01/10/2025
েলে
#আরেব্বা_চৌধুরী
#পর্ব_সংখ্যাঃ- ৩০
পরের দিন মৃদুল আবারও বাহারি ইফতারি হাতে বাড়িতে হাজির।
কিন্তু এবার আর আগের মতো নয়,
মা দরজায় দাঁড়িয়ে রুক্ষ কণ্ঠে বললেন,
-এই খাবার আমি খাবো না মৃদুল।
যে খাবার একজনের জন্য আনা হয়, যে খাবার একজন খাবে আর বাকিরা চেয়ে থাকবে,
সেই খাবারের আমার প্রয়োজন নেই।
আমার খাবার যেনো সবার সাথে ভাগ করে খাওয়ার মতো হয়, নয়তো না হোক।
মৃদুল কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো।
তারপর চোখ রাঙিয়ে বললো,
-তবে কি এখন পুরো বাড়ির অন্ন জোগাড় করার দায়িত্বও আমার মা?
সবাইকে খাওয়ানোর ভারও কি আমার কাঁধে?
মা শান্ত স্বরে উত্তর দিলেন,
-সেই দিক দিয়ে দেখলে অবশ্যই তোমারই দায়িত্ব।
এরা সবাই তোমার রক্তের না হোক, আত্মার বাঁধনে গাঁথা।
তোর ভাই, তোর ভাবি, তোর ভাইয়ের সন্তান,
আজ নয় তোদের বাবার জীবদ্দশা থেকে শুরু হয়েছে এই সম্পর্ক।
মৃদুল বিরক্ত হয়ে বললো,
-তুমি ভুলে যাচ্ছো মা, সাব্বির আমাদের রক্তের কেউ না।
সে তোমার দয়া, মায়া তোমার পালনকৃত ছেলে।
মায়ের চোখের কোণা লাল হয়ে উঠলো।
চোখ নামিয়ে মৃদু কণ্ঠে বললেন,
-পালক হয়তো ঠিক, কিন্তু স্নেহে, দায়িত্বে, ভালোবাসায় সে তোর চেয়ে কোনো অংশে কম ছিলো না।
আজ তুই যা বলছিস, সেটা শুনলে তোর বাবার কবরও কাঁপবে।
একটুখানি থেমে মা আরও বললেন,
-সাব্বির যদি পালিত হয়েও আমায় আগলে রাখতে পারে, তবে রক্তের বাঁধন কেবল শরীরের নয়,
রক্তের সম্পর্কের চেয়েও বড় হয় হৃদয়ের সম্পর্ক।
আর তোর হৃদয়, সে তো শুধু হিসেব বুঝে, ভালোবাসা না।
মৃদুল থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে রইলো কিছুক্ষণ।
সেদিনের মতো কোনো উত্তর না দিয়ে, মাথা নিচু করে ফিরে গেলো সে।
মায়ের কণ্ঠ তখনও থেমে থাকেনি।
আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে তিনি ফিসফিস করে বললেন,
-আসল সন্তান কে, তা সময় নিজেই ঠিক করে দেয়।
ঘরে ঢুকে পাঞ্জাবিটা চেয়ারে ছুড়ে ফেলে বসে পড়লো মৃদুল।
পারমিতা জলভরা গ্লাস বাড়িয়ে দিলো।
মৃদুল ধপ করে গ্লাসটা টেবিলে রেখে বললো,
-একটা কথা বল তো পারমিতা, মা কি শুধু সাব্বিরকেই ভালোবাসে?
পারমিতা একটু চমকে তাকালো,
-কেন হঠাৎ এমন বলছো?
-আজ আমার হাতে করে আনা খাবার মা ফিরিয়ে দিলো।
বললো, "যে খাবার সবাই মিলে খেতে পারে না, সেটা আমার দরকার নেই।"
এটা কি কোনো কথা হলো?
