22/08/2025
কুরআনের দুআগুলো আমাকে বেশ আশ্চর্যান্বিত করে। যেন সেগুলো তাকওয়া, তাওয়াক্কুল আর ঈমানের জোয়ারে টইটম্বুর। ঠিক এমনই একটা দুআর দেখা মিলে সূরা আল-বাকারায়, যা আল্লাহর কাছে করেছিলেন আমাদের পিতা ইবরাহীম আলাইহিস সালাম।
পুত্র ইসমাঈলকে সাথে নিয়ে যখন তিনি কা’বার ভিত্তিপ্রস্তর পুনরায় স্থাপন করলেন, ঠিক সেই মুহূর্তেই তিনি এই দুআটা করেন।
দুআটার ভেতরে যাওয়ার আগে আমি আপনাদের একটা দৃশ্যের সামনে দাঁড় করাতে চাই। ধরা যাক বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী শাসকের কাছ থেকে আপনাকে একটা কাজ দেওয়া হলো। কাজটা হলো—তারা নির্মাণ করবে দুনিয়ার সবচেয়ে বড় দালান, যা হার মানাবে বুর্জ আল-খলিফাকেও! মহা এই কাজের দায়িত্ব দুনিয়ার আর কেউ নয়, পেয়ে গেছেন আপনি!
এমন একটা কাজের মহা-দায়িত্ব যদি আপনি আজ রাতে পেয়ে যান, ভাবুন তো আপনার চারপাশে কেমন হইচই পড়ে যাবে? আপনার ফেইসবুক-ইন্সটাগ্রাম-টুইটারসহ সকল সোশ্যাল মিডিয়ায় কী অভাবনীয় কাণ্ড ঘটবে, তা কি আপনি ভাবতে পারেন? এই ঘটনা যখন আপনি সোশ্যাল মিডিয়ায় জানাবেন, তখন লাখ লাখ মানুষ আপনাকে অভিনন্দন আর শুভেচ্ছা জানাবে। রাতারাতি আপনি হয়ে যাবেন মহা-সুপারস্টার! আপনার পা তখন আর মাটিতে থাকবে না।
এমনই এক মহা-প্রজেক্টের দায়িত্ব পেয়েছিলেন ইবরাহীম আলাইহিস সালাম। প্রায়-বিলীন হয়ে যাওয়া পৃথিবীর সর্বপ্রথম গৃহ কা’বাকে পুনরায় নির্মাণের এক মহা-দায়িত্ব আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা অর্পণ করেছেন তাঁর ওপর। সেই দায়িত্বে যখন তিনি হাত লাগালেন, তখন নিজের পুত্রকে সাথে নিয়ে তিনি আল্লাহর কাছে হাত তুলে বললেন :
رَبَّنَا تَقَبَّلْ مِنَّا ۖ إِنَّكَ أَنۡتَ السَّمِيۡعُ الْعَلِيۡمُ ١٢٧
“হে আমাদের প্রতিপালক! (এই কাজটাকে) আপনি আমাদের পক্ষ থেকে কবুল করুন। নিশ্চয়ই আপনি সর্বশ্রোতা এবং সর্বজ্ঞ।”
পৃথিবীর সবচেয়ে হাই-রেইজ বিল্ডিংয়ের ভিত্তিপ্রস্তর যখন স্থাপন করতে যাবেন, তখন নিশ্চয় মুহুর্মুহু ক্যামেরার ক্লিকে বন্দী হয়ে পড়বেন আপনি। সেলফিতে, ফটোতে, ভিডিওতে দুনিয়ার সকলকে জানাতে আপনি মরিয়া হয়ে উঠবেন যে—কী বিরল সম্মানের অধিকারী আপনি হয়েছেন!
আপনি লিখবেন—‘Yes, I've done it! Hurrr re...’
পত্রিকাগুলো আপনাকে নিয়ে ফিচার ছাপবে, চ্যানেলগুলো আপনাকে নিয়ে সিরিজ-প্রোগ্রামের আয়োজন করবে। সবকিছুকে ঘিরে আপনার তখন সে কী উন্মাদনা!
কিন্তু কা’বা, যেটা দুনিয়ার সবচাইতে সম্মানিত এবং পবিত্র ইবাদাত-গৃহ, সেই গৃহের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের দায়িত্ব পেয়ে ইবরাহীম আলাইহিস সালাম উন্মত্ত উল্লাসে ফেটে পড়েননি। তিনি মক্কা থেকে মিশরে এসে তাঁর কওমকে জানাননি যে—‘জানো, আমি কিন্তু কা’বা গৃহ নির্মাণের দায়িত্ব পেয়েছি! কা’বা গৃহ কি তোমরা জানো? সেটা হলো আল্লাহর পবিত্র ঘর! দুনিয়ার বুকে নির্মিত সর্বপ্রথম ইবাদাত-গৃহ!’
