গল্পের পৃথিবী

গল্পের পৃথিবী Contact information, map and directions, contact form, opening hours, services, ratings, photos, videos and announcements from গল্পের পৃথিবী, Radio Station, Dhaka.

সকল গল্প প্রেমিদের গল্পের পৃথিবীতে(Story World) স্বাগতম।

"নতুন পর্ব সবার আগে পেতে এবং সবধরনের গল্প পেতে এখনই পেজটি ফলো করে সাথে থাকুন!"

জয়েন্ট করুন- গল্পের পৃথিবী (রাইটার্স Vs রিডার্স)

 েলে #আরেব্বা_চৌধুরী  #পর্ব_সংখ্যাঃ- ৩০পরের দিন মৃদুল আবারও বাহারি ইফতারি হাতে বাড়িতে হাজির।কিন্তু এবার আর আগের মতো নয়,ম...
01/10/2025

েলে
#আরেব্বা_চৌধুরী
#পর্ব_সংখ্যাঃ- ৩০

পরের দিন মৃদুল আবারও বাহারি ইফতারি হাতে বাড়িতে হাজির।
কিন্তু এবার আর আগের মতো নয়,
মা দরজায় দাঁড়িয়ে রুক্ষ কণ্ঠে বললেন,
-এই খাবার আমি খাবো না মৃদুল।
যে খাবার একজনের জন্য আনা হয়, যে খাবার একজন খাবে আর বাকিরা চেয়ে থাকবে,
সেই খাবারের আমার প্রয়োজন নেই।
আমার খাবার যেনো সবার সাথে ভাগ করে খাওয়ার মতো হয়, নয়তো না হোক।

মৃদুল কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো।
তারপর চোখ রাঙিয়ে বললো,
-তবে কি এখন পুরো বাড়ির অন্ন জোগাড় করার দায়িত্বও আমার মা?
সবাইকে খাওয়ানোর ভারও কি আমার কাঁধে?

মা শান্ত স্বরে উত্তর দিলেন,
-সেই দিক দিয়ে দেখলে অবশ্যই তোমারই দায়িত্ব।
এরা সবাই তোমার রক্তের না হোক, আত্মার বাঁধনে গাঁথা।
তোর ভাই, তোর ভাবি, তোর ভাইয়ের সন্তান,
আজ নয় তোদের বাবার জীবদ্দশা থেকে শুরু হয়েছে এই সম্পর্ক।

মৃদুল বিরক্ত হয়ে বললো,
-তুমি ভুলে যাচ্ছো মা, সাব্বির আমাদের রক্তের কেউ না।
সে তোমার দয়া, মায়া তোমার পালনকৃত ছেলে।

মায়ের চোখের কোণা লাল হয়ে উঠলো।
চোখ নামিয়ে মৃদু কণ্ঠে বললেন,
-পালক হয়তো ঠিক, কিন্তু স্নেহে, দায়িত্বে, ভালোবাসায় সে তোর চেয়ে কোনো অংশে কম ছিলো না।
আজ তুই যা বলছিস, সেটা শুনলে তোর বাবার কবরও কাঁপবে।

একটুখানি থেমে মা আরও বললেন,
-সাব্বির যদি পালিত হয়েও আমায় আগলে রাখতে পারে, তবে রক্তের বাঁধন কেবল শরীরের নয়,
রক্তের সম্পর্কের চেয়েও বড় হয় হৃদয়ের সম্পর্ক।
আর তোর হৃদয়, সে তো শুধু হিসেব বুঝে, ভালোবাসা না।

মৃদুল থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে রইলো কিছুক্ষণ।
সেদিনের মতো কোনো উত্তর না দিয়ে, মাথা নিচু করে ফিরে গেলো সে।

মায়ের কণ্ঠ তখনও থেমে থাকেনি।
আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে তিনি ফিসফিস করে বললেন,
-আসল সন্তান কে, তা সময় নিজেই ঠিক করে দেয়।

ঘরে ঢুকে পাঞ্জাবিটা চেয়ারে ছুড়ে ফেলে বসে পড়লো মৃদুল।
পারমিতা জলভরা গ্লাস বাড়িয়ে দিলো।
মৃদুল ধপ করে গ্লাসটা টেবিলে রেখে বললো,
-একটা কথা বল তো পারমিতা, মা কি শুধু সাব্বিরকেই ভালোবাসে?

পারমিতা একটু চমকে তাকালো,
-কেন হঠাৎ এমন বলছো?

-আজ আমার হাতে করে আনা খাবার মা ফিরিয়ে দিলো।
বললো, "যে খাবার সবাই মিলে খেতে পারে না, সেটা আমার দরকার নেই।"
এটা কি কোনো কথা হলো?
সব হয়েছে সাব্বিরের জন্য, সাব্বিরের কুপরামর্শ পেয়েই মায়ের ব্যবহার দিনকে দিন এমন হয়ে যাচ্ছে।

পারমিতা নরম গলায় বললো,
-তুমি কি শুধু বড় ভাইয়ার দোষ খুঁজে বেড়াও, কখনো নিজেরটা খুঁজেছো?

-মানে?

-মানে তুমি দেখো না, তুমি যা দাও তা দেখিয়ে দাও।
তোমার ব্যবহারেই বোঝা যায় তুমি কিছু ফিরিয়ে দিতে চাও, ভালোবাসা না প্রতিশোধ।
আর বড় ভাইয়া, উনি তো বিনা কারণে দেন, বিনা দাবি-দাওয়ায় পাশে থাকেন।

মৃদুল বিরক্ত মুখে বললো,
-তাহলে তুমিও এখন ওর পক্ষ নিচ্ছো?

-পক্ষ নয় মৃদুল, সত্য বলছি।
তুমি যদি একটু থেমে নিজের অবস্থানটা দেখতে, তবে হয়তো বুঝতে পারতে,
মা কেবল ভালোবাসা খোঁজেন, শর্তহীন ভালোবাসা।
আর যেটুকু সাব্বির ভাই দিচ্ছে, তা কোনো দাবির নয় মন থেকে আসে।

মৃদুল থমথমে মুখে তাকিয়ে থাকলো পারমিতার দিকে।
কিছু বলতে গিয়ে থেমে গেলো।
এই প্রথমবারের মতো তার স্ত্রীর চোখে একধরনের গভীর বোধ, কঠিন সত্যের আভাস দেখতে পেলো সে।

রাতের নির্জনতা ঘরে নেমে এসেছে। বাতাসে নিঃশব্দ এক গন্ধ, যেন প্রত্যাশা আর অনুরোধ মিলেমিশে আছে সেখানে।
সাব্বির বিছানায় হেলান দিয়ে বসে। অহনা ধীরে পায়ে এসে তার পাশে বসে পড়লো। চোখে মৃদু দ্বিধা, মুখে অনুচ্চারিত একটি আকুতি।

-আজ একটা অনুরোধ ছিলো আপনার কাছে।
সাব্বির তার দিকে তাকিয়ে স্নিগ্ধ কণ্ঠে বললো,
-বলো, শুনছি।

-মেজো ভাইয়ের দিনকাল খুব খারাপ যাচ্ছে। সংসার ভেঙে পড়ার মতো অবস্থা। সবকিছু সত্ত্বেও তো তিনি আমার ভাই, নিজের রক্ত। চুপচাপ থাকতে কষ্ট হয়।
আমি ভাবছিলাম, আমাদের গ্যারেজে যদি ওর একটা কাজের ব্যবস্থা করে দিতেন, অন্তত একটা অবলম্বন হতো ওর জন্য।

সাব্বির খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বললো,
-মানুষকে নিজেকে বদলাতে জানতে হয়। তুমি কি মনে করো, সে এই সুযোগকে সঠিকভাবে গ্রহণ করতে পারবে?

-আমি নিজে ওকে বোঝাবো। একটু সময় দিলে হয়তো ধীরে ধীরে পরিবর্তন আসবে।
আর গ্যারেজে তো আপনার একার পক্ষে সব সামাল দেওয়া কষ্টকর হয়ে যাচ্ছে, একজনে বাড়লে হয়তো আপনারও একটু উপকার হবে।

সাব্বির হালকা হাসলো।
-তুমি কি কখনো দেখেছো আমি তোমার কোনো কথা উপেক্ষা করেছি?

অহনা মাথা নিচু করে একটু লাজুক হেসে বললো,
-না।

-তাহলে এতো যুক্তি দিয়ে কেন বলো? সরাসরি বললেই তো হতো।
কালই উনাকে বলে দিও, প্রয়োজনীয় সব জিনিসপত্র নিয়ে শহরের পথে রওনা দিতে।
আমি আশপাশে খোঁজ নিচ্ছি, যদি কোনো সস্তা বাসা মেলে।
আর বলে দিও, হাঁড়ি-পাতিল, কাপড়, যা যা লাগে সব যেনো নিয়ে আসে, নইলে নতুন করে কিনতে গেলে খরচ বাড়বে।

অহনার মুখে এবার হাসি ফুটলো।
সাব্বিরের হাতে নিজের হাতটা রাখলো সে, যেনো কৃতজ্ঞতা জানাতে চায় কোনো শব্দ ছাড়াই।
অধরিত স্বরে বললো,
-আপনি জানেন, আপনি না থাকলে আমি বোধহয় আর কাউকে এতটা ভরসা করে কিছু বলতে পারতাম না।

সাব্বির চোখ মেলে তাকালো অহনার দিকে,
-ভরসা করার মতো মানুষ হয়ে উঠতে পেরেছি জেনে নিজেকেই ধন্য মনে হয়।
তবে শুনো, তাকে শুধু কাজ দেবো না, মানুষ করবো।
এই শহরে টিকে থাকতে হলে শুধু রুটি রোজগার না, শৃঙ্খলা আর দায়িত্ববোধও লাগে।
তুমি পাশে থেকো, বুঝিয়ে বলো উনাকে, আমি শাসনের খামতি রাখবো না।

অহনা মাথা নাড়লো স্নিগ্ধ প্রশান্তিতে।
মুখের কোণে হাসি নিয়ে বললো,
-ওকে ঠিক করে তোলার দায় আমাদের দুজনেরই, আমি জানি আপনি পারবেন।

সাব্বির নরম কণ্ঠে বললো,
-আমরা পারবো অহনা, ইনশাআল্লাহ।
আমরা শুধু নিজের জন্য না, আশপাশের জন্যও বাঁচবো।
ভালোবাসা শুধু কাছের মানুষকে না, পথভ্রান্ত মানুষকেও মানুষ করে তোলার চেষ্টা।

কথামতো পরদিনই শহরে এসে পৌঁছালো অহনার মেজো ভাই।
সাব্বির আগেই একটা ছোট, সচ্ছল বাসার ব্যবস্থা করে রেখেছিলো।
থাকা-খাওয়ার প্রয়োজনীয় যা কিছু দরকার, তারও বন্দোবস্ত করে রেখেছে নিঃশব্দে।
ভবিষ্যতের কথা ভেবেই সে গুছিয়ে চলেছে, নয় কেবল আত্মীয়তার দায়ে বরং একজন মানুষ হিসেবে আরেকজনকে দাঁড়ানোর সুযোগ করে দেওয়ার তাগিদে।

গলার স্বরে কিছুটা দৃঢ়তা এনে সাব্বির বললো,
-কাল সকাল থেকে গ্যারেজে যাবেন।
কাজ বুঝে নেবেন, প্রথম প্রথম দেখিয়ে দেওয়া হবে কাজগুলো।

মেজো ভাই কিছুটা সংকোচ নিয়ে সাব্বিরকে বললো,
-আমি কি গ্যারেজের কাজ ঠিকঠাক করতে পারবো?

