21/07/2023
সাত বছরের একটা মেয়েকে ধর্ষণের চেষ্টা করার অপরাধে পুরো গ্রামের লোকজন যখন আমার বাবাকে মারছিল, তখন আমি ঘরের দরজার ফাঁকে ভয়ে লুকিয়ে ছিলাম। ভেবেছিলাম বাবাকে মারার পরে হয়তো আমাকেও সবাই মিলে মারবেন। আর আমার মা অহ! মা নয়, সৎ মা বারান্দার খুঁটি ধরে মিটি মিটি হাসছিলো। তার চোখে মুখে আনন্দের সীমা নেই। নিজের স্বামীর এমন অবস্থা দেখে কেউ এভাবে মুচকি মুচকি হাসতে পারে ভাবতেও পারছি না। যদি গ্রামের লোক গুলো এখন বাবাকে রেখে, বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা মাকে ধরে মারতে থাকে? এইসব ভাবতেই আমি ভয়ে ভয়ে মা কে ডাক দিয়ে লুকিয়ে যেতে বলি,, তখনই মা তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে বলে,,
তোর বাপের মতন আমি কি লুচ্চামি করতে গিয়ে ধরা খায়ছি যে, লোকজন আমাকে মারতে আসবে।
আমি বুঝতে পারছি বাবা কোন অপরাধ করেছেন, তাই আমি আর কিছু জিজ্ঞেস করিনি। আসলে ভয়েই প্রশ্ন করিনি, যদি আমার কথা শুনে গ্রামের মানুষ বুঝতে পারে আমি এখানে লুকিয়ে আছি, তাহলে তো আমাকেও মারবেন। যেমন টা মারেন আমার মা,, বাবা যখনই মাকে জোরে কথা বলে বা চড় থাপ্পড় দেয়, তারপর ই মা আমাকে খুব মারে, আর বলে তোর বাপের দোষে তুই মার খাচ্ছিস। বাবার অগোচরে আমাকে মারার পরে আবারও শাসিয়ে দেয়,, যদি বাবা আসার পরে আমি বাবাকে বলে দিই তাহলে আমাকে আরো বেশি মারা হবে। তাই ভয়ে কখনো বাবাকে বলিনি এইসব কথা। বাবা যে মেয়েটাকে ধর্ষণ করতে চেষ্টা করছিলো ওই মেয়েটার সাথে আমি মাঝে মাঝে খেলা করতাম, ওর নাম ছোঁয়া। সে ও আমার সমান।
কি?? বুঝতে পারছেন না তো? তাহলে আসুন এবার জেনে নিই পুরো ঘটনা টা। আমি তোরশা! বয়স ৭ কি ৮ বছর। বাবা বলেন, আমার জন্মের ৩ বছর পরে কলেরিয়া হয়ে আমার মা মারা গেছেন। তারপর থেকে তিনি আমাকে আদর যত্নে বড় করতে থাকেন। আমার দাদা দাদি কেউ জীবিত না থাকায়, মা মারা যাওয়ার পরে বাবা কাজে গেলে আমাকে সাথে নিয়ে যেতেন। বাবা রোদে রোদে কাজ করতেন আর আমাকে একটা ছাতার নিচে অনেক গুলো জঙ্গলি ফুল, ইটের টুকরো, বালি মাটি দিয়ে বসিয়ে রেখে যেতেন। আর খুব ভালো করে বুঝিয়ে বলতেন, যেন আমি ছাতার ছায়ার নিচে থেকে বাইরে না যায়, আর এইসব ফুল মাটি নিয়ে বসে বসে খেলা করি।
আমি বাবার লক্ষি মেয়ের মতো চুপচাপ বসে বসে খেলতাম, ছোট মানুষ তাই বাবার পরিশ্রমের কষ্ট গুলো কে বুঝতাম না। বাবা কিছুক্ষণ পরপরই এসে আমাকে পানি বিস্কুট খাইয়ে যেতেন। এভাবেই কাটে আমাদের বাপ বিটির জীবন। একদিন আমার একটা কেমন যেন দাদি আমাদের বাড়িতে বেড়াতে এসে বাবাকে বারবার আবারও বিয়ে করার কথা বলে,কিন্তু বাবা রাজি হয় নি দেখে আমাকে শিখিয়ে দেয়, যেন আমি বাবার কাছে নতুন মা নেওয়ার বায়না ধরি। আমাদের পাশের বাড়ির ছোঁয়া কি সুন্দর করে চুলে ঝুটি বেধে, নতুন নতুন জামা কাপড় পড়ে খেলে। মাঝে মাঝে ঠোঁটে লাল টুকটুকে লিপস্টিকও দেয়। আমারও খুব ইচ্ছে করে ওর মতো করে সাজতে। কিন্তু বাবা সারাদিন কাজ করে তাই আমাকে দুই তিন দিন পরপর গোসল করায়, আর জামাকাপড় গুলোতে অনেক ময়লা জমে থাকে। একটা মা থাকলে আমাকেও ছোঁয়ার মতো সাজিয়ে দিবে ভেবে বাবার সাথে খুব বায়না ধরি নতুন মা এনে দিতে।
আমি বাবার সাথে কথা না বলে সব সময় চুপ থাকতাম। সহজে কিছু খেতাম না। এভাবে কয়েকদিন যাওয়ার পরে বাবা আমাকে রাতে মাথায় তেল দিয়ে দিতে দিতে বলেন,,
মারে,,নতুন মা তোকে আমার থেকে বেশি ভালো বাসবে না রে।তুই যা ভাবছিস তেমন মা তুই পাবি না। সৎ মা কখনো আপন মায়ের মতো হয় না রে মা!!
