Niamot Al Hasan

Niamot Al Hasan আমি কি আর আমার নাকী!
আমি তো শুধু তোর,
দূরে ঠেললে রাত্রি হবো
কাছে ডাকলেই ভোর!..
(1)

 #কালো_জামাই১০গাড়ির স্টিয়ারিং হুইলটা আমার ভেজা, কাঁপা হাতে যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছে। রাতের নিয়ন আলো ঝাপসা কাঁচ ভেদ করে আমার...
30/10/2025

#কালো_জামাই
১০
গাড়ির স্টিয়ারিং হুইলটা আমার ভেজা, কাঁপা হাতে যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছে। রাতের নিয়ন আলো ঝাপসা কাঁচ ভেদ করে আমার চোখে তীক্ষ্ণ তীরের মতো বিঁধছে, কিন্তু আমি পথ থেকে একচুলও বিচ্যুত হচ্ছি না। আমার পুরো সত্তা জুড়ে এখন একটাই লক্ষ্য, একটাই গন্তব্য—আকাশের বাসা।...
আমার মস্তিষ্ক আর হৃদপিণ্ডের যুদ্ধ থেমে গেছে; দুটোই এখন একসুরে একটাই নাম জপ করছে—নিতু।

আকাশের অ্যাপার্টমেন্টের নিচে গাড়িটা প্রায় আছড়ে ফেলার মতো করে পার্ক করলাম। লিফটের বোতাম চাপার মতো মানসিক স্থিতি আমার ছিল না, সিঁড়ির ধাপগুলোকে দুই-তিনটা করে টপকে আমি পাগলের মতো ছুটলাম।
দরজায় পৌঁছানোর আগেই আকাশ দরজা খুলে দাঁড়িয়ে ছিল, আমার বিধ্বস্ত, পাগলাটে চেহারা দেখে সে এক মুহূর্তের জন্য থমকে গেল। তার চোখে উদ্বেগ আর করুণার এক অদ্ভুত মিশ্রণ।

"শুভ্র, তুই..."

আমি কোনো কথা বলার সুযোগ দিলাম না। হাঁপাতে হাঁপাতে বললাম, "কোথায়? নিতু কোথায়?"

আকাশ আমার কাঁধে একটা হাত রাখলো, তার স্পর্শে একটা অদ্ভুত শীতলতা ছিল। সে গলায় বলল, "আমার সাথে আয়।"

আমরা আবার নিচে নামলাম। আকাশ এবার তার নিজের গাড়ির দিকে এগোল। আমি প্রশ্ন করতে গিয়েও থেমে গেলাম। তার থমথমে মুখটা বলে দিচ্ছিল, পরিস্থিতি যতটা সহজ আমি ভাবছি, ততটা নয়।...
কোনো রকম বাক্য বিনিময় ছাড়াই আমরা গাড়িতে উঠে বসলাম। গাড়িটা রাতের নিস্তব্ধ রাস্তা চিরে ছুটতে লাগলো এক অজানা গন্তব্যের দিকে। আমার ভেতরের আশা আর আশঙ্কার দোলাচলটা তখন এক প্রলয়ংকরী ঝড়ের রূপ নিয়েছে।

কিছুক্ষণ পর গাড়িটা শহরের কোলাহল ছাড়িয়ে একটা পুরোনো, নির্জন এলাকার দিকে মোড় নিলো। আবছা আলোয় একটা প্রাচীন মন্দিরের চূড়া দেখতে পেলাম। গাড়িটা থামলো সেই কালি মন্দিরের সামনের রাস্তায়। আমার বুকের ভেতরটা অজানা ভয়ে হিম হয়ে গেল। এখানে কেন? নিতু এখানে কী করছে?

