08/01/2025
পদযাত্রার ৯ম দিন
দুরত্ব অতিক্রম: ৪১ কিলোমিটার।
তারিখ:২৮/০৪/২০২৩
গন্তব্য: হাটিকুমুরুল গোলচত্ত্বর,সিরাজগঞ্জ থেকে এলেঙ্গা মোড়,টাংগাইল।
পদযাত্রা বিশেষন...
সকাল ৭.৪০ এ খালি পেটে গ্লাস দুয়েক পানি খেয়ে কাধে ব্যাগ ঝুলিয়ে রওনা দিলাম। গোল চত্ত্বর এর শেষপ্রান্তে এসে একটা ঝুপড়ি দোকানে হাল্কা নাস্তা করে নিলাম। খাওয়া দাওয়া সেরে বাইরে রাস্তায় এসে দেখি মাত্রাতিরিক্ত ধুলায় আচ্ছন্ন হয়ে আছে চারপাশটা। ধুলার মাঝে ব্যস্ত সড়ক ধরে হাটা শুরু।
কিছুদূর আসার পর গাড়ির জ্যাম চোখে পড়ল। শ খানেক গাড়ির দীর্ঘ সারি ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। রাস্তায় ফুটপাত নেই, তাই পাশের সড়ক প্রসারনের অংশ দিয়েই হাটা শুরু করলাম। পা দেবে যাচ্ছে বালিতে,তাও গতি বাড়িয়েই হাটতে লাগলাম। গাড়ি এবং আশেপাশের লোকজন উদ্দেশ্যহীন দৃষ্টিতে থাকিয়ে দেখছে। হয়তো মনে মনে নিজেকে জিজ্ঞেস করছে " কে এই লোক? কাধে ব্যাগ আর প্রান্তে পানির বোতল ঝুলিয়ে এই গরমে এত দ্রুত হেটে যাচ্ছে কই?।
আমি ধুলাবালি,গরম আর শয়ে শয়ে দৃষ্টিকে তোয়াক্কা না করে এগুতে লাগলাম সামনের দিকে। সামনে কিছুদুর এগুতেই দৃশ্যটা চোখে পড়ল। একটা গাড়ির পিছনে আরেকটা গাড়ির পিছনের অংশ বেধে নিয়ে সিরাজগঞ্জের দিকে যাচ্ছে। দেখতে অদ্ভুদ ঠেকল,তাই দুয়েকটা ভিন্ন এংগেলে ছবি তুলে নিয়ে আবার আবার রওনা দিলাম। মিনিট বিশেক হাটার পর বাংগালী নদীর উপর নির্মিত নলকা সেতু পার করে এলাম।
সেতু ক্রস করার পর গাড়ির গতি বেড়ে যায়। হুশহাশ করে গায়ের পাশ দিয়ে ভয় ধরিয়ে ক্রস করছে যান্ত্রিক বাহন গুলো।
নলকা সেতু পার হয়ে কিছুদূর এগুলেও কামারখন্দ উপজেলা। উপজেলার চিহ্নিত মাইলফলক এর আশে পাশে দুয়েকটা ছবি তুলে হাটার গতি বাড়ি আবার এগুতে শুরু করলাম।
তীব্র গরমে হাটতে বেশ কষ্ট হচ্ছে। তার উপর রাস্তায় ফুটপাত না থাকার দরুন পাশের বালির উপর দিয়ে হাটতে হচ্ছে। বালু রোদের তাপে উত্তপ্ত হয়ে গেছে অসহনীয় ভাবে।
আরো ঘন্টা দেড়েক হাটার পর শরীরে অস্বস্তি শুরু হল। কোনাবাড়ি কলেজ মোড়ে যখন পৌছায় তখন ১০.৩০ পার হয়েছে। পথচারি একজনকে জিজ্ঞেস করে পাশের মসজিদের ওয়াশরুমে বিসর্জন কার্য সেরে নিলাম।
পাশের নলকূপ থেকে ফ্রেশ হয়ে আবার শুরু যাত্রা। বেশ কিছুক্ষন ধরে ভুগিয়েছে 🥵
গরমের তীব্রতায় শরীরের অবস্থা কাহিল। মধ্য দুপুরের দিকে কি অবস্থা হয় ভাবতেই গা শিউরে উঠছে। কিছুদুর এগুতেই ধান গবেষনা ইনস্টিটিউট আর কোনাবাড়ি কলেজটা চোখে পড়ল। এখানেও কয়েকটা ছবি তুলে নিলাম।
