24/07/2025
আ-ত্মা কাপানো সত্য কি??
সেদিন দুপুরটা ছিল অন্যরকম, ফ্লাইট লাইন থেকে ভেসে আসছিল চেনার শব্দ ট্রেইনার বিমানের ইঞ্জিন। আকাশ ছিল পরিষ্কার। কেবল একটি মেঘপুঞ্জ যেন অপেক্ষা করছিল নির্দিষ্ট সময়ের জন্য। স্কুল ঘন্টা বাজছিল শিশুরা বইয়ের ব্যাগ হাতে বাড়ি ফিরছিল। হঠাৎ আকাশ কেঁপে উঠল। এক নিমিষে বিস্ফোরণ, আগুন ধোঁয়ার ঘূর্ণি। আকাশে একটি ট্রেইনার বিমান যা নিয়মিত প্রশিক্ষণের অংশ হিসেবেই উঠছিল। মুহূর্তে আগুনে পুড়ে মাটিতে ভেঙে পড়ল। ঘড়ির কাটা থেমে গেল একটি পরিবারের জীবনে থেমে গেল একটি স্বপ্ন, একটি সাহসী হৃদয়ের স্পন্দন। তিন মিনিটের ভেতর সব শেষ।
শুধু বাতাসে ভেসে থাকলো পুড়ে যাওয়া ইঞ্জিনের গন্ধ আর আশেপাশে শিশুদের চিৎকার। সেদিন দুপুরটা ছিল অন্যরকম। সরকারি বিবৃতিতে এমনটাই বলা হয়েছে। একটি রুটিন প্রশিক্ষণ উড্ডয়ন একটি অনুশীলন মাত্র। কিন্তু প্রশ্ন উঠে আসে একটি প্রশিক্ষণ মিশনে অংশ নিতে গিয়েই যদি একজন তরুণ পাইলটকে জীবন দিতে হয় সেটি কি সত্যিই রুটিন? যদি একটি পুরনো মডেলের ট্রেইনার বিমান আকাশে উড়তে উড়তেই আগুন ধরে যায় সেটি কি কেবল প্রযুক্তিগত ত্রুটি? কেন এত পুরনো বিমান এখনো আমাদের ফ্লিটে রয়েছে? এই প্রশ্নগুলো কেউ করে না।
সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকরা জিজ্ঞেস করলে উত্তরে ঠোঁট কামড়ে বিষয়টি তদন্তনাধীন। আর সেই তদন্তের রিপোর্ট অন্তহীন কালক্ষেপণ অদৃশ্য ফাইল চাপা। প্রশ্ন ছিল আরো। বিমানটির মেইনটেনেন্স কবে হয়েছিল? তার ইঞ্জিন কতটা কার্যকর ছিল? আগুন ধরার মুহূর্তে ব্ল্যাকবক্স কি রেকর্ড করেছিল? আরো একটি প্রশ্ন যা কেউ জোরে বলেনি? এই দুর্ঘটনার দায় কি শুধুই কারিগরি ব্যর্থতা? নাকি এর পেছনে আছে সাংগঠনিক গাফিলতি? এমনকি রাজ**নৈতিক স্বার্থ?
