24/10/2025
ধোলাইখাল ও লোহারপুলের ইতিহাস ও নামকরণ ||
নামকরণ ও সূচনা
ঢাকার মুঘল রাজধানী জাহাঙ্গীরনগর প্রতিষ্ঠার সময় সুবাদার ইসলাম খানের নির্দেশে ১৬০৮–১৬১০ খ্রিষ্টাব্দে যে খালটি খনন করা হয়, তার নাম থেকেই আশপাশের এলাকা “ধোলাইখাল” নামে পরিচিত হয়। এই খালটি শহরের প্রতিরক্ষা ও নৌ-যাতায়াত—দুই উদ্দেশ্যেই ব্যবহৃত হতো। প্রাচীন নথিতে ধোলাইখালের আলাদা কোনো “পূর্বনাম” পাওয়া যায় না; মুঘল আমল থেকেই ‘ধোলাই খাল’ নামেই পরিচিত। খালটি ডেমরার দিকে বালু নদী থেকে বের হয়ে দক্ষিণ–পশ্চিমে শহর কেটে বুড়িগঙ্গায় মিলব্যারাকের কাছে গিয়ে মিশেছিল।
বিস্তারিত ধোলাইখালের ইতিহাস:----
ধোলাইখাল – হারিয়ে যাওয়া এক জলপথের ইতিহাস
পুরান ঢাকার বুকে একসময় প্রবাহিত হতো ঐতিহাসিক ধোলাইখাল। এটি মূলত বুড়িগঙ্গা নদী থেকে শুরু হয়ে শাখা খাল হিসেবে শহরের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে উত্তর–পূর্ব দিকে শীতলক্ষ্যা নদীর সঙ্গে যুক্ত ছিল।
📌 মোগল আমল:
মোগল সুবাদার ইসলাম খান ঢাকাকে রাজধানী করার পর শহরের ভেতরে যোগাযোগ ও নৌপথ সহজ করার জন্য খাল খননের উদ্যোগ নেন। সেই সময় ধোলাইখাল খনন করা হয়। এ খাল দিয়ে নৌকায় করে পণ্য আনা–নেওয়া হতো, ফলে ঢাকার ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রাণকেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল এটি।
অনেকের মতে---
“ধোলাইখাল” নামটি এসেছে এখানকার কাপড় ধোয়ার কাজ থেকে। পুরান ঢাকার কারিগররা এই খালের পানি ব্যবহার করতেন কাপড় ধোয়া, রং করা ও নানা শিল্পকর্মে। এজন্য একে বলা হতো “ধোলাইখাল”।
📌 ব্রিটিশ আমল:
ব্রিটিশ শাসনামলে ধোলাইখাল আরও গুরুত্ব পায়। তখন এটিকে ঘিরে গড়ে ওঠে গুদামঘর, বাজার এবং নানা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান। ঢাকার লোহারপুল বা সূত্রাপুর এলাকায় প্রবেশের অন্যতম নৌপথ ছিল এই খাল।
📌 পতন ও বিলুপ্তি:
কালের আবর্তে ধীরে ধীরে ধোলাইখাল ভরাট হতে শুরু করে। ১৯৭০-এর দশকে খালটির বড় অংশ ভরাট হতে শুরু করে,এবং ১৯৮০ এর দশকে খালটি পুরোপুরি বিলুপ্ত হয়ে যায়,এরপর ১৯৯৭ সালে এর উপর নির্মিত হয় বক্স-কালভার্ট। আজ ধোলাইখাল নেই, তবে স্থাননাম হিসেবে এখনও ঢাকার মানচিত্রে বেঁচে আছে।
