হতে চাই জান্নাতের সবুজ পাখি.....
كُلُّ نَفْسٍ ذَآىِٕقَةُ الْمَوْتِ
"প্রত্যেক প্রাণীকে মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে"
আমরা প্রায় সকলেই এই আয়াতটির সাথে পরিচিত এবং সকলে বিশ্বাসও করি আমাদেরকে অবশ্যই একদিন দুনিয়া ছেড়ে চলে যেতে হবে। কিন্তু আমরা নিজেদের জন্য কেমন মৃত্যু কামনা করি? কোন অবস্থায় মৃত্যুর আকাঙ্খা রাখি?
বর্তমান সময়ে এক্ষেত্রে একেকজনের চিন্তাধারা একেক রকম "কেউ তাহাজ্জুদের সিজদায় মৃত্যু চায়, কেউ
কুরআন তিলাওয়াত-জিকির করা অবস্থায়, কেউ রমজানে রোজাদার অবস্থায়, কেউ হজে গিয়ে ইহরাম পরা অবস্থায়, কেউ চায় মদিনায় মরে জান্নাতুল বাকীতে দাফন হতে, কেউবা শাহীদ হতে চায়, ইত্যাদি।"
কিন্তু আপনি যদি সাহাবায়ে কেরাম রাঃ দের জামানার দিকে তাকান তাহলে দেখতে পাবেন উমার ইবনে খাত্তাব থেকে শুরু করে আমর ইবনে জামূহর মত বয়োবৃদ্ধ খোড়া সাহাবী পর্যন্ত সকলেই শাহাদাত কামনা করছেন! শাহাদাতের তালাশে বদর উহুদ খন্দকে ছোটাছুটি করছেন!
আর এমনটা হবেই'বা-না কেন? যেখানে স্বয়ং রাসুলুল্লাহ ﷺ নিজের অবস্থাই হচ্ছে-
وَالَّذِي نَفْسِي بِيَدِهِ… لَوَدِدْتُ أَنِّي أُقْتَلُ فِي سَبِيلِ اللَّهِ، ثُمَّ أُحْيَا ثُمَّ أُقْتَلُ، ثُمَّ أُحْيَا ثُمَّ أُقْتَلُ، ثُمَّ أُحْيَا ثُمَّ أُقْتَلُ
ঐ সত্ত্বার কসম, যার হাতে আমার প্রাণ! আমার বড় ইচ্ছে হয়, আমি আল্লাহর রাস্তায় নিহত হবো, আবার আমাকে জীবিত করা হবে, আবার আমি নিহত হবো, আবার আমাকে জীবিত করা হবে, পুনরায় আমি নিহত হবো, পুনরায় আমাকে জীবিত করা হবে এবং পুনরায় আমি আল্লাহর রাস্তায় নিহত হবো।[সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৭২২৬]
-
একটু ভাবুন তো, ঐ মৃত্যুর চেয়ে উত্তম মৃত্যু আর কী হতে পারে, যেই মৃত্যু স্বয়ং রাসুলুল্লাহ ﷺ নিজের জন্য বারবার কামনা করছেন?
কী আছে এই মৃত্যুর ভিতরে?
হ্যা, এই মৃত্যুর ভিতরে আছে জীবন।
কি? বিশ্বাস হয়না?
দেখুননা, শাহাদাত ব্যাতিত অন্য যেকোনো ভাবে কেউ মারা গেলে আমরা বলি, "লোকটা মারা গেছে, লোকটার হায়াত ফুরিয়ে গেছে" এক্ষেত্রে কুরআন-হাদিসের কোথাও কোনো প্রতিবাদ প্রতিরোধ নেই। সবাই মেনে নিচ্ছে যে লোকটা আসলেই মারা গেছে।
কিন্তু কেউ যদি আল্লাহর জন্য জীবন বিলিয়ে দিয়ে শহীদ হয়। তখন যদি কেউ বলে, "লোকটা মারা গেছে, লোকটার হায়াত ফুরিয়ে গেছে" সাথেসাথে স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা এর প্রতিবাদ করে বলছেন, খবরদার! এদেরকে মৃত বলবেনা!
