04/08/2023
#মায়াবতী
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ
পর্ব-০১
#তানিশা_সুলতানা
হাসপাতালের বাইরে আসতেই তন্নি বুক ভরে শ্বাস টানে। চোখ মেলে দেখে চারিপাশটা। কখনো কি চিন্তা করেছিলো আবার দেখতে পারবে এই সুন্দর পৃথিবী?
আবার মাথা রাখতে পারবে অর্ণবের প্রশস্ত বুকে। অথৈয়ের হাতটা ধরতে পারবে। বাবাকে দেখতে পারবে। ভাইটার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে পারবে।
কখনোই ভাবে নি তন্নি। ভেবেছিলো তার আয়ু শেষ। এই পৃথিবীতে তার আর থাকা হচ্ছে না। কিন্তু আল্লাহ অশেষ দয়া আর অর্ণবের ভালোবাসা আবার ফিরিয়ে এনেছে তাকে। আরও কিছুদিন সময় দিয়েছো বেঁচে থাকার।
অর্ণব তন্নিকে গাড়িতে বসিয়ে নিজেও পাশে পাশে বসে। ড্রাইভারকে কড়া গলায় বলে দিয়েছে একদম ধীরে গাড়ি চালাতে। যেনো তন্নির কোনো অসুবিধা না হয়। অথৈ বসেছে তন্নির আরেকপাশে। সাগর ড্রাইভারের পাশে বসেছে। বাকিরা অন্য গাড়িতে চলে গেছে।
রিজুয়ান তার চেম্বারের জানালা দিয়ে দেখছিলো তন্নিকে। যুদ্ধ জয় করেছে সে। পাক্কা তিন মাস চিকিৎসা দিয়ে বাঁচাতে পেরেছে তন্নিকে। তার ডাক্তার হওয়া আজকে সার্থক হয়েছে। আজকে থেকে তন্নিকে দেখা হবে না। রাত জেগে তন্নির পাশে বসে থাকা হবে না। তন্নিকে ছুঁয়ে দেওয়া হবে না। ভাবতেই বুকটা ভার হয়ে আসে তার। তন্নি যে এখন অন্য কারোর বউ।
এই জীবনে একটা আফসোস থেকেই যাবে। কেনো অর্ণবের আগে তন্নিকে পেলো না সে? মায়াবতীকে কেনো নিজের করে পেলো না?
রিজুয়ানের চোখের কোণে পানি চলে আসে। সেটা গড়িয়ে পরার আগেই সে মুছে ফেলে। তখনই পেছন থেকে মেয়েলি কন্ঠ শুনতে পায়।
"মে আই কাম ইন ডাক্তার?
রিজুয়ান দীর্ঘ শ্বাস ফেলে পেছন ঘুরে তাকায়। মেয়েটাকে রিজুয়ান দেখেছে। মাঝেমধ্যেই আসে হাসপাতালে তন্নিকে দেখতে। সেভাবে নাম জানে না। মেয়েটার ড্রেস আপ তার পছন্দ না তাই কখনোই ভালো করে তাকায় নি।
আজকেও একটা শর্ট হাতা কাটা জামা পড়ে এসেছে। ফর্সা পা দুটো উদাম।
রিজুয়ান এক পলক তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নেয়। মুখে গম্ভীর ভাব টেনে চেয়ারে বসে।
" ইয়েস কাম ইন
নিধি ভেতরে ঢোকে। রিজুয়ানের পারমিশন না নিয়েই চেয়ার টেনে বসে পড়ে। ভ্রু কুচকে ফেলে রিজুয়ান। ভারি অসভ্য মেয়ে।
"আমি নিধিরা নিধি
" কিভাবে হেল্প করতে পারি?