আমি বাবার কথার আগামাথা কিছু না বুঝেই বারবার বলছিলাম, আমি নতুন মা চাই, নতুন মা এনে দাও।
কয়েকদিন পরে বাবা আমার জন্য সবুজ আর হলুদ রঙের মিশানো সিট দিয়ে একটা ফ্রক জামা বানিয়ে দেয়। একটা কার্টুন বসানো সেন্ডেল আর মাথার বেন্ড নিয়ে আসে। তারপর সেই নতুন জামা সেন্ডেল নিয়ে ছোঁয়ার মায়ের থেকে আমাকে সাজিয়ে নিয়ে আসে। ওইদিন ছোঁয়ার লাল লিপস্টিক আমার ঠোঁটে দিয়ে দিয়েছিলেন। আমি লিপস্টিক উঠে যাওয়ার ভয়ে সারাদিন ঠোঁট দুটো এক সাথে করিনি। আর আমাদের ভাঙা আয়নার টুকরোতে একটু পরপরই ঠোঁট উল্টিয়ে উল্টিয়ে দেখছিলাম।
দুপুরের পরে বাবাকে নতুন পাঞ্জাবি টুপি পড়িয়ে আমার সামনে নিয়ে আসে আমার সেই দাদি। বাবা আমাকে কোলে নিয়ে গ্রামের ধানক্ষেতের রাস্তা পেড়িয়ে ইট পাথরের রাস্তা দাঁড়িয়ে থাকা ভ্যান গাড়িতে উঠেন। সাথে আমাদের গ্রামের আরো দুটো মানুষ আর ছোঁয়ার বাবাও ছিলেন। আমরা কিছু দূরে যেতেই বাবাকে জিজ্ঞেস করি,
বাবা আমরা কই যায়?
তোমার জন্য নতুন মা আনতে!
ওরে আমারও নতুন মা হবে কি মজা! কিই মজা!
বলেই হাতে তালি দিয়ে লাফাচ্ছিলাম। বাবা কেন যেন আমাকে চুপ করে বুকে জড়িয়ে ধরে ছিলেন শুধু।
আমি নতুন মায়ের কোলে বসে আহ্লাদে আটখানা হয়ে আছি,, কোন মতেই আজ আমি মায়ের কোল থেকে নামছি না। নতুন মা ও আমাকে পরম আদরে বুকে জরিয়ে আছে। অনেক রাতে আমি বাবা আর নতুন মা বাড়িতে আসি।
প্রথম প্রথম কয়েকদিন আমি বাবা মায়ের সাথে ছিলাম কিন্তু কিছুদিন পর থেকে মা আমাকে বারবার তাদের সাথে না থাকার জন্য বলতে শুরু করে এবং বাইরে বারান্দায় আমাকে ঘুমাতে বলে বিছানা পেতে দেয়। একা ঘুমাতে আমার খুব ভয় লাগে তাই বাবা বাড়িতে এসে যখনই বলতো,
কই!! আমার তোরশা মা কই?