গাড়ি থেকে নামতেই একটা চাপা গুঞ্জন আমার কানে এলো। মন্দিরের পাশের বিশাল বটগাছটার নিচে, যেখানে ঘাটটা নদীর দিকে নেমে গেছে, সেখানে একটা ছোটখাটো জটলা। কিছু মানুষের অস্পষ্ট ফিসফাস, গুজুরগুজুর শব্দ রাতের নিস্তব্ধতাকে আরও ভারী করে তুলেছে। আকাশ আমার হাতটা শক্ত করে ধরে ভিড়ের দিকে এগিয়ে গেল।

আমার হৃদপিণ্ডটা গলার কাছে এসে আটকে গেছে। প্রতিটি পদক্ষেপ আমার কাছে মনে হচ্ছিল অনন্তকালের যাত্রা। ভিড়টা ঠেলে আমরা যখন সামনে এগোলাম, আমার পৃথিবীটা যেন দ্বিতীয়বারের জন্য থেমে গেল।

ঘাটের ভেজা মাটির ওপর, খোলা আকাশের নিচে নিতু শুয়ে আছে। তার শাড়িটা জলে ভিজে শরীরের সাথে লেপ্টে আছে, খোলা চুলগুলো ভেজা মাটিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। অসংখ্য কৌতূহলী চোখ তাকে ঘিরে ধরেছে। তাদের চাপা কণ্ঠের আলোচনা আমার কানে বিষের মতো প্রবেশ করছিল। "কোন বাড়ির মেয়ে কে জানে...", "রাতে এই ঘাটে কী করছিল...", "আত্মহত্যার চেষ্টা নাকি অন্য কিছু..."

আমি আর এক মুহূর্তও দাঁড়ালাম না। চারপাশের মানুষ, তাদের মন্তব্য, পৃথিবীর সবকিছু আমার কাছে অর্থহীন হয়ে গেল। আমি ভিড় ঠেলে নিতুর পাশে হাঁটু গেড়ে বসে পড়লাম। ওর মুখটা চাঁদের আলোয় ফ্যাকাসে, নির্জীব দেখাচ্ছে। বুকের ভেতরটা ধক করে উঠলো এক তীব্র আতঙ্কে। এই কি তবে সেই নিতু, যার হাসিতে আমার সকাল হতো? এই কি সেই মেয়ে, যে আমাকে 'কালো ভূত' বলে আমার অস্তিত্বকে চুরমার করে দিয়েছিল?

আমার সব রাগ, সব অপমান, সব যন্ত্রণা কর্পূরের মতো উবে গেল। আমি কাঁপা কাঁপা হাতটা ওর নাকের কাছে নিয়ে গেলাম। কয়েক মুহূর্তের জন্য আমার নিজের শ্বাসও বন্ধ হয়ে এলো। তারপর... হ্যাঁ, অতি ক্ষীণ, প্রায় অনুভূত না হওয়া একটা উষ্ণ বাতাস আমার আঙুল স্পর্শ করলো। ও বেঁচে আছে!

আমার মৃতপ্রায় শরীরে যেন কেউ সঞ্জীবনী সুধা ঢেলে দিল। আমি আকাশের দিকে চিৎকার করে উঠলাম, "আকাশ, ও বেঁচে আছে! গাড়ি নিয়ে এদিকে আয়, তাড়াতাড়ি!"

আকাশ ততক্ষণে গাড়ি নিয়ে হাজির। আমরা মানুষের ভিড় আর তাদের হাজারো প্রশ্নকে উপেক্ষা করে নিতুর নিথর দেহটা পাঁজাকোলা করে তুলে নিলাম।
গাড়িতে উঠিয়ে দ্রুত হাসপাতালের দিকে ছুটলাম। গাড়ির পেছনের সিটে নিতুর মাথাটা আমার কোলে রাখা, আমি ওর শীতল কপালে হাত বুলিয়ে দিচ্ছি আর বিড়বিড় করে কেবল একটাই কথা বলছি, "কিছু হবে না নিতু, আমি আছি। আমি তোমার পাশে আছি।"

জরুরী বিভাগে ওকে নিয়ে যাওয়ার পর সময়টা যেন আবার থমকে গেল। প্রতিটা মুহূর্ত আমার কাছে এক একটা যুগের মতো মনে হচ্ছিল। একজন নার্স এসে ওকে পরীক্ষা করে গেলেন। আমার অস্থির অবস্থা দেখে তিনি শান্ত গলায় বললেন, "অক্সিজেন লেভেল কিছুটা কম, আর শরীর খুব দুর্বল। তবে ভয়ের কিছু নেই। জ্ঞান ফিরতে একটু সময় লাগবে। আপনারা চিন্তা করবেন না।"