সব হয়েছে সাব্বিরের জন্য, সাব্বিরের কুপরামর্শ পেয়েই মায়ের ব্যবহার দিনকে দিন এমন হয়ে যাচ্ছে।
পারমিতা নরম গলায় বললো,
-তুমি কি শুধু বড় ভাইয়ার দোষ খুঁজে বেড়াও, কখনো নিজেরটা খুঁজেছো?
-মানে?
-মানে তুমি দেখো না, তুমি যা দাও তা দেখিয়ে দাও।
তোমার ব্যবহারেই বোঝা যায় তুমি কিছু ফিরিয়ে দিতে চাও, ভালোবাসা না প্রতিশোধ।
আর বড় ভাইয়া, উনি তো বিনা কারণে দেন, বিনা দাবি-দাওয়ায় পাশে থাকেন।
মৃদুল বিরক্ত মুখে বললো,
-তাহলে তুমিও এখন ওর পক্ষ নিচ্ছো?
-পক্ষ নয় মৃদুল, সত্য বলছি।
তুমি যদি একটু থেমে নিজের অবস্থানটা দেখতে, তবে হয়তো বুঝতে পারতে,
মা কেবল ভালোবাসা খোঁজেন, শর্তহীন ভালোবাসা।
আর যেটুকু সাব্বির ভাই দিচ্ছে, তা কোনো দাবির নয় মন থেকে আসে।
মৃদুল থমথমে মুখে তাকিয়ে থাকলো পারমিতার দিকে।
কিছু বলতে গিয়ে থেমে গেলো।
এই প্রথমবারের মতো তার স্ত্রীর চোখে একধরনের গভীর বোধ, কঠিন সত্যের আভাস দেখতে পেলো সে।
রাতের নির্জনতা ঘরে নেমে এসেছে। বাতাসে নিঃশব্দ এক গন্ধ, যেন প্রত্যাশা আর অনুরোধ মিলেমিশে আছে সেখানে।
সাব্বির বিছানায় হেলান দিয়ে বসে। অহনা ধীরে পায়ে এসে তার পাশে বসে পড়লো। চোখে মৃদু দ্বিধা, মুখে অনুচ্চারিত একটি আকুতি।
-আজ একটা অনুরোধ ছিলো আপনার কাছে।
সাব্বির তার দিকে তাকিয়ে স্নিগ্ধ কণ্ঠে বললো,
-বলো, শুনছি।
-মেজো ভাইয়ের দিনকাল খুব খারাপ যাচ্ছে। সংসার ভেঙে পড়ার মতো অবস্থা। সবকিছু সত্ত্বেও তো তিনি আমার ভাই, নিজের রক্ত। চুপচাপ থাকতে কষ্ট হয়।
আমি ভাবছিলাম, আমাদের গ্যারেজে যদি ওর একটা কাজের ব্যবস্থা করে দিতেন, অন্তত একটা অবলম্বন হতো ওর জন্য।
সাব্বির খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বললো,
-মানুষকে নিজেকে বদলাতে জানতে হয়। তুমি কি মনে করো, সে এই সুযোগকে সঠিকভাবে গ্রহণ করতে পারবে?
-আমি নিজে ওকে বোঝাবো। একটু সময় দিলে হয়তো ধীরে ধীরে পরিবর্তন আসবে।
আর গ্যারেজে তো আপনার একার পক্ষে সব সামাল দেওয়া কষ্টকর হয়ে যাচ্ছে, একজনে বাড়লে হয়তো আপনারও একটু উপকার হবে।
সাব্বির হালকা হাসলো।
-তুমি কি কখনো দেখেছো আমি তোমার কোনো কথা উপেক্ষা করেছি?
