28/03/2025
একদিন হঠাৎ রাতে বাড়ি ফিরলো না অর্ক। ভীষণ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন বাবা, মা, আর ছোটো বোন। এরকম তো কোনোদিন হয়নি। ইউনিভার্সিটির শেষ বর্ষে পড়ে অর্ক। না বলে কোনোদিন রাতে বাইরে থাকেনি। ওর হাতে থাকা মুঠোফোনটিও বন্ধ যেমনটি হয়নি কখনও। ফাতেমা বারবার বলছিলেন, 'একটা কিছু হয়েছে আমার ছেলের। না হলে একটা ফোন কি করতে পারতো না!'
ছোটো বোন নার্গিস ফোন করে বান্ধবী সালেহাকে, ও তার ভাইয়ের প্রেমিকাও। ওরা অর্কর বন্ধুদের ওখানে খোঁজ নিয়েছিলো, কিন্তু কোথাও থেকে অর্কের খবর পাওয়া যায়নি।
ভয়াবহ খবরটা পরদিন শুনতে পেলেন অর্কের পিতা জসিম। বিনিদ্র রজনী যাপনের পর ভোরে উঠে এদিকসেদিক হাঁটতে থাকেন তিনি। মোড়ের টঙের মতো চায়ের দোকানে শুনতে পেলেন, মানুষগুলো বলছে, গতকাল এখান থেকে একটি যুবক ছেলেকে জোর করে গাড়িতে উঠিয়ে নিয়ে গেছে, ওরা হয়তো কোনো বাহিনীর লোক।
মেয়েকে নিয়ে সকালে থানায় গেলেন জসিম। থানা পাত্তাই দিলো না তাদের। কোনো মামলাও নিলো না। সেই থেকে বোন নার্গিস ওর বান্ধবী সালেহাকে নিয়ে আইনশৃঙ্খলার দরজায় কড়া নাড়তে লাগলো। কিন্তু কোনো দরজাই তাদের জন্য খুললো না। পত্র-পত্রিকায় খবর ছাপা হল, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র অর্ক গুম হয়েছে।
গুম শব্দটি এখন সারা বিশ্বে, বিশেষ করে বাংলাদেশে এক আতঙ্কের নাম। সবচেয়ে বড় কষ্ট, গুম হওয়া ব্যক্তিটির স্বজনরা জানতে পারেন না যে তার কী ঘটেছে। এক বিবাহিতা যুবতী প্রেসক্লাবে দাঁড়িয়ে কেঁদে কেঁদে বলছিলেন (যার স্বামী কয়েক বছর ধরে নিখোঁজ), 'মানুষটার জন্য আমি আল্লাহর কাছে দোয়া চাইতে পারি না। হতে তো পারে সে এখনও বেঁচে আছে। জীবিত মানুষের জন্য আল্লাহর কাছে এভাবে দোয়া চাওয়া যায় না। আবার যখন আমার পাঁচ বছরের মেয়ে জিজ্ঞেস করে, মা আব্বু কোথায়, আসে না কেন, তখন বলতে পারি না, আব্বু আছে; আসবে। আমি জানি না, আমি কি বিধবা, না-কি সধবা।'
হারিয়ে যাওয়া মানুষের স্বজনদের সংগঠন মায়ের ডাকের আয়োজনে আমি প্রত্যেক বছর যাই। এই সভায় ছয় বছরে শিশু থেকে ৬০ বছরের বৃদ্ধা হৃদয় চিরে আর্তনাদ করে। বৃদ্ধা মা বুক চাপড়ে উচ্চকণ্ঠে বিলাপ করেন। সবাই মিনতি জানায় সরকারের প্রতি, সরকার প্রধানের প্রতি, 'আমাদের পিতা, স্বামী সন্তানদের খুঁজে দাও, ওরা কোথায় আছে, ওদের আমাদের কাছে ফিরিয়ে দাও।' তাদের সেই কান্না প্রেসক্লাবের বাতাসে অথবা গণজাগরণ মঞ্চের চত্বরে মিলিয়ে যায়। এক দশক, এক যুগ পেরিয়ে যায়। পরিবারগুলো দুমড়ে মুচড়ে ধ্বংস হয়ে যায়। তারা তাদের স্বজনদের খবর পায় না।
এইসব হৃদয় চেরা দুঃখ জাগানিয়া ঘটনা নিয়ে রচিত হয়েছে গুম নামের উপন্যাস। এখানে একটি পরিবারের কথা বলা হয়েছে যে পরিবারের সন্তানটি হঠাৎ একদিন আর বাড়ি আসেনি।
দুই নারীর কথা বলা হয়েছে, সেই রকম দুই নারী যারা শামসুর রহমানের কবিতার মতো সুন্দর। ইচ্ছার নদীতে নাইতে নাইতে অনায়াসে পৌঁছে যেতে পারতো শান্তির দারুচিনি দ্বীপে। কিন্তু এই নির্মম, হৃদয়হীন সমাজের কারণে চাপাকলির মতো আঙুল সমুদয় ইস্পাতের কাঠিন্যে বজ্রমুষ্টিতে রূপায়িত হলো। কণ্ঠ মিললো শত কন্ঠের সাথে। শামিল হলো রাজপথে।
প্রকৃতপক্ষে এই উপন্যাসের কোন নায়ক বা নায়িকা নেই। এ উপন্যাসের নায়ক হতে পারে অর্ক অথবা ওই দুই মেয়ে অথবা আমি, আপনি যে কেউ যাদের মনে দ্রোহ আছে, বুকে সাহস আছে, চিত্তে আছে কোটি কোটি মানুষের জন্য ভালোবাসা।
বই : গুম
লেখক : মাহমুদুর রহমান মান্না
পাঠকমূল্য : ২০০ ৳
যোগাযোগ ✪ ০১৯১২৬৫৬৭৪১