
08/07/2025
েলে
#আরেব্বা_চৌধুরী
#পর্ব_সংখ্যাঃ- ২৮
সকাল সকাল উঠে নাশতা সেরেই ব্যাগপত্র গুছাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো অহনা।
মায়ের কাপড়চোপড় গুছাতে গিয়ে আলমারির দরজা খুলতেই একরাশ ধুলোর গন্ধে ভরে উঠলো চারপাশ।
পুরনো স্মৃতির ভারে নুয়ে থাকা সেই আলমারিতে, একটার উপর আরেকটা করে রাখা নানান রঙের শাড়ি।
এক এক করে যখন নামাচ্ছিলো তখন চোখে পড়লো নিচে রাখা একটা ডায়েরি।
ধুলোমলিন পাতাগুলোর উপর স্পষ্ট করে লেখা, "সাব্বির।"
এক মুহূর্ত থমকে দাঁড়িয়ে গেলো অহনা।
আঙ্গুল দিয়ে ছুঁয়ে দেখলো সেই অক্ষরগুলো,
যেন শব্দের ভেতরও জমে থাকা দীর্ঘশ্বাসগুলো চুপ করে বসে আছে।
ডায়েরিটা খুলে দেখার সুযোগ তখন ছিল না,
তবুও নিঃশব্দে যেন একটি কণ্ঠ বললো, কোনো একদিন পড়ে নিও।
অহনা ডায়েরিগুলো শাড়ির ফাঁকে ভরে রাখলো ব্যাগে,
কারণ কিছু কিছু লেখা চোখের চেয়ে হৃদয় দিয়ে পড়া উচিত।
এদিকে হালকা নাশতা করে আয়নার সামনে দাঁড়ালো সাব্বির।
চেহারায় ক্লান্তির রেখা, কিন্তু তাতে যেন এক আলাদা তৃপ্তির ছায়া।
বুকের ভেতর জমে থাকা দীর্ঘদিনের ভার একটুখানি হলেও যেন হালকা হয়েছে।
মৃদুল নীরব, কোনো কথা নেই মুখে,
সাব্বির বেরিয়ে যাবার সময় শুধু ছোট একটা শব্দ উচ্চারণ করেছিলো,
"ভালো থাকিস।"
অবশেষে মা, শাশুড়ি, স্ত্রী আর দুই সন্তানকে নিয়ে শহরের উদ্দেশে রওনা হলো সাব্বির।
আজ আর কোনো দুঃখ, অভিমান কিংবা অভিযোগ নিয়ে নয়।
রওনা হলো নতুন করে সবকিছু শুরু করার আশায়।
এই শহর, যেখানে কখনো সে আশ্রয় খুঁজেছিলো,
সেই শহরই আজ তার ঠিকানা, তার ঘর।
তবে এবার সে একা নয়।
সাথে আছে তার পৃথিবী, তার আত্মার অবশিষ্ট অংশগুলো।
বাড়ি ফিরেই ঘর গোছাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো অহনা।
তিন দিন তালাবদ্ধ থাকায় রুম দুটোতে যেন একধরনের ভারি গুমোট ভাব।
দেয়ালে জমে থাকা ধুলো, বাতাসে আটকে থাকা একঘেয়েমি।
জানালা খুলতেই দিনের আলো ঝাপসা হয়ে এসে ছুঁয়ে দিলো ঘরটিকে।
অহনা পরিপাটি করে বিছানা গুছিয়ে নিলো, কাপড় সরিয়ে রাখলো আলমারিতে,
সব কিছুতে যেন নতুন করে জীবনের স্পর্শ ছড়িয়ে দিতে চাইছে সে।
সাব্বির কাকার কাছ থেকে আরও একটি রুম ভাড়া নিয়ে বেরিয়ে পড়লো গ্যারেজের দিকে।
মাথায় দায়িত্বের বোঝা, মনজুড়ে ভবিষ্যতের চিন্তা।
কোথা থেকে শুরু করবে, কীভাবে আবার আগের মতো সবকিছু গুছিয়ে তুলবে?
