19/07/2025
মহামুনি ঋষি বেদব্যাসের মতে গর্ভাধান অর্থাৎ সন্তান ধারণ সময়কাল সম্পর্কে বলেছেন—
কৃষ্ণ দ্বৈপায়ণ বা বেদব্যাস বা সংক্ষেপে ব্যাস একজন ঋষি ছিলেন। ইনি বশিষ্ঠের প্রপৌত্র, শক্তির পৌত্র, পরাশরের পুত্র এবং শুকদেবের পিতা। ইনি হিন্দুধর্মের প্রাথমিক প্রত্যাদিষ্ট হিন্দুশাস্ত্র হিসেবে স্বীকৃত বেদের ব্যবহারিক-বিন্যাসকারী , ঐতিহাসিক মহাকাব্য মহাভারত, বেদান্তদর্শন, প্রভৃতির সংকলক, সম্পাদক ও অবশেষে সমন্বায়ক এক জ্ঞানান্বেষী ঋষি। যমুনানদীতে খেয়া নৌকার ভিতর পরাশর মুনি সত্যবতীর সাথে মিলিত হলে, সত্যবতী গর্ভবতী হন। পরে যমুনার একটি দ্বীপে তার জন্ম হয়। যমুনার দ্বীপে জন্মগ্রহণ করেন বলে এর নাম হয় দ্বৈপায়ন। এঁর গায়ের রং কালো ছিল বলে, পুরো নাম দাঁড়ায় কৃষ্ণ-দ্বৈপায়ন। তার মাথায় কপিল বর্ণের জটা ছিল। তার চোখ ছিল উজ্জ্বল ও মুখে পিঙ্গল বর্ণের দাড়ি ছিল। তিনি তপস্যাবলে মহর্ষিত্ব প্রাপ্ত হয়ে বেদকে চার ভাগে ভাগ করেছিলেন। এই কারণে ইনি বেদব্যাস বা 'ব্যাস' নামে পরিচিত হন। জন্মের পরপরই ইনি তার মায়ের অনুমতি নিয়ে তপস্যার জন্য যাত্রা করে।। তার তপস্যার স্থান ছিল বদরিকাশ্রম। এই কারণে ইনি বাদরায়ণ নামেও পরিচিত ছিলেন। মহামুনি ঋষি বেদব্যাসের মতে গর্ভাধান অর্থাৎ সন্তান ধারণ সময়কাল সম্পর্কে বলেছেন—
গর্ভাধান অর্থাৎ একজন নারীর নির্দিষ্ট বয়সে মাসিক শুরু হবার পর থেকে প্রতি মাসে একটি করে ডিম্বাণু পরিপক্ব হয়। এই ডিম্বাণু সাধারণত দুই মাসিকের মাঝামাঝি সময়ে ডিমের থলি থেকে ডিম্ববাহী নালীতে আসে। এই সময়ে যদি যৌন মিলন হয়, তাহলে পুরুষের শুক্রাণু যোনিপথ দিয়ে ডিম্ববাহী নালীতে গিয়ে পৌঁছে। সেখানে ডিম্বাণুর সাথে মিলিত হবার ফলে ভ্রুণ তৈরি হয়। একে গর্ভধারণ বলে। এই ভ্রুণ কয়েক দিন পর জরায়ুতে এসে পৌঁছে এবং সেখানে বড় হয়ে শিশুতে পরিণত হয়।
সন্তান না থাকা যে কোনও দম্পতির কাছেই এক চরম অভিশাপ। চিকিৎসা বিজ্ঞানের মতে সন্তান না হওয়ার একাধিক কারণ রয়েছে। এই নিবন্ধে এর ব্যাখ্যা করা হবে না। এখানে দৃষ্টিপাত করা হবে শাস্ত্রীয় মতে কী কী নিয়ম মেনে চলতে পারলে সুসন্তান লাভ অসম্ভব নয়। ঋতুর প্রথম দিন থেকে ১৬ দিন পর্যন্ত স্ত্রীর গর্ভধারণ করার শক্তি থাকে।
অল্প কথায় গর্ভাধান একটি পবিত্র কর্ম, একটি সাধনা।
শুদ্ধ বস্ত্রে, শুদ্ধ শয্যায়, শুদ্ধ চিত্তে সহবাসে লিপ্ত হতে হয় তবেই সুশীল, ধার্মিক, সুকুমার সুকুমারী পুত্র বা কন্যা সন্তান লাভ হয়। ক্লান্ত, চিন্তিত, ভয়ার্ত, বাহ্যক্রিয়া কিংবা প্রস্রাবের বেগ, ক্ষুধা, পিপাসা, মানসিক প্রতিকূলতার সময় সহবাস নিষিদ্ধ। গর্ভধারণের সময় ধর্ম চিন্তা করলে সন্তান ধার্মিক হবে তা শতসিদ্ধ নিশ্চয়তা প্রদান করেছেন শাস্ত্র।