তার কথাগুলো আমার ঝোড়ো মনের সমুদ্রে যেন এক টুকরো শুকনো ডাঙার মতো কাজ করলো। আমি একটা চেয়ারে ধপ করে বসে পড়লাম। এতক্ষণের চেপে রাখা ক্লান্তি আর আবেগ যেন বাঁধভাঙা বন্যার মতো আমার শরীর আর মনকে গ্রাস করলো।

ঘড়ির কাঁটাটা টিক্ টিক্ করে এগিয়ে চলেছে। রাত গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছে। কেবিনের কাঁচের ভেতর দিয়ে আমি নিতুর শান্ত মুখের দিকে তাকিয়ে আছি। সেই মুখে এখন কোনো রাগ নেই, কোনো ঘৃণা নেই, আছে শুধু একরাশ ক্লান্তি আর অসহায়ত্ব। আমার মনে হলো, এই মেয়েটা হয়তো জগতের সবচেয়ে বড় বোঝাটা নিজের কাঁধে বয়ে বেড়াচ্ছিল।

রাত সাড়ে তিনটের দিকে ওর আঙুলগুলো একটু নড়ে উঠলো। আমি সচকিত হয়ে ওর বিছানার পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। ধীরে ধীরে, খুব ধীরে ধীরে নিতু চোখ খুলল। প্রথমে ঘোলাটে দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো, তারপর ওর দৃষ্টি আমার ওপর স্থির হলো। আমাকে দেখার সাথে সাথেই ওর চোখের তারা দুটো কেঁপে উঠলো। একরাশ লজ্জা, অপরাধবোধ আর ভয় এসে ওর দৃষ্টিকে আবৃত করে ফেলল। ও দ্রুত চোখ নামিয়ে নিল।

আমার বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো। আমি ওর মাথায় হাত রেখে শান্ত গলায়, ফিসফিস করে বললাম, "তুমি ঠিক আছো?"

নিতু কোনো কথা বলল না। শুধু খুব আস্তে করে মাথা নাড়ল, যার অর্থ 'হ্যাঁ'।

আমি আর কিছু জিজ্ঞেস করলাম না। কেন এই অবস্থা, কী হয়েছিল, রাতুলের কী হলো—কোনো প্রশ্নই আমার মাথায় এলো না। আমার শুধু মনে হলো, এই মুহূর্তে মেয়েটার সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন আশ্রয়, নিরাপত্তা। প্রশ্নবাণে জর্জরিত হওয়ার জন্য তো সারা জীবন পড়ে আছে।

সকালের আলো ফোটার পর ডাক্তার ওকে ছেড়ে দিলেন। বাড়ি ফেরার পুরো পথটা ও আমার দিকে একবারও তাকায়নি, পাথরের মূর্তির মতো গাড়ির জানালার দিকে তাকিয়ে ছিল। আমিও নীরবতা ভাঙার চেষ্টা করিনি।

আমাদের ফ্ল্যাটে পা রাখার পর পরিবেশটা কেমন যেন অচেনা লাগছিল। তিন দিন আগে যেটাকে আমার কবরস্থান মনে হচ্ছিল, সেটা এখন এক অদ্ভুত নীরবতায় পরিপূর্ণ। আমি সোজা জানালার ধারে গিয়ে দাঁড়ালাম। বাইরের ভোরের আকাশটা দেখছি আর ভাবছি, জীবন কত বিচিত্র!

তিন দিন আগে এই আমিই ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে ছিলাম, আর আজ আমার পাশে সেই ধ্বংসের কারণ দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু আমার ভেতর কোনো ঘৃণা নেই।

কিছুক্ষণ পর একটা কাপ হাতে আমার পাশে এসে দাঁড়ালো নিতু। চায়ের উষ্ণ গন্ধ আমার নাকে এসে লাগলো। ও আমার দিকে কাপটা এগিয়ে দিয়ে ভাঙা, প্রায় অশ্রুত স্বরে বলল, "এই নিন।...
আমি ওর হাত থেকে চায়ের কাপটা নিলাম। আমাদের আঙুলগুলো এক মুহূর্তের জন্য স্পর্শ করলো, আর ও যেন বিদ্যুতের শক খাওয়ার মতো হাতটা সরিয়ে নিল। আমি চায়ে চুমুক দিতেই ও আর নিজেকে ধরে রাখতে পারল না। ওর কণ্ঠ চিরে একটা চাপা কান্নার শব্দ বেরিয়ে এলো।