গ্যারেজের সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই মনে হলো,
এই ছোট্ট গ্যারেজটাই যেন তার জীবনের সবচাইতে বড় প্রশ্নের উত্তর খোঁজে।
তালাবদ্ধ সেই দরজাটা আজ যেন আরও ভারী হয়ে উঠেছে।
সাব্বির চোখ বুলিয়ে নিলো আশেপাশে,
একসময় এই দরজার ওপারে দিনভর চলতো ব্যস্ততা,
মেকানিকদের হাঁকডাক, যন্ত্রের ঘর্ষণ,
আর আজ সেখানে স্তব্ধতা।
গলার ভেতর একরাশ কষ্ট আটকে গেলো।
ভেতরের অন্ধকারে হাত বাড়িয়ে যেন ছুঁতে চাইলো সেই আলো,
যেখান থেকে তার রুটি-রুজি আর সম্মান দুটোই জন্ম নিয়েছিলো।
নিজেকে শক্ত করে মনে মনে বললো,
শূন্য থেকেই তো শুরু করেছিলাম, আবার পারবো,
এবার পিছনে রয়েছে পরিবার মা, অহনা আর আমার সন্তানেরা।
আর আমি তো এখনও হেরে যাইনি।
তার পা আবারও গড়িয়ে গেলো কর্মের পথে,
এক নতুন শুরু, এক নিঃশব্দ লড়াই।
পরের দিনই তিন কর্মচারীর মধ্যে দুজনকে ছাঁটাই করে দিলো সাব্বির।
হৃদয়ে কষ্ট নিয়েই সিদ্ধান্তটা নিতে হয়েছে তাকে।
জানতো, এই সিদ্ধান্ত কারো কাছে নির্মম মনে হবে,
কিন্তু বর্তমানে বাস্তবতাই তার সবচেয়ে বড় শিক্ষক।
বাকি একজন সালাম, বছরের পর বছর ধরে তার পাশে ছিলো ছায়ার মতো।
দক্ষ, বিশ্বস্ত আর পরিশ্রমী।
সাব্বির তাকে রেখে দিলো পাশে, যেন এক নীরব যোদ্ধা।
বললো শুধু,
-তুই আছিস বলেই আমি সাহস পাই।
নিজের কাঁধেই তুলে নিলো গ্যারেজের অধিকাংশ ভার।
সকালের আলো ফোটার আগেই চলে আসে সে,
রাত গড়ালে তবেই ফেলে ক্লান্ত শরীরটা নিজের সংসারের চৌকাঠে।
কারণ, এখন টাকার দরকার শুধু নিজের জন্য নয়,
একটা সংসার, বৃদ্ধা মা, দুটো নিষ্পাপ মুখ, আর অহনার প্রতিটি না বলা স্বপ্ন
সব মিলিয়ে যেনো সে হয়ে উঠেছে এক জীবন্ত দায়িত্বের প্রতিমূর্তি।
নিজেকে প্রতিদিন একটু করে গড়ছে সে,
একটা ইট আরেকটা ইটের উপর রাখছে নিঃশব্দে,
হয়তো কেউ দেখছে না, কিন্তু সে জানে,
আকাশের পানে তাকানোর আগে মাটি শক্ত করতে হয়।
কেটে গেছে এক বছর,,,
অনাথআশ্রম থেকে তিন বছরের এক শিশুকে দত্তক নিয়েছে মৃদুল।
না, ভালোবাসা কিংবা মমতার টানে নয়,
সে খুঁজছিলো নিজের বার্ধক্যের এক অবলম্বন,
যে বৃদ্ধ বয়সে তার ওষুধ-পানি এগিয়ে দেবে,
তার দেহখানা কবরে রাখার বন্দোবস্ত করবে।
ঘরের ভিতর যতটুকু কোমলতা থাকা উচিত,
মৃদুলের আচরণে তা ছিলো রুক্ষ মরুভূমির মতো।
বাচ্চাটার কান্না, ভয় কিংবা অভিমান,
তাকে স্পর্শ করে না এতটুকু।
বাবার থেকে জোর করে নিজের নামে লিখিয়ে নেওয়া
শেষ সম্বল সেই একখানা ভিটেটুকুও আজ বিক্রি করে দিলো সে।
যেই ঘরে একদিন ছিলো মায়ের হাসি,
বাবার সন্ধ্যাবেলা নামাজের সময়ের ডাক,
আর ছিলো ছোট ছোট ঝগড়ার মধ্যেও পরিপূর্ণ এক সংসার।
কিন্তু মৃদুলের কাছে ঘর ছিলো কেবল একখানা সম্পত্তি,
যার বদলে শহরে গিয়ে সে গড়বে নিজের স্বপ্নের রাজ্য।
স্ত্রীর শেষ গয়না আর নিজের কিছু জমানো টাকা
সঙ্গে নিয়ে শহরের দিকে পাড়ি জমালো সে,
পেছনে ফেলে গেলো সম্পর্ক, আবেগ আর দায়বদ্ধতার গল্পগুলো।
তার চোখে এখন কেবলই হিসাব,
কে কতটা দিতে পেরেছে, কে কতটা কেড়ে নিয়েছে।
শিশুটিকে কোলের বদলে ধরলো বগলে,
আর পাথরের মতো ঠোঁটে ফিসফিসিয়ে বললো,
-এখন থেকে তুইই আমার ইনভেস্টমেন্ট।
রাতে অহনা চুপচাপ বিছানার একপাশে শুয়ে ছিলো। আলো নিভে গেছে অনেকক্ষণ, শুধু পাশ ফিরে ঘুমিয়ে থাকা সাব্বিরের নিশ্বাসের শব্দটাই ভেসে আসছে নীরব রাতে।
তবুও অহনার চোখে ঘুম নেই।
হঠাৎ ধীর কণ্ঠে বললো,
-আপনি কি জানেন, আপনার জীবনের গল্পটা আমার কাছে এখন একটা অপূর্ণ উপন্যাসের মতো লাগে?