এইবার আসুন জেনে নিন সুসন্তান লাভ করতে চাইলে কী কী বিষয় মেনে চলা উচিত, ঋতৌ দিনভেদে কন্যাপুত্র জন্মজ্ঞানম্ বেদব্যাস বলেছেন—
রাত্রৌ চতুর্থাং পুত্রঃ সাদল্লয়ুর্ধন বর্জিতঃ।
পঞ্চম্যাং পুত্রিনীঃনারী ষষ্ঠাং পুত্রঃ সুমধ্যমঃ।
সপ্তম্যাম প্রজা যেষিদষ্ট ম্যামীশ্বরঃ পুমান।
নবম্যং সুতপানারী দশম্যাং প্রবরঃ সুতঃ।
একাদশ্যাম ধৰ্ম্মা স্ত্রী দাদশাং পুরুষোত্তমঃ।
এয়োদশ্যাং সুতা পাপা বর্ণ সঙ্কর কারিনী।
ধর্মজ্ঞশ্চকৃতজ্ঞশ্চ আত্মবেদী দৃঢ়ব্রতঃ।
প্রজায়তে চতুদ্দশ্যাং পঞ্চদশ্যাং পতিব্রতা।
আশ্রয়ঃ সর্বভূতানাং ষোড়শ্যাং যায়তে পুমান।
বেদব্যাস মতে ঋতুর দিন ভেদে কন্যা ও পুত্র জন্ম নিরুপিত হইয়াছে।
ঋতুর প্রথম দিনাবধি ষোড়শদিন পর্যন্ত ঋতুকাল তাহার ১, ২,৩, ৪, ৭, ১১, ১৩ রাত্রি অবশ্যই পরিত্যাজ্য।
১) ৪র্থ দিবসের রাত্রিতে মিলনে পুত্র অল্পায়ু, ধনহীন।
২) ৫ম দিবসের রাত্রিতে মিলনে কন্যা জন্ম।
৩) ৬ষ্ঠ দিবসের রাত্রিতে মিলনে সুমধ্যম পুত্র।
৪) ৭ম দিবসের রাত্রিতে মিলনে বন্ধ্যা কন্যা জন্ম।
৫) ৮ম দিবসের রাত্রিতে মিলনে শ্রেষ্ঠ পুত্র সন্তান।
৬) ৯ম দিবসের রাত্রিতে মিলনে সুভগা কন্যা সন্তানে জন্ম।
৭) ১০ম দিবসের রাত্রিতে মিলনে শ্রেষ্ঠতর পুত্র জন্ম।
৮) ১১তম দিবসের রাত্রিতে মিলনে ধর্মহীনা কন্যা জন্ম।
৯) ১২তম দিবসের রাত্রিতে মিলনে উত্তম পুত্র জন্ম।
১০) ১৩তম দিবসের রাত্রিতে মিলনে পাপিনী ব্যাভিচারিনী, কন্যা জন্ম।
১১) ১৪তম দিবসের রাত্রিতে মিলনে ধার্মিক, কৃতজ্ঞ, আত্মবান, সম্পন্ন কন্যা জন্ম।
১২) ১৫তম দিবসের রাত্রিতে মিলনে পতিব্রতা কন্যা জন্ম।
১৩) ১৬তম দিবসের রাত্রিতে মিলনে ঈশ্বরাংশ সস্তুত পরম ধর্মপরায়ন, সত্যবাদী, জিতেন্দ্রীয় শতায়ু, সর্বলোকের আশ্রয় মহাপরুষের জন্ম হয়।
সাধারণ জ্ঞাতব্য সময় হলো—
১) মিলনের সময় রাত্রি ১১টা হইতে ৩ টার মধ্যে এর আগে ও পরে আসুরিক সময় এবং দিবা মিলন নিষিদ্ধ।
২) রাত্রির প্রথম প্রহরে গর্ভধারণ করলে, সেই গর্ভস্থ সন্তান রুগ্ন ও স্বল্প আয়ুর হয়।
৩) রাত্রির দ্বিতীয় ও তৃতীয় প্রহর গর্ভধারণের জন্য খুব একটা ভাল সময় নয়।
৪) চতুর্থ প্রহরে গর্ভধারণ করলে, সন্তান দীর্ঘায়ু ও নীরোগ হয়।
৫) চতুর্থ প্রহরে গর্ভধারণের ক্ষেত্রে খুবই উপযুক্ত সময় ও ভাল সময়।
৬) সোমবার, বৃহস্পতিবার এবং শুক্রবার রাত্রে সহবাস করলে খুব ভাল।
৭) মঙ্গলবার রাত্রে সহবাস না করাই ভাল।
৮) সকাল, সন্ধ্যা এবং দ্বিপ্রহরে সহবাস হানি কারক। সন্ধ্যা সময় আসুরিক কাল। এই সময় প্রজাপতি কশ্যপ আরাধনায় রত ছিলেন সেই সময় তার স্ত্রী দিতি স্বামীর সঙ্গে মিলনের প্রার্থনা করাতে কশ্যপের নিষেধ সত্ত্বেও মিলনে অসুর পুত্রদ্বয় (হিরন্যকশিপু ও হিরন্যক্ষ) জন্ম লাভ করেছিলেন।
