয়েছে আমি কেবল বইয়ের জগতেই থাকতে চাই। শুধু প্রচ্ছদই আঁকবো, সিদ্ধান্তটাও সেই সময়ই নেওয়া। সারা জীবন প্রচ্ছদই করবো- এটা একটা পাগলের মতো সিদ্ধান্ত।
ফিকশন ফ্যাক্টরি : পাগলের মতো সিদ্ধান্ত হবে কেন? এ পেশার কারণে আফসোস বা হতাশা কাজ করে নাকি আপনার?
ধ্রুব এষ : আফসোস করার বা হতাশ হওয়ার তো প্রশ্নই আসে না। এই কাজটাকে আমি যতটা ভালোবাসি, অন্য কিছুকে সেভাবে নয়। পাগলের মতো সিদ্ধান্ত বললাম, কারণ প্রচ্ছদ এঁকে পেট চালানোর চিন্তা পাগল ছাড়া আর কে করতে পারে?
ফিকশন ফ্যাক্টরি : আপনি তো প্রতি বছর অসংখ্য প্রচ্ছদ করেন, এ ক্ষেত্রে কি কোনো বিশেষ বইকে গুরুত্ব দেন?
ধ্রুব এষ : না। কোনো বইকে আলাদাভাবে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়ার কী আছে? আমার কাছে সব বই-ই সমান, সবগুলোকেই সমান গুরুত্ব দিয়ে থাকি।
ফিকশন ফ্যাক্টরি : প্রচ্ছদ করতে গিয়ে কতটুকু স্বাধীনতা পান?
ধ্রুব এষ : প্রচ্ছদ করার ক্ষেত্রে আবার স্বাধীনতা-পরাধীনতার কী আছে?
ফিকশন ফ্যাক্টরি : আছে না! বইয়ের যিনি লেখক থাকেন, প্রচ্ছদ করার ক্ষেত্রে নিশ্চয় তার একটা পরামর্শ থাকে, আপনি কি নিজের মতো করেই করেন, নাকি সেগুলোও মাথায় রাখার চেষ্টা করেন?
ধ্রুব এষ : কেউ কেউ পরামর্শ দেন। তবে আমার ক্ষেত্রে এগুলো কম হয়। আমি এসব কম ফেস করি।
ফিকশন ফ্যাক্টরি : এই যে প্রতি বছর এত প্রচ্ছদ করেন, কিন্তু একটার সঙ্গে আরেকটার কোনো মিল নেই, একঘেয়েমিও নেই। কীভাবে বৈচিত্র্য আনছেন কাজে?
ধ্রুব এষ : বছরে ৭০০ প্রচ্ছদ যদি করি, তবে প্রতিদিন প্রায় দুইটা প্রচ্ছদের কাজ করতে হয়। এটুকু তো মনে রাখা যায়। একটার সঙ্গে আরেকটা মেলার সম্ভাবনা নেই, তবে ইদানীং কম্পিউটার ব্যবহারের কারণে কিছু দুর্ঘটনা ঘটে যায়।
ফিকশন ফ্যাক্টরি : কী রকম দুর্ঘটনা?
ধ্রুব এষ : একটা কাজ দেখে মনে হলো আগে কোথাও সেটা ব্যবহার করিনি, কিন্তু হয়তো পরে আবিষ্কার করলাম অন্য বইয়ে ইতোমধ্যে ওইটা ব্যবহৃত হয়ে গেছে অথচ আমার মনে নেই বা কনফিউশনের কারণে এটা হয়েছে।
ফিকশন ফ্যাক্টরি : ৭০০-৮০০ বইয়ের প্রচ্ছদ করতে গিয়ে মানের দিক দিয়ে কিছু বইয়ের প্রতি অবিচার করা হয় না?
ধ্রুব এষ : কখনোই না। আমি কখনোই এটা করি না। আমি এ ধারণায় বিশ্বাসী না যে ১০টা কাজ খুব ভালো করে করবো, আর বাকিগুলো কোনোমতে হেলায়ফেলায় করে দেবো। প্রতিটা কাজকেই আমি সমান গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে থাকি। প্রচ্ছদের ক্ষেত্রে প্রতিটা বইয়ের ডিমান্ড ফুলফিল করতে পেরেছি কি না, সেটাই আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ।
ফিকশন ফ্যাক্টরি : প্রায় প্রত্যেকেরই স্বপ্ন থাকে ধ্রুব এষ তার বইয়ের প্রচ্ছদটা করুক, প্রচ্ছদ করতে গেলে আপনি কোন বিষয়টাকে প্রাধান্য দেন?