সাব্বির চমকে উঠলো।
-মানে?
-মানে, আমি সেই শেষ অধ্যায়ের চরিত্র, যার আগে অনেককিছু লেখা হয়ে গেছে, আর আমার অংশটুকু যেন শুধু দায়সারা।
সাব্বির পাশে ফিরে অহনার মুখোমুখি হলো।
-তুমি এমন বলছো কেন?
-কারণ আমি আজও বুঝি না, আমি আপনার জীবনের ভালোবাসা, না দায়িত্ব?
আপনি আমাকে বিয়ে করেছেন, সংসার করছেন, সন্তানদের মানুষ করছেন সব ঠিক আছে, কিন্তু তবু কোথাও যেন শূন্যতা, যেন আমি আপনার অতীতে লেখা কারো ছায়ার পাশে দাঁড়িয়ে আছি, যার নাম অধরা।
-মানে?
-আপনার একটা পুরনো ডায়েরি পেয়েছিলাম মায়ের শাড়ির নিচে। বহু দিন ধরে রেখে দিয়েছিলাম পড়ে দেখবো বলে। কাল হঠাৎ সময় পেলাম, খুলে পড়লাম কয়েকটা পাতা, প্রতিটি লাইন, প্রতিটি শব্দে আপনি শুধু অধরাকে ডেকেছেন, তাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেছেন, ভবিষ্যৎ কল্পনা করেছেন, তাহলে আমার জায়গা কোথায়?
সাব্বির দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
-তুমি জানো না, আমি প্রতিদিন কতটা চেষ্টা করি তোমার সেই প্রশ্নগুলোর উত্তর হতে।
আমি অধরাকে ভালোবেসেছিলাম, ঠিক, কিন্তু সেটা ছিল আমার কৈশোরের অনুভব।
তোমার সঙ্গে আমার জীবন শুরু হয়েছে সেই দিন থেকে, যেদিন তুমি নিজের সব ছেড়ে আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলে।
অহনা চুপ করে রইলো
সাব্বির আবার বললো,
-অধরা আমার প্রথম অনুভব ছিলো, কিন্তু তুমি আমার জীবনসঙ্গী।
তুমি আমার জীবনের সেই অধ্যায়, যেটার পরে আর কোনো পাতা ওল্টাবো না।
তোমার আগে ভালোবাসা ছিলো, তোমার পরে নেই, আর কখনো আসবেও না।
বাবা যখন অসুস্থ হয়ে পড়লেন, সংসারের হাল যখন ধরতে হলো, সেদিনই এই ডায়েরি তুলে রেখেছিলাম মায়ের শাড়ির ভাঁজে আর খোলা হয় নি।
ভেবেছিলাম, যেখানে আমি অধরাকে রেখে এসেছি, সেইখানেই তার সমস্ত স্মৃতি চিরতরে গুটিয়ে রাখবো।
তুমি তো জানো না, তুমি না থাকলে আমি কেমন হয়ে যাই। তুমি আমার ভাঙা সময়ের সবচেয়ে মজবুত ভরসা। অধরা ছিলো আবেগ, তুমি বিশ্বাস। অধরা ছিলো স্বপ্ন, তুমি বাস্তবতা। আর আমি বিশ্বাস করি, বাস্তবতাই মানুষের জীবনে সবচেয়ে স্থায়ী আশ্রয়।
তুমি যদি কখনো অনুভব করতে পারতে, আমি তোমাকে কতখানি ভালোবাসি,
তাহলে আর প্রশ্ন করতে না, অহনা।
অধরা আমার শৈশবের অনুভব ছিলো, আর তুমি আমার জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ।