অহনা মাথা নিচু করে একটু লাজুক হেসে বললো,
-না।
-তাহলে এতো যুক্তি দিয়ে কেন বলো? সরাসরি বললেই তো হতো।
কালই উনাকে বলে দিও, প্রয়োজনীয় সব জিনিসপত্র নিয়ে শহরের পথে রওনা দিতে।
আমি আশপাশে খোঁজ নিচ্ছি, যদি কোনো সস্তা বাসা মেলে।
আর বলে দিও, হাঁড়ি-পাতিল, কাপড়, যা যা লাগে সব যেনো নিয়ে আসে, নইলে নতুন করে কিনতে গেলে খরচ বাড়বে।
অহনার মুখে এবার হাসি ফুটলো।
সাব্বিরের হাতে নিজের হাতটা রাখলো সে, যেনো কৃতজ্ঞতা জানাতে চায় কোনো শব্দ ছাড়াই।
অধরিত স্বরে বললো,
-আপনি জানেন, আপনি না থাকলে আমি বোধহয় আর কাউকে এতটা ভরসা করে কিছু বলতে পারতাম না।
সাব্বির চোখ মেলে তাকালো অহনার দিকে,
-ভরসা করার মতো মানুষ হয়ে উঠতে পেরেছি জেনে নিজেকেই ধন্য মনে হয়।
তবে শুনো, তাকে শুধু কাজ দেবো না, মানুষ করবো।
এই শহরে টিকে থাকতে হলে শুধু রুটি রোজগার না, শৃঙ্খলা আর দায়িত্ববোধও লাগে।
তুমি পাশে থেকো, বুঝিয়ে বলো উনাকে, আমি শাসনের খামতি রাখবো না।
অহনা মাথা নাড়লো স্নিগ্ধ প্রশান্তিতে।
মুখের কোণে হাসি নিয়ে বললো,
-ওকে ঠিক করে তোলার দায় আমাদের দুজনেরই, আমি জানি আপনি পারবেন।
সাব্বির নরম কণ্ঠে বললো,
-আমরা পারবো অহনা, ইনশাআল্লাহ।
আমরা শুধু নিজের জন্য না, আশপাশের জন্যও বাঁচবো।
ভালোবাসা শুধু কাছের মানুষকে না, পথভ্রান্ত মানুষকেও মানুষ করে তোলার চেষ্টা।
কথামতো পরদিনই শহরে এসে পৌঁছালো অহনার মেজো ভাই।
সাব্বির আগেই একটা ছোট, সচ্ছল বাসার ব্যবস্থা করে রেখেছিলো।
থাকা-খাওয়ার প্রয়োজনীয় যা কিছু দরকার, তারও বন্দোবস্ত করে রেখেছে নিঃশব্দে।
ভবিষ্যতের কথা ভেবেই সে গুছিয়ে চলেছে, নয় কেবল আত্মীয়তার দায়ে বরং একজন মানুষ হিসেবে আরেকজনকে দাঁড়ানোর সুযোগ করে দেওয়ার তাগিদে।
গলার স্বরে কিছুটা দৃঢ়তা এনে সাব্বির বললো,
-কাল সকাল থেকে গ্যারেজে যাবেন।
কাজ বুঝে নেবেন, প্রথম প্রথম দেখিয়ে দেওয়া হবে কাজগুলো।
মেজো ভাই কিছুটা সংকোচ নিয়ে সাব্বিরকে বললো,
-আমি কি গ্যারেজের কাজ ঠিকঠাক করতে পারবো?
সাব্বির এবার দৃঢ় গলায় বললো,
-আপনি কি পুরুষ না?
জীবনে সব পুরুষকে একসময় না একসময় নিজের সীমা ভাঙতে হয়।
পারবো কি না, এই প্রশ্ন ত্যাগ করতে শিখুন।
একটা কথা মনে রাখবেন, জীবন কাউকে প্রস্তুতি নিয়ে সময় দেয় না,
জীবন শুধু বলে "এগিয়ে চলো"।
একটা পুরুষ তখনই সম্মান পায়, যখন সে পরিশ্রম করে, দায়িত্ব নেয়, নিজের অবস্থান নিজে গড়ে তোলে।
পরিবারের দিকে তাকিয়ে যদি বুক শক্ত না করতে পারেন, তাহলে কে করবে আপনার হয়ে আপনার পরিবারের কাজ?