সাব্বির এবার দৃঢ় গলায় বললো,
-আপনি কি পুরুষ না?
জীবনে সব পুরুষকে একসময় না একসময় নিজের সীমা ভাঙতে হয়।
পারবো কি না, এই প্রশ্ন ত্যাগ করতে শিখুন।
একটা কথা মনে রাখবেন, জীবন কাউকে প্রস্তুতি নিয়ে সময় দেয় না,
জীবন শুধু বলে "এগিয়ে চলো"।

একটা পুরুষ তখনই সম্মান পায়, যখন সে পরিশ্রম করে, দায়িত্ব নেয়, নিজের অবস্থান নিজে গড়ে তোলে।
পরিবারের দিকে তাকিয়ে যদি বুক শক্ত না করতে পারেন, তাহলে কে করবে আপনার হয়ে আপনার পরিবারের কাজ?

মেজো ভাবি কুণ্ঠিত ভঙ্গিতে পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন।
সাব্বির এবার তাকিয়ে মৃদু হেসে বললো, আপনি তো একজন নারী, একজন ঘরের বাতি।
ঘরে আলো জ্বলে আপনার কোমল আচরণে, আপনার বুদ্ধিমত্তায়।
আপনার স্বামী দিনের শেষে ক্লান্ত হয়ে ফিরবে, হয়তো হতাশা নিয়ে।
সেই সময় আপনি যদি তাকে ভালোবাসা না দেন, শান্তি না দেন, তাহলে সে কোথায় যাবে?

তর্ক করে সংসার চলে না ভাবি,
ভালোবাসা দিয়ে, ধৈর্য ধরে বোঝাতে হয়।
পুরুষ রেগে কিছু বলে ফেলতে পারে, আপনি তখন চুপ থাকুন,
রাতের নরম আলোয় আবার তাকে বুঝিয়ে দিন তার ভুলটা।

আমি অহনাকে অনেক ভালোবাসি, শুধু এই জন্য নয় যে সে আমার স্ত্রী,
বরং সে আমায় বোঝে।
সে আমায় তর্ক শেখায় না, সে আমায় থামায় না,
সে শুধু আমাকে পাশে থেকে বলে, "তুমি পারবে, আমি তোমার সাথে আছি।"

এই কথাগুলো শুনে অহনার মেজো ভাবি মাথা নিচু করে ফেললেন।
চোখের কোণে জল চিকচিক করছিলো।
এমন কথা তো কেউ কোনোদিন তাকে বলেনি।

সাব্বির আবার মেজো ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললো,
-কাল সকাল থেকে কাজ শুরু করবেন।
শুরুর দিন কষ্ট হবে, হাতে ব্যথা হবে, ঘাম ঝরবে।
কিন্তু মনে রাখবেন, ওই ঘামের গন্ধেই আপনার সন্তানের মুখে খাবার যাবে,
ওই পরিশ্রমেই গড়ে উঠবে আপনাদের ভবিষ্যৎ।

-আরেকটা কথা ভাইজান, আপনার কাজের পারিশ্রমিক আপনি ঘাম দিয়ে কিনবেন।
আপনি আমাদের আত্মীয় বলে নয়, আপনি আপনার প্রাপ্য বুঝে পাবেন।
নিজেকে ছোট ভাববেন না, আপনি এখন নিজের পায়ে দাঁড়াতে চলেছেন, এটাই গর্বের।

অহনা তখন পাশ থেকে বললো,
-দেখলে তো মেজো ভাই, আমি বলেছিলাম না,
আমার স্বামী কখনো কাউকে অমর্যাদা করেন না,
তিনি শুধু চান মানুষ যেন নিজেকে সম্মানের জায়গায় রাখতে পারে।

মেজো ভাই ধীর পায়ে ঘরের এককোণে বসে থাকলো কিছুক্ষণ,
চোখে ছিলো অনুচ্চারিত কৃতজ্ঞতা আর হৃদয়ের ভেতর জন্ম নিচ্ছিলো নতুন এক আশার চারা।
এই শহর তার জন্য শুধু একটা নতুন ঠিকানা নয়,
এ যেন নিজের জীবনের একটা নতুন জন্ম।

সন্ধ্যা তখনও পুরোপুরি রাতের অন্ধকারে মিশে যায়নি। গ্যারেজ থেকে ঘামে ভেজা ক্লান্ত শরীর নিয়ে ঘরে ঢুকলো সাব্বির।
কিছু না বলে সোজা এসে দাঁড়ালো দরজার ফ্রেমে, চোখে একরাশ প্রশান্তি।

-রেডি হও, একটু বাইরে যাবো।

রান্নাঘর থেকে পেঁয়াজ কাটতে কাটতে মুখ তুললো অহনা, চোখেমুখে বিস্ময়ের রেখা।
-হঠাৎ? কোথায়?

সাব্বির হাসলো, শান্ত সুরে বললো,
-চলো না একটুখানি হাঁটতে। আজ আমাদের বিবাহবার্ষিকী।

মুহূর্তেই স্থির হয়ে গেলো অহনার সমস্ত গতি। ছুরিটা টেবিলে নামিয়ে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো সাব্বিরের দিকে।
-আপনি, আপনি এসব এখনো মনে রাখেন?

সাব্বির কাছে এসে হাত ধরে বললো,
-এই জীবনটাই তো তোমাকে ঘিরে, সেখানে তোমাকে ভুলে থাকাটা কেমন করে সম্ভব?
আমি ভুলে যেতে পারি গাড়ির পার্টসের দাম, দিন শেষে কত আয় হলো, কিন্তু তোমার সাথে কাটানো মুহূর্তগুলোর হিসেব আমি কোনোদিন হারাইনি।

অহনা চোখ নিচু করে ফেললো, চোখে অশ্রু জমে উঠছে।

-তুমি রেডি হও, বাচ্চারা দাদি-নানির সাথে থাকুক আজ।
আজ শুধু তুমি আর আমি।

কিছু না বলে চুপচাপ শাড়ি বদলাতে চলে গেলো অহনা।
স্নেহা-সায়েম তখন পাশের ঘরে খেলা করছে, হাসাহাসির শব্দে ঘরটা ভরে আছে।
তাদের রেখে বেরিয়ে পড়লো তারা দুজনে হাত ধরে, যেন নতুন করে আবার পথচলা শুরু হলো।

রাস্তায় হেঁটে চলেছে দুই মানুষ, পাশে ছোট দোকানপাটের ঝলমলে আলো, মাথার ওপর নরম চাঁদের আলো।
সাব্বির বাঁ হাত বাড়িয়ে অহনাকে জড়িয়ে নিলো নিজের বুকে।
তার গলা নিঃশব্দে কেঁপে উঠলো।

-তুমি শুধু আমার স্ত্রী নও, তুমি আমার জীবনের দ্বিতীয় জন্ম।
আমার প্রথম জীবন যদি মা দিয়ে থাকেন, তবে দ্বিতীয় জীবন তুমি দিয়েছো অহনা।
ভেঙে যাওয়া আমিকে তুমি আবার যত্নে, নিখুঁতভাবে জোড়া দিয়েছো।
একজন স্ত্রী এতোটা নিঃস্বার্থ হতে পারে, সেটা তোমায় না দেখলে বিশ্বাস করতাম না।

অহনা শান্ত কণ্ঠে বললো,
-এসব কিছুই আমার একার কৃতিত্ব নয়। আপনি আমায় সম্মান দিয়েছেন, বুঝেছেন, পাশে থেকেছেন।
আপনার ভালোবাসা না পেলে আমি কিছুই পারতাম না।
ভালোবাসা থাকলে মেয়েরা সব পারে, শুধু পাশে একজন সহচর দরকার। আপনি ছিলেন, আছেন, থাকবেন, এটাই আমার শক্তি।

একটু থেমে, কিছুক্ষণ হাঁটার পর অহনা বললো,
-শুনুন না, সামনে রোজার ঈদ, তারপর কোরবানির ঈদ।
আমি ভাবছি, আপনি যদি চারটা ছোট গরু কিনে দেন, আমি দেখাশোনা করবো।
ঈদের সময় বিক্রি করলে ভালো দাম পাওয়া যাবে।
যদি লাভ হয়, সেই টাকা দিয়ে ঘরের অসম্পূর্ণ কাজটা শেষ করা যাবে।

সাব্বির তাকিয়ে রইলো তার স্ত্রীর মুখের দিকে, অবাক হয়ে।
হালকা হাসলো।

-তুমি তো এখন আমার পার্টনারও বনে গেছো।
স্নেহা-সায়েমের যত্ন, ঘর সামলানো, মাকে দেখা, আবার বাড়ির ভবিষ্যৎ নিয়েও ভাবো।
তুমি একাই যেন একটা শক্ত ভিত্তি!

