26/12/2024
কবির কিছুটা ভ্যাবাচেকা খেয়ে ওর দিকে তাকালো। সুনেরাহ সত্যি সত্যিই ওকে বিয়ে করতে রাজি হয়ে গেছে? আনন্দে যেন কিছুক্ষণ ওর মুখ দিয়ে কোনো কথাই বের হলো না। সুনেরাহ নিজে থেকেই কিছু বলতে যাবে, এমন সময় হঠাৎ বিছানার উপর তার ফোনের রিংটোন বেজে উঠলো। কবির সেদিকে তাকিয়ে দেখে, নাম্বারটি "ডিয়ার হাজবেন্ড" বলে সেভ করা। কবিরের এভাবে তাকিয়ে থাকা দেখে সুনেরাহও মনে হলো বেশ ভয় পেয়েছে।
কবির একদৃষ্টিতে ওর মোবাইলের দিকে চেয়ে আছে। ব্যাপারটা খেয়াল করে সুনেরাহ তড়িৎগতিতে তার ফোনটা পাশে সরিয়ে আড়াল করে কেটে দিলো। সম্পর্ক শুরু হবার আগেই কবিরের মনে সন্দেহ বাসা বাধে। মানুষ মাত্রই যেমন ভুল,তেমন মানুষ সর্বদাই বেঈমানীর আরেক রুপ বহন করে।
কবির কিছুটা কঠিন সুরেই জিজ্ঞাসা করে,
—কোনো সমস্যা, মিস সুনেরাহ? গুরুত্বপূর্ণ কেউ কল করেছে মনে হচ্ছে। সমস্যা নেই৷ আমি ডাইনিংয়ে যাচ্ছি। আপনি কথা শেষ করুন।
—আরে না, না। এমন কিছু নয়। আসলে আজ আমাকে পাত্রপক্ষ দেখতে আসছে,এটা আমার প্রাক্তণ শশুরবাড়ির লোকও জেনে গেছে। তাই সেই বিকাল থেকেই কল দিয়ে খোঁজ নিচ্ছে। আর দেখছেন না? কলও করেছে অনিকের সীম থেকে। ওর নাম্বারটা তো আর কখনোই ডিলেট করতে পারিনি।
সুনেরাহ একবার বড় করেই দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। সেই দীর্ঘশ্বাসের ভারি হাওয়া যেন সোজা এসে লাগলো কবিরের বুকের ঠিক মাঝখানে। ছিঃ,ছিঃ, সামান্য এইটুকু কারণে এতক্ষণ তাকে কী না কী ভাবছিল সে! নিজের এই বোকামির জন্য নিজের উপরেই ভীষণ রাগ হচ্ছে ওর।
সুনেরাহকে আর কিছু না বলেই লজ্জায় আর সঙ্কোচে মাথা দুলিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে যায়। কবির বের হতেই সুনেরাহ যেন হাফ ছেড়ে বাঁচে। মোবাইল ফোনটা তাড়াতাড়ি সুইচ অফ করতে গিয়ে আবার রিংটোন বেজে ওঠে। সে কিছুটা ভয়ে ভয়েই কল রিসিভ করে বললো,
— বারবার কল দিচ্ছো কেন? পাত্রপক্ষ আমাকে দেখতে এসেছে, জানো না?
ওপাশ থেকে যে জবাব এলো, তা স্পষ্ট করে শোনা গেল না। তবে মুহুর্তেই সুনেরাহ তার মোবাইল ফোন বন্ধ করে ডাইনিং রুমে ফিরে আসে।
(২)
সুনেরাহ'র সাথে নিজের একমাত্র ছেলের বিয়ের কথা সম্পূর্ণরুপে পাকাপোক্ত করেই রাফিয়া রহমান বাড়ি ফিরেছেন। আর বাড়ি ফিরেই বিয়ে নিয়ে বেশ তড়িঘড়ি শুরু করে দিলেন। হাজার হোক, তার একমাত্র ছেলের বিয়ে বলে কথা। বিয়েতে কোনো ত্রুটি রাখা যাবে না। কবির কেবলই অবাক হয়ে তার মাকে দেখছে।
নিজের মাকে সে যতটুকু চেনে, এই ভদ্রমহিলা কোনো বিধবা,এক বাচ্চার মায়ের সাথে নিজের ছেলের বিয়ে দিতে চাইবেন না। তাহলে সুনেরাহ'র মাঝে তিনি কী এমন দেখলেন? কবিরের মনে মায়ের এই বিষয়টা নিয়ে বেশ খটকা লাগে।
রাফিয়া রহমান নিজের বিছানায় শুয়ে আয়েস করে বসে মোবাইলে অপরিচিত কারো একজনের কথা বলছেন।
"ছেলের একটা ব্যবস্থা করেই ছাড়লাম। এই বিয়েই আমার ছেলের ভাগ্য ফেরাবে। আপনি দেখে নিয়েন। যদিও হাতে এখনও যথেষ্ট সময় আছে। কিন্তু তাতে কী? শুভ কাজে দেরি করা ভালো নয়। যত দেরি, তত সংশয়। পরে যদি এমন পাত্রী হাতছাড়া হয়ে যায়? তখন কী করবো আমি!"