ঢাকার এক অদূরে রাজশাহী শহরে একটি সাধারণ বাসা। জানালার পাশে বসা একজন মা। তার হাতে ধরা ছেলের পাসপোর্ট সাইজের ছবি। এক মুহূর্তও তা ছাড়েন না। মাঝে মাঝে বলেন, ও বলতো যদি কোনদিন ফিরে না আসি, আম্মু তুমি কেঁদো না। কিন্তু কিভাবে না কাঁদে সেই মা। তার সামনে বারবার ভেসে ওঠে ছেলের শেষ ফোন কল। আজ খুব ক্লাউডি। কিন্তু ঠিক সময় ফিরবো। তোমার জন্য শাড়ি আনব আম্মু। কিন্তু সেই শাড়ি আর ফিরে আসে না। শুধু আসে খবর তার ছেলে আর ফিরবে না। ঘরের ভেতর ছড়িয়ে আছে ছেলের ইউনিফর্ম বই একখানা ছোট ডায়েরি যেখানে লেখা দেশের আকাশে উড়তে পারাই সবচেয়ে বড় গর্ব। সেই গর্বটাই যেন আজ ছাই হয়ে গেছে। সন্তান হারানোর শোক একা সেই মায়ের না এই জাতিরও।
কারণ রাষ্ট্র যখন প্রশ্ন শুনতে চায় না, উত্তর খোঁজেনা, তখন সেই শোক জাতীয় ব্যর্থতায় পরিণত হয়। একজন সাবেক এয়ারফোর্স কর্মকর্তা বলেন, দুর্ঘটনাটা প্রযুক্তিগত নয় কেবল এটা একটা সাংগঠনিক ব্যর্থতা।” অথচ সেই বাক্য হারিয়ে যায় যেন কেউ কিছু শোনেনি। কেউ কিছু বলতেও চায় না। শুধু একা এক মা রাত গভীরে জানালায় তাকিয়ে থাকেন। কখনো বলেন ও আমার বুকে ভর দিয়ে হাঁটতো। আজ আমি ওর না থাকা বুকের ভার বইছি।
বাংলাদেশের আকাশ প্রতিরক্ষা নিয়ে প্রায়ই নানা উচ্চস্বরের বক্তৃতা হয়। বলা হয় মডারনাইজেশন প্ল্যান চলছে। বলা হয় যুদ্ধবিমান কেনা হবে। কিন্তু বাস্তব অফিসের ফাইলে কোটি কোটি টাকা খরচ হয়।ভিজিবিলিটি স্টাডি নামক অদৃশ্য প্রকল্পে। অথচ আধুনিক যুদ্ধবিমান কিনতে বাজেট অনুপস্থিত। প্রশ্ন করলে বলা হয় কাজ চলছে। এমনকি প্রতিরক্ষা বাজেট বিশ্লেষণে দেখা যায় ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট ও প্রোটোকল ম্যানেজমেন্টে বরাদ্দ বেশি। কিন্তু বিমানের জন্য কার্যকর আপগ্রেড প্রায় নেই। পাইলটাররা যখন অনুশীলনে যান তাদের ভাগ্যে থাকে 40 বছরের পুরনো প্লেন যার কিছু যন্ত্রাংশ পাওয়া যায় না। আবার কিছু অংশ নিজেদের খুরিয়ে খুরিয়ে জোড়া দিতে হয়। এইসব প্লেন নিয়েই আমাদের আকাশ রক্ষা করার কথা ? আর তখনই প্রশ্ন আসে এই ভিজিবিলিটি প্রকল্পের দৃষ্টিতে কি নিহত পাইলটের মরদেহ আসে? একজন প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক বলেন, আমরা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত না। আমাদের প্রস্তুত করা হয় শুধু কাগজে কলমে।
সেনানিবাসে ঘটনার পর দিন হয়তো কয়েক ঘন্টার জন্য পতাকা অর্ধনমিত থাকবে। কিছু প্রটোকল অনুসরণ করা হবে। কবরস্থান, সামরিক কফিনে জাতীয় পতাকা, গান, স্যালুট তারপর সবই আবার স্বাভাবিক। ফাইল ক্লোজড রিপোর্ট ইন প্রসেস তদন্ত গোপন। কেউ আর আজকের দিনের মতো উচ্চবাচ্য করবে না। পাইলটের নামে হয়তো একদিন একটি রাস্তার নামকরণ হবে। একটি ছোট ম্যারাথন আয়োজিত হবে তার সম্মানে কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়। একটি জাতির ব্যর্থতার জাতীয় চিহ্ন হিসেবে।
সেনাবাহিনীর সাবেক অফিসার জিয়াউল হক জানান, এই ধরনের বিমান দুর্ঘটনার অনেক কেসে আমরা প্যাটার্ন খুঁজে পাই। দুর্বল যন্ত্রাংশ, বাজে মেইনটেনেন্স সবই চলে কমিশনের ছায়ায়। উন্নয়নের নামে টাকা চলে অন্য পথে। কিছু দালাল চক্র এখন যুদ্ধবিমান বা প্রতিরক্ষা যন্ত্রাংশ নিয়েও দালালি করে। তারা ঠিক করে কে জিতবে টেন্ডার। কাদের মালামাল আসবে? বিমান ভালো কি খারাপ তা বড় বিষয় না। বড় বিষয় কমিশনের ভাগ। একজন পাইলট প্রশ্ন তুলেছিলেন, এই যন্ত্রাংশ দিয়ে কিভাবে ফ্লাই করব? সেই প্রশ্নের জবাব কি তার মৃত্যুতেই দেওয়া হলো?