ধ্রুব এষ : আমি সব ধরনের বইয়ের কাজই করি। বইয়ের মান যাচাইয়ের সুযোগ কোথায় আমার? আমি তো পেশাদারিত্বের জায়গা থেকে প্রচ্ছদ করছি। আমি তো ভাই ইন্টেলেকচুয়াল আর্টিস্ট না। প্রচ্ছদ এঁকে কিছু পরিবর্তন করার ইচ্ছা আমার নেই। কেউ যদি আমাকে সিনেমার বইয়ের কাভার করতে দেয়, শাবনূর-পপির ছবি দিয়ে আমি সেটাও করবো। বই যে মানের হবে, প্রচ্ছদও সে মানের থাকবে।
ফিকশন ফ্যাক্টরি : বাংলাদেশের বইয়ের প্রচ্ছদে আধুনিকতা তো আপনার হাত ধরে এসেছে...
ধ্রুব এষ : এগুলো আপনারা শুধু শুধু বাড়িয়ে বলেন। আমাকে প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি ক্রেডিট দিয়ে ফেলেন। আধুনিকতার বিষয় না কিন্তু এটা, বিষয় হচ্ছে একটা পরিবর্তনের। এ পরিবর্তনটা সম্ভব হয়েছিল হুমায়ূন আহমেদের মতো একজন ব্যক্তিকে পাশে পেয়েছিলাম বলে। আগে উপন্যাসের বইয়ের প্রচ্ছদ ফিগার এঁকে করা হতো। একজন বা দুজনের ফিগার দিয়েই প্রচ্ছদ হয়ে যেত। হুমায়ূন স্যার সেখান থেকে ভিন্ন জিনিস ভাবতে পেরেছিলেন। তিনিই আমাকে ডেকে বলেছিলেন তার বইয়ের প্রচ্ছদে কোনো ফিগার আঁকার প্রয়োজন নেই। বলেছিলেন, ‘আমার বইয়ের প্রচ্ছদ করার সময় চিন্তা করবা কবিতার বইয়ের প্রচ্ছদ করতেছো, ফিগার আঁকার দরকার নাই।’ একজন আর্টিস্টকে যদি এ সুযোগ দেওয়া হয়, সে বোকা না হলে এ সুযোগকে অবশ্যই কাজে লাগাবে। আমার পেশা জীবনে আমাকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করেছিলেন হুমায়ূন আহমেদ। তিনি ছিলেন বলেই আমি ধ্রুব এষ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছি।
ফিকশন ফ্যাক্টরি : হুমায়ূন আহমেদ দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন জানলাম, কিন্তু প্রচ্ছদ আঁকার পেছনে নিশ্চয় কোনো অনুপ্রেরণা কাজ করেছে?
ধ্রুব এষ : আমরা সবাই-ই তো আসলে ইউনিক। প্রত্যেকেই যার যার মতো করে কাজ করেন। অনেকের প্রচ্ছদই তো ভালো লাগে আমার। আদর্শ মানা-টানা এসব প্রাচীন বিষয়। আগে ভিঞ্চিকে আদর্শ মেনে মানুষ ছবি আঁকতো, এখন কি আঁকে? এসবের চল নেই এখন আর।
ফিকশন ফ্যাক্টরি : প্রচ্ছদ যে একটা শিল্প, পূর্ণেন্দু পত্রীর পরে এ ব্যাপারটা তো মনে হয় আপনিই তুলে এনেছিলেন...