ধোলাইখাল শুধু একটি খাল ছিল না—এটি ছিল পুরান ঢাকার ব্যবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্রবিন্দু এবং ঢাকার ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।
সূত্রাপুর ব্রিজ (লোহারপুল) – হারানো এক ইতিহাস
পুরান ঢাকার সুত্রাপুর এলাকায় ধোলাইখালের উপর একসময় দাঁড়িয়ে ছিল এক ঐতিহাসিক সেতু—লোহারপুল। কিন্তু স্থানীয় মানুষজন এই সেতুটিকে ডাকত “সূত্রাপুর ব্রিজ” নামে।
১৮৩২ সালে ঢাকার কালেক্টর মি. ওয়াল্টারের উদ্যোগে সেতুটি নির্মিত হয়েছিল। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল ধোলাইখাল পেরিয়ে সহজে নারায়ণগঞ্জ ও বন্দর এলাকায় যাতায়াত নিশ্চিত করা। সেতুটি ছিল লোহার তৈরি ঝুলন্ত কাঠামো—তখনকার ঢাকায় একেবারেই ব্যতিক্রমী।
সূত্রাপুরের গুরুত্ব
সূত্রাপুর পুরান ঢাকার এক প্রাচীন জনপদ। মোগল আমলে এখানে ব্যবসা-বাণিজ্য ও আবাসন গড়ে ওঠে। ধোলাইখালের তীরবর্তী এই এলাকা যোগাযোগের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তাই সেতুটি স্থাপনের পর থেকেই স্থানীয়রা একে বলত “সূত্রাপুর ব্রিজ”।
পুনর্নির্মাণ ও প্রতিস্থাপন:---
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় লোহার পুলটি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পর
লোহার পুলটি ভেঙে ফেলা হয় এবং এর স্থানে নতুন করে আরেকটি লোহার পুল তৈরি করা হয়।
১৯৯০–এর দশকে ধোলাইখাল ভরাট করে বক্স-কালভার্টে রূপান্তরিত করা হলে এই সেতুর অস্তিত্বও হারিয়ে যায়। আজ আর সেই সেতু নেই, তবে ইতিহাসে রয়ে গেছে “লোহারপুল” নামের পাশাপাশি তার আরেক নাম—সূত্রাপুর ব্রিজ।
ধোলাইখালের পথরেখা ও সেতু
খালের এক শাখা শহরের কেন্দ্র দিয়ে গিয়ে শাহবাগ–কাওরান বাজারের কাছে আম্বর ব্রিজ পার হতো (খাজা আম্বরের নামে)।
পুরান ঢাকার দিকে ফরাশগঞ্জ–গান্ডারিয়া অংশে খালের ওপর নির্মিত হয় ঢাকার একমাত্র ঝুলন্ত লোহার সেতু—লোহারপুল/ধোলাই ব্রিজ। এটি ছিল নারায়ণগঞ্জ–ঢাকা যাতায়াত সহজ করার এক বড় পদক্ষেপ।
পূর্বাংশে নারিন্দা সেতু (হায়াত ব্যাপারীর সেতু)—শহরের পূর্বভাগকে মূল শহরের সঙ্গে যুক্ত করা এক প্রাচীন সেতু—ধোলাইখালের ধারেই ছিল।
লোহারপুল সেতুর সম্পূর্ণ ইতিহাস (সংক্ষেপে টাইমলাইন)
নির্মাণ শুরু: ১৮২৮ খ্রিষ্টাব্দ (ইংল্যান্ড থেকে লোহার সামগ্রী এনে কাজ শুরু) ।
সমাপ্তি/উদ্বোধন: ১৮৩২—ঢাকার কালেক্টর মিস্টার ওয়াল্টার একটি এক-স্প্যানের ঝুলন্ত (hanging) লোহার সেতু নির্মাণ করেন। উদ্বোধনের দিন হাতি চালিয়ে সেতুর শক্তি পরীক্ষা করার কাহিনি প্রচলিত।