অহনা হেসে বললো,
-এখন তো দুই মা প্রায় সময় স্নেহা সায়েমকে নিয়ে ব্যস্ত থাকে, আমিও কিছু করতে চাই।
শুধু একা বসে থাকতে থাকতে বড্ড একঘেয়ে লাগে।
আর আমি কাজ করতে ভালোবাসি, আমি চাই না আমার কাজ থেমে থাকুক, কাজ করলে শরীরে রোগ বাসা বাঁধে না, আমি আপনার পাশে দাঁড়াতে চাই।
আমি আপনার বোঝা নয়, বরং আপনার স্বপ্নকে বাস্তব করার হাতিয়ার হবো।

সাব্বির একটু থেমে, অহনার হাত চেপে ধরলো।
-তুমি পাশে আছো বলেই তো সব সম্ভব হচ্ছে।
আমি শুধু রিকশার প্যাডেল চালাচ্ছি, কিন্তু গন্তব্য ঠিক করে দিচ্ছো তুমি।

কয়েক দিনের মধ্যেই ধারদেনা ও ঘরের জন্য বহুদিনের সঞ্চয় সব মিলিয়ে চারটি গরু কিনে আনলো সাব্বির।
অহনার হাতে গরুগুলোর রশি তুলে দিতে দিতে বললো,
-এবার তোমার স্বপ্নগুলো নিজের মতো করে গড়ো।

অহনা কথার উত্তর না দিয়ে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে রইলো স্বামীর মুখে।
তার মুখে তখন একধরনের প্রশান্তি, একধরনের গর্ব।
দীর্ঘসময় পর যেন নিজের পুরোনো জীবনকে ফিরে পেলো সে।

গরুগুলোর যত্ন নিতে নিতে আশপাশের হাট থেকে হাস-মুরগির বাচ্চাও কিনে আনলো।
মাটি মাখা হাতেই রান্না করলো, নিজের হাতে বাড়ির উঠোনে ঘাস ফলালো,
এভাবেই সে আবার মিশে গেলো তার চেনা জীবনে।
যেখানে সে শ্রম করে, হাসে, গুছিয়ে রাখে একটি সংসার।

এদিকে অহনার মেজো ভাইয়ের মাঝেও দৃশ্যমান পরিবর্তন।
যে ছেলেটা একদিন কাজ করে তিন দিন শুয়ে থাকতো,
আজ সে রোজ ভোরে উঠে গ্যারেজে আসে।
হাড়ভাঙা খাটুনি আর ঘামের গন্ধমাখা হাতে
দিনশেষে স্ত্রী সন্তানের মুখে হাসি দেখতে চায়।

সাব্বির গ্যারেজে তাকে চোখে চোখে রাখে,
শুধু কাজ নয় অগ্রগতির প্রতিটি ধাপে নজর রাখে।
সন্তুষ্ট কণ্ঠে বলে,
-আজ সত্যিই মনে হচ্ছে, একজন পুরুষ শুধু জন্মেই নয়, দায়িত্বে পূর্ণ হয়।

প্রতিদিন সাতশো-আটশো টাকা মজুরি হাতে নিয়ে
মেজো ভাই নিজের পরিবারের প্রয়োজন মেটাতে শেখে।
ধীরে ধীরে অহনার সাথে সম্পর্কের গভীরতায় ফিরে আসে হারানো আত্মীয়তার উষ্ণতা।

অহনা এক বিকেলে উঠোনে বসে গরুগুলোকে খৈল ছিটিয়ে দিতে দিতে ফিসফিস করে বলে,
-জীবন যেমনই হোক, ভালোবাসা আর প্রেরণার ছোঁয়া পেলে
সবাই একদিন বদলে যায়, একদিন গড়ে ওঠে।

সেই মুহূর্তে বাড়ির আঙ্গিনআয় সাব্বির ঘাস কাটতে কাটতে বললো,
-তুমি জানো অহনা, তোমার একটুখানি চেষ্টায় শুধু একটা সংসার নয়,
একটা মানুষ, একটা জীবন নতুন করে গড়ে উঠেছে।
তুমি শুধু আমার জীবনসঙ্গিনী নও, তুমি এই বাড়ির আশীর্বাদ।

এমন মুহূর্তে সায়েম আর স্নেহা দৌড়ে এসে বাবার কোল জড়িয়ে ধরলো।
সায়েম মুখ ফুলিয়ে বললো,
-তুহিন ভাইয়া তো ঈদের অনেকগুলো জামা কিনে ফেলেছে,
আমরা কবে কিনবো বাবা?

সাব্বির হালকা হেসে কপালে চুমু দিলো ছেলের,
-ঈদ তো সবার জন্য খুশি নিয়ে আসে বাবা,
এই খুশি সবার সাথে ভাগ করে নেওয়ার মাঝেই তো আছে ঈদের প্রকৃত সৌন্দর্য।
তুহিন কিনেছে, তোমরাও কিনবে, আর কেউ কিনেছে, সেটা দেখে ঈর্ষা নয়, উৎসাহ নিতে শিখো।

স্নেহা একটু চুপ থেকে বললো,
-বাবা, আমরা তো জামা কিনবোই, কিন্তু ভাবছি,
কম দামে জামা কিনে যদি বাঁচা টাকা দিয়ে
আরও দু’জন পথশিশুকে জামা কিনে দিই?
ঈদের আনন্দ তো একা পাওয়ার জিনিস না,
সবাই মিলে, একসাথে পরলে, তবেই তো ঈদটা সত্যিকারের ঈদ হবে।

সাব্বির স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলো মেয়ের দিকে।
তার বুকটা গর্বে ভরে উঠলো।
সে জানতো এই ছোট্ট মেয়েটা কোনোদিন বড় হয়ে শুধু ভালো মানুষ নয়,
একদিন সমাজের আলো হয়ে উঠবে।

সে ফিসফিস করে বললো,
-মাশাআল্লাহ, আমার মেয়ে যেন তার মায়েরই প্রতিচ্ছবি।
বুদ্ধিমতী, হৃদয়বান, আর পরের প্রতি সহানুভূতিশীল।
তোমরা ঈদের বাজারে যাবে, কিন্তু আগে দু’জন পথশিশুকে খুঁজে বের করো,
তাদের মাপ বুঝে জামা কিনতে হবে তো,
তারপর আমরা নিজেদের জন্য কিনবো।

সায়েম খুশিতে হাততালি দিয়ে উঠলো,
-ইয়া! আমি পেপে ভাইকে জামা কিনে দিবো, সে তো রোজ সিগনালে দাঁড়িয়ে থাকে।

স্নেহা বললো,
-আর আমি কিনে দিবো সেই মেয়েটিকে, ওই যে ওইদিন যাকে রাস্তায় বসে থাকতে দেখেছিলাম।

সাব্বির এবার গম্ভীর গলায় বললো,
-এই হচ্ছে শিক্ষা, এই হচ্ছে ভালোবাসা।
সব বইয়ে লেখা থাকে না, কিছু শিক্ষা আসে অভ্যাস আর অনুভব থেকে। তোমাদের এমন উদার চিন্তা-ভাবনা যেনো বড় হলেও থাকে, তখন যেনো স্বার্থের টানে রক্তের সম্পর্ক ভুলতে বসো না।
*আজকাল আপনাদের রেসপন্স কমে যাওয়ার কারণ কি?
আগামী তিন পর্বে গল্পের সমাপ্তি টানবো তাই এবার বেশি বেশি রেসপন্স করুন।

চলবে,,,,,,

 েলে #আরেব্বা_চৌধুরী  #পর্ব_সংখ্যাঃ- ২৯অহনার বিষণ্ণ মুখটা যেন চাঁদের ওপর মেঘের ছায়া।নীরবে বসে রয়েছে সে, চোখদুটো নিচের দি...
27/09/2025

েলে
#আরেব্বা_চৌধুরী
#পর্ব_সংখ্যাঃ- ২৯

অহনার বিষণ্ণ মুখটা যেন চাঁদের ওপর মেঘের ছায়া।
নীরবে বসে রয়েছে সে, চোখদুটো নিচের দিকে, অথচ মনের ভেতর চলছিল প্রবল ঢেউ।
সায়েম আর স্নেহা ঘুমিয়ে পড়েছে, ছোট্ট বুকের নিঃশ্বাস উঠছে-নামছে অবিরাম।
সাব্বির পাশের ঘর থেকে এসে দেখলো, অহনা চুপচাপ বসে আছে অদ্ভুত এক মৌনতা নিয়ে।

- কী হয়েছে তোমার?

অহনা চুপ।
সাব্বির আবারও প্রশ্ন করলো,

- বলো না, কিছু হয়েছে?

অহনা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে ধীরে বললো,

- একটা কথা বলবো, আপনি রাগ করবেন না তো?

- না রাগ করবো না, তুমি বলো।

- আপনি একটু ভেবে দেখবেন, এটা ঠিক না ভুল, বিচার করবেন আপনি।

সাব্বির মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো।

অহনার কণ্ঠ তখনও শান্ত, কিন্তু প্রতিটি শব্দে জমে ছিলো দীর্ঘদিনের অভিমান।

- মা নিজে পাশে বসে তারই নাতি-নাতনিদের রেখে ভালো ভালো খাবার খান এটা কেমন কথা বলুন?
আমার সন্তানরা তারই রক্তের না হলেও, বড় হয়ে তাকে দাদি বলেই তো ডাকে।
তবু কি একবারও উনি ভাবেন না, ওদের মুখেও কিছু তুলে দেওয়া উচিত?

সাব্বির কিছু বললো না, চুপ করে শুনছিল।

- আমি তো বলি না মৃদুল যেনো কিছু নিয়ে না আসে, আমি শুধু বলি, আমাদের সন্তানদের যেনো ওইসব দেখিয়ে না খাওয়ানো হয়।
আমি মায়ের ঘরে কেনো ওদের যেতে দেই না জানেন? কারণ ওরা এসব দেখে কান্না করে, খেতে চায়, আমি তাদের দিতে পারি না।
কিন্তু আপনি বলেন, ওরা দাদির ঘরে যাক আদর পাক।
আদর? আদর যদি বিভাজিত হয়, তবে সেটা আদর না, সেটা অবহেলা হয়ে দাঁড়ায়।

- অহনা,,,

- না, আজ আমি বলবো।
আপনি নিজেই বলেন, মৃদুল নিজের হাতে খাইয়ে দেয় মা'কে, তাহলে উনি তো বলতে পারেন।
"না, আমি খাবো না যদি সায়েম আর স্নেহা না খায়!"
উনি কি কখনো বলেছেন?
উনি কি কখনো মৃদুলকে থামিয়েছেন?

