26/11/2023
সোয়া দুই ফুট
পর্ব-২
#উপন্যাস #ভালোবাসারগল্প
(প্রথম পর্বের লিংক পাওয়া যাবে কমেন্ট সেকশনে।)
মাঝে মাঝে এমন হয়।
কোনো তুচ্ছ ঘটনা, অথবা ছোট্ট কোনো কথা মনের মাঝে অকারণেই একটু হুটোপুটি করে যায়। আজকাল মনকে নাড়া দিয়ে যাবার মতন ঘটনা খুব একটা ঘটে না জীবনে। কী যে ছাই হয়েছে মনের, কুষ্ঠ রোগীর ত্বকের মতন অনুভবহীন এখন!
অবশ্য নতুন কিছু, মনকে নাড়া দেয়ার মতন বিশেষ কিছু যে ঘটছে জীবনে তা-ও তো নয়। রোজই তো সেই গতবাঁধা পুনরাবৃত্তি। ঘুম ভাঙে দুপুর গড়িয়ে যাবার পর, গোসল করে দুটো মুখে দিয়ে আস্তে আস্তে তৈরি হওয়া কাজে যাবার জন্যে। শরীরটাকে পরিচ্ছন্ন করা ঘষে ঘষে যেন পুরানো পিতলের বাসন, চুলগুলো বাঁধা বাহারি ঢঙে। আর মাগরিবের আযানটা হয়ে গেলেই বেরিয়ে পড়া কামরুলের ডাকে…
যেভাবে বহু আগে ছেড়ে এসেছিল আপন ঘর, বাবা-মা, ভাই-বোন। নিজের উঠোন, নিজের আকাশ, গ্রামের ছোট্ট ভিটেয় মায়ের কোল ঘেঁষে বড় সাদাসিধে কিন্তু নিরাপদ এক জীবন… ছেড়ে এসেছিল ভালোবাসার টানে, কামরুলের ডাকে। যে ডাক আজীবনের মত ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছে শাহানার জীবনটা…
বাপজানের অর্থ-বিত্ত ছিল ভালোই। মাঠে জমি ছিল, বাজারে দোকান ছিল একটা। তিন কন্যা আর আহলাদের একমাত্র পুত্রকে নিয়ে হেসেখেলে দিন কেটেই যেতো। বিলাসিতা হয়তো ছিল না ঠিকই, তবে কারও সামনে হাত পাতার মতন পরিস্থিতির তৈরি হয়নি কোনোদিন। চার সন্তানকে স্কুলেও পাঠাতেন বাপজান। বলতেন-
“আমি মুরুক্ষু বইলে কি পুলাপানগো তাই বানামু?”
আম্মার অবশ্য এতে সায় ছিল না মোটেই। সংসারের সমস্ত ঝামেলা একা সামলে উঠতে উঠতে হাঁপিয়ে উঠতেন বেচারী, আর প্রায়ই আর্জি জানাতেন স্বামীর দরবারে। মুখ ঝামটা মেরে বলতেন-
“স্কুলে যায়ে আপনের মাইয়ারা কি জর্জ ব্যারিষ্টর হইবো নাকি? হইবো তো পরের বউ, জীবন কাটবো চুলার পাড়ে! হুদাহুদি পয়সা পানিতে না ঢাইলা আমার কাছে দ্যান, সংসার-ধর্ম শিখাই। পরের শ্বাশুড়ীতে কইবো, ধামড়ি মাইয়ারে মাতে কিছু শেখায় নাই.. ..”
কথোপথন এভাবে চলতো দীর্ঘসময় প্রায়ই। এক পর্যায়ে বিড়ির প্যাকেটটা হাতে অন্য দিকে চলে যেতেন বাপজান, গোমড়া মুখে বেশী বেশী বিড়ি ফুঁকতেন স্ত্রীকে দেখিয়ে দেখিয়ে। মানুষটার কাছে সন্তানেরাই ছিল সব, কন্যাদের বিবাহের প্রসঙ্গে তাই সর্বদা রাগ করে বসতেন শিশুদের মতন। কলিজার টুকরা কন্যাদেরও তাই কেউ পরের ঘরে পাঠায়?
আম্মা অবশ্য তখনও টিপ্পনী কাটতে ছাড়তেন না। খুব হাসতে হাসতে বলতেন-
“বুইড়া ব্যাটার ঢঙ দেখছো? ভাবখান এরম যে মাইয়া বিয়া দিবো না। ঘরের খুটি বানায় রাখবো। পরে মাইয়া যখন পিরিত কইরে পালায় যাইবো, তক্ষণ তো চউখের পানিতে চাইরদিক ভাসায় ফেলবা.. ..”
