09/09/2024
পরিচয়হীন ১০৪ অভাগা ছাত্র-জনতা :
৪ আগস্ট দুপুর ২টা। রাজধানীর জুরাইন কবরস্থানের মোহরার আমিনুল ইসলামের মোবাইল ফোনে হঠাৎ একটি কল আসে। পরিচয় দেন যাত্রাবাড়ী থানার অপারেশন ইনচার্জ (ওসি)। নাম আবুল হাসান। প্রথমে অনুরোধ, কয়েকটি লাশ মাটিচাপা দিতে হবে। ইনচার্জ জানতে চান, কয়টি? ওসি জানান, ১০টি। এরপর আমিনুল ইসলাম জানিয়ে দেন, কাগজপত্র ছাড়া লাশ দাফন করা যাবে না। এতে ক্ষিপ্ত হন পুলিশ কর্মকর্তা। আমিনুলকে নানাভাবে কিছুক্ষণ হুমকি-ধমকি দিতে থাকেন। তার পরও আমিনুলের ভাষ্য ছিল, শরিয়ত এবং আইন অনুযায়ী না হলে তিনি কবরস্থানে কোনো লাশ দাফন করতে পারবেন না।
১০টি লাশ ছিল বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সমর্থনে রাজপথে নেমে আসা ছাত্র-জনতার। আন্দোলন দমাতে মরিয়া পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছিলেন তারা। হত্যাযজ্ঞের প্রমাণ ধ্বংস করতে লাশগুলো যেনতেন ধরনের মাটিচাপা দেওয়ার চেষ্টা করছিলেন পুলিশ কর্মকর্তা। তবে ইনচার্জ আমিনুল ইসলামের দৃঢ়তায় জুরাইন কবরস্থানে তা সম্ভব হয়নি।
ওই ১০টি মরদেহ নিয়ে পুলিশ এরপর কী করেছিল—তা উদ্ঘাটন করা অবশ্য সম্ভব হয়নি। সেগুলো কোথায় দাফন করা হয়েছিল কিংবা আদৌ তা করা হয়েছিল কি না—তা জানতে এক মাস ধরে অনুসন্ধান চালিয়েছে কালবেলা। জুরাইন কবরস্থানে গোরখোদক হিসেবে কাজ করেন, এমন কয়েকজনের সঙ্গে আলাপ করা হয় ছদ্মবেশে। তবে কোনোভাবেই তারা দাফন-সংক্রান্ত বিষয়ে কথা বলতে চাননি। এরপর যাত্রাবাড়ী থানার তৎকালীন ওসিকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করা হয়; কিন্তু তার ব্যক্তিগত মোবাইল নম্বরটি বন্ধ। ব্যাচমেটদের মাধ্যমে খোঁজ নিলেও কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারছেন না ওসি আবুল হাসান এখন কোথায়? গত ৩১ আগস্ট আবুল হাসানকে প্রশ্ন লিখে হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ পাঠানো হয়। মেসেজটি সেন্ড হয়েছিল। এর কিছু সময় পর দেখা যায়, তিনি তার ব্যবহৃত হোয়াটসঅ্যাপ অ্যাকাউন্টটি মুছে ফেলেছেন।
প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, এর বাইরে জুরাইন কবরস্থানে আরও পাঁচটি অজ্ঞাত মরদেহ দাফন করা হয়েছে। সেগুলো স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা জোর করে দাফন করেন। একটি সূত্রের মাধম্য অজ্ঞাত লাশ দাফনের বিষয়ে নিশ্চিত হয়ে গত ২০ আগস্ট কালবেলার প্রতিবেদক প্রথমে জুরাইন কবরস্থানে যান। সেখানে লাশের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়ার চেষ্টা করা হয়। তবে কবরস্থানের দায়িত্বশীলরা সহায়তা করেননি। এরপর তাদের কাছে থাকা লাশ দাফনের হিসাবের খাতা দেখতে চাইলে তা দিতেও অপারগতা প্রকাশ করেন। পরদিন ফের গেলে জানানো হয় সেই খাতা নিয়ে গেছেন সিটি করপোরেশনের ঊর্ধ্বতন অফিসাররা। এরপর আরও অন্তত আটবার জুরাইন কবরস্থানে যাওয়া হয়। তবে তারা কোনো তথ্য দিতে পারেননি। প্রতিবারই বলা হয়, খাতা করপোরেশনের ঊর্ধ্বতনরা নিয়ে গেছেন।