সাব্বির চোখ নামিয়ে ফেললো।
কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেলো।

- ওরা তাদের রক্তের কেউ নয় বলেই কি এতোটা দূরত্ব?
আমার বুক ফেটে যায় যখন দেখি, নিজের দুই শিশুর দিকে তাকিয়ে কেউ ভালোবাসার ছায়াও ফেলতে চায় না।
আপনি নিজের ভাইয়ের দোষ দেখেন, কিন্তু মায়ের ভূমিকা নিয়ে আপনি একবারও ভাবেন না কেন?

সাব্বির দীর্ঘশ্বাস ফেললো।
তার কণ্ঠ যেনো কেমন ভারী হয়ে এলো।

- আমি সবই বুঝি অহনা।
কিন্তু কিছু কথা না বলেই বুকে পাথর হয়ে জমে থাকে।
তোমার মতো সাহস আমার নেই, যে খোলাখুলি বলতে পারি, কাকে কোথায় ব্যথা দিচ্ছে।
আমি তো চুপ করেই সহ্য করি।

- চুপ করে থাকলে অন্যায় থামে না, বরং সাহস পেয়ে যায়।
আমার সন্তানদের যেনো কেউ অবহেলার চোখে না দেখে, এটুকুই চাই আমি।
কারণ তারা আমাদের পরিশ্রমে বেড়ে উঠছে, মনের রক্ত-ঘামে তাদের আমরা গড়ছি।

সাব্বির ধীরে উঠে দাঁড়ালো।
গলা নিচু স্বরে বললো,

- তুমি ঠিক বলেছো।
আজ থেকে ওদের আর কাউকে ছোট করে দেখতে দেবো না।
এরা আমার জীবন, আমার আত্মা, এদের চোখে জল এলে, আমিও আর শক্ত থাকতে পারি না।

অহনা একটুখানি হাসলো।
মাথা নিচু করেই বললো,

-আপনার এই কথাগুলোর জন্যই আমি সব কিছু ছাড়তে পেরেছি।
আপনার পাশে থাকার জন্যই সব যন্ত্রণাকে আপন করে নিতে পেরেছি।

অতীতের সেই শূন্যতা ভরা রাতগুলো, যখন একটা কোমল ছোঁয়ার জন্য সারাটা রাত চোখের পানি ফেলতো রুহি, আজ যেন তারই প্রতিদান নিয়ে ফিরে এসেছে।
স্বামীর হাতের উষ্ণতায় এক অনাবিল প্রশান্তি ঘিরে ধরেছে তাকে।
চুপচাপ বসে থাকা রুহির চোখে তখন শুধুই কৃতজ্ঞতা, চোখের কোণে চিকচিক করে উঠলো এক বিন্দু জল।

স্বামী আস্তে করে জিজ্ঞেস করলো,

-কেমন লাগছে?

রুহি কিছু বললো না, শুধু মাথা নিচু করে হাসলো।
সেই হাসিতে যেনো লুকানো ছিলো হাজারো না-পাওয়ার গ্লানি মুছে পাওয়ার গভীর তৃপ্তি।
তারপর ধীরে বললো,

- এইটুকু স্পর্শই তো চেয়েছিলাম এতদিন ধরে, শুধু একটু বোঝার মানুষ, একটু মন দিয়ে ভালোবাসা।
আজ মনে হচ্ছে আমি বেঁচে আছি, ভালোবেসে বেঁচে আছি।

স্বামী চুলে আরও একটু তেল ঢেলে আদর করে বললো,

- কষ্টের দিন পেরিয়ে গেলে তবেই তো সুখের মর্ম বোঝা যায়।
আমি জানি, অনেক কিছুতে আমি দেরি করেছি,
কিন্তু এখন থেকে আর কোনো অভাব থাকবে না, না ভালোবাসায়, না যত্নে।

রুহি এবার চোখ বন্ধ করলো।
চোখ বেয়ে নেমে এলো এক বিন্দু জল, শান্তি আর ভালোবাসার জল।
যেটা কোনো অভিমান নয়, বরং এক দগ্ধ অপেক্ষার পূর্ণতা।

ঘরের বাতাসে তখন শুধু নিঃশব্দ ভালোবাসার গন্ধ।
যেখানে শব্দের দরকার পড়ে না, শুধু অনুভূতিই বলে দেয়,
"আমি আছি, তোমার জন্য।"

সকালে ধীর পায়ে মায়ের ঘরে গেলো সাব্বির।
কোমল কণ্ঠে বললো,
- মা, তোমাকে কিছু বলার ছিলো।
- হ্যাঁ বল, শুনছি।

সাব্বির এক মুহূর্ত থেমে নিঃশ্বাস নিলো, তারপর বললো,
- মা, মৃদুলের মতো আমার কাছে টাকার পাহাড় নেই, যা পাই তা দিয়ে কোনোরকমে সংসার চালাই। তাই তোমাকে সবসময় ভালোমন্দ খাওয়াতে পারি না।
তুমি চাইলে মৃদুলের কাছেই থেকে যেতে পারো, আমি কিছু মনে করবো না।
আমার মন রাখতে বলছিনা, আমি সত্যিই চাই তুমি যেখানেই থাকো ভালো থেকো। তুমি যদি ওখানে ভালো খেতে পাও, স্বস্তি পাও, তাহলে তুমি ওখানেই থাকো আমি খুশি হবো।

মা কিছু না বলে চুপচাপ ছেলের দিকে তাকিয়ে থাকলেন।
সাব্বির মাথা নিচু করে আবার বললো,
-আমি জানি তোমার মন বড়, তুমি রাগ অভিমান করো না।
কিন্তু একটা অনুরোধ করছি, যদি তুমি এখানে থাকতে চাও, তাহলে মৃদুলকে বলো যেনো এসব বাহারি খাবার না নিয়ে আসে।
আমার সন্তানরা যখন এইসব দেখে, তাদের চোখে যে আকুলতা জমে তা আমি সহ্য করতে পারি না।
আমার সাধ্য মতো ওদের ফলমূল দিই, তবু প্রতিদিন না দিতে পারলে ওরা কষ্ট পায়, আর আমি ভেঙে পড়ি।
আমি চাই না ওরা অভ্যাস গড়ে তোলে এমন কিছুর প্রতি, যা আমি দিতে পারি না।
আমি চাই ওরা বুঝে যাক সুখ মানে কেবল রাজকীয় খাবার নয়, বরং শান্তি ও ভালোবাসায় মোড়া একবেলার ভাতও অনেক।

সাব্বিরের কথা শুনে মা কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন।
তারপর ধীরে ধীরে উঠে জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন।
হালকা বাতাসে উড়তে থাকা পর্দার ফাঁক গলে ছুঁয়ে গেলো তার মুখ, চোখে তখন এক অদ্ভুত বেদনা মেশানো প্রশান্তি।
তিনি জানেন এমনটা একদিন হবেই।
জীবনের শেষপ্রান্তে এসে মায়েরা বোঝেন, কার চোখের ভালোবাসা সত্য, কারটা কেবল কর্তব্য।

নরম স্বরে বললেন,

-সাব্বির, তুই যেটুকু পারিস, ততটুকুই দিস।
আমি তোদের মুখের দিকে তাকিয়ে খাই, খাবারের দিকে নয়।
মৃদুলের বড় বড় খাবারে মমতার গন্ধ নেই,
আর তোর শুকনো ভাতেও আমি সন্তুষ্ট, কারণ তোর মনটা আমার পাশে বসে থাকে।

সাব্বির মায়ের পায়ের কাছে বসে পড়লো।
তার গাল বেয়ে নেমে এলো অশ্রু, চুপচাপ মাটির দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ।
তারপর বললো,

- মা, আমি কখনো চাই না তুমি কষ্ট পাও।
কিন্তু আমার ছেলেমেয়েকে আমি সেই পথে বড় করতে চাই না যেখানে পেট পূর্ণ থাকে কিন্তু মন খালি হয়ে যায়।
তারা যেন বুঝতে শেখে,
কষ্টের ঘাম দিয়ে কেনা খাবারেই সবচেয়ে বেশি স্বাদ।

মা একহাতে ছেলের মাথায় হাত রেখে বললেন,

- তুই যেমন চাস, তোর সন্তানরা তেমনই হবে।
আমি কথা দিচ্ছি, এখন থেকে আর মৃদুলকে এসব আনতে দেবো না।
তোর সন্তানদের জন্য তুই যে ভবিষ্যৎ আঁকছিস, সেই স্বপ্ন যেন পূর্ণ হয়, এই দোয়া থাকলো আমার।

ঘরের বাতাসে তখন শান্তির এক নিঃশব্দ কম্পন ছড়িয়ে পড়ে।
মায়ের ছোঁয়ায় ভরসার ছায়া পায় আবার এক ক্লান্ত সন্তান।

অহনার বড় ভাইয়ের পরিবার মোটামুটি সচ্ছল হলেও মেজো ভাইয়ের সংসারে নিত্যদিন একধরনের যুদ্ধ চলে।
তাদের ঘরে যেন ভালোবাসার চেয়ে উচ্চস্বরে ঝগড়া আর অপমানেরই আধিক্য বেশি।
প্রতিদিন অন্তত একবার ‘বিচারসভা’ বসে অভিযোগ, জবাব, প্রতিশোধ।
তাদের সংসারে হাসির চেয়ে কান্না আর শব্দের চেয়ে তিরস্কার বেশি।

মাঝেমধ্যে যখন অহনার মেজো ভাই তার স্ত্রীর ওপর হাত তোলে,
স্ত্রীও তখন নীরব থাকার নারী নন।
সে প্রতিটি আঘাতের জবাব দেয় সমান আঘাতে,
একটা গালির বদলে দুটো গালি ছুড়ে দেয়,
কথা নয়, যেন প্রতিযোগিতা চলে কে কাকে বেশি আহত করতে পারে।
সেই বাড়ির দেয়ালগুলো পর্যন্ত বুঝে গেছে এই সংসারে বোঝাপড়ার স্থান নেই, কেবল রাগ, অভিমান আর দুঃখ জমে আছে প্রতিটি কোণায়।