বিধাতা বোধহয় মুচকি হাসতেন তখন… তখন কে জানতো আম্মার কথাই এমন করে সত্য হয়ে যাবে একদিন? শাহানা একদিন সত্যিই সব ছেড়ে চলে যাবে প্রেমিকের হাত ধরে?
কামরুলের সাথে কখন-কোথায়-কী করে পরিচয়, সে কাহিনী এখন অবান্তর। সত্য এটুকুই যে এই লোকটাকেই কখনও ভালোবেসেছিল ক্লাস নাইন পড়ুয়া শাহানা। আর একদিন তার হাত ধরে ছেড়ে এসেছিল আজন্ম চেনা গ্রামটাকে, ছিঁড়ে এসেছিল ওইটুকুন জীবনের চিরচেনা সমস্ত বন্ধন। কথা ছিল, পরিস্থিতি একটু শান্ত হলেই আবার ফিরে আসা হবে। শাহানার সুখী-সমৃদ্ধ জীবন দেখে তখন কি আর মুখ ফিরিয়ে থাকতে পারবে আম্মা কিংবা বাপজান? পারবেন না, একেবারেই না। তখন সব ঠিক হয়ে যাবে।
বলেনি যে তা নয়, কামরুল অবশ্য গত কয়েক বছরে বেশ কয়েকবারই বলেছে বাপের বাড়ি থেকে ঘুরে আসার কথা। তোয়াজ করে করে বলেছে। রুজি-রুটি যার ওপরে নির্ভরশীল, তাকে বোধকরি একটু-আধটু ভয়ই করে মানুষ। কামরুল-ও হয়তো ভয় করে তাকে। বেশ ভালোভাবেই করে।
তবে এটা এখনকার দৃশ্য, বর্তমানের দিনের। প্রথম যখন এই শহরে পা রেখেছিল সেই কিশোরী শাহানা, অবুঝ শাহানা, ভালোবাসার আবেগে ভেসে যাওয়া শাহানা… চিত্রটা একেবারে ভিন্ন ছিল তখন! কোথায় নিজেদের দোতলা বাড়ি, কোথায় নিজের গ্যারেজের ব্যবসা, আর কোথায় মা-বাবা-ভাই-বোন নিয়ে ভরা পরিবার! স্বপ্ন শুরু হবার আগেই সব শেষ, এক রাতেই সোজাসাপ্টা অশালীন বাস্তবতাটা দেখতে পেয়েছিল কল্পনার রাজ্যে ভেসে বেড়ানো সরল গ্রাম্য কিশোরী।
মা অবশ্য ছিল কামরুলের, তবে কেবল ওই এক মা-ই। পেশায় বেশ্যা, কামরুল তার পিতৃপরিচয়হীন সন্তান। গ্যারেজের ব্যবসা নয়, বরং একটা জরাজীর্ণ গ্যারেজ লাগোয়া টিনশেডের এক কামরায় ছিল দুই মা-ছেলের সংসার। ননদও একজন ছিল বটে, তবে শ্বশুরবাড়িতে। দেহপসারীনি মা তার পুত্রকে কখনোই সঠিক করে বলতে পারেন নি পিতার পরিচয়টা, তবে কন্যাকে পেরেছিলেন। ব্যাপারটা নিয়ে কামরুলের মাঝে একটু উত্তাপ আছে ঠিকই, তবে ভাই-বোনের সম্পর্কে সে উত্তাপের ছোঁয়া পৌছায় না। শাহানা সংসারে প্রবেশের আগেই ছোট বোনকে বিয়ে করিয়ে দিয়েছে সে। বেশ্যার দালাল কোনো ভাই তার বোনকে যতটা বিয়ে দিতে পারে, তার চাইতে ভালোই দিয়েছে।
হ্যাঁ, কামরুলের পেশা ছিল দেহপসারিনী মেয়েদের দালালী। তাদের ভালো খদ্দের খুঁজে দেয়া আর বিনিময়ে উর্পাজনের একটা অংশ নিজের পকেটে পোরা। ওটাই সংসারে একমাত্র আয়ের উৎস।