দরজার পাশে দাঁড়িয়ে মায়ের সমস্ত কথোপকথনই শুনছে কবির। মায়ের এইরুপ আচরণ তাকে আরও যেন ঘেটে দিচ্ছে। এবাড়িতে তার বিয়ে নিয়ে কী এমন বিষয় চলছে! সে রাফিয়া রহমানের দরজায় কড়া নাড়লে তিনি সচকিত ভঙ্গিতে মুহুর্ত সময় চেয়ে রইলেন। কবির ভিতরে ঢুকে মায়ের হাত ধরে জিজ্ঞাসা করে,
—তুমি ঠিক আছো মা?
—একদম। কেন? আমার আবার কী হবে?
—সেটাই তো জানতে চাইছি। মা, একটা সত্যি কথা বলো তো। আমি তোমাকে যতটুকু জানি,তুমি সুনেরাহ'র মত এতগুলো বাহ্যিক দোষে পরিপূর্ণ মেয়ের সাথে আমার বিয়ে তো কখনোই হতে দেবে না। অন্যান্য আত্মীয়দের ক্ষেত্রেও তোমার আচরণ আমি দেখেছি। তাহলে আজ কেন? তাও আবার আমাকেই!
—তোর কী মেয়েটাকে পছন্দ নয়?
—আরে না মা। ওকে আমার অনেক পছন্দ। কত আত্মসম্মানবোধ সম্পন্ন মেয়ে। সেই সাথে বুদ্ধিমতীও।
—সুনেরাহ'কে বুদ্ধিমতী মনে হচ্ছে?
রাফিয়া রহমান কিছুটা ভড়কে গেলেন। শেষ কথাটি তিনি যে সুনেরাহ'র ক্ষেত্রে একদমই আশা করেননি, তা তার মুখভঙ্গি দেখেই অনুমান করা যাচ্ছে। ছেলের সামনে জোরপূর্বক নিজেকে সামলে নিয়ে তিনি বললেন,
—আরে, তুই কী আমাকে এতই নীচু চিন্তাভাবনার মানুষ মনে করিস নাকি?
কেউ যোগ্য হলে তার সেই যোগ্যতার কদর করতে জানতে হয়। আমিও তাই করেছি। দেখ কবির, সুনেরাহ'র ব্যাপারে আমি যথেষ্ট খোঁজ খবর নিয়েছি। মোটামুটি বেশ শিক্ষিত, ভদ্র, মানুষের সাথে সম্মান দিয়ে কথা বলে। আশেপাশের মানুষের কাছে তুই যদি মেয়েটার ব্যাপারে প্রশ্ন করিস, সবাই একটাই উত্তর দেবে-"অমন মেয়ে এই যুগে পাওয়া ভার"। তাছাড়া তুই নিজের চোখেই দেখলি না কীভাবে তোর সাথে বিয়ে ক্যান্সেল করতে চাচ্ছিলো!
—হ্যাঁ মা, সবই দেখেছি, বুঝেছিও। কিন্তু তোমাকে দেখে বুঝতে পারছি না। ছোট মামা কখন আসবেন?
—তোর বিয়ের কেনাকাটা করতে গেছে। পরশুই তো বিয়ে। ঘরোয়াভাবে বিয়ের আয়োজন করছি তো কী হয়েছে? বউমার কোনো কিছুর কমতি আমি রাখতে চাই না, বুঝলি?