এমন সম্মানের অধিকারী হয়ে তিনি মিশরে মাস-ব্যাপী মনোজ্ঞ অনুষ্ঠানের আয়োজনে মত্ত হয়ে যাননি। তিনি দুনিয়া-ব্যাপী ঘোষণা দেননি তার অর্জনের। বরং দায়িত্বটা পেয়ে তিনি আল্লাহর কাছে হাত তুলে বললেন যেন মহামহিম রব তার কাজটাকে কবুল করে নেন।
কিন্তু এখানে কবুল করার প্রশ্নটা এলো কেন? এই কাজের জন্য আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলাই তো ইবরাহীম আলাইহিস সালামকে মনোনীত করেছেন। এই দায়িত্ব আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে তাঁর ওপর অর্পণ করেছেন। তিনি যদি তাঁকে ‘যোগ্য’ মনে না-ই করতেন, তাহলে দায়িত্বটা তো তাঁকে দিতেন না। তবে কেন ইবরাহীম আলাইহিস সালাম কাজটা করতে গিয়ে অনুনয়-বিনয় করে, কাতর গলায় বললেন—‘আল্লাহ, আমাদের পক্ষ থেকে কাজটাকে আপনি কবুল করে নিন’?
এটাই হচ্ছে বিনয়। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার ক্ষমতার প্রতি প্রশ্নাতীত আনুগত্য।
ইবরাহীম আলাইহিস সালাম খুব ভালো করেই জানেন যে—আল্লাহর সাহায্য আর দয়া না থাকলে এই কাজ তিনি কোনোদিনও সমাপ্ত করতে পারবেন না। এই কাজ করার যে যোগ্যতা তাঁর মাঝে আছে, তার পুরোটাই আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা প্রদত্ত। তিনি নিজ থেকে কোনোকিছুই করার ক্ষমতা রাখেন না। এবং যেহেতু তিনি মানুষ, তাই কাজটা করতে গিয়ে তাঁর ভুলত্রুটি হতে পারে। সমস্ত ত্রুটিকে, সমস্ত ভুলকে ক্ষমা করে দিয়ে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা যেন তার কাজটাকে কবুল করেন এটাই তাঁর আর্জি।
যে শাসক আপনাকে দুনিয়ার সবচেয়ে উঁচু দালান নির্মাণের দায়িত্ব দেন, তার সামনে গিয়ে আপনি কি এটা কখনোই বলবেন যে—‘আপনার কাজটা করতে গিয়ে আমার খানিকটা এদিক-সেদিকও হতে পারে। আপনাকে হান্ড্রেড পার্সেন্ট কাজ বুঝিয়ে দিতে পারবো—এমন কোনো কথা নেই কিন্তু।’
আপনি এভাবে বলেন না। আপনি জানেন এভাবে বলতে গেলে দুনিয়ার মানুষেরা আপনার দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন উঠাবে। তাদের মনে সন্দেহ দানা বাঁধবে আপনার যোগ্যতা নিয়ে। তাদের সামনে আপনাকে থাকতে হয় প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাসী। আপনাকে বলতে হয়—‘এই টাইপ কাজ তো আমি কতো অনায়াসেই করে ফেলি। আমার অমুক প্রেজেক্ট দেখেন, তমুক প্রজেক্টের ব্যাপারে খোঁজ নেন দরকারে।’
বসের কাছে নিজের এক্সেলেন্সি প্রমাণে আপনি তখন মরিয়া হয়ে উঠবেন। কোনো কাজ শুরুর পূর্বে অথবা শুরু করতে গিয়েই যদি আপনি নিজের পক্ষ থেকে সামান্য ত্রুটির আশঙ্কাও প্রকাশ করে ফেলেন, দুনিয়ার কোনো বস-ই সেটাকে ভালোভাবে গ্রহণ করবে না।
কিন্তু আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার কাছে ব্যাপারটা পুরোপুরিই অন্যরকম। আপনার সমস্ত অক্ষমতা, অদক্ষতা, অপারগতা আর কেউ জানুক বা না-জানুক, আল্লাহর কাছে তা কি আদৌ কোনোভাবে গোপন থাকে? তিনি অবশ্যই জানেন যে আপনার আসলে বড়াই করার মতো কোনো যোগ্যতা নেই। আপনি যেটাকে নিজের ‘যোগ্যতা’ ভাবেন, তা আসলে আল্লাহর ‘দয়া’। তিনি দয়া করেন বলেই আপনি কাজটা ভালো পারেন।
আল্লাহর এই অনুগ্রহকে ইবরাহীম আলাইহিস সালাম অনুভব করেছিলেন বলেই পবিত্র কা’বা ঘর নির্মাণের দায়িত্ব পেয়েও তিনি অহংকারে ফেটে পড়ার বদলে বিনয়াবনত হয়েছিলেন। ওই একই দুআয় তিনি বলেছিলেন—‘নিশ্চয়ই আপনি সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ।’
বান্দার সকল কাজে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার যে নিরন্তর তদারকি, ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কোনো বিষয়ই যে আল্লাহর কাছে গোপন করা যায় না, এতো বড় সম্মানের অধিকারী হওয়ার পরেও ইবরাহীম আলাইহিস সালাম আল্লাহর এই গুণের কথা ভুলে বসেননি। কোনো কাজে আপনি কতোটুকু হেলাফেলা করেন তা কেবল নয়, হেলাফেলা করার ভাবনা যখন আপনার অন্তরে উদয় হয়, ওই ভাবনাটাও আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার কাছে গোপন থাকে না।
আমি আশ্চর্য হয়ে ভাবী—স্বীকৃতি লাভের পর আনন্দের আতিশয্যে যেখানে মানুষ দিশেহারা হয়ে পড়ে, সেখানে নবি-রাসূলগণ কী সুন্দর সংযম আর বিনয়ের দীক্ষাই না আমাদের দিয়ে গেলেন!
'কুরআন থেকে জীবনের পাঠ' বই থেকে নেওয়া টুকরো অংশ।