তাছাড়া একাদশী, পূর্ণিমা, অমাবস্যা, জ্যেষ্ঠ্য, মূলা, অঘা, মঘা, অশ্লেষা, রেবতী, কৃত্তিকা, অশ্বিনী, মৃগশিরা উত্তরফল্গুনী, উত্তরাষাঢ়া, উত্তর ভাদ্রপদ, চিত্রা, পুনর্ব্বসু, স্বাতী, হস্তা, শতভিষা, রোহিনী, ধনিষ্ঠা, শ্রবণা, পুষ্যানক্ষত্রে বিষ্টিভদ্রা এবং পর্বদিন, ষষ্ঠী, চতুর্থী ও নবমী ত্যাগ করিয়া সোম, বুধ, বৃহস্পতি, শুক্রবার মঙ্গলবার রবিবার যুগ্মরাত্রিতে গর্ভধান করিবে। প্রত্যেক নারী পুরুষের একাদশী ব্রত অবশ্যই পালনীয়। একাদশীতে শুধু দুধ, ফল, জল, মুলজাতীয় খাদ্য গ্রহনীয়। ধান, গম, ডাল, যব শস্য জাতীয় খাদ্য ত্যাগ করিতে হইবে।
সাধারণ জ্ঞাতব্য তথ্য বলা হয়েছে—
১) গর্ভধান রাত্রিতে শুদ্ধ বিছানায়, শুদ্ধবস্ত্র পরিধান এবং গৃহে সুগন্ধ ধূপ ও সুগন্ধ তৈল দেহে ধারণ করিতে হইবে।
২) স্ত্রী পুরুষ উভয়ে ভগবানের স্তব স্তুতি গুণকীর্ত্তন করিতে হইবে।
৩) পরদিন প্রাতে উভয়ে ভগবান শ্রীহরির পূজা সমাপন করিয়া ব্রাহ্মণ ভোজন করাইয়া উভয়ে ভগবানের নিবেদিত মহাপ্রসাদ গ্রহণ করিবে।
৪) স্ত্রীজাতি গর্ভে সন্তান অবস্থায় সৎ কর্ম ও অধ্যায়ন করিবে তাহলে সন্তান সৎ, ধর্মপরায়ন ও বিদ্যান হইবে।
৫) বিনা কারণে স্ত্রীকে নির্যাতন মহাপাপ।
৬) স্ত্রীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে মিলন মহাপাপ।
৭) স্ত্রীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে আসুরিক মিলনে পাপী সন্তান জন্মে।
৮) স্ত্রীর চুল ধরে নির্যাস্ত মহাপাপ।
৯) স্ত্রীরও মনে রাখতে হবে পতি তার দেবতা এবং পতিকে ভগবানের ন্যায় শ্রদ্ধা ও পূজা করা তার ধর্ম।
১০) ভাগবত নক্ষত্র গণের মধ্যে ভরনী, অদ্রা, পুর্বফাল্গুনী, বিশাখা, অনুরাধা, পূর্বষাঢ়া, গর্ভধারণে প্রসস্থ।
১১) আপনি সন্তান লাভের চিন্তা তখনই করবেন, যখন আপনার শরীর সম্পূর্ণ সুস্থ থাকবে এবং মনের ভিতর কোনও রূপ খারাপ চিন্তা থাকবে না এবং পেট খালি থাকবে না, তখনই সহবাস করবেন।
১২) পায়খানা, প্রস্রাব, খিদে ও পিপাসার্ত থাকা অবস্থায় সহবাস করা উচিত নয়।
১৩) যখন সন্তান গর্ভে আসবে, তখন ধর্ম চিন্তা ও সৎ চিন্তা করলে, সন্তান ধার্মিক ও সুখী হয়।
১৪) গর্ভবতী রাগ, হিংসা, মিথ্যা কথা বলা প্রভৃতি অন্যায় আচরণ এবং লোভ করলে গর্ভস্থ সন্তান সেই সমস্ত খারাপ গুণ নিয়ে জন্মায়।
১৫) গর্ভাবস্থায় দিবা নিদ্রা, উপবাস, সহবাস এবং রাত্রি জাগরণ পরিত্যগ করা উচিত।
১৬) রজঃস্বলা অবস্থায় সহবাস করা উচিত নয়। এই সময়ে সহবাস করে গর্ভধারণ হলে এই সমস্ত সন্তান স্বল্পায়ু ও অসুস্থ হয়।
১৭) গর্ভের চতুর্থ মাসে, গর্ভস্থ সন্তানের অঙ্গ ও প্রতঙ্গ ও চৈতন্যের প্রকাশ পায়। এই সময় মা যে ধরনের বিদ্যাচর্চা করবে, সন্তান সেই ধরনেরই গুণ নিয়ে জন্মাবে।
শ্রী বাবলু মালাকার
(সনাতন ধর্মের প্রচারক, বাংলাদেশ)।
জয় শ্রীকৃষ্ণ, জয় শ্রীরাম
হর হর মহ
পার্থ কুমার PV Partha Vlog Partha Kumar
Partha Kumar Personal Blog シ︎
জ্ঞানের আলো সংগঠন - Gyaner Alo Sangathan