কবির আর কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ মায়ের ঘর থেকে বের হয়ে আসে। তার অগোচরে কিছু তো একটা চলছেই। কিন্তু কী চলছে? পর্তুগাল থেকে "বিজনেস ম্যানেজমেন্ট" নিয়ে পড়াশোনা করে এসেছে সে। যদিও মা এবং ছোট মামার ইচ্ছে ছিল ডাক্তারি পড়ে কবির তার মামার প্রাইভেট হাসপাতালেই যুক্ত হোক।
কিন্তু নানান রকম জোর করলেও কবিরের জিদের কাছে কেউ জিততে পারেনি। পড়াশোনা শেষ করে বর্তমানে একটি প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরিও জুটিয়ে নিয়েছে। আর সেই সাথে শুরু হয়েছে তার মায়ের তাকে নিয়ে বিয়ের তোড়জোড়।
বারান্দায় বসে অনেক রাত জেগে প্রায় দুটোর দিকে কবিরের দু'চোখ টেনে আসতে শুরু করে। ঘুমের ঘোরে একরকম টলতে টলতেই সে বিছানায় এসে বসে। দূরের রাস্তায় একনাগাড়ে রাস্তার কুকুরগুলো ঘেউঘেউ করে ডাকছে। পথে নিশ্চয় কোনো অপরিচিত পথচারী দেখেছে সে। আশেপাশে আর তেমন কোনো শব্দ নেই।
জানালার পাশেই কোনো গাছ থেকে একটা দুটো পাতা ঝরে পড়লো। কবিরের মনে হচ্ছে,সেই পাতা ঝরে পড়ার শব্দও সে শুনতে পেল। ঘুম ঘোরঘোর চোখে জোরপূর্বক তাকিয়ে কান খাড়া সে বেশ আগ্রহ নিয়েই পাতা ঝরার শব্দ শোনার চেষ্টা করে। ঠিক এমনই এক মুহুর্তে সুনেরাহ'র নাম্বার থেকে কল এলো।
কবির সিনেমার নেশাড়ু অভিনেতাদের মত ঘুমের নেশায় নেশাগ্রস্থ হয়ে ঘাড় কাঁত করে নাম্বার দেখার চেষ্টা করে।
"সুনেরাহ এত রাতে কল দিয়েছে!"
স্ক্রিণে ঘড়ির সময় দেখে সে এমনভাবে আঁৎকে ওঠে যে, মুহুর্তেই তার ঘুম হাওয়ায় মিলে গেল। ওপাশ থেকে সহাস্যে সুনেরাহ জিজ্ঞাসা করলো,
—আমার কেন জানি মনে হচ্ছিলো আপনি এখনও ঘুমোননি। শেষ পর্যন্ত আমার ধারণা সঠিক হলো। তাই না বলুন?
—ঠিক তা নয়। মাত্রই ঘুমোতে যাচ্ছিলাম। ঘুমের ঘোরে মরি মরি অবস্থা আমার।
—মাত্র! এখন রাত দুটো পনেরো বাজে।
কবির সহসা জবাব দিতে পারে না। এতক্ষণ তার সত্যিই যে ঘুম আসছিল না- একথা ধামাচাপা দেবার মত বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ নয়। তার চেয়ে মৌনতাই উত্তম। ওপাশ থেকে সুনেরাহ আবার বললো,
—আমারও ঘুম আসছে না। সব কেমন যেন অদ্ভুত লাগছে। এভাবে হঠাৎ করে বিয়ে, শশুরবাড়ি! ছোট ওইটুকু মেয়ে নিয়ে এতকিছু সামলে মানিয়ে নেওয়া। সব কেমন যেন এলোমেলো লাগছে। আমি কী করছি, নিজেও জানি না। আমার কী করা উচিত বলুন তো কবির সাহেব। আমার নিশ্চিত হয়ে জানতে ইচ্ছে করছে, আপনি সত্যিই এই বিয়েতে রাজি?
সুনেরাহ'র কথায় কবিরের যেন বড্ড মায়া হলো। সুনেরাহ'কে খুব কাছ থেকে দেখে চোয়ালে হাত রেখে বলতে ইচ্ছে হচ্ছে—সব ঠিক হয়ে যাবে। আমি আছি তো। কিন্তু এবারও বলা হলো না।
—দেখুন, আল্লাহ কার কপালে কী লিখে রেখেছেন,এসব তিনিই ভালো জানেন৷ আর আমার সম্পর্কে যদি কিছু জানার থাকে৷ নিঃসঙ্কোচে আমাকে প্রশ্ন করবেন।
—আচ্ছা, এভাবে আপনার ঘুম নষ্ট করার বিশেষ প্রয়োজন নেই। মেয়েটা উঠে পড়েছে। গুড নাইট।
সুনেরাহ কবিরকে "গুড নাইট" বলার সময়টুকুও দিলো না। নিজের কথা শেষ হবার ন্যানো সেকেন্ডের মধ্যেই বোধহয় কল কেটে দিলো। খাটের পাশে হেলান দিয়ে পা দুটি ঝুলিয়ে সে মুচকি হেসে ভাবে আর বলে,
" নতুন করে তো আর কিছু জানার নেই কবির সাহেব। বাকিটা জানাজানি বরং ময়দানেই হয়ে যাবে!"