এ সংসারে না আছে ভবিষ্যতের স্বপ্ন, না আছে শান্তি গড়ার চেষ্টা।
দুজনের একজনও সংযমী বা মর্মবোধসম্পন্ন নয়।
কেউ কারও ভুল বুঝতে চায় না, শুধুই কথার পাল্টা কথা, আঘাতের প্রতিআঘাত।

অহনার মেজো ভাবির মাঝে সংসারের প্রতি বিন্দুমাত্র দায়িত্ববোধ নেই।
তিনি কোনোদিনও স্বামীকে সহনশীলতা শেখাতে চেয়েছেন বলে মনে হয় না,
না তিনি নিজে সামাল দিয়েছেন সংসারের ভাঙা হাল।
বাজারে কী আছে, কী নেই, তাতে তার আগ্রহ নেই।
শুধু ঘরে রান্নার সময় বুঝতে পারেন চাল-ডাল শেষ,
আর তখনই শুরু হয় এক নতুন লড়াই।

ভাবি কখনো ভাবেন না আগামীকাল কীভাবে চলবে,
শুধু আজকের কড়াইতে কী পড়বে, তাই নিয়ে তার যত ভাবনা।
যেখানে সংসার মানেই সঞ্চয়, সহমর্মিতা, পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা।
সেখানে তারা যেন একে অন্যের শত্রু হয়ে উঠেছে।

সাব্বিরের মনে কেমন এক অজানা ব্যথা উঁকি দিতে লাগলো।
মায়ের সেই শান্ত হাসির আড়ালেও যে চাপা কষ্ট লুকিয়ে আছে, তা সে স্পষ্ট অনুভব করলো।
তার কণ্ঠে কাঁপন জড়ালো,
-মা, আমার কথায় তুমি কষ্ট পাও নি তো?

মা এবার একটু থেমে, শান্ত গলায় বললেন,
-কষ্ট? না বাবা, আমি কষ্ট পাইনি।
তবে সত্যি কথা বলতে কী, এত মানুষের সামনে একা বসে যখন খাবার খেতে হয়, তখন নিজেরই খারাপ লাগে।
তুই যে বলেছিস, আমি বুঝি সেটাই ঠিক।
তোর ছেলেমেয়ের দিকে তাকালেও মনটা কেমন করে ওঠে, কিন্তু মৃদুলকে কিছু বলতেও পারি না।
সব শেষে তো আমারই সন্তান,
সে যদি ভুল বোঝে, দূরে সরে যায়, সেই ভয়েই তো কিছু বলা হয় না।
তোকেও কতকিছু বলতে গিয়েও বলতে পারি না।

মায়ের চোখের কোনে জমে থাকা জলচাপা কান্না সাব্বিরের অন্তর ভেদ করে গেলো।
সে মাথা নিচু করে বললো,
-তুমি যদি আমাকে না বলো, তাহলে কে বলবে মা?
আমি যে প্রতিদিন ভয় পাই, তোমার মুখের দিকে তাকাতে।
আমি চাই না তোমার জন্য কিছু করাটা আমার অহংকার হোক, আমি চাই সেটা হোক আমার দায়িত্ব, আমার ভালোবাসা।

মা এবার কোমল হাতে ছেলের মাথায় হাত রাখলেন।
তার চোখে এখন একটাই ভাষা, গভীর ভালোবাসা আর দোয়ার প্রার্থনা।
-তুই যতটুকু করছিস, সেটাই অনেক সাব্বির, একটা সন্তান যেমন হয় তুই তার চেয়েও বেশি।
তোকে নিয়েই আমি গর্ব করি।
তুই আমাকে বুঝেছিস, এটা সব সন্তানের পক্ষে সম্ভব হয় না।

সাব্বির আর কিছু বললো না।
শুধু চুপচাপ বসে রইলো মায়ের পায়ের কাছে,
সায়েম স্নেহা রেডি হয়ে সাব্বিরকে ডেকে উঠলো।

-ও বাবা, বললে না ঘুরতে নিয়ে যাবে?

মেয়ের চঞ্চল কণ্ঠে ডাকা মাত্রই সাব্বির হাসিমুখে উঠে দাঁড়ালো।
অহনাকে বলে দু'হাতে ছেলে-মেয়ের হাত ধরে বেরিয়ে পড়লো সে।
শহরের কোলাহল ছাড়িয়ে, গন্তব্য নেই, তবু উদ্দেশ্য আছে, সন্তানদের সাথে কিছু সময় কাটানো।

ফুটপাত ধরে তিনজন হাঁটছে পাশাপাশি।
স্নেহা একটু হাঁপিয়ে বললো,

-বাবা, আর কত দূর? পা দুটো ব্যথা করে যাচ্ছে।

সাব্বির হেসে মাথায় হাত রেখে বললো,

-এতেই হাঁপিয়ে গেলে আম্মু?
জীবনে তো এখনো অনেকটা পথ বাকি।
তোমরা যেমন হাঁটতে হাঁটতে এক সময় গন্তব্যে পৌঁছাবে,
তেমনই জীবনে পরিশ্রম করে একদিন সফলতাও ধরা দেবে।

কিছুক্ষণ থেমে আবার বললো সাব্বির,
-জানো, সফলতা কখনো সহজে আসে না।
প্রত্যেক সফল মানুষের পেছনে থাকে অসংখ্য পরিশ্রম, ত্যাগ আর অপেক্ষা।

সে উদাহরণ টানলো কেবল অনুপ্রেরণার জন্য,
বললো,
-স্টিভ জবস, যিনি ছোটবেলাতেই দত্তক গৃহে বড় হয়েছেন,
তবু নিজের প্রতিভা দিয়ে গড়ে তুলেছেন অ্যাপল, বদলে দিয়েছেন প্রযুক্তির ইতিহাস।

-জে.কে. রাউলিং, যাঁর হ্যারি পটার বইটি ১২টি প্রকাশনী ফিরিয়ে দিয়েছিলো,
তবু তিনি থামেননি, আজ সেই গল্প কোটি মানুষের জীবনের প্রেরণা।

সায়েম চুপ করে বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলো,
স্নেহা হাত দুটো আকাশে ছুঁড়ে হেসে বললো,

-তাহলে আমিও অনেক বড় হবো বাবা! এমন বড়, যেন তোমার পরিচয় হয় আমার নাম দিয়ে।

সাব্বিরের চোখ চিকচিক করে উঠলো।
সে মৃদু কণ্ঠে বললো,

-তোমরা যদি মানুষ হও, দয়ালু হও, মাটির মতো নম্র হও,
তাহলেই আমি গর্ব করে বলবো, ওরা আমার সন্তান।
আর সে গর্ব হবে জীবনভর এক শান্তির আশ্রয়।

হেঁটে চলা সেই বিকেল যেন হয়ে উঠলো জীবনের এক অনুপম পাঠশালা,
যেখানে বইয়ের পাতা নয়, বাবার কণ্ঠে লেখা হলো দুটি শিশুর ভবিষ্যতের দিশা।

রুশার স্বামী দোকান থেকে ফিরতেই শাশুড়ি মুখ গোমড়া করে বসা।
কোনো ভূমিকা না দিয়েই সরাসরি বললেন,
-বাচ্চা নিচ্ছিস না কেন? তুই কি আর সন্তানের মুখ দেখবি না? এই বাড়ির বংশধর তবে কোথা থেকে আসবে?

প্রতিদিনকার এই পুনরাবৃত্তি আজ আর নতুন কিছু নয় রুশার কাছে।
সে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকলো।
কিন্তু তার স্বামী চুপ রইলো না আজ।

দীর্ঘশ্বাস ফেলে শান্ত গলায় বললেন,
-মা, আল্লাহ চাইলে রুশার কোলেই আসবে আমার বংশধর।
আর যদি আল্লাহ না চান, তাহলে এক নয় দশটা বিয়ে করলেও কোনো লাভ হবে না।
সন্তান হোক বা না হোক, তা একমাত্র তাঁর ইচ্ছায় নির্ভর করে।

রুশার শাশুড়ি একটুও দমে গেলেন না, জেদের সুরে বললেন,
-তাই বলে কি চেষ্টা করবি না? কেবল তাকিয়েই থাকবি ভাগ্যের দিকে?

ছেলের কণ্ঠ এবার একটু কঠিন হলো,
-কে বলেছে আমরা চেষ্টা করছি না?
আমরা দুজনই সবরকম চেষ্টা করছি, ডাক্তার দেখিয়েছি, ওষুধ খেয়েছি, দোয়া করছি, রোজা রাখছি,
তবু সন্তান তো কেবল দাম্পত্য জীবনের উদ্দেশ্য নয় মা,
রুশা আমার স্ত্রী, আমার দায়িত্ব, আমার সম্মান।
তাকে ছোট করে আমি কখনোই বড় হতে চাই না।

রুশার চোখ চিকচিক করে উঠলো।
শুধু চোখে নয়, মনে যেন বৃষ্টির পর এক ফালি রোদ এসে পড়েছে।
স্বামীর এমন প্রতিবাদী ও সজাগ অবস্থান তাকে প্রশান্তি দেয়।
এমনও ভালোবাসার ভাষা হয় তা সে কখনো জানতো না , শুধু অনুভব করছিলো অন্তরের গভীর এক আশ্রয়ে।

সে ধীরে পায়ের আওয়াজ ছাড়া পাশে গিয়ে বসলো।
অল্প স্বরে বললো,
-আমার কোল খালি থাকলেও, আপনি যে আমার পাশে আছেন, এটুকুই আমার পূর্ণতা।

তার স্বামী হাত ধরে বললো,
-তোমার কোল হয়তো এখনো খালি, কিন্তু তোমার বুকটা আমার ভালোবাসায় ভরা।
আর যাইহোক আমাদের আর কখনো ভালোবাসার অভাব থাকবে না।

ফুটপাত ধরে হাঁটছে তিনজন।
চারপাশে ব্যস্ত শহর, কিন্তু সাব্বিরের দৃষ্টি নিবদ্ধ রাস্তার ধারে বসে থাকা অনাথ কিছু শিশুদের দিকে।
কোনোটা ময়লা কুড়িয়ে হাতে নিয়েছে, কোনোটা ভিক্ষার পাত্র বাড়িয়ে দিয়েছে পথচারীর দিকে।

সাব্বির থেমে দাঁড়ালো।
-দেখো বাবু, ওদের ভালো করে দেখো।
তাদের গায়ে নেই ঠিকঠাক জামা, পায়ে নেই জুতো, পেটে নেই ভরপুর খাবার।
তবুও দেখো, তারা বেঁচে আছে হাসে, কাঁদে, কাজ করে, শুধুই বেঁচে থাকার জন্য।

সে হাঁটু গেঁড়ে বসে দুই সন্তানের চোখের সমান হয়ে বললো,
-তারা তোমাদের মতো স্কুলে যেতে পারে না, খেলনা নিয়ে খেলতে পারে না।
তাদের সকাল শুরু হয় না বাবার স্নেহে কিংবা মায়ের কোলে ঘুম ভেঙে।
তাদের জন্য নেই কারো ভালোবাসা, নেই কেউ যে আদর করে ডাকবে।

স্নেহা ধীরে বললো,
-আমরা তো তাদের চেয়ে ভালো আছি, তাই না বাবা?