স্বৈ*রাচারী হাসিনার রাজ*নীতির ছায়া কি তাহলে এখনো আকাশ প্রতিরক্ষাকে গ্রাস করে আছে? আরো গুঞ্জন উঠছে? কিছু ভেতরের আও*য়ামী লী*গ লেসপেন্সার মহল ইচ্ছাকৃতভাবে আধুনিকায়ন বিলম্বিত করছে যেন প্রতিরক্ষা বাজেট থেকে ব্যক্তিগত ভাগ বটোয়ারা নিশ্চিত হয়। রাত বাড়ছে হাজার বছরের পুরনো রাত সেই মায়ের ঘুম আসে না। জানালার বাইরে তাকিয়ে থাকেন। তার কল্পনায় ছেলে এখন আকাশে উঠছে সোজা নিখুত গর্বিত। হঠাৎ করেই তিনি কেঁপে ওঠেন। কারণ স্বপ্নেও ছেলেটা বলে ওঠে আম্মু আমি ফিরতে পারিনি। কারণ আমার বিমানে ছিল ছিদ্র। ক্যামেরা ধীরে ধীরে দূরে সরে যায়।
স্ক্রিনে লেখা ওঠে এই গল্প শুধু একটি পাইলটের না এটি একটি রাষ্ট্রের অক্ষমতার প্রতিচ্ছবি। একজন পাইলট ছিলেন যিনি বাঁচতে চেয়েছিলেন, লড়তে চেয়েছিলেন, আমরা তাকে বাঁচাতে পারিনি। কারণ আমাদের আকাশেই ছিল ফাঁক। তার মৃত্যুর কয়েক সপ্তাহ পর কেউ একজন একটি শোকাবাহ চিঠি লিখেছিলেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক। সে ছিল এই দেশের সবচেয়ে সাহসী ছেলে। কিন্তু তার পেছনে যে রা*ষ্ট্র দাঁড়িয়ে থাকার কথা সেই রা*ষ্ট্রই তার ডানা ভেঙে দিয়েছিল। এই দৃশ্যগুলো যেন একটি নীরব প্রতীক একটি পতাকা যার নিচে একজন মা বসে আছেন আর উপরে শূন্য আকাশ সেই আকাশে আর কেউ ফিরবে না।
একজন ক্যাডেট অফিসার ধীরে হেঁটে আসেন সেই মায়ের পাশে। তার চোখে জল হাতে ঝাজড়া হয়ে যাওয়া একটি জুতো। তিনি বলেন এই জুতোয় ও প্রথম প্যারেডে হাঁটতো। আজও এটা আমাদের ব্যারাকে ঝুলে থাকে। আমাদের ভুলের স্বারক হয়ে। পেছনে বাঁচতে থাকে স্লোগানহীন নীরবতা। ব্যারাকের এক কোণে একটি নাম না জানা পাখি ডাকে। সেই ডাক কি ফেরত আসার নাকি চিরবিদায়ের? আর কত মৃত্যু লাগবে আকাশ মেরামত করতে?