#জলতরঙ্গ ৩য় পর্ব
সুনেরাহ'র কথায় কবিরের যেন বড্ড মায়া হলো। সুনেরাহ'কে খুব কাছ থেকে দেখে চোয়ালে হাত রেখে বলতে ইচ্ছে হচ্ছে—সব ঠিক হয়ে যাবে। আমি আছি তো। কিন্তু এবারও বলা হলো না। সে বালিশে মাথা রেখে বলে,
—দেখুন, আল্লাহ কার কপালে কী লিখে রেখেছেন,এসব তিনিই ভালো জানেন৷ আর আমার সম্পর্কে যদি কিছু জানার থাকে৷ নিঃসঙ্কোচে আমাকে প্রশ্ন করবেন।
—আচ্ছা, এভাবে আপনার ঘুম নষ্ট করার বিশেষ প্রয়োজন নেই। মেয়েটা উঠে পড়েছে। গুড নাইট।
সুনেরাহ কবিরকে "গুড নাইট" বলার সময়টুকুও দিলো না। নিজের কথা শেষ হবার ন্যানো সেকেন্ডের মধ্যেই বোধহয় কল কেটে দিলো। খাটের পাশে হেলান দিয়ে পা দুটি ঝুলিয়ে সে মুচকি হেসে ভাবে আর বলে,
" নতুন করে তো আর কিছু জানার নেই কবির সাহেব। বাকিটা জানাজানি বরং ময়দানেই হয়ে যাবে!"
সুনেরাহ’র মনের খবর কবির জানে না। কে কাকে ঠকাতে চায়, তাও একে অপরের অজানা।
দেখতে দেখতে বিয়ের দিন ঘনিয়ে আসে। কবির গাঢ় খয়েরি রঙের একটা পাঞ্জাবি পরেছে। তার মাথার মাঝারি সাইজে চুলগুলো কেউ বোধহয় খুব যত্ন করেই আঁচড়ে দিয়েছে। কবিরকে কী ভারি সুন্দর লাগছে আজ। রাফিয়া রহমান নিষ্পলকভাবে ছেলের দিকে চেয়ে রইলেন।
যেন কতদিন তিনি নিজের ছেলেকে এমন মন ভরে দেখেননি। কবির মায়ের কাছে এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলো,
-মা, তোমার ছেলেকে কী চান্দের টুকরোর মত লাগছে?
-উঁহু , আমার ছেলে চাঁদের টুকরোর চেয়েও মূল্যবান। আল্লাহ তোকে হাজার বছর বাঁচিয়ে রাখুক বাবা।
-রাখবে, রাখবে। এবার তুমি আমাকে একটা সত্যি কথা বলো তো। তুমি ভিতরে ভিতরে কোন একটা বিষয় নিয়ে একা একাই বুকের ভিতর ক্ষত বানাচ্ছো। সেই ক্ষতটা আসলে কী মা? প্লিজ, আমাকে তুমি মিথ্যে বলবে না। আমি বাচ্চা ছেলে নই,তা তুমি জানো।
রাফিয়া রহমান ছেলের মুখখানা নিজের কাছে এগিয়ে ধরে কবিরের কপালে চুমু খেলেন। তারপর বললেন,
-বেশ, তোকে আমি সব বলব। তবে এখন নয়। বিয়ের পর। এখন এসব ছোটখাটো মন খারাপের কথা বলে তোর মুড অফ করতে চাই না। মায়ের উপর এইটুকু বিশ্বাস রাখ।
কবির আর কথা বাড়ায় না। এমনিতেই বেশ দেরি হয়ে গেছে তাদের। মায়ের পা ছুঁয়ে সালাম করে বেরিয়ে পড়ে। রাফিয়া রহমান ছেলেকে একা ছাড়তে চাচ্ছিলেন না,কিন্তু কবিরের ছোটমামার জন্য আর যেতে পারলেন না। বিয়ের সময় পাত্রীর বাড়িতে পাত্রের মায়ের যাবার নিয়ম নেই। যা কিছুই ঘটুক, তা তিনি একাই সামলে নিতে পারবেন।
কিন্তু বিয়ে বাড়িতে ছোটমামা সব সামলাতে পারলেন না। বিয়ে পড়ানোর ঠিক আগ মুহুর্তে সুনেরাহ হঠাৎ কবিরকে ডেকে বসলো। কন্ঠে বেশ কাঠিন্য টেনেই সে বললো,
-আমার কেমন সন্দেহ হচ্ছে।
–মানে? কীসের সন্দেহ!
