15/09/2025
বাংলার আকাশ থেকে হারিয়ে গেল একটি জীবন্ত লাইব্রেরি
হাফেয আহমাদুল্লাহ সাহেব
জন্ম আর মৃত্যু আল্লাহর হাতে। আজ হাফেয আহমাদুল্লাহ সাহেব যাত্রা করলেন তাঁর রবের সান্নিধ্যে।
ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।
আমার শাইখুল হাদিস, হাফেয আহমাদুল্লাহ সাহেব—যার কিতাবপ্রীতি ছিল সমুদ্রের গভীরতার মতো, আর দুনিয়ার হালচাল ছিল তাঁর কাছে বালুকণার মতো তুচ্ছ। আমি সৌভাগ্যবান, তাঁকে খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছিল ২০০৪ সালে, পটিয়া মাদরাসার দাওরায়ে হাদিস পড়ার সময়ে।
হুজুর সম্পর্কে একটি কথা আমরা শুনেছিলাম, যা হয়তো অনেকেই জানেন না—
তিনি ছিলেন আল্লামা তাকি উসমানি সাহেবের ক্লাসমেট। অবাক করা বিষয় হলো, সেই ক্লাসে প্রায়ই প্রথম হতেন আহমাদুল্লাহ সাহেব, আর দ্বিতীয় হতেন তাকি উসমানি সাহেব। শুনে তখন মনে হয়েছিল—এ যেন ইতিহাসের গোপন অধ্যায়, যা শুধু পটিয়ার বাতাসই জানে।
আমি ইমাম গাজ্জালিকে দেখিনি, দেখিনি ইমাম সুয়ুতির মতো এলেমপাগল মহা মানবদের। কিন্তু আমি দেখেছি হাফেয আহমাদুল্লাহ সাহেবকে—একজন মানুষ, যিনি খাওয়া, অল্প ঘুম আর প্রয়োজনীয় কাজ ছাড়া তাঁর পুরো জীবন সমর্পণ করেছিলেন কিতাবের পাতায়। মনে হতো তিনি কিতাব পড়ছেন এমন নয় বরং, কিতাবই তাঁকে গিলে নিয়েছে।
একটি দৃশ্য আমার আজও চোখে ভাসে—
পটিয়াতে ভর্তি হতে গেলে হুজুরই নিয়েছিলেন আমার ভর্পতি রীক্ষা। আমি তাঁর কামরার সামনে দাঁড়িয়ে সালাম দিয়েছিলাম। আধাঘণ্টা দাঁড়িয়ে রইলাম, একবার, দু’বার, তিনবার সালাম দিলাম—কোনো উত্তর নেই। ভেতরে একজন মানুষ চৌকিতে বসে আছেন, নুয়ে পড়ে, যেন সমুদ্র ডুবে আছে পাতার ভেতর। চারপাশের পৃথিবী যেন তাঁর কাছে অস্তিত্বহীন। আধাঘণ্টা পর তিনি মাথা তুললেন, আমার একটি সালাম তাঁর কানে পৌঁছল। তারপর শুধু একবার দৃষ্টিপাত, আর একটি অনুমতি। আমি ভেতরে ঢুকলাম—সেই মুহূর্তে মনে হয়েছিল আমি এক আধ্যাত্মিক জগতের দরজায় প্রবেশ করেছি।
হুজুরের হয়তো লেখা কম, কিন্তু পড়ার পরিমাণ ছিল অকল্পনীয়। পৃথিবীতে এমনও কিছু মানুষ আছে যাদের জন্য গুনাহের রাস্তা বন্ধ হয়ে যায়—হুজুর ছিলেন তাদের একজন। কিতাবের দিকে তাকানো ছাড়া জীবনে আর কিছুতে তাঁর মন স্থির হয়নি। গুনাহের চিন্তা আসারও সুযোগ ছিল না।
আজ যখন তিনি চলে গেলেন, মনে হচ্ছে একটি যুগ শেষ হলো।
একটি মাদরাসার আঙিনা, একটি গ্রন্থাগারের নিঃশব্দতা, একটি উম্মাহর গৌরব—সব একসাথে জান্নাতের পথে রওনা দিল। আমার জানা নেই এমন কিতাবের পোকা জীবন্ত আকাবিরের প্রতিচ্ছবি আরো একজন বেচে আছেন কিনা।
আমি ভাগ্যবান—হুজুরের কাছে মুসলিম শরীফ পড়েছি।
অল্প সময় হলেও, তাঁর সুহবত পেয়েছি।
এটাই আমার জীবনের এক অমূল্য সম্পদ।
আল্লাহ তাঁর এই বিশেষ বান্দাকে জান্নাতুল ফেরদাউস দান করুন।