
04/03/2023
"লাল মেঘে বৃষ্টি ঝরে আদিবাসী কোনো গ্রামে
তোমার কান্না আমার কান্না ঝিরিপথ হয়ে নামে।"
কোক স্টুডিও বাংলার বনবিবি শিরোনামে প্রকাশিত এই গানের লাইন সকলেরই পরিচিত হয়ে উঠছে ইতিমধ্যেই। ঝিরিপথে কান্না না নামলেও ঝিরিঝিরি পথে যে প্লাস্টিক নামে এই নিয়ে আমাদের সন্দেহ থাকার কথা না।
বনবিবি শিরোনামে প্রকাশিত বনবিবি আসলে কে? কি তার পরিচয়?
বনবিবি হলেন বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গের অন্তর্গত সুন্দরবন অঞ্চলে মৎস্যজীবী, মধু-সংগ্রহকারী ও কাঠুরিয়া জনগোষ্ঠীর দ্বারা পূজিত এক লৌকিক দেবী তথা পিরানি। উক্ত জনগোষ্ঠীর মানুষেরা বাঘের আক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে বনবিবির পূজা করে। বনবিবি বনদেবী, বনদুর্গা, ব্যাঘ্রদেবী বা বণচণ্ডী নামেও পরিচিত।
বনবিবি তার ভক্তদের ডাকে সাড়া দিয়ে বাঘ থেকে রক্ষা করেন কিনা জানি না। বাঘের হাত থেকে মানুষের রক্ষা পাওয়ার অনেক গল্প শোনা গেলেও প্লাস্টিক নামক বাঘের হাত থেকে বনকে রক্ষা করা যাবে কি না তার উত্তর হয়তো আমরা কেউই দিতে পারবো না। একটি গবেষণায় দেখা যায় ব্রক্ষপুত্র, যমুনা, গঙ্গা, পদ্মা, যুমনা মতো নদী গুলো বঙ্গোপসাগরে পতিত হওয়ার আগে বছরে ৭২০০০ টন প্লাস্টিক বয়ে নিয়ে যায়। বঙ্গোপসাগরের কোল ঘেঁষা সুন্দরবন যা ঘূর্ণিঝড়ের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগে বাংলাদেশের ঢাল হয়ে থাকে সব সময় যা এই প্লাস্টিক দূষণের কবল থেকে মুক্ত হয়। এই প্লাস্টিক দূষণ সুন্দরবনের জৈববৈচিত্র ধ্বংসের অন্যতম কারণ।
প্লাস্টিক দূষণের আলোচনায় কোকাকোলা কোম্পানির নাম আসাটাই খুব স্বাভাবিক। আমাদের
দৈনন্দিন জীবনের সবচাইতে প্রচলিত পানীয় কোকাকোলা বছরে ৩ মিলিয়ন টন প্লাস্টিক বোতল তৈরি করে তাদের পণ্য বাজারজাত করার জন্যে, যা মিনিট প্রতি ২ লাখ বোতল প্রায়। এত পরিমাণ প্লাস্টিক উৎপাদনের কারনে ইতিমধ্যেই কোকাকোলার গায়ে বিশ্বে সবচেয়ে বড় প্লাস্টিক দূষণকারীর তকমা।
যদিও কোকাকোলার ভাষ্য মতে তাদের তৈরিকৃত প্লাস্টিক বোতল শতভাগ রিসাইকেল করা যায়। তারা আরও জানায় তারা তাদের বোতল গুলো আর সর্বাধিক ইকো-ফ্রেন্ডলি ভাবে তৈরির করার চেষ্টা করছে। তাদের লেবেলিং এ ব্যবহৃত সেলোফেন প্লাস্টিকটিতেই লক্ষ্য করলে তা দেখা যায়। মোটা মানের প্লাস্টিক থেকে বেরিয়ে এসে তারা পাতলা প্লাস্টিক ব্যবহার করছে তাদের বোতলের লেবেলিং করতে। যা আসলেই প্রশংসনীয়।
কিন্তু বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশ যেখানে কোকাকোলার বাজার অনেক বড়। মানুষের ক্রয় ক্ষমতার সাথে মিল রেখে কোকাকোলা হয়ে উঠেছে বাংলাদেশী ভোক্তাদের নিত্য ব্যবহার্য পানীয়। বাংলাদেশে হরহামেশাই কোকাকোলার বিজ্ঞাপন দেখা যায়। কোকাকোলা বাংলাদেশের বিজ্ঞাপনের ক্ষেত্রে সব সময়ই বাংলাদেশ উৎসব গুলোকে মূল লক্ষ্য হিসেবে ব্যবহার করে এসেছে। ঈদ, পুজো কিংবা পহেলা বৈশাখের মতো উৎসবে কোকাকোলার বিজ্ঞাপন দেখা যায় সর্বত্র। আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশে যেখানে কনজিউমার বিহেভিয়ার অনেক বড় ইস্যু সেখানে কোকাকোলা শুধু মাত্র ১০০% রিসাইকেলএবল বোতল বাজারজাত করে তাদের দায় এড়াতে পারে না। আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষই যেখানে এক বোতল কোক খেয়ে সেই বোতলটি রাস্তায় ফেলে দেয়, তারপর সেই বোতলের ঠিকানা কোথায় হয় তা আমাদের কারওই অজানা নয়। সেখানে কোকাকোলার কোনো মাথা ব্যাথাই নেই তাদের রিসাইকলএবল বোতল সম্পর্কে ভোক্তাদের সচেতন করার ব্যাপারে। তাদের উল্লেখ যোগ্য কোনো কার্যক্রমই লক্ষ্য করা যায় না সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য। কোকাকোলা স্পন্সরড কোক- স্টুডিও যাদের মূল লক্ষ্য কোকাকোলার ভোক্তাদের উৎসবের অংশ হওয়া। এবং তারা এই কাজে মোটামুটি সফলও বলা চলে। কোক স্টুডিও এর কনসার্টে বাংলাদেশে মানুষের উপস্থিতি তাই জানান দেয়। তাদের এই প্ল্যাটফর্ম যা সরাসরি তাদের ভোক্তাদের সাথে সম্পৃক্ত কিন্তু তাতেও তাদের ভোক্তাদের সচেতন করার ব্যাপারে উল্লেখ যোগ্য কোনো কার্যক্রম লক্ষ্য করা যায় না। একটি কর্পোরেট কোম্পানি হিসেবে যদিও ভোক্তাদের মাঝে রিসাইকল বিহেভিয়ার প্রাকটিসিং করানো কোকাকোলার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না৷ তবে আমাদের মতো দেশ গুলো ক্ষেত্রে তারা এ কাজটি করতেই পারেন যাতে করে তাদের রিসাইকেল করার উদ্দেশ্য সফল হয়। রিসাইকেল করার উদ্দেশ্য সফল করা না গেলে কোনো এক সময় হয়তো দেখা যাবে প্লাস্টিকের ভয়ানক থাবায় আমাদের সুন্দরবনও একটি লোকশ্রুতি হয়ে উঠবে।