-আপনারা ওবারিতে যাবার পর সত্যিই আমার সাথে একজন নতুন বউয়ের মত ট্রিট করবেন তো? আমার এত দোষ, এত ত্রুটি-সবটাই আপনারা মেনে নিচ্ছেন। পৃথিবীটা এত সহজে বদলে গেছে,এই কথাটা বিশ্বাস করতে কেন জানি প্রচন্ড কষ্ট হচ্ছে। আপনি প্লিজ আমাকে ভুল বুঝবেন না। আমার জায়গায় দাঁড়িয়ে একবার অনুভব করে দেখুন।
কবির ছোট করে একবার শ্বাস ফেলে। নারীর মন খুব সহজে কোনো বস্তু, কোনো ব্যক্তির উপরেই ভরসা করে না। একথা সেও জানে।
তবে এও সত্যি যে, একবার ওদের কারো প্রতি ওদের বিশ্বাস জন্মে গেলে, একবার কারো মায়ায় পড়ে গেলে, সারা দুনিয়া বিরোধীতা করলেও ওরা সেই বিশ্বাস আর মায়াটুকুই আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চায়। সে নিজের অজান্তেই সুনেরাহ’র একটি হাত নিজের মুঠির মধ্যে আগলে ধরে বললো,
-আপনার এমন দুশ্চিন্তার হেতু আমি উপলব্ধি করতে পারছি।
শুধু আপনি নন, এই সম্পর্কটা নিয়ে আমারও সংশয়ের শেষ নেই। কিন্তু সাহস করে কদম উঠাতে তো দোষ নেই। বাকি সব কেমন হবে আমি জানি না, কিন্তু আমি কবির, আমি আজ পর্যন্ত কোনো নারীর সাথে এমন প্রতারণার চেষ্টাও করিনি, যার দরূণ সে দুঃখ পায়। আর সেখানে আপনি তো আমার স্ত্রী হবেন! মিস সুনেরাহ, আমি আপনাকে অভয় দেব না। কিন্তু নিজের উপর ভরসা করে সৎ সাহসটুকু দেব।
আমি বুঝতে পারছি, আপনার সমস্ত চিন্তা আপনার মেয়েকে নিয়ে। তাই তো? আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি, আমার বাড়িতে প্রবেশ করার পর ওর আগামীর দিনগুলোর সমস্ত দ্বায়িত্ব আমার উপর থাকবে। আর আমি সেই ব্যবস্থা করবো।
কিন্তু ওর কথায় সুনেরাহ খুব একটা সন্তুষ্ট হলো বলে মনে হয় না। না হবারই কথা। স্বামীহারা সদ্য মা হওয়া একটি অল্পবয়সী নারী খড়কুটো ধরে বাঁচতে চায়।
যে লতা হাতের সামনে জোটে, সেটি আঁকড়ে ধরে থাকে। কিন্তু সুনেরাহ কী তাই? সে নিজের বোধ ও আত্মসম্মান নিয়ে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। তাছাড়া, মাত্র তেরোদিন আগে সে বাচ্চার মা হয়েছে। এর মধ্যেই রাফিয়া রহমান এই মেয়েকেই ছেলের বউ করার জন্য পাগল হয়ে যাচ্ছেন।
যদিও সম্বন্ধ পাকা হবার সময় কথা হয়েছে, অন্তত দুইমাস তারা একে অপরের ঘনিষ্ঠ হবে না। তারপরেও, হঠাৎ করে ব্যাপার এত সহজে মানিয়ে নেওয়াও অসম্ভব। এদেশের ইতিহাসে এমন অদ্ভুত ঘটনা কী এর আগে ঘটেছে?