নিধি নিজের পার্স থেকে দুই ব্যান্ডিল টাকা বের করে টেবিলে রাখে রিজুয়ানের সামনে
"অর্ণব আমার এক্স। আমি জানি তন্নির টিটমেন্টের পুরো টাকাটা দেওয়া হয় নি। তো বাকি গুলো আমি দিয়ে দিলাম।
রিজুয়ান আশ্চর্য হয়। এক্স গার্লফ্রেন্ড তার এক্স বয়ফ্রেন্ডের বউয়ের চিকিৎসার টাকা দিচ্ছে?
" আমি বুঝতে পারলাম না?
নিধি বিরক্ত হয়। সে কি হিন্দিতে কিছু বলেছে না কি?
"তন্নির চিকিৎসার যে টাকা গুলো বাকি ছিলো সেই গুলো আমি দিয়ে দিলাম।
" কেনো নিবো?
"দিয়েছি তাই।
" সরি মিসস
এমনটা হয় না
"কেনো হবে না? আমি তন্নির পরিচিত। আমাকে তো দেখেছেন তন্নির সাথে।
"অর্ণবের সাথে একটা সময় আমার রিলেশন ছিলো। আমাকে অনেক হেল্প করেছে। অনেক টাকা উড়িয়েছে আমার পেছনে। কিন্তু আমি তার সাথে চিট করেছিলাম।
এই মুহুর্তে অর্ণবের হাতে ক্যাশ টাকা নেই। সে এই টাকা নিয়ে সারাক্ষণ টেনশন করবে।
আমি দিলে নিবে না। তাই আপনার কাছে এসেছি।
এই প্রথমবার মেয়েটাকে ভালো লাগে রিজুয়ানের মুগ্ধ হয় কথা শুনে।
নিদি দীর্ঘ শ্বাস ফেলে আবার বলে
"তন্নিকে সে পাগলের মতো ভালোবাসে। আমার পা জড়িয়ে ধরে তন্নির জন্য দোয়া চেয়েছে। এরকম ভালোবাসার মানুষ পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার ।
শেষের কথাটা বলতে গিয়ে হেসে ফেলে নিধি।
রিজুয়ান বলে
" তার টাকা বাকি নেই। যেটুকু ছিলো আমি দিয়ে দিয়েছি।
নিধি অবাক হয়।
"আপনি মানে বুঝলাম না?
রিজুয়ান দাঁড়িয়ে যায়। হাত ঘড়িতে সময় দেখে নেয়।
" পেশেন্ট দেখতে যাবো
বলেই বেরিয়ে যায়। পেছনে রেখে যায় হতদম্ভ নিধিকে।
তন্নির জন্য বাড়িটাকে নতুন ভাবে সাজানো হয়েছে। পুরো বাড়িটাতে বেলুন লাগানো হয়েছে৷ তন্নিকে হুইল চেয়ারে বসিয়ে দেয় অর্ণব। গেইটের সামনে বেলুন দিয়ে লেখা হয়েছে "Welcome Mayaboti"
আশা আয়েশা আনোয়ার তারেক তামিম আর্থি সাগর সবাই লাইন ধরে দাঁড়িয়ে আছে। তন্নির একপাশে অর্ণব আরেক পাশে অথৈ। সবাই তন্নির দিকে ফুলের পাপড়ি ছুঁড়ে দিচ্ছে।
তন্নি হেসে ফেলে৷ এতোটাও সুখ লেখা ছিলো?
তন্নির জন্য সুন্দর করে রুম সাজানো হয়েছে। প্রতিটি কোণায় অর্ণব তন্নির পিক লাগানো। তন্নি অথৈয়েরও অনেক পিক। পিক দেখে তন্নির মন খারাপ হয়ে যায়। কি ছিলো আর কি হয়ে গেলো? জীবনটা কিভাবে বদলে গেলো?
অর্ণব বিছানায় গা এলিয়ে দেয়। অনেকদিন হয়ে গেছে শান্তিতে ঘুমানো হয় না। পেট ভরে ভাত খাওয়া হয় না। ঠিকমতো গোসলও করা হয় না। তামিম দৌড়ে আসে তন্নীর সামনে দাঁড়ায়। তন্নীর মুখে হাত বুলিয়ে দেয়। তন্নি হাসে
আপু বাড়ি যাবে না।?