সাব্বির হালকা হেসে বললো,
-হুম, শুনো কারো ভালো খাবার দামী জামা দেখে কখনো আফসোস করবে না, বরং এদের দিকে তাকিয়ে বলবে "আলহামদুলিল্লাহ" আল্লাহ এদের থেকে তো আমাদের ভালো রেখেছেন।কত আছে খেতে পায় না, আমরা তো খেতে পাচ্ছি, পরতে পাচ্ছি, ভালোবাসা পাচ্ছি।

সায়েম ও স্নেহা একসাথে বলে উঠলো,
-আলহামদুলিল্লাহ,

সাব্বির আবার বললো,
-সব কিছুতে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করতে হয়, ভরসা রাখতে হয়, অল্প নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হয়। এই যে দেখছো ছোট ছোট বাচ্চারা, ওদের চাহিদা কিন্তু খুব বেশি না।
তিন বেলা পেট ভরে খাওয়া আর গায়ে জড়ানোর মতো জামা, শুধু এটুকুই চায় ওরা।
তবে ওদের কপালে তা-ও জোটে না।

সায়েম সরল কণ্ঠে বললো,
-আমি ওদের খাবার কিনে দেবো, জামাও কিনে দেবো।

তার কথায় স্নেহা হেসে উঠলো।

সাব্বির সাথে সাথেই বললো,
-স্নেহা, কেউ ভালো কাজ করতে চাইলে তাকে নিয়ে হাসাহাসি করা ঠিক না।
বরং উৎসাহ দিতে হয়, যাতে সে ভালো কাজটা সত্যিই করে ফেলতে পারে।

স্নেহা মাথা নিচু করে চুপ হয়ে গেলো।

সাব্বির দুই সন্তানের মাথায় হাত রেখে বললো,
-জানো, বইয়ের পাতা থেকেই সব শেখা যায় না।
জীবনের কঠিন অভিজ্ঞতা, রাস্তায় দেখা মানুষদের গল্প থেকেও শেখার অনেক কিছু আছে।
মানুষ হতে হলে কেবল বিদ্যা নয়, দরকার হৃদয়ের গভীরতা, অন্যের দুঃখ বোঝার চোখ।

তারপর ধীরে ধীরে হেঁটে চললো তারা,
আকাশে সূর্য মধ্য গগনে,
আর তিনটি হৃদয়ে এক অনাবিল মানবিক আলো ফুটে উঠলো,
নীরব, কিন্তু দৃঢ় এক শিক্ষার আলো।
*গত ছয় দিন ধরে আমি শারীরিকভাবে খুবই অসুস্থ ছিলাম, তাই গল্প দিতে পারিনি, এজন্য আন্তরিকভাবে দুঃখিত।
কেউ-ই চায় না তার পাঠকপ্রিয়তা কমে যাক, আমিও চাই না।
আশা করি, আপনারা বুঝতে পেরেছেন।
এবার গল্পপ্রেমী সবাই একটু সাড়া দিন তো!
আপনাদের রেসপন্স দেখলে মন'টা ভরে যায়।

চলবে,,,,

 েলে #আরেব্বা_চৌধুরী  #পর্ব_সংখ্যাঃ- ২৮সকাল সকাল উঠে নাশতা সেরেই ব্যাগপত্র গুছাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো অহনা।মায়ের কাপড়চোপড় গু...
08/07/2025

েলে
#আরেব্বা_চৌধুরী
#পর্ব_সংখ্যাঃ- ২৮

সকাল সকাল উঠে নাশতা সেরেই ব্যাগপত্র গুছাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো অহনা।
মায়ের কাপড়চোপড় গুছাতে গিয়ে আলমারির দরজা খুলতেই একরাশ ধুলোর গন্ধে ভরে উঠলো চারপাশ।
পুরনো স্মৃতির ভারে নুয়ে থাকা সেই আলমারিতে, একটার উপর আরেকটা করে রাখা নানান রঙের শাড়ি।
এক এক করে যখন নামাচ্ছিলো তখন চোখে পড়লো নিচে রাখা একটা ডায়েরি।
ধুলোমলিন পাতাগুলোর উপর স্পষ্ট করে লেখা, "সাব্বির।"

এক মুহূর্ত থমকে দাঁড়িয়ে গেলো অহনা।
আঙ্গুল দিয়ে ছুঁয়ে দেখলো সেই অক্ষরগুলো,
যেন শব্দের ভেতরও জমে থাকা দীর্ঘশ্বাসগুলো চুপ করে বসে আছে।
ডায়েরিটা খুলে দেখার সুযোগ তখন ছিল না,
তবুও নিঃশব্দে যেন একটি কণ্ঠ বললো, কোনো একদিন পড়ে নিও।
অহনা ডায়েরিগুলো শাড়ির ফাঁকে ভরে রাখলো ব্যাগে,
কারণ কিছু কিছু লেখা চোখের চেয়ে হৃদয় দিয়ে পড়া উচিত।

এদিকে হালকা নাশতা করে আয়নার সামনে দাঁড়ালো সাব্বির।
চেহারায় ক্লান্তির রেখা, কিন্তু তাতে যেন এক আলাদা তৃপ্তির ছায়া।
বুকের ভেতর জমে থাকা দীর্ঘদিনের ভার একটুখানি হলেও যেন হালকা হয়েছে।

মৃদুল নীরব, কোনো কথা নেই মুখে,
সাব্বির বেরিয়ে যাবার সময় শুধু ছোট একটা শব্দ উচ্চারণ করেছিলো,
"ভালো থাকিস।"

অবশেষে মা, শাশুড়ি, স্ত্রী আর দুই সন্তানকে নিয়ে শহরের উদ্দেশে রওনা হলো সাব্বির।
আজ আর কোনো দুঃখ, অভিমান কিংবা অভিযোগ নিয়ে নয়।
রওনা হলো নতুন করে সবকিছু শুরু করার আশায়।

এই শহর, যেখানে কখনো সে আশ্রয় খুঁজেছিলো,
সেই শহরই আজ তার ঠিকানা, তার ঘর।
তবে এবার সে একা নয়।
সাথে আছে তার পৃথিবী, তার আত্মার অবশিষ্ট অংশগুলো।

বাড়ি ফিরেই ঘর গোছাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো অহনা।
তিন দিন তালাবদ্ধ থাকায় রুম দুটোতে যেন একধরনের ভারি গুমোট ভাব।
দেয়ালে জমে থাকা ধুলো, বাতাসে আটকে থাকা একঘেয়েমি।
জানালা খুলতেই দিনের আলো ঝাপসা হয়ে এসে ছুঁয়ে দিলো ঘরটিকে।
অহনা পরিপাটি করে বিছানা গুছিয়ে নিলো, কাপড় সরিয়ে রাখলো আলমারিতে,
সব কিছুতে যেন নতুন করে জীবনের স্পর্শ ছড়িয়ে দিতে চাইছে সে।

সাব্বির কাকার কাছ থেকে আরও একটি রুম ভাড়া নিয়ে বেরিয়ে পড়লো গ্যারেজের দিকে।
মাথায় দায়িত্বের বোঝা, মনজুড়ে ভবিষ্যতের চিন্তা।
কোথা থেকে শুরু করবে, কীভাবে আবার আগের মতো সবকিছু গুছিয়ে তুলবে?

গ্যারেজের সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই মনে হলো,
এই ছোট্ট গ্যারেজটাই যেন তার জীবনের সবচাইতে বড় প্রশ্নের উত্তর খোঁজে।
তালাবদ্ধ সেই দরজাটা আজ যেন আরও ভারী হয়ে উঠেছে।
সাব্বির চোখ বুলিয়ে নিলো আশেপাশে,
একসময় এই দরজার ওপারে দিনভর চলতো ব্যস্ততা,
মেকানিকদের হাঁকডাক, যন্ত্রের ঘর্ষণ,
আর আজ সেখানে স্তব্ধতা।

গলার ভেতর একরাশ কষ্ট আটকে গেলো।
ভেতরের অন্ধকারে হাত বাড়িয়ে যেন ছুঁতে চাইলো সেই আলো,
যেখান থেকে তার রুটি-রুজি আর সম্মান দুটোই জন্ম নিয়েছিলো।

নিজেকে শক্ত করে মনে মনে বললো,
শূন্য থেকেই তো শুরু করেছিলাম, আবার পারবো,
এবার পিছনে রয়েছে পরিবার মা, অহনা আর আমার সন্তানেরা।
আর আমি তো এখনও হেরে যাইনি।

তার পা আবারও গড়িয়ে গেলো কর্মের পথে,
এক নতুন শুরু, এক নিঃশব্দ লড়াই।
পরের দিনই তিন কর্মচারীর মধ্যে দুজনকে ছাঁটাই করে দিলো সাব্বির।
হৃদয়ে কষ্ট নিয়েই সিদ্ধান্তটা নিতে হয়েছে তাকে।
জানতো, এই সিদ্ধান্ত কারো কাছে নির্মম মনে হবে,
কিন্তু বর্তমানে বাস্তবতাই তার সবচেয়ে বড় শিক্ষক।