তখনই আমি ঝটপট উত্তর দিতাম,, এখানে বাবা। তবে মাঝে মাঝে আমি কিছু বলার আগেই মা বলতেন, ঘরে খুব গরম, ছোট মেয়ে বারান্দায় বিছানা পেতে দিয়েছি, বাইরের শীতল হাওয়ায় আরামে ঘুমাচ্ছে,, থাক না ওখানেই,, জানালা দিয়ে মাঝে মাঝে উঠে দেখবো।
কিন্তু বাবা আমাকে নিতে এলেই আমি বলতাম,, বাবা আমি এখনো ঘুমাই নি।
আসলে বাইরে আমার ঘুম পেতোই না,, তাই চুপ করে চোখ বন্ধ করে থাকতাম। এভাবে কয়েকদিন যাওয়ার পরে মা আমার গায়ে হাত তুলে বলতেন, যদি আমি আবারও বাবার সাথে ঘরে যেতে চাই তাহলে পরের দিন আমাকে খেতে দিবে না। মা তার কথা রাখতেন ও,, সত্যিই আমাকে পরের দিন না খাইয়ে রাখতেন আর সেই কথা বাবাকে বললে আরো বেশি মাইর দিবে বলে শাসিয়ে দিতেন।
এর পরে থেকে বাবা আমাকে নিতে আসলেও আমি যেতাম না,, বাবাকে বলতাম,, ঘরে অনেক গরম লাগে আমার, ভালো ভাবে ঘুমাতে পারিনা আমি,, তাই আমি বাইরের বারান্দার চৌকিতে ঘুমাবো। বাবা অবাক হয়ে বলতেন,,
তোরশা মা! আমি তো সারা রাত তোকে তালপাখা দিয়ে বাতাস করি,, তোর গা ঘামতেও দিই না,, তাহলে কখন তোর গরম লাগে।
আরে ছাড়ো না,,তুমি কি সারারাত জেগে থাকো নাকি।সারাদিন কত পরিশ্রম করো, তাই রাতে সোয়ার সাথে সাথে ঘুমিয়ে যাও আর সেই সকালে তোমার ঘুম ভাঙে। তোমার কাছে মনে হয় সারারাত জেগে তালপাখার বাতাস করেছো কিন্তু তা বাস্তবে হয় না। আচ্ছা তুমি ঘরে ঘুমাও, আমি তোরশার সাথে থাকি।
মা আমার পাশে সামান্য কিছু সময় থাকলেও রাত একটু গভীর হওয়ার সাথে সাথে উঠে চলে যায়। আমি ভয়ে কাপটি মেরে সুয়ে থাকি,, আশেপাশে ঘুঘড়ি পোকা, শেয়াল, বিড়াল সহ কত রকম পাখি রাতে ভুতের মতো শব্দ করে, তা শুনে আমার কলিজা ধরফর করে। ভয়ে চোখ বন্ধ করে বালিশ চেপে ধরে রাখি। এভাবেই কখন ঘুমিয়ে যায় বুঝতে পারিনা, তবে ঘুমানোর আগে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়তে হয় প্রতিদিন।
বাবা বারান্দার খুঁটির সাথে খেঁজুর পাতার ডাল দিয়ে বেড়া বেঁধে দেয়। বাতাস আসার জন্য জানালার মতো করে ফাঁক রেখেছে। এখন আমি প্রতিদিন এখানেই ঘুমায়। বাড়ির ছোট ছোট কাজ,যেমন ঝাড়ু দেওয়া থালাবাসন পরিষ্কার করা, ছাগলের জন্য ঘাস নিয়ে আসা,, মায়ের গোসলের কাপড় ধুয়ে দেওয়া, সব গুলো কাজ আমি করি।
বাবা খুব সকালে দুইটা পান্তা ভাত, কাচা মরিচ আর পেয়াজ দিয়ে মাখিয়ে খেয়ে কাজে চলে যায়, আর আসে সেই সন্ধ্যার পরে, কখনো কখনো রাত দশটাও বাজে। বাবা গঞ্জের হাটে বিভিন্ন রকম কাজ করে। সারাদিন বাবা বাড়ির বাইরে থাকার জন্য আমাদের গ্রামের একটা বড়আব্বা সব সময় আমাদের বাড়িতে এসে বসে মায়ের সাথে হাসাহাসি করতেন। বড়আব্বা আসার সাথে সাথে মা আমাকে ছোঁয়ার সাথে খেলার জন্য বলতেন। আমাকে মাঝে মাঝে ছোয়াদের বাড়িতে রেখে আসতেন।
নতুন মা আসার পরে বাবা আর কাজে যাওয়ার সময় আমাকে সাথে নিয়ে যায় না। আমি যেতে বায়না করলে বাবা বলেন,,