কলেজ পার হয়ে পাশেই একটা ছোট হাট। একটা হোটেলে বসে রুটি/ডাল খেয়ে রওনা দিতে উদ্যোগী হলাম আবার। রওনা দেয়ার আগে পানির বোতলটা আর এক তরফা পানিপূর্ন করতে ভুললাম না।
ততক্ষণে রোদের তীব্রতা বেড়ে গেছে মারাত্মক ভাবে। পিঠে দুকাধি হয়ে ব্যাগ ঝুলিয়ে নেয়ার দরুন পিঠ ঘামে ভিজে একাকার। মাথার উপর তীব্র রোদ আর ঘর্দমাক্ত শরীর নিয়েই হাটা শুরু করলাম। হাটার গতি অনেক কমে গেছে। শুরুর দিকে ঘন্টা প্রতি ৫ কি.মি থেকে নেমে ৩ কি.মি হয়ে গেছে। ফোনের স্পিড মিটার চেক করে তা নিশ্চিত হয়ে নিলাম একদফা।
মহাসড়কের পাশ ঘেষে বালির রাস্তায় আরো ঘন্টা দেড়েক হাটার পর মিয়াবাড়ি মোড়ে এসে থামলাম। তখন ১২.৪০ হয়ে গেছে। মাথার উপর ঝলসে দেয়া রোদ।
একটা ভ্রাম্যমান দোকান থেকে এক গ্লাস লেবু পানি খেয়ে পাশের দোকানে গিয়ে বসলাম। এক জোড়া কলা আর চা খেয়ে আবার হাটতে শুরু করলাম যমুনা সেতুর দিকে।
শরীরে দূর্বলতা চলে আসছে, হয়তো অতিরিক্ত ঘাম বের হওয়ার কারনে। তাও হাটার গতি না থামিয়ে ধীর লয়ে এগুতে লাগলাম। যতক্ষনে আমি যমুনা সেতুর পশ্চিম প্রান্তে এসে পৌছায় তখন দুপুর ২ টা বেজে গেছে। মাথার উপরে গরমের তীব্রতাও অনেকাংশে কমে গেছে। পেটে ক্ষিধে অনুভব করতে পারছি। যমুনা সেতু চত্বরে খাবার হোটেল থাকলেও তাতে যাওয়ার সাহস পাচ্ছিনা দামের কারনে।
ভাবলাম ওপার গিয়েই নাহয় খেয়ে নিব। রাস্তা পার হয়ে ওপারের নিরাপত্তা কর্মিদের জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম কোনোভাবেই হেটে ব্রিজ পার হওয়া সম্ভব না। তাই বাধ্য হয়ে একটা বাসে করেই ব্রিজ পার হওয়া যুক্তিযুক্ত মনে করলাম। বেশকিছুক্ষন বিফল চেষ্টার পর একটা বাস৷ পেলাম। ৪.৬ কিলোমিটার এই ব্রিজটা পার হতে সে ১০০ টাকা চাইল। যেহেতু আমার পাশের লোকজন ও একই ভাড়ায় যাচ্ছে আমারও এতেই যাওয়ায় শ্রেয়। সেতুটা পার হতে তো হবেই। অনিচ্ছা সত্ত্বেও বাসে উঠে পড়লাম
মানুষের দূর্বলতার সুযোগ নিয়ে ফায়দা লুটে নেয়ার অভ্যাসটা প্রাত্যহিক হয়ে গেছে! নাহয় ৫ কিলোমিটার রাস্তার জন্য ১০০ টাকা ভাড়া!
বাসে বসার সিট নেই, দাঁড়িয়েই যেতে হবে। যেহেতু যমুনা সেতুর উপর দিয়ে প্রথমবার যাচ্ছি তাই ছবি আর ভিডিও করে রাখার চিন্তা করলাম।
কিন্তু দাঁড়িয়ে থাকার কারনে তার কোনোটাই সম্ভব না। বাস কনট্রাক্টরকে বলে সামনের ইঞ্জিন বক্সে বসে একটা লোককে দিয়ে বেশ কিছু ছবি আর পুরো সেতুর ভিডিও করে নিলাম। ব্রিজের উঠানামা আর চারপাশের দৃশ্য বেশ মুগ্ধময় ছিল। হেটে আসতে পারলে বেশ ভালোই লাগত!