বাকি একজন সালাম, বছরের পর বছর ধরে তার পাশে ছিলো ছায়ার মতো।
দক্ষ, বিশ্বস্ত আর পরিশ্রমী।
সাব্বির তাকে রেখে দিলো পাশে, যেন এক নীরব যোদ্ধা।
বললো শুধু,
-তুই আছিস বলেই আমি সাহস পাই।

নিজের কাঁধেই তুলে নিলো গ্যারেজের অধিকাংশ ভার।
সকালের আলো ফোটার আগেই চলে আসে সে,
রাত গড়ালে তবেই ফেলে ক্লান্ত শরীরটা নিজের সংসারের চৌকাঠে।

কারণ, এখন টাকার দরকার শুধু নিজের জন্য নয়,
একটা সংসার, বৃদ্ধা মা, দুটো নিষ্পাপ মুখ, আর অহনার প্রতিটি না বলা স্বপ্ন
সব মিলিয়ে যেনো সে হয়ে উঠেছে এক জীবন্ত দায়িত্বের প্রতিমূর্তি।

নিজেকে প্রতিদিন একটু করে গড়ছে সে,
একটা ইট আরেকটা ইটের উপর রাখছে নিঃশব্দে,
হয়তো কেউ দেখছে না, কিন্তু সে জানে,
আকাশের পানে তাকানোর আগে মাটি শক্ত করতে হয়।

কেটে গেছে এক বছর,,,

অনাথআশ্রম থেকে তিন বছরের এক শিশুকে দত্তক নিয়েছে মৃদুল।
না, ভালোবাসা কিংবা মমতার টানে নয়,
সে খুঁজছিলো নিজের বার্ধক্যের এক অবলম্বন,
যে বৃদ্ধ বয়সে তার ওষুধ-পানি এগিয়ে দেবে,
তার দেহখানা কবরে রাখার বন্দোবস্ত করবে।

ঘরের ভিতর যতটুকু কোমলতা থাকা উচিত,
মৃদুলের আচরণে তা ছিলো রুক্ষ মরুভূমির মতো।
বাচ্চাটার কান্না, ভয় কিংবা অভিমান,
তাকে স্পর্শ করে না এতটুকু।

বাবার থেকে জোর করে নিজের নামে লিখিয়ে নেওয়া
শেষ সম্বল সেই একখানা ভিটেটুকুও আজ বিক্রি করে দিলো সে।
যেই ঘরে একদিন ছিলো মায়ের হাসি,
বাবার সন্ধ্যাবেলা নামাজের সময়ের ডাক,
আর ছিলো ছোট ছোট ঝগড়ার মধ্যেও পরিপূর্ণ এক সংসার।

কিন্তু মৃদুলের কাছে ঘর ছিলো কেবল একখানা সম্পত্তি,
যার বদলে শহরে গিয়ে সে গড়বে নিজের স্বপ্নের রাজ্য।

স্ত্রীর শেষ গয়না আর নিজের কিছু জমানো টাকা
সঙ্গে নিয়ে শহরের দিকে পাড়ি জমালো সে,
পেছনে ফেলে গেলো সম্পর্ক, আবেগ আর দায়বদ্ধতার গল্পগুলো।

তার চোখে এখন কেবলই হিসাব,
কে কতটা দিতে পেরেছে, কে কতটা কেড়ে নিয়েছে।
শিশুটিকে কোলের বদলে ধরলো বগলে,
আর পাথরের মতো ঠোঁটে ফিসফিসিয়ে বললো,
-এখন থেকে তুইই আমার ইনভেস্টমেন্ট।

রাতে অহনা চুপচাপ বিছানার একপাশে শুয়ে ছিলো। আলো নিভে গেছে অনেকক্ষণ, শুধু পাশ ফিরে ঘুমিয়ে থাকা সাব্বিরের নিশ্বাসের শব্দটাই ভেসে আসছে নীরব রাতে।

তবুও অহনার চোখে ঘুম নেই।

হঠাৎ ধীর কণ্ঠে বললো,
-আপনি কি জানেন, আপনার জীবনের গল্পটা আমার কাছে এখন একটা অপূর্ণ উপন্যাসের মতো লাগে?

সাব্বির চমকে উঠলো।
-মানে?

-মানে, আমি সেই শেষ অধ্যায়ের চরিত্র, যার আগে অনেককিছু লেখা হয়ে গেছে, আর আমার অংশটুকু যেন শুধু দায়সারা।

সাব্বির পাশে ফিরে অহনার মুখোমুখি হলো।
-তুমি এমন বলছো কেন?

-কারণ আমি আজও বুঝি না, আমি আপনার জীবনের ভালোবাসা, না দায়িত্ব?
আপনি আমাকে বিয়ে করেছেন, সংসার করছেন, সন্তানদের মানুষ করছেন সব ঠিক আছে, কিন্তু তবু কোথাও যেন শূন্যতা, যেন আমি আপনার অতীতে লেখা কারো ছায়ার পাশে দাঁড়িয়ে আছি, যার নাম অধরা।

-মানে?
-আপনার একটা পুরনো ডায়েরি পেয়েছিলাম মায়ের শাড়ির নিচে। বহু দিন ধরে রেখে দিয়েছিলাম পড়ে দেখবো বলে। কাল হঠাৎ সময় পেলাম, খুলে পড়লাম কয়েকটা পাতা, প্রতিটি লাইন, প্রতিটি শব্দে আপনি শুধু অধরাকে ডেকেছেন, তাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেছেন, ভবিষ্যৎ কল্পনা করেছেন, তাহলে আমার জায়গা কোথায়?

সাব্বির দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
-তুমি জানো না, আমি প্রতিদিন কতটা চেষ্টা করি তোমার সেই প্রশ্নগুলোর উত্তর হতে।
আমি অধরাকে ভালোবেসেছিলাম, ঠিক, কিন্তু সেটা ছিল আমার কৈশোরের অনুভব।
তোমার সঙ্গে আমার জীবন শুরু হয়েছে সেই দিন থেকে, যেদিন তুমি নিজের সব ছেড়ে আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলে।

অহনা চুপ করে রইলো

সাব্বির আবার বললো,
-অধরা আমার প্রথম অনুভব ছিলো, কিন্তু তুমি আমার জীবনসঙ্গী।
তুমি আমার জীবনের সেই অধ্যায়, যেটার পরে আর কোনো পাতা ওল্টাবো না।
তোমার আগে ভালোবাসা ছিলো, তোমার পরে নেই, আর কখনো আসবেও না।

বাবা যখন অসুস্থ হয়ে পড়লেন, সংসারের হাল যখন ধরতে হলো, সেদিনই এই ডায়েরি তুলে রেখেছিলাম মায়ের শাড়ির ভাঁজে আর খোলা হয় নি।
ভেবেছিলাম, যেখানে আমি অধরাকে রেখে এসেছি, সেইখানেই তার সমস্ত স্মৃতি চিরতরে গুটিয়ে রাখবো।
তুমি তো জানো না, তুমি না থাকলে আমি কেমন হয়ে যাই। তুমি আমার ভাঙা সময়ের সবচেয়ে মজবুত ভরসা। অধরা ছিলো আবেগ, তুমি বিশ্বাস। অধরা ছিলো স্বপ্ন, তুমি বাস্তবতা। আর আমি বিশ্বাস করি, বাস্তবতাই মানুষের জীবনে সবচেয়ে স্থায়ী আশ্রয়।

তুমি যদি কখনো অনুভব করতে পারতে, আমি তোমাকে কতখানি ভালোবাসি,
তাহলে আর প্রশ্ন করতে না, অহনা।
অধরা আমার শৈশবের অনুভব ছিলো, আর তুমি আমার জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ।
তোমায় ছাড়া আমার ঘর, আমার দিন, আমার রাত্রি, কিছুই তো চলে না।

অহনা চোখ নামিয়ে ফিসফিস করে বললো,
-তবুও আমি চাই না কোনো পাতায়, কোনো কোণে, কোনো হৃৎপিণ্ডের অলিন্দে, অন্য কারো নাম থাকুক।
আমি আপনার ‘পুরোটা’ চাই, ভগ্নাংশ নয়।

সাব্বির একটু হাসলো, সেই হাসিতে অভিমানের ছায়া, ভালোবাসার স্পর্শ।

-ভালোবাসা যদি ভাঙা-ভাঙা হতো, তাহলে এ জীবন অনেক আগেই থেমে যেতো অহনা।
তুমি শুধু স্ত্রী নও, তুমি আমার সংসারের ভরসা, আমার জীবনের দিশা।
অধরাকে ভালোবেসেছিলাম আমি,কিন্তু তাকে সঙ্গে নিয়ে পথ চলিনি।
তোমাকে ভালোবেসে চলছি, প্রতিটি পদক্ষেপে।

অহনা নিঃশব্দে সাব্বিরের বুকে মাথা রাখলো।
চোখ বেয়ে নেমে এল জল, তবে এবার সেই জলে হিংসা ছিল না, ছিল আত্মপ্রত্যয়।
কারণ সে জানে, প্রথম নয়, শেষ ভালোবাসা হতেই তো ভাগ্য লাগে।

সাব্বিরের বাসার লাগোয়া গলিতেই ভাড়া নিয়েছে মৃদুল।
বলে বেড়ায়, শহরের নামী এক মার্কেটে কাপড়ের দোকান দিয়েছে সে।
আসলে উদ্দেশ্য কেবল ব্যবসা নয় চোখের আড়াল হলেও মনে মনে সাব্বিরের প্রতিটি পদক্ষেপের হিসেব রাখা।

দিনে একবার করে মা’র খোঁজ নিতে এসে বড় ছেলের সংসারে ঢুঁ মেরে যায়।
বলে,
-মা কেমন আছো? সাব্বির ঠিক মতো খাওয়ায় তো?