অর্ণব চোখ বন্ধ অবস্থায় বলে"
"তোমার আপুকে বিরক্ত করো না।
তামিমের হাসি মুখটা গোমড়া হয়ে যায়। তার ভালো লাগে না। কেউ নেই। মা নেই। বাবা ঠিকমতো কথা বলে না। আপি নেই। এভাবে থাকা যায় না কি?
বাবাকে মায়ের কাছে যাওয়ার কথা বললেই ধমক দেয়। বকে।
কিন্তু তামিম কি করে বোঝাবে? মাকে ছাড়া থাকতে তার কষ্ট হয়। খেতে কষ্ট হয়,ঘুমতে কষ্ট হয়। কার কাছে বলবে সে?
তন্নির মনটাও খারাপ হয়ে যায়। এভাবে ধমক না দিলেও পারতো। তামিম মাথা নিচু করে বেরিয়ে যায়। তন্নি আটকাতে গিয়েও পারে না। অর্ণবের দিকে তাকিয়ে থাকে।
মনটা ভালো হয়ে যায় অর্ণবের মুখটা দেখে। আহারে
মুখটা শুকিয়ে গেছে। চোখের কোণে কালি জমেছে। ঝাঁকড়া চুল গুলো পাখির বাসার মতো হয়ে গেছে। তন্নির ইচ্ছে করছে লোকটার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে। কপালে একটা চুমু খেতে। কিন্তু সে তো একা একা চলতেই পারে না। তাকে কি করে যত্ন করবে?
গরম গরম সুপ নিয়ে অথৈ রুমে ঢোকে। তন্নির সামনে হাঁটু মুরে বসে চামচ নাড়তে নাড়তে বলে
"এখন খেয়ে নিতে হবে ময়নাপাখি।
তন্নিরও খুব খিধে পেয়েছিলো। সে আলতো হেসে অথৈয়ের দিকে তাকায়।
খুব কষ্ট থেমে থেমে বলে
" তুই খেয়েছিস?
অথৈ ঠোঁটের কোণে হাসি চওড়া করে বলে
"তোকে খাইয়ে খাবো।
তন্নি খেতে থাকে। অথৈ যত্ন করে সুপ চামচে তুলে তাতে ফুঁ দিয়ে ঠান্ডা করে তন্নির মুখে দিচ্ছে।
তন্নি মুগ্ধ হয়। একটা বোন থাকলেও এভাবে যত্ন করতো না।
এতো বেশি কেনো ভালোবাসে মেয়েটা?
তন্নিকে খাওয়ানো শেষে ধরে বিছানায় বসিয়ে দেয় অথৈ। তারপর ওড়না খাটের পাশে রেখে ওয়াশরুমে ঢুকতে যায়। তন্নি হাত ধরে
অথৈ পেছন ঘুরে তাকায়
" খাবি না?
"তোকে ফ্রেশ করিয়ে তারপর খাবো।
" আগে খেয়ে আয়।
"সময় লাগবে না বেশি।
" যেতে বলেছি
অথৈ গোমড়া মুখে ওড়না তুলে নেয়। অর্ণবকে ডাকে কয়েকবার। কিন্তু সে সাড়াশব্দ করে না। শান্তিতে ঘুমচ্ছে সে।
"ঠিক আছে। উনি পরে খেয়ে নেবে।
অথৈ চলে যায়। তারেক সোফায় বসে ছিলো। আর্থি তামিমকে খাওয়াচ্ছে। বাচ্চাটার প্রতি তার এক আকাশ সমান পরিমাণ মায়া। অথৈ যেতেই সাগর খেতে বসে।
আনোয়ার তারেকের পাশে গিয়ে বসে।
" আমি বলি কি? ইতিকে নিয়ে এস। ছেলেটার কথা ভাবো একটু।
তারেক দীর্ঘ শ্বাস ফেলে।
"যা হওয়ার হয়ে গেছে৷ ইতিও নিজের ভুল বুঝতে পেরেছে। তোমাদের ছেলেকেও মা হারা করো না। তাছাড়া তন্নি তার মাকে ভীষণ ভালোবাসে। সে দেখতে চাইবে। তখন কি বলবে তুমি?