ব্রিজ পার হয়ে পূর্ব প্রান্তের গোলচত্ত্বরে নেমে পড়লাম। নেমেই ঝটপট আরো কয়েকখানা ছবি তুলে নিলাম। পাশের খোলা মাঠে অনেক মানুষ দেখলাম। বেশিরভাগই মোটরসাইকেল। হয়তো এদিক সেদিক যাওয়া আসার ফাঁকে ভ্রাম্যমান দোকানে খাওয়া আর ছায়ায় ঝিরিয়ে নেয়ার মানসেই ঝটলা পাকিয়েছে এখানে।
তাদের একজনকে জিজ্ঞেস করে পাশের যমুনা সেতু বাজারের খোজ পেলাম। দুপুরে খাওয়ার সময় পার হয়েছে,এদিকে পেটে ক্ষিধে বেড়ে গেছে। কিছুদূর হেটে বাজারের সম্মুখেই খাবার হোটেলটায় ঢুকে পড়লাম। দোকানদারকে বলে ফোন চার্জে লাগিয়ে ফ্রেশ হয়ে ঝটপট খেতে বসলাম। ঘন্টা দেড়েক বিশ্রাম নেয়ায় শ্রেয় মনে হল। কেননা শরীরটাও ভীষন রকমের দূর্বল লাগছে আর ফোনেও চার্জ কমে গেছে।
খাওয়া দাওয়া সেরে বাজারের এদিক সেদিক কিছুক্ষন ঘুরে আবার হোটেলে ফেরত আসলাম। বেশকিছুক্ষন ঝিরিয়ে নিয়ে এবার রওনা শুরু।
বাজার পেরিয়ে মাঠ,মাঠ পেরিয়ে কিছুদূরেই আরেকটা বাজার।
বাজার পেরিয়ে ধানক্ষেতের বুক চিরে এগিয়ে চলা মহাসড়ক ধরে দ্রুত হাটতে লাগলাম। পাশ দিয়ে এগিয়ে গেছে রেলের রাস্তাও। কিছুসময় পরপর রেলের যাওয়া দেখি। অন্যসময় গায়ের পাশ দিয়ে তীব্র গতিতে ছুটে চলা বাস,ট্রাক।
সময় ৫.২০! হাতিয়া বাসস্ট্যান্ড নামক ছোট বাজারটাতে এসে থামলাম। পা ব্যথা হয়ে গেছে বিষমভাবে। চলতি পথে আরো দুয়েকটা ছোট বাজার ক্রস করে এলেও তা স্মরনে নেই।
পাশের একটা ছোট চায়ের দোকানে বসে পড়লাম পা টেনে। দোকানদারকে চায়ের কথা বলে আশে পাশে থাকালাম। দোকানের ভেতরে দুয়েকজন পুলিশ সদস্যকে দেখা যাচ্ছে। হয়তো পাশের অস্থায়ী ক্যাম্পে ডিউটিতে আসছে।
চা খেয়ে আরো মিনিট পনের বিশ্রামের পর আবার রওনা দিলাম।
সূর্য অস্ত যাচ্ছে। পাশের রেলের রাস্তা দিয়ে বাইরে ছাদে ভেতরে করে যাত্রী নিয়ে একটা রেল ছুটে গেল ঢাকার দিকে। তাকিয়ে দেখলাম কিছুসময়। গাড়ির চলে যাওয়া,পাশের রেল রাস্তায় ঘুরতে আসা মানুষজন আর পাশের ক্ষেত দেখতে দেখতে যতক্ষনে এলেঙ্গা মোড়ে এসে থামলাম তখন ফোনে সময় দেখাচ্ছে ৭.১২।
টাংগাইল সদরে গিয়ে থামার কথা থাকলেও পায়ের ব্যথা আর অনিচ্ছার কারনে রাতটা এখানেই কাটাব ভাবলাম। দুয়েকটা হোটেল ঘুরেফিরে একটাতে উঠে পড়লাম। দিনের সমাপ্তির সাথে যে ব্যস্থতা থমকে যায় একই নিয়মে সে ব্যস্থতা গ্রাস করবে আগামিও।
যে যান্ত্রিকতা মানুষের সৃষ্টি,তার গর্জনের বিশালতার কাছে মানুষের ব্যক্তিত্বও ক্ষুদ্র হয়ে পড়ে। মানুষকে শুধু দেখা যায় পেটের ক্ষিধে মিটানোর তাগিদে পিঠে ভারি বোঝা নিয়ে কুজো হয়ে হাটতে! -ম্যাক্সিম গোর্কি
#নদীর তালিকা নিশ্চিত কর।
#দখলদারদের উচ্ছেদ কর।