আমার পরীর মতো মেয়েটা রোদের তাপে কালো হয়ে যাবে,, আমার মেয়ে আমার গরীবি রাজ্যের রাজকুমারী। আমার মা কে আমি কখনো কোন কাজ করতে দিবো না। আমার মেয়েকে ঘোড়ায় চড়ে রাজকুমার এসে রানী বানিয়ে নিয়ে যাবে। আরো কত কথা বলে বলে আমাকে আদর করতেন। অথচ সেই মেয়েকে, বাবার অনুপস্থিতিতে কত কি হজম করতে হয়।
আজ দুপুরের আগে আমি উঠোনের কোণায় বসে ধুলাবালি নিয়ে খেলছিলাম। তখন বড়আব্বা আমাদের বাড়িতে আসেন। মা কলপাড়ে তরকারি ধুচ্ছিলো। বড়আব্বা এসেই আমার হাতে পাঁচ টাকা দিয়ে বলে,, এক দৌড়ে ওই পাড়ার রমিজ মোল্লার দোকান থেকে কেক খেয়ে আয়। আমি যেতে চাইছিলাম না। কিন্তু মা আমাকে আরো দুই টাকা দিয়ে ঠেলে ঠেলে যেতে বলে। তাই আমি ধিরে ধিরে দোকানের দিকে যায়।
আজও সকালে বাবা পান্তা ভাত খেয়ে কাজে গেছে। আমি দোকান থেকে কেক নিয়ে, খেতে খেতে বাড়ির দিকে আসতেই অনেক সোরগোল শুনতে পায়। অনেক মানুষ ছুটে আসছে আর বলছে,, তালিব আলী (আমার বাবা)একটা ছোট্ট মেয়েকে ধর্ষণের চেষ্টা করেছে। কি এই ধর্ষণ? মনে হয় ঝগড়া করাকে ধর্ষণ বলে। আমি ভাবছিলাম মা পাশের বাড়ির কারো সাথে ঝগড়া করছে। কিন্তু হেষেল ঘরের কাছে আসতেই দেখি সবাই মিলে আমার বাবাকে মারছে। ছোঁয়ার মা ছোঁয়াকে নিয়ে এক কোনায় দাঁড়িয়ে আছে। ছোঁয়ার গায়ে জামা না থাকায় তার বুকে রক্তের আচঁড় দেখতে পেলাম। সেও আমার মতো ভয়ে মায়ের সাথে মিশে গেছে। আমি এক দৌড়ে ঘরের দরজা ফাঁকে লুকিয়ে পড়ি।
পাড়ার লোকজন বাবাকে মেরে রক্তাক্ত করে ফেলে চলে গেছে। সবাই অনেক বাজে বাজে গালি দিতে দিতে যাচ্ছে। মা এখনো বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। সবাই যখন বাড়ি থেকে অনেক দূরে চলে গেছে তখন আমি বাবার কাছে আসি। বাবার পুরো মুখ রক্তে ভিজে গেছে, ছাই রঙের আধাছেড়া জামাটা পুরো টা ছিড়ে গিয়ে বুকে পিঠে হাতে আঘাতের যায়গা থেকে রক্ত বেরুচ্ছে। আমাকে কাছে আসতে দেখেই বাবা বিনিয়ে বিনিয়ে বলে,,
মা, মা রে বিশ্বাস কর আমি তোর খারাপ বাবা না, আমি এইসব কিছু করিনি।
বাবার এমন কষ্ট দেখে আমিও কান্না করতে করতে নিজের জামা দিয়ে বাবার রক্ত মুছে দিই। বাবা কোন রকম আমাকে ধরে অনেক কষ্টে উঠে বসে। তারপর আস্তে আস্তে বারান্দায় গিয়ে শুয়ে পড়ে। মা তখন কাছে আসতে চাইছিলো কিন্তু বাবা ধমক দিয়ে বলে,
খবরদার হারামজাদি,, কাছে আসবি না।
,,,,,,,,,,,
মা রে ওই গামছা টা ভিজিয়ে এনে দে তো।
আমি এক দৌড়ে গামছা ভিজিয়ে এনে বাবার হাতে দিলাম। বাবা নিজের শরীর মুছে বিছানায় সুইয়ে পড়ে। মা আজ বাইরের চৌকিতে আছে। বাবা আমাকে তার সাথে সাথে থাকতে বলছে সব সময়, তাই আমিও আজ বাবার সাথে আছি। বাবা নিজে নিজেই, বাতিতে জলন্ত আগুনের শিষের উপর, ছোট্ট ষ্টীলের বাটিতে করে সরিষার তেলের সাথে কালিজিরা দিয়ে গরম করে, সমস্ত শরীরে মালিশ করছেন। আর আমাকে শুধু একটু পরপর এটা দে ওটা দে করছেন।
আমি বাবার মালিশ করা তেলের বাটি-টা দূরে রাখার পরে বাবাকে জিজ্ঞেস করি,,
আচ্ছা বাবা! ধর্ষণ কি?
চলবে,,,,,,
# বাবা
প্রথম পর্ব
লেখিকা # Fabiha_Busra_Borno