ধ্রুব এষ : আমি এটা বিশ্বাস করি না। যারা এ কথা বলছেন, তারা আসলে কাজই দেখেননি। অনেক ভালো কাজ হয়েছে। পূর্ণেন্দু পত্রী যে প্রচ্ছদ এঁকেছেন, আমার সাত জন্মেও সে রকম প্রচ্ছদ করতে পারব না আমি। শুভ্র গঙ্গোপাধ্যায়, সুব্রত জহিরের কাজ দেখেন, অসম্ভব ভালো কাজ তাদের। আমাদের দেশে কিন্তু প্রথম প্রচ্ছদে পরিবর্তন আনেন কাজী হাসান। এরপর আফজাল হোসেন। ডিজাইনার হিসাবে আফজাল ভাই অসাধারণ। উনি বিজ্ঞাপন নিয়ে ব্যস্ত না হয়ে পড়লে আরও ভালো কাজ উনার কাছ থেকে পাওয়া সম্ভব ছিল। আমি কিন্তু আফজাল ভাইয়ের কাজ দেখেই অনুপ্রাণিত, মানে যখন প্রথম কাজ করতে এসেছি তখন আফজাল ভাইয়ের কাজগুলো আমাকে মুগ্ধ করত। কাইয়ুম স্যার, নবী স্যার, হাশেম স্যারদের কথা না হয় বাদ-ই দিলাম। এছাড়াও কিন্তু এ দেশে অনেক ভালো মানের কাজ হয়েছে, এখনো হচ্ছে।
ফিকশন ফ্যাক্টরি : অলঙ্করণ এবং প্রচ্ছদের মধ্যে পার্থক্য মূলত কী?
ধ্রুব এষ : অলঙ্করণ আর প্রচ্ছদ সম্পূর্ণ ভিন্ন দুইটা জিনিস। আমাদের দেশে প্রচ্ছদের মাপ হলো পৌঁনে নয়-ছয়। এইটুকুর মধ্যে চূড়ান্ত মাত্রায় একটা এক্সপ্রেশন তৈরি করাই হলো প্রচ্ছদ। অলঙ্করণ করতে গেলে অবশ্যই গল্পের ডিটেইলিং সেখানে আনতে হবে। পুরো লেখাটাকে অলঙ্কৃত করাকে অলঙ্করণ বলে। সত্যজিতের অলঙ্করণ দেখলে মুগ্ধ হতে হয়। উনি ফেলুদায় যে ঘোড়ার গাড়ি এঁকেছেন, তার থেকে আমি ক্ষুরের শব্দ শুনতে পারি। যেসব অলি-গলি এঁকেছেন, মনে হয় যেন আমি সেখানেই আছি। প্রচণ্ড শক্তিশালী সেসব অলঙ্করণ।
ফিকশন ফ্যাক্টরি : আপনি প্রচ্ছদকে কি হিসাবে দেখেন? শিল্প না বিজ্ঞাপন?
ধ্রুব এষ : আমি প্রচ্ছদকে আর আট-দশটা মোড়কের মতো বিজ্ঞাপনই মনে করি। অনেকে হয়তো প্রতিক্রিয়া দেখাবেন, আমি আমার দৃষ্টিকোণ থেকে বললাম। বই না থাকলে খালি প্রচ্ছদ কোনো কাজে আসবে? ফলে প্রচ্ছদকে আমি কখনোই পূর্ণমাত্রার শিল্প মনে করি না। শিল্পের নিজস্বতা আছে, স্বকীয়তা আছে। প্রচ্ছদ তো পরাশ্রয়ী। ভেতরে লেখা না থাকলে এবার বইমেলায় যদি আমি ৭০০ প্রচ্ছদ টানিয়ে রাখি, কেউ কিনবে? আবার গুরুত্বপূর্ণ বইয়ের কুৎসিত প্রচ্ছদ হলেও সেটা কিন্তু লোকে কিনবেন।
ফিকশন ফ্যাক্টরি : লেখক হিসাবেও আপনি জনপ্রিয়। লেখালেখিকে কি তাহলে আপনার নেশা বলা যায়?
ধ্রুব এষ : আমার পেশা ও নেশা সবকিছুই প্রচ্ছদ করা। লেখালেখিটা বরঞ্চ আমার শখ বলতে পারেন। আমার লেখা আদৌ কেউ পড়ে কি না আমি জানি না।
ফিকশন ফ্যাক্টরি : স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন কোনটাতে?
ধ্রুব এষ : স্বাভাবিকভাবেই প্রচ্ছদ করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি, তবে সারা জীবন যদি শুধু বই পড়ে যেতে পারতাম, তাহলে বোধহয় আরও বেশি ভালো লাগত। কিন্তু সেটা তো আর সম্ভব না।
ফিকশন ফ্যাক্টরি : পাঠকের কাছে তো হুমায়ূন-ধ্রুব এষ এক অসাধারণ যুগলবন্দি। কেমন ছিল সেই যাত্রা?