তোমায় ছাড়া আমার ঘর, আমার দিন, আমার রাত্রি, কিছুই তো চলে না।
অহনা চোখ নামিয়ে ফিসফিস করে বললো,
-তবুও আমি চাই না কোনো পাতায়, কোনো কোণে, কোনো হৃৎপিণ্ডের অলিন্দে, অন্য কারো নাম থাকুক।
আমি আপনার ‘পুরোটা’ চাই, ভগ্নাংশ নয়।
সাব্বির একটু হাসলো, সেই হাসিতে অভিমানের ছায়া, ভালোবাসার স্পর্শ।
-ভালোবাসা যদি ভাঙা-ভাঙা হতো, তাহলে এ জীবন অনেক আগেই থেমে যেতো অহনা।
তুমি শুধু স্ত্রী নও, তুমি আমার সংসারের ভরসা, আমার জীবনের দিশা।
অধরাকে ভালোবেসেছিলাম আমি,কিন্তু তাকে সঙ্গে নিয়ে পথ চলিনি।
তোমাকে ভালোবেসে চলছি, প্রতিটি পদক্ষেপে।
অহনা নিঃশব্দে সাব্বিরের বুকে মাথা রাখলো।
চোখ বেয়ে নেমে এল জল, তবে এবার সেই জলে হিংসা ছিল না, ছিল আত্মপ্রত্যয়।
কারণ সে জানে, প্রথম নয়, শেষ ভালোবাসা হতেই তো ভাগ্য লাগে।
সাব্বিরের বাসার লাগোয়া গলিতেই ভাড়া নিয়েছে মৃদুল।
বলে বেড়ায়, শহরের নামী এক মার্কেটে কাপড়ের দোকান দিয়েছে সে।
আসলে উদ্দেশ্য কেবল ব্যবসা নয় চোখের আড়াল হলেও মনে মনে সাব্বিরের প্রতিটি পদক্ষেপের হিসেব রাখা।
দিনে একবার করে মা’র খোঁজ নিতে এসে বড় ছেলের সংসারে ঢুঁ মেরে যায়।
বলে,
-মা কেমন আছো? সাব্বির ঠিক মতো খাওয়ায় তো?
আসলে তার চোখ পড়ে অন্যখানে, সাব্বিরের পরিশ্রমে গড়া একেকটা ইটের দিকে, গ্যারেজের ধুলোমলিন বারান্দায় জমে ওঠা স্বপ্নের দিকে, সায়েমের অবুঝ হাসিতে লেগে থাকা অহনার শান্ত প্রশান্তির দিকে।
মৃদুল তুহিনকে নিয়ে আসলে মা আদরে ভরিয়ে দেন।
তুহিন মায়ের গলা জড়িয়ে বলে,
-দাদী, আমি তোমাকে নিয়ে যেতে এসেছি।
মায়ের চোখ ঝাপসা হয়, অথচ কিছু বলেন না।
অপরদিকে সায়েম ধীরে ধীরে হাঁটতে শিখেছে।
ছোট্ট দু’পায়ে পা ফেলে টুকটুক করে ঘরে ঘরে হেঁটে বেড়ায়।
মৃদুল একবারও কোলে তোলে না তাকে।
চোখে চোখ রাখলেও, ভালোবাসার ন্যূনতম স্পর্শটুকু দেয় না।
সাব্বির যতটুকু পারে তা দিয়েই ছেলের মুখে হাসি ফোটাতে চায়, সাব্বির সায়েমের জন্য একটা রঙিন জামা কিনে আনলে মৃদুল পরদিনই তুহিনের জন্য এনে দেয় দামি দুটো পোশাক।
তুহিন হাঁটতে গিয়েও পা মাটিতে ফেলে না, বাবা কাঁধে তুলে নিয়ে ঘোরায়।
এ যেন অদৃশ্য এক প্রতিযোগিতা, যেখানে কেউ কিছু না বললেও, যার যার চোখে স্পষ্ট উচ্চারণ,
"কে বেশি ভালো বাবা?"