মেজো ভাবি কুণ্ঠিত ভঙ্গিতে পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন।
সাব্বির এবার তাকিয়ে মৃদু হেসে বললো, আপনি তো একজন নারী, একজন ঘরের বাতি।
ঘরে আলো জ্বলে আপনার কোমল আচরণে, আপনার বুদ্ধিমত্তায়।
আপনার স্বামী দিনের শেষে ক্লান্ত হয়ে ফিরবে, হয়তো হতাশা নিয়ে।
সেই সময় আপনি যদি তাকে ভালোবাসা না দেন, শান্তি না দেন, তাহলে সে কোথায় যাবে?
তর্ক করে সংসার চলে না ভাবি,
ভালোবাসা দিয়ে, ধৈর্য ধরে বোঝাতে হয়।
পুরুষ রেগে কিছু বলে ফেলতে পারে, আপনি তখন চুপ থাকুন,
রাতের নরম আলোয় আবার তাকে বুঝিয়ে দিন তার ভুলটা।
আমি অহনাকে অনেক ভালোবাসি, শুধু এই জন্য নয় যে সে আমার স্ত্রী,
বরং সে আমায় বোঝে।
সে আমায় তর্ক শেখায় না, সে আমায় থামায় না,
সে শুধু আমাকে পাশে থেকে বলে, "তুমি পারবে, আমি তোমার সাথে আছি।"
এই কথাগুলো শুনে অহনার মেজো ভাবি মাথা নিচু করে ফেললেন।
চোখের কোণে জল চিকচিক করছিলো।
এমন কথা তো কেউ কোনোদিন তাকে বলেনি।
সাব্বির আবার মেজো ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললো,
-কাল সকাল থেকে কাজ শুরু করবেন।
শুরুর দিন কষ্ট হবে, হাতে ব্যথা হবে, ঘাম ঝরবে।
কিন্তু মনে রাখবেন, ওই ঘামের গন্ধেই আপনার সন্তানের মুখে খাবার যাবে,
ওই পরিশ্রমেই গড়ে উঠবে আপনাদের ভবিষ্যৎ।
-আরেকটা কথা ভাইজান, আপনার কাজের পারিশ্রমিক আপনি ঘাম দিয়ে কিনবেন।
আপনি আমাদের আত্মীয় বলে নয়, আপনি আপনার প্রাপ্য বুঝে পাবেন।
নিজেকে ছোট ভাববেন না, আপনি এখন নিজের পায়ে দাঁড়াতে চলেছেন, এটাই গর্বের।
অহনা তখন পাশ থেকে বললো,
-দেখলে তো মেজো ভাই, আমি বলেছিলাম না,
আমার স্বামী কখনো কাউকে অমর্যাদা করেন না,
তিনি শুধু চান মানুষ যেন নিজেকে সম্মানের জায়গায় রাখতে পারে।
মেজো ভাই ধীর পায়ে ঘরের এককোণে বসে থাকলো কিছুক্ষণ,
চোখে ছিলো অনুচ্চারিত কৃতজ্ঞতা আর হৃদয়ের ভেতর জন্ম নিচ্ছিলো নতুন এক আশার চারা।
এই শহর তার জন্য শুধু একটা নতুন ঠিকানা নয়,
এ যেন নিজের জীবনের একটা নতুন জন্ম।
সন্ধ্যা তখনও পুরোপুরি রাতের অন্ধকারে মিশে যায়নি। গ্যারেজ থেকে ঘামে ভেজা ক্লান্ত শরীর নিয়ে ঘরে ঢুকলো সাব্বির।
কিছু না বলে সোজা এসে দাঁড়ালো দরজার ফ্রেমে, চোখে একরাশ প্রশান্তি।
-রেডি হও, একটু বাইরে যাবো।
রান্নাঘর থেকে পেঁয়াজ কাটতে কাটতে মুখ তুললো অহনা, চোখেমুখে বিস্ময়ের রেখা।
-হঠাৎ? কোথায়?