ধ্রুব এষ : আমি যখন প্রচ্ছদ করতে আসি, সবচেয়ে বেশি কাজ করেছি ইমদাদুল হক মিলনের সঙ্গে। এর তিন বছর পর সুযোগ আসে হুমায়ূন স্যারের বইয়ের প্রচ্ছদ করার। আমি তখন তার মুগ্ধ পাঠক। একদিন এক প্রকাশক এসে বললেন, একজনের বইয়ের প্রচ্ছদ করতে হবে, কিন্তু তিনি খুব খুঁতখুঁতে স্বভাবের। কাজ ভালো না লাগলে উল্টাপাল্টা কথা বলতে পারেন। আমি বললাম, নাম কী তার? প্রকাশক হুমায়ূন স্যারের নাম বলতেই রাজি হয়ে গেলাম কাজ করতে। একটা মঞ্চনাটকের প্রচ্ছদ ছিল। প্রথমে একটা প্রচ্ছদ করলাম, প্রকাশক তার কাছে নিয়ে গেল কিন্তু তিনি পছন্দ করলেন না। আরো দুইটা করলাম, এবারও তার পছন্দ হলো না। প্রকাশক এসে বললেন, হুমায়ূন স্যার আপনার সঙ্গে দেখা করতে চান। গেলাম। উনি আমাকে দেখেই বললেন, ‘ভাই, তোমার তো কোনো প্রচ্ছদই আমার পছন্দ হয় নাই। তুমি কি আরো প্রচ্ছদ করবা?’ আমি উত্তর দিলাম, হ্যাঁ করবো। সেদিন অনেকক্ষণ তার কাছে বসে মন্ত্রমুগ্ধের মতো কথা শুনলাম। সেখান থেকে বের হয়ে প্রকাশককে বললাম, যদি উনার জন্য ১০০ প্রচ্ছদও করতে হয়, আমি তা-ই করবো। প্রচ্ছদ উনাকে পছন্দ করাবোই। এরপর অবশ্য বেশি কষ্ট আর করতে হয়নি। ওখান থেকে বের হয়েই যে প্রচ্ছদটা করেছিলাম, সেটাই তিনি পছন্দ করেছিলেন। সেই থেকেই শুরু। এরপর বোধহয় আমি ছাড়া দু-একজনই স্যারের প্রচ্ছদ করার সুযোগ পেয়েছেন। শুধু উনার বইয়ের প্রচ্ছদই আমি আড়াইশ’র মতো করেছি।
ফিকশন ফ্যাক্টরি : ব্যক্তি হিসাবে তো তিনি চমৎকার মজার মানুষ ছিলেন...
ধ্রুব এষ : লেখকের সঙ্গে আর্টিস্টের এত ব্যক্তিক সম্পর্ক যে তৈরি হতে পারে, উনি ছাড়া অন্য কাউকে আমি দেখিনি। এত মায়া দিয়ে উনি ছাড়া কেউ আগলে রাখেননি। প্রকাশকরা আমার প্রাপ্য ঠিকমতো দিচ্ছেন কি না, সেটা নিয়েও তিনি কনসার্ন থাকতেন। এমনকি নিজে প্রকাশকদের ফোন দিয়ে আমার টাকা পরিশোধ হয়েছে কি না খোঁজ নিতেন। আমার পক্ষে আসলে এই মানুষটাকে ব্যাখ্যা করা খুব কঠিন। আমি পারবো না ব্যাখ্যা করতে। প্রতি বছর আমি যে দু-একটা বই বের করি সেটা উনাকেই উৎসর্গ করে। যতদিন বেঁচে থাকবো, এটাই করবো।
ফিকশন ফ্যাক্টরি : প্রচ্ছদশিল্পী, শিশু-কিশোর সাহিত্য, গল্প, কবিতা-সব ক্ষেত্রেই আপনার সমান দক্ষতা রয়েছে। আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে ভোগেন?
ধ্রু এষ : আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে পৃথিবীর কোন মানুষটা ভোগে না? আমি একা ভুগব কেন? আপনি ভোগেন না? ‘আমি কে’-এই প্রশ্নের উত্তর কি আমাদের কারোর জানা আছে? আমি নিজেকে স্রেফ একজন কামলা মনে করি।
ফিকশন ফ্যাক্টরি : কিন্তু প্রচ্ছদ শিল্পী হওয়ার কারণে আপনার ‘কথাশিল্পী’ পরিচয়টা আড়ালে চলে যাচ্ছে না?