দক্ষিণ সিটির অঞ্চল-৫-এর সহকারী সমাজকল্যাণ কর্মকর্তা সাইদুর রহমান তখন জানিয়েছিলেন, ‘জুরাইনে কোনো অজ্ঞাত লাশ দাফন করা হয়নি।’
শিকার হচ্ছে হয়রানির। শাকিলকে তুলে নেওয়ার সিসিটিভি ফুটেজ রয়েছে কালবেলার হাতে।
তাতে দেখা যায়, শাকিলের বন্ধু অনিককে তুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে একটি বাইকে করে। বাইকটি চালাচ্ছিলেন গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তা ফিরোজ। পেছনে আর একটি অটোতে করে তুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল শাকিলকে। পরে অনিককে ছেড়ে দেওয়া হলেও এখন পর্যন্ত শাকিলের খোঁজ মেলেনি।
জানতে চাইলে শাকিলের বন্ধু অনিক কালবেলাকে বলেন, ‘আমাকে আর শাকিলকে মিরপুর ১৩ নম্বর পুলিশ কনভেনশন সেন্টারের পাশে অবস্থিত কাফরুল থানাধীন রাকিন সিটি থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। তারা ডিজিএফআইর পরিচয় দেয়। তারা মোট পাঁচজন ছিলেন। ফিরোজ আমাকে মোটরসাইকেলে করে ১৪ নম্বর মোড়ে এনে ছেড়ে দেয়। আর শাকিলকে অটোতে করে নিয়ে যায়।’ অনিক আরও বলেন, ‘আমরা কাফরুল থানা পুলিশের কাছে গিয়ে ঘটনা খুলে বলি। থানার সিসিটিভি ফুটেজ থেকে আমি ফিরোজকে শনাক্ত করি। পরে কাফরুল থানার এসআই রশিদ, ফিরোজের সঙ্গে ১৪ নম্বর মানিক হোটেলের পাশের সেনা কোয়ার্টারে ঘণ্টাখানেকের মতো একান্ত আলাপ করেন। কথাবার্তা শেষে এসআই রশিদ কোনো কথা না বলে চলে যান। ’
এ বিষয়ে কাফরুল থানার উপপরিদর্শক (এসআই) আব্দুর রশিদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি উত্তেজিত হয়ে পড়েন। কালবেলাকে তিনি বলেন, ‘ভুক্তভোগীদের শনাক্ত করে দেওয়ার জন্য আমি ফিরোজকে ডেকে কথা বলেছি। ফিরোজ অস্বীকার করেছেন, যে তিনি তাদের নেননি। পরে আমি তাকে ছেড়ে দিয়েছি।’
তবে একটি সূত্র থেকে কাফরুল থানার উপপরিদর্শক (এসআই) রশিদের ১১ মিনিট ৩৫ সেকেন্ডের একটি অডিও এসেছে কালবেলার হাতে। সেখানে এসআই রশিদকে বলতে শোনা যায়, ‘আমি বলি, ওরা ডিজিএফআই এফএস মানে ফিল্ড সোর্স। ওদের কাজই এগুলা। আমি তো ৩টা বছর র্যাবে থাইকা আইছি, আমি তো জানি। আমি তো ওদের সঙ্গে থাকছি।’
রশিদকে আরও বলতে শোনা যায়, ‘আমি আপনাদের সামনে বলতেছি, আমি একশ পার্সেন্ট শিওর তারাই (ডিজিএফআই) কাজটা করছে। আপনাদের কাছে একটা কথাই বলতেছি, যদি ডিজিএফআই ছেলেকে না নিত, অন্য কোনো পাবলিক ফাংশন হতো, তাহলে কবে শাকিলকে উদ্ধার করে ফেলতাম।’
আন্দোলন সময়ে যারা নিখোঁজ হওয়ার বিষয়ে সাধারণ ডায়েরি (জিডি) সম্পর্কিত তথ্যের জন্য ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) মিডিয়া সেন্টারে বেশ কয়েকবার যোগাযোগ করা হয়। তবে শুরুতে আশ্বাস দিয়েও শেষ পর্যন্ত তারা কোনো তথ্য দেননি।