সাব্বির হাসলো, শান্ত সুরে বললো,
-চলো না একটুখানি হাঁটতে। আজ আমাদের বিবাহবার্ষিকী।
মুহূর্তেই স্থির হয়ে গেলো অহনার সমস্ত গতি। ছুরিটা টেবিলে নামিয়ে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো সাব্বিরের দিকে।
-আপনি, আপনি এসব এখনো মনে রাখেন?
সাব্বির কাছে এসে হাত ধরে বললো,
-এই জীবনটাই তো তোমাকে ঘিরে, সেখানে তোমাকে ভুলে থাকাটা কেমন করে সম্ভব?
আমি ভুলে যেতে পারি গাড়ির পার্টসের দাম, দিন শেষে কত আয় হলো, কিন্তু তোমার সাথে কাটানো মুহূর্তগুলোর হিসেব আমি কোনোদিন হারাইনি।
অহনা চোখ নিচু করে ফেললো, চোখে অশ্রু জমে উঠছে।
-তুমি রেডি হও, বাচ্চারা দাদি-নানির সাথে থাকুক আজ।
আজ শুধু তুমি আর আমি।
কিছু না বলে চুপচাপ শাড়ি বদলাতে চলে গেলো অহনা।
স্নেহা-সায়েম তখন পাশের ঘরে খেলা করছে, হাসাহাসির শব্দে ঘরটা ভরে আছে।
তাদের রেখে বেরিয়ে পড়লো তারা দুজনে হাত ধরে, যেন নতুন করে আবার পথচলা শুরু হলো।
রাস্তায় হেঁটে চলেছে দুই মানুষ, পাশে ছোট দোকানপাটের ঝলমলে আলো, মাথার ওপর নরম চাঁদের আলো।
সাব্বির বাঁ হাত বাড়িয়ে অহনাকে জড়িয়ে নিলো নিজের বুকে।
তার গলা নিঃশব্দে কেঁপে উঠলো।
-তুমি শুধু আমার স্ত্রী নও, তুমি আমার জীবনের দ্বিতীয় জন্ম।
আমার প্রথম জীবন যদি মা দিয়ে থাকেন, তবে দ্বিতীয় জীবন তুমি দিয়েছো অহনা।
ভেঙে যাওয়া আমিকে তুমি আবার যত্নে, নিখুঁতভাবে জোড়া দিয়েছো।
একজন স্ত্রী এতোটা নিঃস্বার্থ হতে পারে, সেটা তোমায় না দেখলে বিশ্বাস করতাম না।
অহনা শান্ত কণ্ঠে বললো,
-এসব কিছুই আমার একার কৃতিত্ব নয়। আপনি আমায় সম্মান দিয়েছেন, বুঝেছেন, পাশে থেকেছেন।
আপনার ভালোবাসা না পেলে আমি কিছুই পারতাম না।
ভালোবাসা থাকলে মেয়েরা সব পারে, শুধু পাশে একজন সহচর দরকার। আপনি ছিলেন, আছেন, থাকবেন, এটাই আমার শক্তি।
একটু থেমে, কিছুক্ষণ হাঁটার পর অহনা বললো,
-শুনুন না, সামনে রোজার ঈদ, তারপর কোরবানির ঈদ।
আমি ভাবছি, আপনি যদি চারটা ছোট গরু কিনে দেন, আমি দেখাশোনা করবো।
ঈদের সময় বিক্রি করলে ভালো দাম পাওয়া যাবে।
যদি লাভ হয়, সেই টাকা দিয়ে ঘরের অসম্পূর্ণ কাজটা শেষ করা যাবে।
সাব্বির তাকিয়ে রইলো তার স্ত্রীর মুখের দিকে, অবাক হয়ে।
হালকা হাসলো।
-তুমি তো এখন আমার পার্টনারও বনে গেছো।
স্নেহা-সায়েমের যত্ন, ঘর সামলানো, মাকে দেখা, আবার বাড়ির ভবিষ্যৎ নিয়েও ভাবো।
তুমি একাই যেন একটা শক্ত ভিত্তি!