সাব্বির এসব দেখে কিছু বলে না, শুধু দূর থেকে একটুখানি হেসে ছেলে সায়েমের মাথায় হাত রাখে।
মনের ভেতর দিয়ে ঢেউয়ের মতো বয়ে যায় একটাই কথা।
ভালোবাসা কখনো প্রতিযোগিতা হতে পারে না। ভালোবাসা মানে নিঃস্বার্থ থাকা, নিরব দায়িত্ব নেওয়া, প্রতিদান না চাওয়া।
কিন্তু মৃদুল পদে পদে বুঝাতে চায়, সাব্বির তার কাছে সায়েমকে দত্তক না দিয়ে কত বড় ভুল করেছে।
দিনের অর্ধেক সময় কাটে গ্যারেজের তপ্ত ইঞ্জিনের মাঝে,
লোহার গন্ধ, গ্রীসের দাগ, আর ক্লান্ত ঘাম মিশে যেন শরীর থেকে বেরিয়ে আসে তার জীবনের কাহিনি।
বাকি অর্ধেক সময় চলে যায় বাড়ির কাজ সামলাতে ইট, সিমেন্ট, রডের হিসাব, শ্রমিকদের তদারকি।
নিজের জন্য সময় রাখার মতো কোনো অবসর নেই, নেই বিশ্রামের ছায়া।
রাতে একা দাঁড়ায় আয়নার সামনে,
কোনো বিশেষ কারণ ছিল না, হঠাৎই নিজেকে দেখার ইচ্ছে হলো।
আয়নার দৃষ্টিতে চমকে উঠে সে,
চেনা সেই চেহারা যেন বদলে গেছে,
চোখে ঘুমহীনতা, মুখে ক্লান্তির রেখা,
শরীর শুকিয়ে জীর্ণ হয়েছে, মাথার চুলে স্পষ্ট ফাঁক।
কখন যেন বয়স কাঁধে চেপে বসেছে নিঃশব্দে।
নিজেই নিজের চোখে তাকিয়ে এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে,
-এতো কিছু করে শেষ পর্যন্ত কি আমি আমার পরিবারের মুখে হাসি এনে দিতে পেরেছি?
কিন্তু পরক্ষণেই মনে পড়ে যায় স্নেহা ও সায়েমের উচ্ছ্বল হাসি,
অহনার গভীর মমতা,
আর মায়ের প্রশান্ত মুখ।
তখনই সে আয়নার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে ফেলে,
-যদি ভালোবাসা থাকে পুরস্কার, তাহলে এই ক্ষয় হয়ে যাওয়া দেহও হয়ে উঠুক সবচেয়ে মূল্যবান উৎসর্গ।
রোজার সময় হয়ে আসছে।
চৈত্রের রোদ যেন রোজার প্রস্তুতির আগেই পরীক্ষা নিতে চায়।
সাব্বির কিছুদিনের জন্য ঘরের নির্মাণকাজ বন্ধ রাখলো,
পুরো মনোযোগ দিলো গ্যারেজে কারণ এখন উপার্জনের টাকা দিয়ে রোজার বাজার করতে হবে।
ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সে নিজেই খাটে, ঘামে ভেজে শরীর,
তবু ক্লান্তির কোনো ছাপ নেই চোখে মুখে।
কারণ তার একটাই লক্ষ্য ঘরটা আবার গড়ে তোলা,
আর নিজের আত্মসম্মানটাকে ফিরিয়ে আনা।
গ্যারেজে বসেই এক দুপুরে রুশাকে ফোন করলো সে।
রুশার কণ্ঠে প্রশান্তির ঢেউ,
সে জানালো এখন বেশ ভালোই আছে।
শাশুড়ী কিছু বললে সে কিছু বলার আগেই তার স্বামী উত্তর দিয়ে দেয়।
এখন শাশুড়ী অনেকটাই বদলে গেছেন,
একটা অদৃশ্য সীমারেখা তৈরি হয়েছে যেটা কারো সম্মানকে ম্লান হতে দেয় না।
দোকানটা ছোট, আয়ও আহামরি না,
তবু শান্তি আছে ভাইয়া।
তোমার দেওয়া টাকাটার মর্যাদা আমি কখনো ভুলবো না।
একটা আশ্রয়, একটুখানি সম্মান, এর চেয়ে বড় সম্পদ আর কিছু নেই।
সাব্বির কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো,
-এসব শুনেই শান্তি পাই, রুশা।
তোরা ভালো থাকলেই আমার শান্তিতে ঘুম আসে।
ফোন কেটে দিয়ে ছায়ায় বসে চোখ বন্ধ করলো সাব্বির।
এক মুঠো নিঃশ্বাস বুকে জমিয়ে মনে মনে বললো,
এই জীবনের যুদ্ধে সে হেরে যেতে চায় না,
কারণ অনেক মানুষের হাসি এখন তার কাঁধে ভর করে দাঁড়িয়ে আছে।
মৃদুলের মধ্যে আজও কোনো পরিবর্তন নেই।
তার কথাবার্তা, চালচলন, এমনকি হাঁটাচলার ভঙ্গিতেও এখনও ঝরে পড়ে একরকম ঔদ্ধত্য।
সে ব্যবসার কাজে শহরে এসেছে, এই নামেই পরিচিতি দিয়ে বেড়ায়,
কিন্তু সাব্বিরের মনে গভীর একটা প্রশ্নই ঘুরপাক খায়,
সে কি সত্যিই ব্যবসার তাগিদে এসেছে?