وَلَا تَقُوۡلُوۡا لِمَنۡ یُّقۡتَلُ فِیۡ سَبِیۡلِ اللّٰہِ اَمۡوَاتٌ ؕ بَلۡ اَحۡیَآءٌ وَّلٰکِنۡ لَّا تَشۡعُرُوۡنَ
আর যারা আল্লাহর রাস্তায় নিহত হয়, তাদের মৃত বলো না। বরং তারা জীবিত, কিন্তু তোমরা তা বুঝ না। (আল বাকারা - ১৫৪)
وَلَا تَحۡسَبَنَّ الَّذِیۡنَ قُتِلُوۡا فِیۡ سَبِیۡلِ اللّٰہِ اَمۡوَاتًا ؕ بَلۡ اَحۡیَآءٌ عِنۡدَ رَبِّہِمۡ یُرۡزَقُوۡنَ ۙ
আর যারা আল্লাহর রাহে নিহত হয়, তাদেরকে তুমি কখনো মৃত মনে করো না। বরং তারা নিজেদের পালনকর্তার নিকট জীবিত ও রিযিকপ্রাপ্ত। (আল ইমরান - ১৬৯)
-
শুধু কি তাই? যতবড় আল্লাহওয়ালা বুজুর্গই হোক মরণের যন্ত্রণা কিছুনা কিছু তাকে ভোগ করতেই হবে। এক্ষেত্রে শহীদরাই শুধু ব্যাতিক্রম। তাদের মৃত্যু যন্ত্রণা নামমাত্র কিংবা নেই বললেই চলে।
"ما يجد الشهيد من مس القتل إلا كما يجد أحدكم من مس القرصة " . قال أبو عيسى هذا حديث حسن صحيح غريب"
"শহীদ ব্যক্তি মৃত্যুর কষ্ট শুধু ততটুকুই অনুভব করে, তোমাদের কাউকে একবার চিমটি কাটলে সে যতটুকু কষ্ট অনুভব করে। (জামে' আত-তিরমিজি ১৬৬৮, ইবনু মা-জাহ ২৮০২, মান: সহিহ)
-
কি ভাবছেন, শহীদের কবরের কথা? ধুর! শহীদের কবরে আবার ঝামেলা করবে কে?
رَجُلًا قَالَ: يَا رَسُولَ اللَّهِ، مَا بَالُ الْمُؤْمِنِينَ يُفْتَنُونَ فِي قُبُورِهِمْ إِلَّا الشَّهِيدَ؟ قَالَ: «كَفَى بِبَارِقَةِ السُّيُوفِ عَلَى رَأْسِهِ فِتْنَةً»
এক সাহাবী জিজ্ঞাসা করলেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ্! শহীদ ব্যতীত অন্যান্য মুমিনগণ কবরের পরীক্ষার বা ফিৎনার সম্মুখীন হবে, এর কারণ কি? (অর্থাৎ, শহীদ কেন কবরে পরীক্ষার সম্মুখীন হবেনা?) রাসুল ﷺ বললেন, তার(শহীদের) মাথার উপর উজ্জল তরবারি তাকে কবরের পরীক্ষা থেকে নিরাপদ রাখবে। (সুনানে আন-নাসায়ী ২০৫৩, মানঃ সহিহ)
-
শহীদের রুহ কোথায় থাকবে? তারা কি কবরে ঘুমিয়ে পড়ে থাকবে?
আরে নাহ্! আল্লাহ তায়ালা তাদের রুহকে সবুজ পাখির ভিতর ঢুকিয়ে দিয়ে বলবেন, যাও অন্য নেককারদের মত হাশরের ময়দান, হিসাব কিতাবের জন্য ওয়েট করা লাগবেনা, তোমরা এখন থেকেই জান্নাতে ঘুরেফিরে উপভোগ করতে থাকো!