প্রথম কয়েক মাস অবশ্য কিশোরী বধূ বুঝে উঠতে পারেনি কিছুই। শ্বাশুড়ীর লাথি-গুঁতো-গালাগাল সয়ে মুখ বুঝে ঘর করেছে, যা হোক যেমন-তেমন দুটো ভাত-তরকারিই নিজের সংসার ভেবে তৃপ্তি নিয়ে খেয়েছে আর রাতের বেলা স্বামীর বিছানায় কয়েক মিনিটের শরীরী ভালোবাসা পেয়েই সন্তষ্ট থেকেছে বেশ। অবশ্য সেটাকে “ভালোবাসা” বলা যায় কিনা তাই বা কে জানে। শ্বাশুড়ী ঘুমাতো চৌকিতে, আদুরে ছেলেকে পাশে নিয়েই। মা ঘুমিয়ে গেলে সরীসৃপের মতন নিঃশব্দে নিচে নেমে আসতো কামরুল, শাড়িটা উচুঁ করে নির্বিকার অনুপ্রবেশের আকাঙ্খায়। অবশ্য কিছু বুঝে ওঠার আগেই ফুরিয়ে যেতো সব, শরীরে রয়ে যেতো উগড়ে দেয়া থকথকে সাদা তরলটা কেবল।
জানে না কেন, সেসব দিনের কথা মনে করলে এখন শুধু গা ঘিনঘিনে একটা অনুভবই তৈরি হয় মনের মাঝে। তবে সংসারটা সে সত্যিই বড় মন দিয়ে করতো! মুখ বুজে শ্বাশুড়ীর সেবা করা, বড় শখ করে মায়ের কাছে শেখা এটা-ওটা রান্না করা, ননদ বেড়াতে এলে সাধ্যমত অতিথি অ্যাপ্যায়ন করা। তখন কি আর ছাই জানতো নাকি যে কামরুল তাকে বিয়ে করেনি, করেছে তার পরিষ্কার চামড়া আর ধারালো চেহারাটাকে। বাজারে নাকি অমন মেয়ের ভারী কদর! পরের দালালী করে করে পয়সাই বা পকেটে আসে। ভাড়ায় খাটাবার মতন নিজের একটা মেয়েমানুষ হলে তো পুরোটাই লাভ।
কী করে আর কীভাবে এই ধান্দায় এলো, সে কাহিনীরও এখন আর কোনো প্রয়োজন নেই। তবে একথা সত্যি যে মার খেতে হয়েছিলো খুব। কামরুল গরুর মতন পেটাতো তাকে। শরীরে বস্তা চাপিয়ে পিটাতো, যাতে দাগ না পড়তে পারে। না হলে যে আবার বিকোবে না শরীরটা! ছয়দিন না খাইয়ে বেঁধে রেখেছিলো জানালার সাথে, এখনও মনে আছে পরিষ্কার। না দানা, না পানি। এক বিন্দুও না। মা-ছেলে সামনেই বসতো ভাতের থালা নিয়ে, খেয়ে উঠে গতরে শক্তি সঞ্চয় করে আবার পেটাতো। খদ্দেরের বিছানায় উঠতে রাজি না হয়ে তবেই ছয়দিন পর এক চুমুক পানি জুটেছিল কপালে…
আর এও সত্যি যে, জীবনে প্রথম বার যখন কামরুল ব্যতীত অন্য কোনো পুরুষের সাথে মিলিত হলো.. ..নাহ, খারাপ লাগলো না একটুও! বরং ভালোই লাগলো, কেমন যেনো সুখ সুখ! কই, কামরুল তো তার শরীরটাকে এমন সুখ দিতে পারেনি কখনও!
কাহিনীটা আজো মনে আছে স্পষ্ট, বুঝি আজীবনই থাকবে। নতুন এক সেট থ্রি পিস পরিয়ে কামরুল নিয়ে গেলো তাকে, সস্তা দরের একটা হোটেলের কামরায়। গদগদ কণ্ঠে পরিচয় দিলো- “কলেজ গার্ল স্যার! কলেজ গার্ল!.. ..ভেরি স্মার্ট গার্ল স্যার!”