না কি নীরব প্রতিযোগিতায় নেমেছে বড় ভাইকে হারানোর মঞ্চে?
মাঝেমধ্যে বাসায় বড় রুই মাছ, ব্রয়লার মুরগি কিংবা বাহারি ফলমূল এনে হাজির করে মৃদুল ।
তারপর ছোট্ট সায়েম ও স্নেহাকে ডেকে বলে,
-এই দেখো চাচ্চু কত বড় মাছ এনেছে, এই দেখো মুরগি!
কিন্তু এই দেখানোতেই শেষ,
না কোনো মাছের একটা টুকরো,
না কোনো রসালো ফলের এক খণ্ড
সায়েম কিংবা তার ছোট বোনটির ভাগ্যে জোটেছে।
শুধুই চোখের সামনে একরাশ বিলাসিতা,
আর হাতের মুঠোয় অভাবের শিকল।
একদিন সন্ধ্যায় চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকা অহনাকে দেখে সাব্বির কড়া গলায় বলেছিলো,
-ছেলেমেয়েকে এ বাড়ি ও বাড়ি যাতায়াত করতে দিবে না অহনা।
ওদের চোখে যেন লোভের ছবি না আঁকে।
ওদের শেখাতে হবে কীভাবে মানুষের মুখে খাবার তুলে দেওয়ার আগে
নিজের কপালের ঘাম মুছতে হয়।
আমি চাই আমার সন্তানরা হোক অল্পে তুষ্ট,
অহংকার নয়, তারা যেন শিখে কৃতজ্ঞতা।
তবুও শান্তি মেলে না মৃদুলের,
মা'কে দেওয়ার নাম করে,রোজ রোজ ইফতারি নিয়ে আসে,
কিন্তু খাবারের পরিমাণটা এমন হিসাবি
যেন শুধু একজনের পেটই ভরুক,
আর কারও যেনো নজর না পড়ে।
সাব্বির বোঝে, এ এক ধরনের সূক্ষ্ম খোঁচা,
এক ধরণের শ্রেষ্ঠত্ব দেখানোর প্রয়াস।
নিজে বসে মা'কে খাইয়ে দেয়,
মায়ের ঠোঁটের কোণায় কিছুমাত্র হাসি ফুটলেও
সাব্বির যেন দেখতে না পারে এমন কৌশলে বিদায় নেয়।
সায়েম জানে না, কেন ইফতারের সময় বাবার মুখটায় গাম্ভীর্য লেগে থাকে,
কেন মা অল্প খাবার পাতে তুলে দেয়, কেন ইফতারিতে ফলমূল থাকে না।
কেন দাদির প্লেটের পাশে তার হাত ছুঁতে গেলেই মা তাকে টেনে সরিয়ে নেয়।
এই ঘর, এই পরিবার, এই রক্তের বন্ধন,
সব আছে, তবু কিছু নেই।
ভালোবাসা নেই, সংবেদন নেই, তা স্পষ্ট।
*মন্তব্য যখন গঠনমূলক হয়, তখন কলমের ডগা দিয়ে আপনা-আপনি কালি বের হয়।
চলবে,,,,