অহনা হেসে বললো,
-এখন তো দুই মা প্রায় সময় স্নেহা সায়েমকে নিয়ে ব্যস্ত থাকে, আমিও কিছু করতে চাই।
শুধু একা বসে থাকতে থাকতে বড্ড একঘেয়ে লাগে।
আর আমি কাজ করতে ভালোবাসি, আমি চাই না আমার কাজ থেমে থাকুক, কাজ করলে শরীরে রোগ বাসা বাঁধে না, আমি আপনার পাশে দাঁড়াতে চাই।
আমি আপনার বোঝা নয়, বরং আপনার স্বপ্নকে বাস্তব করার হাতিয়ার হবো।
সাব্বির একটু থেমে, অহনার হাত চেপে ধরলো।
-তুমি পাশে আছো বলেই তো সব সম্ভব হচ্ছে।
আমি শুধু রিকশার প্যাডেল চালাচ্ছি, কিন্তু গন্তব্য ঠিক করে দিচ্ছো তুমি।
কয়েক দিনের মধ্যেই ধারদেনা ও ঘরের জন্য বহুদিনের সঞ্চয় সব মিলিয়ে চারটি গরু কিনে আনলো সাব্বির।
অহনার হাতে গরুগুলোর রশি তুলে দিতে দিতে বললো,
-এবার তোমার স্বপ্নগুলো নিজের মতো করে গড়ো।
অহনা কথার উত্তর না দিয়ে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে রইলো স্বামীর মুখে।
তার মুখে তখন একধরনের প্রশান্তি, একধরনের গর্ব।
দীর্ঘসময় পর যেন নিজের পুরোনো জীবনকে ফিরে পেলো সে।
গরুগুলোর যত্ন নিতে নিতে আশপাশের হাট থেকে হাস-মুরগির বাচ্চাও কিনে আনলো।
মাটি মাখা হাতেই রান্না করলো, নিজের হাতে বাড়ির উঠোনে ঘাস ফলালো,
এভাবেই সে আবার মিশে গেলো তার চেনা জীবনে।
যেখানে সে শ্রম করে, হাসে, গুছিয়ে রাখে একটি সংসার।
এদিকে অহনার মেজো ভাইয়ের মাঝেও দৃশ্যমান পরিবর্তন।
যে ছেলেটা একদিন কাজ করে তিন দিন শুয়ে থাকতো,
আজ সে রোজ ভোরে উঠে গ্যারেজে আসে।
হাড়ভাঙা খাটুনি আর ঘামের গন্ধমাখা হাতে
দিনশেষে স্ত্রী সন্তানের মুখে হাসি দেখতে চায়।
সাব্বির গ্যারেজে তাকে চোখে চোখে রাখে,
শুধু কাজ নয় অগ্রগতির প্রতিটি ধাপে নজর রাখে।
সন্তুষ্ট কণ্ঠে বলে,
-আজ সত্যিই মনে হচ্ছে, একজন পুরুষ শুধু জন্মেই নয়, দায়িত্বে পূর্ণ হয়।
প্রতিদিন সাতশো-আটশো টাকা মজুরি হাতে নিয়ে
মেজো ভাই নিজের পরিবারের প্রয়োজন মেটাতে শেখে।
ধীরে ধীরে অহনার সাথে সম্পর্কের গভীরতায় ফিরে আসে হারানো আত্মীয়তার উষ্ণতা।
অহনা এক বিকেলে উঠোনে বসে গরুগুলোকে খৈল ছিটিয়ে দিতে দিতে ফিসফিস করে বলে,
-জীবন যেমনই হোক, ভালোবাসা আর প্রেরণার ছোঁয়া পেলে
সবাই একদিন বদলে যায়, একদিন গড়ে ওঠে।
সেই মুহূর্তে বাড়ির আঙ্গিনআয় সাব্বির ঘাস কাটতে কাটতে বললো,
-তুমি জানো অহনা, তোমার একটুখানি চেষ্টায় শুধু একটা সংসার নয়,
একটা মানুষ, একটা জীবন নতুন করে গড়ে উঠেছে।
তুমি শুধু আমার জীবনসঙ্গিনী নও, তুমি এই বাড়ির আশীর্বাদ।
এমন মুহূর্তে সায়েম আর স্নেহা দৌড়ে এসে বাবার কোল জড়িয়ে ধরলো।
সায়েম মুখ ফুলিয়ে বললো,
-তুহিন ভাইয়া তো ঈদের অনেকগুলো জামা কিনে ফেলেছে,
আমরা কবে কিনবো বাবা?