ধ্রুব এষ : কথাশিল্পী পরিচয়েরই তো আমার দরকার নেই। এমনকি কোনো পরিচয়েরই তো দরকার নেই আমার। আজকে যদি কেউ বলে বইয়ে প্রচ্ছদ আর্টিস্টের নাম যাবে না, আমি বরঞ্চ খুশিই হবো। কাজ করে যদি আমি তৃপ্ত হই, তাহলে নামের প্রয়োজন হবে কেন? আমি তো জানি কোনটা আমার কাজ; এখানে নাম থাকায়, না থাকায় কী আসে-যায়?
ফিকশন ফ্যাক্টরি : এই যে এত ব্যস্ত থাকেন, ব্যক্তিসত্তার সঙ্গে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়?
ধ্রুব এষ : শোনেন, এ বাংলায় রবীন্দ্রনাথ জন্মেছিলেন। তিনি যে পরিমাণ চিঠি লিখেছিলেন, আমার সারা জীবনেও সে পরিমাণ কাজ আমি করতে পারবো না। দুটো কাজ করেই যদি সবাইকে বলি অনেক কাজ করে ফেলেছি, সেটা কেমন কথা? আমার অন্তত মনে হয় না আমি এমন কিছু কাজ করে ফেলেছি। কাজের ক্ষেত্রে চাপ নিই না আমি। চাপ অনুভব করি তখন, যখন কেউ কাজ দিয়ে তাগাদা দিতে থাকেন কালকেই কাজ দিয়ে দেওয়ার জন্য। আমি প্রায় ২৮-২৯ বছর এ পেশায় যুক্ত আছি, কোনোদিনই কাজের জন্য আলাদা কোনো চাপ আমার অনুভব হয়নি। প্রথম দিন এ কাজটির প্রতি আমার যেমন ভালোবাসা ছিলো, আজকেও তাই আছে। শেষদিন পর্যন্তও ঠিক এমনটাই থাকবে।
ফিকশন ফ্যাক্টরি : জীবনযাত্রার দিক থেকে আপনাকে বেশ উদাসীন মনে হয়...
ধ্রুব এষ : আমি অগোছালো। উদাসীন না। অগোছালো আর উদাসীন কি এক জিনিস? আমার মনে হয় না। উদাসীন হলে একজনের পক্ষে আর্টিস্ট হওয়া সম্ভব নয়। আর্টিস্টের থাকতে হয় দেখার মতো চোখ। আমরা কবিদের উদাসীন বলি, আপনি কি উদাসীন? কবিদের যে তীব্র অনুভূতি সেটা আমাদের কারোর মধ্যে নেই। কবির মতো করে আমরা কেউ সত্যকে উচ্চারণ করতে পারি না। কবি মানেই ধরে নিই বোহেমিয়ান। এটা আমাদের ধারণা মাত্র। কবি অন্য মাপের মানুষ। নূর হোসেন মারা যাওয়ার পর যে শামসুর রাহমান লিখবেন ‘বুক তার বাংলাদেশের হৃদয়’-এটা কি কেউ আগে থেকে বুঝতে পেরেছিলেন? অগোছালো হলো আমার ব্যক্তিগত জীবনযাপনের অংশ। এটা তো আর ইচ্ছা করলেই পরিবর্তন করা সম্ভব না।
ফিকশন ফ্যাক্টরি : ব্যক্তিমানুষ রাষ্ট্র ও সমাজ কাঠামোর মধ্যে থাকে, তাকে সবকিছু স্পর্শ করে- আপনার লেখাতেও কি রাজনৈতিক প্রভাব পড়ে?
ধ্রুব এষ : যে কারোর লেখাতেই রাজনৈতিক প্রভাব থাকে। আমরা তো কেউ রাজনীতির বাইরে না। এখন রাজনৈতিক প্রভাব মানেই তো আর মিছিল দেখাতে হবে, লাশ দেখাতে হবে-তা না। একেবারে পলিটিক্যাল লেখা ছাড়া কি রাজনৈতিক লেখা হয় না? মানুষ পুরাটাই রাজনৈতিক। এর বাইরে যাওয়া সম্ভব না।