আসলে তার চোখ পড়ে অন্যখানে, সাব্বিরের পরিশ্রমে গড়া একেকটা ইটের দিকে, গ্যারেজের ধুলোমলিন বারান্দায় জমে ওঠা স্বপ্নের দিকে, সায়েমের অবুঝ হাসিতে লেগে থাকা অহনার শান্ত প্রশান্তির দিকে।

মৃদুল তুহিনকে নিয়ে আসলে মা আদরে ভরিয়ে দেন।
তুহিন মায়ের গলা জড়িয়ে বলে,
-দাদী, আমি তোমাকে নিয়ে যেতে এসেছি।
মায়ের চোখ ঝাপসা হয়, অথচ কিছু বলেন না।

অপরদিকে সায়েম ধীরে ধীরে হাঁটতে শিখেছে।
ছোট্ট দু’পায়ে পা ফেলে টুকটুক করে ঘরে ঘরে হেঁটে বেড়ায়।
মৃদুল একবারও কোলে তোলে না তাকে।
চোখে চোখ রাখলেও, ভালোবাসার ন্যূনতম স্পর্শটুকু দেয় না।

সাব্বির যতটুকু পারে তা দিয়েই ছেলের মুখে হাসি ফোটাতে চায়, সাব্বির সায়েমের জন্য একটা রঙিন জামা কিনে আনলে মৃদুল পরদিনই তুহিনের জন্য এনে দেয় দামি দুটো পোশাক।
তুহিন হাঁটতে গিয়েও পা মাটিতে ফেলে না, বাবা কাঁধে তুলে নিয়ে ঘোরায়।

এ যেন অদৃশ্য এক প্রতিযোগিতা, যেখানে কেউ কিছু না বললেও, যার যার চোখে স্পষ্ট উচ্চারণ,
"কে বেশি ভালো বাবা?"

সাব্বির এসব দেখে কিছু বলে না, শুধু দূর থেকে একটুখানি হেসে ছেলে সায়েমের মাথায় হাত রাখে।
মনের ভেতর দিয়ে ঢেউয়ের মতো বয়ে যায় একটাই কথা।

ভালোবাসা কখনো প্রতিযোগিতা হতে পারে না। ভালোবাসা মানে নিঃস্বার্থ থাকা, নিরব দায়িত্ব নেওয়া, প্রতিদান না চাওয়া।

কিন্তু মৃদুল পদে পদে বুঝাতে চায়, সাব্বির তার কাছে সায়েমকে দত্তক না দিয়ে কত বড় ভুল করেছে।

দিনের অর্ধেক সময় কাটে গ্যারেজের তপ্ত ইঞ্জিনের মাঝে,
লোহার গন্ধ, গ্রীসের দাগ, আর ক্লান্ত ঘাম মিশে যেন শরীর থেকে বেরিয়ে আসে তার জীবনের কাহিনি।
বাকি অর্ধেক সময় চলে যায় বাড়ির কাজ সামলাতে ইট, সিমেন্ট, রডের হিসাব, শ্রমিকদের তদারকি।
নিজের জন্য সময় রাখার মতো কোনো অবসর নেই, নেই বিশ্রামের ছায়া।

রাতে একা দাঁড়ায় আয়নার সামনে,
কোনো বিশেষ কারণ ছিল না, হঠাৎই নিজেকে দেখার ইচ্ছে হলো।
আয়নার দৃষ্টিতে চমকে উঠে সে,
চেনা সেই চেহারা যেন বদলে গেছে,
চোখে ঘুমহীনতা, মুখে ক্লান্তির রেখা,
শরীর শুকিয়ে জীর্ণ হয়েছে, মাথার চুলে স্পষ্ট ফাঁক।
কখন যেন বয়স কাঁধে চেপে বসেছে নিঃশব্দে।

নিজেই নিজের চোখে তাকিয়ে এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে,
-এতো কিছু করে শেষ পর্যন্ত কি আমি আমার পরিবারের মুখে হাসি এনে দিতে পেরেছি?

কিন্তু পরক্ষণেই মনে পড়ে যায় স্নেহা ও সায়েমের উচ্ছ্বল হাসি,
অহনার গভীর মমতা,
আর মায়ের প্রশান্ত মুখ।

তখনই সে আয়নার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে ফেলে,
-যদি ভালোবাসা থাকে পুরস্কার, তাহলে এই ক্ষয় হয়ে যাওয়া দেহও হয়ে উঠুক সবচেয়ে মূল্যবান উৎসর্গ।

রোজার সময় হয়ে আসছে।
চৈত্রের রোদ যেন রোজার প্রস্তুতির আগেই পরীক্ষা নিতে চায়।
সাব্বির কিছুদিনের জন্য ঘরের নির্মাণকাজ বন্ধ রাখলো,
পুরো মনোযোগ দিলো গ্যারেজে কারণ এখন উপার্জনের টাকা দিয়ে রোজার বাজার করতে হবে।
ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সে নিজেই খাটে, ঘামে ভেজে শরীর,
তবু ক্লান্তির কোনো ছাপ নেই চোখে মুখে।
কারণ তার একটাই লক্ষ্য ঘরটা আবার গড়ে তোলা,
আর নিজের আত্মসম্মানটাকে ফিরিয়ে আনা।

গ্যারেজে বসেই এক দুপুরে রুশাকে ফোন করলো সে।
রুশার কণ্ঠে প্রশান্তির ঢেউ,
সে জানালো এখন বেশ ভালোই আছে।
শাশুড়ী কিছু বললে সে কিছু বলার আগেই তার স্বামী উত্তর দিয়ে দেয়।
এখন শাশুড়ী অনেকটাই বদলে গেছেন,
একটা অদৃশ্য সীমারেখা তৈরি হয়েছে যেটা কারো সম্মানকে ম্লান হতে দেয় না।

দোকানটা ছোট, আয়ও আহামরি না,
তবু শান্তি আছে ভাইয়া।
তোমার দেওয়া টাকাটার মর্যাদা আমি কখনো ভুলবো না।
একটা আশ্রয়, একটুখানি সম্মান, এর চেয়ে বড় সম্পদ আর কিছু নেই।

সাব্বির কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো,
-এসব শুনেই শান্তি পাই, রুশা।
তোরা ভালো থাকলেই আমার শান্তিতে ঘুম আসে।

ফোন কেটে দিয়ে ছায়ায় বসে চোখ বন্ধ করলো সাব্বির।
এক মুঠো নিঃশ্বাস বুকে জমিয়ে মনে মনে বললো,
এই জীবনের যুদ্ধে সে হেরে যেতে চায় না,
কারণ অনেক মানুষের হাসি এখন তার কাঁধে ভর করে দাঁড়িয়ে আছে।

মৃদুলের মধ্যে আজও কোনো পরিবর্তন নেই।
তার কথাবার্তা, চালচলন, এমনকি হাঁটাচলার ভঙ্গিতেও এখনও ঝরে পড়ে একরকম ঔদ্ধত্য।
সে ব্যবসার কাজে শহরে এসেছে, এই নামেই পরিচিতি দিয়ে বেড়ায়,
কিন্তু সাব্বিরের মনে গভীর একটা প্রশ্নই ঘুরপাক খায়,
সে কি সত্যিই ব্যবসার তাগিদে এসেছে?
না কি নীরব প্রতিযোগিতায় নেমেছে বড় ভাইকে হারানোর মঞ্চে?

মাঝেমধ্যে বাসায় বড় রুই মাছ, ব্রয়লার মুরগি কিংবা বাহারি ফলমূল এনে হাজির করে মৃদুল ।
তারপর ছোট্ট সায়েম ও স্নেহাকে ডেকে বলে,
-এই দেখো চাচ্চু কত বড় মাছ এনেছে, এই দেখো মুরগি!
কিন্তু এই দেখানোতেই শেষ,
না কোনো মাছের একটা টুকরো,
না কোনো রসালো ফলের এক খণ্ড
সায়েম কিংবা তার ছোট বোনটির ভাগ্যে জোটেছে।
শুধুই চোখের সামনে একরাশ বিলাসিতা,
আর হাতের মুঠোয় অভাবের শিকল।

একদিন সন্ধ্যায় চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকা অহনাকে দেখে সাব্বির কড়া গলায় বলেছিলো,
-ছেলেমেয়েকে এ বাড়ি ও বাড়ি যাতায়াত করতে দিবে না অহনা।
ওদের চোখে যেন লোভের ছবি না আঁকে।
ওদের শেখাতে হবে কীভাবে মানুষের মুখে খাবার তুলে দেওয়ার আগে
নিজের কপালের ঘাম মুছতে হয়।
আমি চাই আমার সন্তানরা হোক অল্পে তুষ্ট,
অহংকার নয়, তারা যেন শিখে কৃতজ্ঞতা।

তবুও শান্তি মেলে না মৃদুলের,
মা'কে দেওয়ার নাম করে,রোজ রোজ ইফতারি নিয়ে আসে,
কিন্তু খাবারের পরিমাণটা এমন হিসাবি
যেন শুধু একজনের পেটই ভরুক,
আর কারও যেনো নজর না পড়ে।
সাব্বির বোঝে, এ এক ধরনের সূক্ষ্ম খোঁচা,
এক ধরণের শ্রেষ্ঠত্ব দেখানোর প্রয়াস।
নিজে বসে মা'কে খাইয়ে দেয়,
মায়ের ঠোঁটের কোণায় কিছুমাত্র হাসি ফুটলেও
সাব্বির যেন দেখতে না পারে এমন কৌশলে বিদায় নেয়।

সায়েম জানে না, কেন ইফতারের সময় বাবার মুখটায় গাম্ভীর্য লেগে থাকে,
কেন মা অল্প খাবার পাতে তুলে দেয়, কেন ইফতারিতে ফলমূল থাকে না।
কেন দাদির প্লেটের পাশে তার হাত ছুঁতে গেলেই মা তাকে টেনে সরিয়ে নেয়।

এই ঘর, এই পরিবার, এই রক্তের বন্ধন,
সব আছে, তবু কিছু নেই।
ভালোবাসা নেই, সংবেদন নেই, তা স্পষ্ট।
*মন্তব্য যখন গঠনমূলক হয়, তখন কলমের ডগা দিয়ে আপনা-আপনি কালি বের হয়।

চলবে,,,,

Address

Dhaka

Alerts

Be the first to know and let us send you an email when গল্পের পৃথিবী posts news and promotions. Your email address will not be used for any other purpose, and you can unsubscribe at any time.

Share

Category