"أرواحهم في جوف طير خضر لها قناديل معلقة بالعرش تسرح من الجنة حيث شاءت ثم تأوي إلى تلك القناديل فاطلع إليهم ربهم اطلاعة فقال هل تشتهون شيئا قالوا أى شىء نشتهي ونحن نسرح من الجنة حيث شئنا ففعل ذلك بهم ثلاث مرات فلما رأوا أنهم لن يتركوا من أن يسألوا قالوا يا رب نريد أن ترد أرواحنا في أجسادنا حتى نقتل في سبيلك مرة أخرى . فلما رأى أن ليس لهم حاجة تركوا"
"তাদের(শহীদদের) রূহসমূহ সবুজ পাখীর উদরে রক্ষিত থাকে, যা ‘আরশের সাথে ঝুলন্ত দীপাধারে বাস করে। জান্নাতের সর্বত্র তারা যেখানে চায় সেখানে বিচরণ করে। অবশেষে সে দীপাধারগুলোতে ফিরে আসে। একবার তাদের প্রভু তাদের দিকে পরিপূর্ণভাবে তাকালেন এবং জিজ্ঞেস করলেন, তোমাদের কি কোন আকাঙ্ক্ষা আছে? জবাবে তারা বলল, আমাদের আর কি আকাঙ্ক্ষা থাকতে পারে, আমরা তো যেভাবে ইচ্ছা জান্নাতে ঘোরাফেরা করছি। আল্লাহ তা’আলা তাদের সাথে এরূপ তিন তিনবার করলেন। যখন তারা দেখলো জবাব না দিয়ে প্রশ্ন থেকে রেহাই পাচ্ছে না তখন তারা বলল, “হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের আকাঙ্ক্ষা হয় যদি আমাদের রূহগুলোকে আমাদের দেহসমূহে ফিরিয়ে দিতেন আর পুনরায় আমরা আপনারই পথে নিহত হতে পারতাম। অতঃপর মহান আল্লাহ যখন দেখলেন, তাদের আর কোন প্রয়োজনই নেই, তখন তদেরকে ছেড়ে দেয়া হলো (আর প্রশ্ন করা হলো না)। (সহিহ মুসলিম ৪৭৭৯, মুসলিম ১৮৮৭, তিরমিযী ৩০১১, দারেমী ২৮২২, সহীহাহ ২৬৩৩, ইবনে মাজাহ ২৮০১,মান: সহিহ)
-
আরে, শুধু তাই নয়! অন্যরা একবার মৃত্যুর স্বাদ ভোগ করে দ্বিতীয় বার আর মৃত্যুর নাম মুখেও আনবেনা। কিন্তু শহীদ? এরা জান্নাতে গিয়েও একই কথা বলবে, "আল্লাহ, আবারও যদি আমাদেরকে দুনিয়াতে পাঠাতেন! আপনার জন্য জীবন দেওয়ার মধ্যে যে উচ্চ মর্যাদা আর স্বাদ পেয়েছি সেটা আমরা বারবার পেতে চাই!"
ما أحد يدخل الجنة يحب أن يرجع إلى الدنيا وله ما على الأرض من شىء، إلا الشهيد، يتمنى أن يرجع إلى الدنيا فيقتل عشر مرات، لما يرى من الكرامة
"জান্নাতে প্রবেশের পর আর কেউ দুনিয়ায় ফিরে আসার আকাঙক্ষা করবে না, যদিও দুনিয়ার সকল জিনিস তাকে দেয়া হয়। একমাত্র শহীদ ব্যতীত; সে দুনিয়ায় ফিরে আসার আকাঙক্ষা করবে যেন দশবার শহীদ হয়। কেননা সে শাহাদাতের মর্যাদা দেখেছে।" (সহিহ বুখারী ২৮১৭, জামে' আত-তিরমিজি ১৬৬১, মান: সহিহ)
-
শহীদ যখন কিয়ামতের কঠিন দিনে উপস্থিত হবে-
عن أبي هريرة رضي الله عنه قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم : «ما من مَكْلُومٍ يُكْلَمُ في سبيل الله، إلا جاء يومَ القيامة، وكَلْمُهُ يَدْمَى: اللَّونُ لَوْنُ الدَّمِ، والرِّيحُ رِيحُ المِسْكِ».