আশা বেগমও সায় জানায়।
" আল্লাহর অশেষ কৃপায় তন্নি সুস্থ হয়েছে। এখন আর শাস্তি দিতে হবে না ইতিকে৷ ছেলেটার ওপর এর প্রভাব পড়ছে।
তারেক বলে
"আর দুদিন দেখি।
" তন্নি আজকেই দেখতে চাইবে তার মাকে৷ তখন?
তারেক কথা বলে না চুপ করে থাকে। সত্যিই তো মেয়ের থেকে কতোদিন লুকাবে? তার মেয়ে এটা মেনে নিবে না।
অনেকদিন পরে নিজেকে ফ্রেশ লাগছে নিজের কাছে। কতোদিন পানি ছোঁয়া হয় না। আজকে অথৈ সুন্দর করে শরীর মুছিয়ে দিয়েছে। ভালো লাগছে খুব। তন্নির এবার ঘুম প্রয়োজন অথৈ খায়ে শুয়িয়ে দিয়ে গেছে। তন্নি অর্ণবের দিকে মুখ করে শুয়ে আছে। এই লোক চোখের সামনে থাকলে তার ঘুম হবে না।
অর্ণব নড়েচড়ে চোখ খুলে। চোখের সামনে তন্নির শুভ্র মুখখানা দেখে ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে ওঠে। তন্নির হাতের ওপর হাত রেখে খানিকটা এগিয়ে যায় তন্নির দিকে৷ তন্নিও মুচকি হাসে।
অর্ণব দুই হাত তন্নির দুই দিকে দিয়ে তন্নির ওপর আধশোয়া হয়। পাশ থেকে বালিশ এনে তন্নির পেটের ওপর দিয়ে তাতে ভর দেয়। তন্নি ভ্রু কুচকে তাকিয়ে আছে।
অর্ণব তন্নির ঠোঁটের দিকে তাকিয়ে হাসতে থাকে।
"ভালোবাসি জান
বলতে বলতে তন্নির ঠোঁটে আলতো করে চুমু খায়। তন্নি লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেলে।
অর্ণব তন্নির নাকে নাক মিলিয়ে ডাকে
"মায়াবতী
তন্নি চোখ বন্ধ করে অর্ণবের হাত ধরে আস্তে করে জবাব দেয়
" হুমমম
"তোমাকে ছাড়া একটা সেকেন্ডও চলে না আমার।
তন্নি কিছু বলে না।
" কষ্ট হচ্ছে?
তন্নি তারাহুরো করে বলে
"নাহহ
" তাহলে এভাবেই থাকবো?
তন্নি কি উওর দেবে? নির্লজ্জের মতে বলবে হ্যাঁ থাকুন? না কি বলবে "না নামুন?"
অর্ণব তন্নির কপালে চুমু খেয়ে নেমে যায়।
"সুস্থ হয়ে ওঠো সারাক্ষণ এভাবেই থাকবো।
বলতে বলতে বিছানা থেকে নেমে যায় অর্ণব।
"খেয়ে আসি। প্রচন্ড খিধে পেয়েছে। তুমি একটু ঘুমিয়ে নাও।
তন্নি বলে উঠে"
“আমার মাকে একটু পাটিয়ে দিয়েন”
অর্ণব তন্নির দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ায়"তার পর ওয়াশরুমে যায় ফ্রেশ হতে।
তন্নি ঘুমিয়ে পড়ে...!
নিয়মিত গল্প পেতে suport koron..
চলবে