01/11/2025
এক সময়, জার্মানির বাজার ছিল এক ধরনের স্বস্তির জায়গা। তুর্কি, পোলিশ, আর স্থানীয় ব্যবসায়ীরা বছরের পর বছর ধরে এক শান্ত পরিবেশে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছিল। তারা জানত, প্রতিযোগিতা থাকলেও তার মধ্যে সম্মান আর শৃঙ্খলা আছে। দাম ছিল স্থিতিশীল, আর লাভও ছিল মডারেট—সবকিছু ছিল নির্দিষ্ট একটি ধারা। সেই ব্যবসা ছিল টেকসই, আর পুরনোদের মধ্যে ছিল এক অঘোষিত বোঝাপড়া। এখানে কেউ একে অপরকে আঘাত করে ব্যবসা করত না। এটা ছিল একটা নিরব শান্তিপূর্ণ সমঝোতা।
তবে, একদিন এক বাংলাদেশি ব্যবসায়ী, নাম রাশেদ, হঠাৎই সেই শান্ত বাজারে প্রবেশ করলেন। তিনি গার্মেন্টস ইন্ডাস্ট্রির অভিজ্ঞ, কিন্তু তার চোখে ছিল নতুন কিছু। তার মাথায় ঘুরছিল এক অসাধারণ পরিকল্পনা। তিনি ভাবলেন, “কেন এই পোশাকগুলো এত দামে বিক্রি হবে? আমি যদি বাংলাদেশে তৈরি করে কম দামে বিক্রি করি, তবে তো সবাই আমার কাছ থেকে কিনবে!”
তখনকার বাজারে সাধারণ পোশাক বিক্রি হতো ৫০–৬০ ইউরোতে, আর কিছু কিছু পণ্যের দাম ৭০–৮০ ইউরো পর্যন্ত থাকত। এসব ব্যবসায়ীরা সাধারণত নির্দিষ্ট দামে বিক্রি করে লাভের অঙ্কে স্থিতিশীল থাকতো। কিন্তু রাশেদ ভাবলেন, কেন না তিনি এই পোশাকগুলো বাংলাদেশে তৈরি করে আনতে পারেন কম দামে। ঠিক সেজন্য, তিনি ২৫–৩০ ইউরোতে সেগুলো বিক্রি করা শুরু করলেন।
এত কম দামে পোশাক বিক্রি হওয়ার কথা কেউ ভাবেনি। প্রথমে, সবাই হতবাক—তুর্কি, পোলিশ, সব ব্যবসায়ীরা সিল গেছিল। ক্রেতারা একে একে রাশেদের দোকানে ছুটে আসতে লাগল। কিছু মাসের মধ্যে তার দোকানটি পুরো বাজারের একমাত্র ঠিকানা হয়ে উঠল। এরপর রাশেদ দোকানদারদের বললেন, “তোমরা এখন নাও, বিক্রি করো, পরে টাকা দিও।” খুব শীঘ্রই পুরো সাপ্লাই চেইনটাই বদলে গেল। টাকা আর ক্যাশ লেনদেন তো প্রায় বন্ধ হয়ে গেল, সবাই "বাকি" আর "ধারের" ব্যবসায় ঝুঁকে পড়লো।
এদিকে, অন্য ব্যবসায়ীরা হতাশ হয়ে গেল। যারা আগে দাম নিয়ন্ত্রণ করে ভালো চলছিল, তারা এখন টিকে থাকার জন্য হিমশিম খাচ্ছিল। তুর্কি আর পোলিশরা তো সোজা হারিয়ে গেল। তাদের ব্যবসার ঝুঁকি এতটা বেড়ে গিয়েছিল যে তারা শেষপর্যন্ত রাশেদের পথ অনুসরণ করতে বাধ্য হলো।
কিন্তু যে সিস্টেম একসময় অনেক সফল ছিল, সেই সিস্টেমই এখন অস্থিতিশীল হয়ে পড়লো। পুঁজি তো বটেই, ব্যবসায়ীরা নিজেদের সম্মানও হারাতে লাগলো। রাশেদ তার লাভের দিকে এতটাই তীব্র মনোযোগ দিয়েছিলেন, যে তিনি বুঝতেই পারেননি বাজারের টেকসই উন্নতি কীভাবে করা যায়। আসলে, তার এক ভুল ছিল—সে কেবল নিজের লাভই দেখল, কিন্তু ইন্ডাস্ট্রির দীর্ঘমেয়াদী ফলাফলটাও বুঝতে পারল না।
রাশেদ যদি একটু ভেবে দেখতেন, এই যে একধরনের স্থিতিশীলতা বজায় রাখা যায়, তার মধ্যে তিনি হয়তো এক বা দুই ইউরো কমিয়ে বাজারে ভারসাম্য রাখতে পারতেন। এতে লাভের পরিমাণ হয়তো কিছুটা কম হত, তবে বাজারও টেকসই থাকত। শ্রমিকরা হত আরো স্বস্তিতে, আর ব্যবসাও আরো স্থায়ী হতে পারতো। কিন্তু রাশেদ তা বুঝতে পারলেন না।
ফলস্বরূপ, আজকের বাজারে সবাই সেখানে আছে, কিন্তু শান্তি কোথাও নেই। সবাই জানে—বাজারটা এখন শুধু লাভের খেলা, কিন্তু কেউ বুঝে না, এই খেলাটাই একটা দিনের জন্য মজার হলেও, পরবর্তীতে সবকিছু দেউলিয়া হয়ে যেতে পারে।
এটাই হলো সেই বাংলাদেশি ব্যবসায়ীর গল্প, যে বাজার দখল করতে জানে, কিন্তু বাজার টিকিয়ে রাখার চেয়ে শুধু নিজের লাভটাই ভেবেছিল।