21/11/2025
গুরুদাসপুরে ‘মুক্তমঞ্চ’ এখন মুত্রাগার
প্রতি মাসে একটি করে নাটক মঞ্চস্থ হতো। প্রতি সন্ধ্যায় বসতো গানের আসর। সুরের মূর্ছনায় নিজেদের ভাসিয়ে দিতেন নানা বয়সি সংস্কৃতিমনারা। শিশুরা এসে গাইতো, নৃত্য করতো। উপভোগ করতে ভীড় জমাতেন দর্শনার্থীরা। এসবের আয়োজন ছিল একটিমাত্র ‘মুক্তমঞ্চ’কে ঘিরে। সেই ‘মুক্তমঞ্চ’ এখনো আছে। কিন্তু হারিয়ে গেছে নাচ-গান আর মঞ্চ নাটক।
সর্বশেষ ২০১০ সালের দিকে এই মঞ্চে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়েছে। এরপর অযতœ অবহেলায় ধীরে ধীরে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছে। মুক্ত সংস্কৃতি চর্চাও মুখ থুবরে পড়ে আছে। মুক্তমঞ্চটি নাটোরের গুরুদাসপুর পৌর সদরের ব্যস্ততম শহর চাঁচকৈড় বাজারের পাদদেশে অবস্থিত।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ১৯৯৩ সালে নবকুঁড়ি নাট্য সংস্থা ও স্বরলীপি শিল্পী গোষ্ঠিসহ স্থানীয় শিল্পীদের সংস্কৃতি বিকাশের জন্য মুক্তমঞ্চটি নির্মাণ করেন তৎকালিন পৌর চেয়ারম্যান মশিউর রহমান বাবলু। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে নিহত শহীদদের স্বরণে মুক্তমঞ্চের ভবনে লাল হরফে লেখা হয় ‘যাঁদের রক্তে স্বাধীন এ দেশ’। কিন্তু দেড় দশকের ব্যবধানে মুক্ত সংস্কৃতির এই মঞ্চ এখন দুর্গন্ধের মুত্রাগারে পরিণত হয়েছে। বেদখল হয়ে যাচ্ছে মঞ্চের জায়গা। মঞ্চের সামনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ময়লা আবর্জনা। গড়ে উঠেছে কিছু অস্থায়ী স্থাপনাও।
স্থানীয় নাট্য ও সঙ্গীত শিল্পীরা জানান, গুরুদাসপুরসহ পার্শ্ববর্তী তাড়াশ, বড়াইগ্রাম ও সিংড়া উপজেলার সাংস্কৃতিমনা মানুষদের আনাগোনা ছিলো এই ‘মুক্তমঞ্চে’। বিকশিত হতে থাকে সংস্কৃতি চর্চা। গড়ে ওঠে চাঁচকৈড় কিশোর সঙ্গীত একাডেমী, গুরুদাসপুর শিল্পকলা একাডেমী, লালন পরিষদের মতো সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানও। ‘মুক্তমঞ্চে’ উৎসব মুখর পরিবেশে নাচ, গান আর মঞ্চ নাটক আয়োজন করতো এসব প্রতিষ্ঠান। মাঝে মাঝে রাজনৈতিক অনুষ্ঠানও ঠাঁই পেত।
নবকুঁড়ি নাট্য সংস্থার সভাপতি আলী আক্কাছ জানান, তাদের দাবির কারণেই নব্বই দশকে ‘মুক্তমঞ্চ’ নির্মিত হয়। ‘ঘাটের মরা’ মঞ্চায়িত হওয়ার মাধ্যমে মুক্তমঞ্চের যাত্রা শুরু। এরপর একে একে মঞ্চায়িত হয়- নাটক ‘স¤্রাট বাহাদুর শাহ, টাকার দোষ, বাঁচতে চাই, চেয়ারম্যান, সতর্ক হোন, এ লাশ কবরে থাকবে না’। এসব নাটক এলাকার মানুষের মধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলে। যোগাযোগ ব্যবস্থা অপ্রতুল্য হলেও প্রতি মাসেই ‘মুক্তমঞ্চে’ নাটক দেখতে ভিড় জমাতেন সংস্কৃতি প্রেমীরা। তৈরি হতে থাকে অনেক কবি, লেখক, শিল্পী।
স্বরলীপি শিল্পী গোষ্ঠির সাধারণ সম্পাদক মঈনুল ইসলাম বলেন, প্রথম এক দশকে স্থানীয় শিল্পীরা মুক্তমুঞ্চকে ঘিরে সাংস্কৃতিক চর্চা চালিয়েছেন। রাজনৈতির বহুমাত্রিক প্রভাব, বহিরাগত শিল্পী এনে অনুষ্ঠান আয়োজন, স্থানীয় শিল্পীদের অবমূল্যায়ণ সহ নানা কারণে ‘মুক্তমঞ্চ’ নিজস্ব স্বকিয়তা হারায়। সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বরা হারিয়ে যায় প্রতিভা বিকাশ করা থেকে। ২০০৮ সাল নাগাদও মুক্তমঞ্চে নাটক, গান বাজনা আর নৃত্য হয়েছে। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকারের দীর্ঘ শাসনামলে বহিরাগত শিল্পীদের এনে সাংস্কৃতিক চর্চা করায় কমে যায় স্থানীয় শিল্পীদের কদর। ধীরে ধীরে জৌলুস হারায় মুক্তমঞ্চটিও। সংস্কারের অভাবে মুক্তমঞ্চটি এখন ব্যবহারের অনুপযোগি হয়ে পড়েছে।
লালন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক শামীম আহমেদ বলেন, বর্তমানে মুক্তমঞ্চের আশপাশ স্থায়ী-অস্থায়ী মুত্রাগার আর ময়লার ভাগার। দূর্গন্ধে নাকাল স্থানীয়রা। মুক্তমঞ্চ ভবনের তিনটি কক্ষের তিনটিই জরাজীর্ণ হয়ে পড়েছে। সংস্কার করে মঞ্চটি সাংস্কৃতিক পরিবেশনার উপযোগী করার দাবি তার।
কবি ও কলামিস্ট জালাল উদ্দিন শুক্তি বলেন, মুক্তমঞ্চে তার লেখা বেশ কিছু নাটক মঞ্চায়িত হয়েছিল। মুক্তমঞ্চের কার্যক্রম বন্ধের সাথে সাথে তার মঞ্চ নাটক লেখাও বন্ধ হয়ে গেছে।
পৌরসভার সাবেক চেয়ারম্যান বিএনপি নেতা মশিউর রহমান বাবলু, চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার পর স্থানীয় শিল্পীদের দাবির মুখে তিনি ‘মুক্তমঞ্চ’টি নির্মাণ করেন। স্থানীয় শিল্পীদের নানা আয়োজনে উৎসবমুখর হয়ে থাকতো মঞ্চটি। অথচ অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে সেই মুক্তমঞ্চটি। এলাকার সাংস্কৃতিক চর্চা ফিরে আনতে মুক্ত মঞ্চটিকে রক্ষার দাবি তার।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও পৌর প্রশাসক ফাহমিদা আফরোজ বলেন, গুরুদাসপুরের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে ‘মুক্তমঞ্চে’র ইতিহাস খুবই সমৃদ্ধ। দ্রুত অর্থবরাদ্দের মাধ্যমে মুক্তমঞ্চটি সংস্কার করে সাংস্কৃতিক অঙ্গনকে দৃষ্টিনন্দন করা হবে।