[صحيح] - [متفق عليه]
“আল্লাহর পথে কেউ আঘাত প্রাপ্ত হলে কিয়ামতের দিন এমতাবস্থায় আসবে যে, তার ক্ষতস্থান থেকে টকটকে লাল রক্ত ঝরছে: রঙ হবে রক্তের রঙ আর সুগন্ধি হবে মেশকের সুগন্ধি।”
সহীহ - মুত্তাফাকুন ‘আলাইহি (বুখারী ও মুসলিম)।
-
শহীদ ব্যক্তি গুনাহগার হলে-
يُغْفَرُ لِلشَّهِيدِ كُلُّ ذَنْبٍ إِلَّا الدَّيْنَ
প্রদেয় ঋণ ব্যতীত শহীদ ব্যক্তির সমস্ত গুনাহ আল্লাহ তাআলা মাফ করে দেবেন। (সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১৮৮৬)
-
শহীদদের জন্য আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে দেওয়া স্পেশাল ৬টি গিফট-
للشهيد عند الله ست خصال يغفر له في أول دفعة ويرى مقعده من الجنة ويجار من عذاب القبر ويأمن من الفزع الأكبر ويوضع على رأسه تاج الوقار الياقوتة منها خير من الدنيا وما فيها ويزوج اثنتين وسبعين زوجة من الحور العين ويشفع في سبعين من أقاربه " . قال أبو عيسى هذا حديث صحيح غريب"
"শহীদের জন্য আল্লাহ্ তা’আলার নিকট ছয়টি পুরস্কার বা সুযোগ আছে।
১। তাঁর প্রথম রক্তবিন্দু পড়ার সাথে সাথে তাঁকে ক্ষমা করা হয়,
২। তাঁকে তাঁর জান্নাতের বাসস্থান দেখানো হয়,
৩। কবরের আযাব হতে তাঁকে মুক্তি দেওয়া হয়,
৪। সে (কিয়ামতের ভয়ংকর) কঠিন ভীতি হতে নিরাপদ থাকবে,
৫। তাঁর মাথায় মর্মর পাথর খচিত মর্যাদার টুপি পরিয়ে দেওয়া হবে। এর এক একটি পাথর দুনিয়া ও তাঁর মধ্যকার সবকিছু হতে উত্তম। তার সাথে বাহাত্তরজন জান্নাতী হূরকে বিয়ে দেওয়া হবে এবং
৬। তাঁর সত্তরজন নিকটাত্মীয়ের জন্য তাঁর সুপারিশ ক্ববূল করা হবে।
(জামে' আত-তিরমিজি ১৬৬৩, তা’লীকুর রাগীব ২/১৯৪, সহীহা ৩২১৩, আহমাদ ১৬৭৩০, বায়হাকী ফিস সুনান ৯/১৬৪, বায়হাকী ফিশ শুআব ১০৮২৩, ১০৮২৪, আল-আহকাম ৩৬ নং পৃষ্ঠা, মিশকাত ৩৮৩৪, ইবনে মাজাহ ২৭৯৯, মান: সহিহ)
-
এখন কেউ বলতে পারেন, ভাই আমি তো অনেক আগে থেকেই শাহাদাত চাই।
আরে ভাই শুধু আপনি আমি কেন? এদেশের অনেক আলিম, খানকাহর পীর বুজুর্গরাও শাহাদাত চান।
কিন্তু আমাদেরকে যখন ডাকা হয় শাহাদাত প্রাপ্তির পথে কাজ করার জন্য, ব্যাপক দাওয়াহ-এ'দাদের মাধ্যমে সাধ্যমত প্রস্তুতি গ্রহণের জন্য, তখন আমরা নিজেরা তো করিইনা অন্যকেউ এগুলো করতে চাইলে তাকে পিছ থেকে টেনে ধরি!
এক্ষেত্রে আমাদের শাহাদাত কামনার উদাহরণ হচ্ছে ঐ ব্যক্তির মত যে নেক সন্তান চায়, নেক সন্তান লাভের জন্য কাবার গিলাফ ধরে, তাহাজ্জুদের সিজদায় গিয়ে চোখের পানি ফেলে দোআ করে, কিন্তু বিয়ে করতে রাজি না!
অথচ আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন-
وَلَوۡ اَرَادُوا الۡخُرُوۡجَ لَاَعَدُّوۡا لَه عُدَّۃً
আর যদি তারা (আল্লাহর রাস্তায়) বের হবার সংকল্প নিত, তবে অবশ্যই কিছু সরঞ্জাম প্রস্তুত করতো। (আত তাওবাহ্ - ৪৬)
-
সর্বশেষ দোয়া চাই যেন আল্লাহ তায়ালা আমাকেও তার পথের জন্য যথাযথ প্রস্তুতির তাওফিক দান করেন। আল্লাহ তায়ালা এমনভাবে তার জন্য জীবন উৎসর্গ করার সুযোগ দেন যেন আমিও মৃত্যুর সময় বলে উঠতে পারি-
أَكْبَرُ فُزْتُ وَرَبِّ الْكَعْبَةِ
"আল্লাহু আকবার! কাবার রবের শপথ! আমি সফল হয়েছি!"