সাব্বির হালকা হেসে কপালে চুমু দিলো ছেলের,
-ঈদ তো সবার জন্য খুশি নিয়ে আসে বাবা,
এই খুশি সবার সাথে ভাগ করে নেওয়ার মাঝেই তো আছে ঈদের প্রকৃত সৌন্দর্য।
তুহিন কিনেছে, তোমরাও কিনবে, আর কেউ কিনেছে, সেটা দেখে ঈর্ষা নয়, উৎসাহ নিতে শিখো।
স্নেহা একটু চুপ থেকে বললো,
-বাবা, আমরা তো জামা কিনবোই, কিন্তু ভাবছি,
কম দামে জামা কিনে যদি বাঁচা টাকা দিয়ে
আরও দু’জন পথশিশুকে জামা কিনে দিই?
ঈদের আনন্দ তো একা পাওয়ার জিনিস না,
সবাই মিলে, একসাথে পরলে, তবেই তো ঈদটা সত্যিকারের ঈদ হবে।
সাব্বির স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলো মেয়ের দিকে।
তার বুকটা গর্বে ভরে উঠলো।
সে জানতো এই ছোট্ট মেয়েটা কোনোদিন বড় হয়ে শুধু ভালো মানুষ নয়,
একদিন সমাজের আলো হয়ে উঠবে।
সে ফিসফিস করে বললো,
-মাশাআল্লাহ, আমার মেয়ে যেন তার মায়েরই প্রতিচ্ছবি।
বুদ্ধিমতী, হৃদয়বান, আর পরের প্রতি সহানুভূতিশীল।
তোমরা ঈদের বাজারে যাবে, কিন্তু আগে দু’জন পথশিশুকে খুঁজে বের করো,
তাদের মাপ বুঝে জামা কিনতে হবে তো,
তারপর আমরা নিজেদের জন্য কিনবো।
সায়েম খুশিতে হাততালি দিয়ে উঠলো,
-ইয়া! আমি পেপে ভাইকে জামা কিনে দিবো, সে তো রোজ সিগনালে দাঁড়িয়ে থাকে।
স্নেহা বললো,
-আর আমি কিনে দিবো সেই মেয়েটিকে, ওই যে ওইদিন যাকে রাস্তায় বসে থাকতে দেখেছিলাম।
সাব্বির এবার গম্ভীর গলায় বললো,
-এই হচ্ছে শিক্ষা, এই হচ্ছে ভালোবাসা।
সব বইয়ে লেখা থাকে না, কিছু শিক্ষা আসে অভ্যাস আর অনুভব থেকে। তোমাদের এমন উদার চিন্তা-ভাবনা যেনো বড় হলেও থাকে, তখন যেনো স্বার্থের টানে রক্তের সম্পর্ক ভুলতে বসো না।
*আজকাল আপনাদের রেসপন্স কমে যাওয়ার কারণ কি?
আগামী তিন পর্বে গল্পের সমাপ্তি টানবো তাই এবার বেশি বেশি রেসপন্স করুন।
চলবে,,,,,,