কবির তার ছোটমামাকে ডেকে কোথায় জানি কল দিতে বললো। বরযাত্রী বিশেষ নেই। খুব কাছের বন্ধুবান্ধবসহ দুই পক্ষের হিসাবে সর্বোচ্চ আঠারো বা বিশের কাছাকাছি মানুষই হবে। রাগিব চেয়েছিল তার খালাকে কল দিতে।
কিন্তু সুনেরাহ কারোর সাথেই যোগাযোগ করতে দেয়নি। সে যখন যাবে, নীরবে চুপিচুপিই যাবে। আর একবার গেলে এবাড়িতে দ্বিতীয়বার ফিরে আসবে বলে মনে হয় না। হয়তো সেকারণেই কবিরের কাছে আরও অধিক কোনো ভরসা খুঁজছে।
ঘন্টাখানিক বিয়ে স্থগিত করার পর মোতালেব সরকার নামের এক উকিল হাজির হলেন। কবিরই তাকে ডেকেছে। সুনেরাহ একবার উকিলের দিকে আরেকবার কবিরের দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকায়। সে যে এখনও ঘোরের মধ্যে আছে, সেটা বুঝতে পেরে কবির বললো,
—সুনেরাহ, আপনাকে বিয়ে করার জন্য আমি টিনেজার ছেলেদের মত পাগল হয়ে যাইনি।
কিন্তু সেদিন দেখতে এসে আমরা যখন একে অপরকে পছন্দ করেছি, তাই নিজেদের মধ্যে কোনো খাদ কিংবা সংশয় কোনোটাই রাখতে চাই না। আপনি আমার জীবনে সেরাদের সেরা মানুষটিও নন। তবে যোগ্য মানুষ। বিয়ের পর অনুদিতি আমারও সন্তান। তাই সেই সন্তানের ভবিষ্যত নিশ্চিত করার দায়িত্ব আমারও। আমার সম্পত্তির অর্ধেক আমি অনুদিতির নামে লিখে দিচ্ছি।
সুনেরাহ হতভম্ব হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। কবির সত্যি সত্যিই তার মেয়ের নিরাপত্তার জন্য এত বড় একটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারছে! ব্যাপারটা যেন বিশ্বাসই হচ্ছে না ওর। কিছুক্ষণ ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থেকে সে বাধা দিয়ে বলে ওঠে,
—আমরা কী তবে দেনাপাওনা করছি!
—না। ভরসার জায়গাটি পোক্ত করছি। যদিও গতকাল রাতেই আমি এই বিষয়টি ভেবে রেখেছিলাম। আশা করি,এরপরে আমাকে ভরসা করতে তোমার দ্বিধা হবে না। মোতালেব ভাই, আপনি উইলটা সঙ্গে এনেছেন?
মোতালেব সরকার উইলের সমস্ত কাগজপত্র কবিরকে বুঝিয়ে দিলেন। কবির সেগুলোতে স্বাক্ষর করে সুনেরাহ'র হাতে তুলে দেয়। এরপর তার আর কিছুই বলার থাকে না। অবশ্য বলতেও হলো না। ঠিক যেমন হাঙ্গামার গতিতে প্রশ্ন উঠেছিল, তেমন গতিতেই নীরবতা বজায় রেখে দুজনের বিয়ে পড়ানো হয়ে গেল।
ছেলে যে পাত্রীপক্ষের বাড়িতে এমন বিচ্ছিরি কান্ড করে বসে আছে, তা রাফিয়া রহমান জানতেন না। এমনকি ছোটমামাও ভেবেছিলেন, তার বোনের পরামর্শেই কবির এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
যদিও ক্ষণিক মুহুর্তের জন্য সে অবাক হয়েছিল। কিন্তু তার যে বোন এমন একটি মেয়ের সাথে ছেলের বিয়ের সিদ্ধান্ত নিতে পারে, সেখানে এমন একটি সিদ্ধান্ত নেওয়াটাও বিশেষ কোনো ব্যাপার না। তবে ছোটমামার ভুল ভাঙলো, যখন বোনের কাছে যেচে গিয়ে কবিরের কথা জানায়।
—কী! তুই নিজে থেকেও এসব করতে দিলি? তুই জানিস না, সুনেরাহ'র সাথে আমি কেন কবিরের বিয়ে দিলাম? মেয়েটা সর্বোচ্চ দুই তিনমাস এ বাড়িতে থাকবে। তারপর? ও তো নাই হয়ে যাবে। ওর বদলে এখন আমাকে ওর ওই বাচ্চার দেখাশোনা করা লাগবে!
゚
゚