লোকটা ছিল মধ্য বয়সী, মাথায় টাক, রঙ কালো আর মানিব্যাগে স্ত্রী-সন্তানের ছবি- টাকা দেবার সময় দেখেছিলো শাহানা। পরপর দু’রাত লোকটার কাছে যেতে হয়েছিলো তাকে। এরপর আরো অনেক বার। সারারাত রাখতো লোকটা, যতবার সম্ভব পয়সাটা উসুল করে নিতো। একটু পর পর কীসের যেন একটা ট্যাবলেটও গিলে নিতো। নারী দেহটা যখন আর কিছুতেই চলতো না, তখন কষে দু’ চারটে লাথিও দিতো।
সেই কোন পাঁচ/সাত বছর আগেকার কথা। নাকি আরো বেশি??? মনেও নেই…
গরুর মতন পিটুনি খাওয়া শাহানার গল্পকে এখন অন্য কোনো জীবনের মনে হয়। আগ্রহ করে এটা-ওটা রাঁধতে বসা শাহানাকে মনে হয় অন্য কেউ। এখনকার শাহানা নির্বিকার আর শীতল, যাকে কামরুল বুঝে-সমঝে চলে। কামরুলের মা যে শাহানাত ভয়ে মেয়ের সংসারে গিয়ে উঠেছে অনেক বছর, ফিরে আসবার আগ্রহ প্রকাশ করারও সাহস নেই। এখনকার শাহানা আর শখ করে কারও জন্যে কিছু রাঁধে না , কোনো মতে দায়সারা দুটো ভাত ফোটায় বেঁচে থাকার তাগিদে।
কিন্তু আজ.. ..
বামনটা এমন করে বললো, বহুদিন পর কেমন যেন নড়ে উঠলো ভেতরটা। বহু বহুকাল পর কেউ তাকে রেঁধে খাওয়াতে বললো কিছু। বাপজান যেমন করে বলতো-
“আম্মাজান, যান তো একটু ডাইল চচ্চড়ি করেন। বেশী কইরে রসুনের কোয়া দিয়া।”
আরমানের কথার মাঝে সেইরকম একটা আহবান ছিল কোথাও। বাপজানের মতন আহবান। নিষ্কলঙ্ক, স্বার্থহীন আহবান। জগৎ সংসারে এই এক আরমানই তো আছে, যার সাথে দুটো কথা বলা যায় শান্তিত্ব। বামনটা তার শরীরের দিকে তাকায় না, হয়তো এই জন্যেই।
ঘরের এক কোণে যত্ন করে গুছিয়ে রাখা হাঁড়ি-পাতিলের ঢেরটার দিকে তাকিয়ে ছোট্ট একা দীর্ঘশ্বাস ফেলে শাহানা। সংসার বলতে এই হাঁড়ি-পাতিলের ঢেরটাই অবশিষ্ট আছে কেবল। কিংবা বলা ভালো- সংসারের স্মৃতি!! হাঁড়ি-পাতিল, থালা-বাসন খরিদ করার বড় শখ তার। কেনে, আর সাজিয়ে রাখে। যত্ন করে সাজিয়ে রাখে।
চৌকির ওপর উপুর হয়ে পড়ে আছে কামরুল। পরনের লুঙ্গিটা কুৎসিতভাবে উচুঁ হয়ে আছে, মুখের লালায় বালিশ ভিজে একাকার। আজকাল সে বস্তির কোণে নতুন ঘরে ওঠা মেয়েটার কাছে যায়, জানে শাহানা। বেশ্যা বউয়ের সাথে শোয়ার চাইতে বাজারের বেশ্যার সাথে শোয়া বোধহয় বেশী আরামের। অবশ্য তাতে কিছু যায় আসে না তার, কেননা নিজেকে তার কামরুলের বউ মনে হয় না কোনো দিক থেকেই। বহুকাল যাবত মনে হয় না।
তবুও,এরকম সকাল গুলোতে কীসের কারণে যেন দীর্ঘশ্বাস ফেলে মন, হাহাকার করে। আবার একই সাথে ঘিনঘিন করে ওঠে শরীরের কোথাও। সব শেষে তালগোল পাকিয়ে….
এক গাদা বিতৃষ্ণায় ভরে যায় মনটা!!!
(চলবে.....)
"সোয়া দুই ফুট"
উপন্যাসটি প্রকাশ করেছে বিদ্যা প্রকাশ
প্রথম প্রকাশ- ফেব্রুয়ারি, ২০১১
মূল্য- ১৫০ টাকা
বইটি সরাসরি অর্ডার করতে পারবেন বিদ্যাপ্রকাশ - Biddyaprokash বিদ্যাপ্রকাশ - Biddyaprokash এর পেজ হতে। এছাড়াও পেয়ে যাবেন রকমারি ডট কম থেকেও। রকমারি.কম এর অর্ডার লিঙ্কও পাবেন কমেন্ট বক্সে।
ভারতে কেউ পেতে চাইলে অর্ডার করতে পারেন কলেজ স্ট্রিটের বইবাংলা তে। আর বিনে পয়সায় পড়তে চাইলে লাইক দিন এই পোস্টে, পেজে ফলো দিয়ে রাখুন। নতুন পর্ব পোস্ট হলেই নোটিফিকেশন পেয়ে যাবেন। 😌