টোল আরোপ: ১৮৬৭–১৮৭২ সময়ে খালপথে প্রবেশকারী বড় নৌযানসহ চলাচলে টোল ধার্য হয়; পরে ১৮৭২ সালে টোল আদায়ের দায়িত্ব পৌরসভার হাতে যায়।
পরিণতি (ভাঙা/নতুনভাবে রূপান্তর): ১৯৯০ দশকে খালের বড় অংশ বক্স-কালভার্টে রূপ নিলে লোহারপুলও উঠে গিয়ে জায়গাটি পাকা সড়ক ও কালভার্টে রূপান্তরিত হয়—আজ সেখানে আর ঝুলন্ত সেতু নেই।
ধর্ম–সংস্কৃতি ও জনজীবন
ধোলাইখাল ছিল নৌকাবাইচ, সাঁতার ও উৎসবের প্রাণকেন্দ্র। রোকনপুরের পাঁচ ভাই ঘাটসহ নানা ঘাটে মেলা বসত, আর হিন্দু সম্প্রদায় পূজা শেষে দেবমূর্তির বিসর্জন দিত এই খালেই।
আশেপাশের উল্লেখযোগ্য প্রাচীন স্থাপনা (ধোলাইখাল ঘিরে পুরান ঢাকায়)
বড় কাটরা (১৬৪৪–১৬৪৬)—শাহ সুজার সময়কার কারভাঁসারাই; চৌক বাজার–বুড়িগঙ্গার ধারে।
ছোট কাটরা (১৬৬৩–১৬৭১)—শায়েস্তা খাঁর আমলের কারভাঁসারাই; বড় কাটরা থেকে পূর্বে।
আহসান মঞ্জিল (নির্মাণ ১৮৫৯–১৮৭২; নবাবদের প্রাসাদ)—বুড়িগঙ্গার তীরে কুমারটুলিতে; আজ জাদুঘর।
লালবাগ কেল্লা (শুরু ১৬৭৮)—মুঘল দূর্গনির্মাণের অপূর্ণ নিদর্শন।
হোসেনি দালান (১৭শ শতক)—শিয়া সম্প্রদায়ের তাজিয়া কেন্দ্র।
আর্মেনিয়ান চার্চ (১৭৮১)—আরমানিটোলা; ইউরোপীয় আর্মেনীয় বণিকদের স্মারক।
বিনত বিবির মসজিদ (১৪৫৬–৫৭)—ঢাকার প্রাচীনতম টিকে থাকা মুসলিম স্থাপনা; নারিন্দায় হায়াত ব্যাপারীর সেতুর পাশে।
বাহাদুর শাহ পার্ক (সাবেক ভিক্টোরিয়া পার্ক, ১৯শ শতক)—স্বাধীনতা–বিপ্লবের স্মৃতি-বহনকারী উন্মুক্ত চত্বর।
ধোলাইখালের বর্তমান চেহারা
আজকের ধোলাইখাল এলাকায় (উত্তরে টিপু সুলতান রোড, দক্ষিণে ভিক্টোরিয়া পার্ক, পূর্বে নারিন্দা, পশ্চিমে ইংলিশ রোড—খুব ছোট্ট এক ব্লক) পাঁচ হাজারেরও বেশি দোকান ও অসংখ্য কারখানা–ওয়ার্কশপ। প্রধান বাণিজ্য এখন গাড়ির যন্ত্রাংশ, স্যানিটারি ফিটিংস, ইলেকট্রনিকস ইত্যাদি—অর্থাৎ জলপথ থেমে গেলেও বাণিজ্যের স্পন্দন থামেনি।
ছবিতে দেখা ‘লোহারপুল’ আজ নেই; কিন্তু ধোলাইখাল আমাদের নগর স্মৃতির অমলিন জলরেখা—ঢাকার জন্ম, বিকাশ আর হারিয়ে যাওয়া জলপথের গল্প একসঙ্গে ধরে রেখেছে।
কপি পেস্ট
লেখা-মোঃনাঈম ভুইয়া
এডমিন-ঢাকার গণপরিবহন
#ধোলাইখাল #লোহারপুল #সূত্রাপুর #পুরানঢাকা
#ঢাকারইতিহাস #ঢাকারঐতিহ্য
#পুরানঢাকারজীবন #ঢাকারসংস্কৃতি