"আমাকে মাফ করে দিয়েন শুভ্র সাহেব। আমি... আমি অনেক বড় ভুল করেছি। আমি বুঝতে পারিনি। আমি চাকচিক্যের পেছনে দৌড়াতে গিয়ে দেখিনি, খাঁটি সোনা তো আমার ঘরেই ছিল।"

ওর 'শুভ্র সাহেব' সম্বোধনটা আমার বুকে ছুরির মতো বিঁধল। আমি ওর দিকে তাকালাম। ওর চোখ দিয়ে অঝোরে জল পড়ছে। আমি কিছু বলার আগেই নিতু আবার বলা শুরু করলো, ওর কণ্ঠস্বর অনুশোচনায় কাঁপছে।

"আমি রাতুলকে ভালোবেসেছিলাম, শুভ্র। বলতে গেলে, ওর রূপের মোহে, ওর মিষ্টি কথায় আমি আকৃষ্ট হয়েছিলাম। আমার মনে হয়েছিল, ওর মতো করে আমাকে এই পৃথিবীতে আর কেউ ভালোবাসতে পারবে না। ওর জন্য আমি আমার পরিবার, আমার মা, এমনকি আপনার দেওয়া সম্মান—সবকিছুকে পায়ে ঠেলে চলে গিয়েছিলাম। আমি ওর প্রেমে হাবুডুবু খেয়েছি, একটা রঙিন ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখেছি।"

ও থেমে দম নিলো। চোখের জল মুছল শাড়ির আঁচল দিয়ে।

"কিন্তু যখন আমি ওর দেওয়া ঠিকানায় ওর বাসায় গেলাম, আমার স্বপ্নটা এক মুহূর্তে কাঁচের মতো ভেঙে গেল। আমি দেখলাম, একটা মহিলা দরজা খুলল, তার কোলে একটা বাচ্চা। আমি কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই ভেতর থেকে আরও একটা ছোট বাচ্চা দৌড়ে এসে রাতুলকে 'বাবা' বলে জড়িয়ে ধরল। আমি জানলাম, ওই মহিলা ওর তিন নম্বর বউ, আর বাচ্চা দুটো আগের দুই সংসারের। আমার পায়ের তলার মাটি সরে গিয়েছিল সেদিন। যে মানুষটাকে আমি আমার সব ভেবেছিলাম, সে আসলে একটা প্রতারক, একটা চরিত্রহীন লোক।"

ওর প্রতিটি শব্দ আমার ভেতরটাকে তোলপাড় করে দিচ্ছিল। আমি শুধু চুপ করে শুনছিলাম।

"আমার তখন আপনার কাছে ফিরে আসার কোনো মুখ ছিল না। যে মানুষটাকে আমি এত বড় অপমান করে, এত কষ্ট দিয়ে চলে এসেছি, তার সামনে আমি কোন মুখে দাঁড়াব? আমার মনে হচ্ছিল, মরে যাওয়া ছাড়া আমার আর কোনো পথ খোলা নেই।...
তাই আমি ওই কালি মন্দিরের ঘাটে গিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম, সব শেষ করে দেবো। আমি জলে ঝাঁপ দিয়েছিলাম, কিন্তু... কিন্তু সাঁতার জানা মানুষ কি আর ডুবে মরে? আমি ডুবতে পারিনি। বাঁচার তীব্র আকুতি নয়, বরং মরতে না পারার ব্যর্থতায় আমি একসময় ক্লান্ত হয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। তারপর কী হয়েছে, আমার আর কিছু মনে নেই।"

কথাগুলো শেষ করে নিতু কান্নায় ভেঙে পড়ল। ও আমার পায়ের কাছে বসে পড়তে যাচ্ছিল, আমি ওকে ধরে ফেললাম। ও আমার বুকে মুখ লুকিয়ে শিশুর মতো কাঁদতে লাগলো। ওর কান্নার প্রতিটি ফোঁটা আমার শার্ট ভিজিয়ে দিচ্ছিল, আর ধুয়ে দিচ্ছিল আমার মনের সব ক্ষত, সব অভিযোগ।

আমি ওকে আরও শক্ত করে নিজের সাথে জড়িয়ে ধরলাম। ও আমাকে বলল, "আমাকে আপনি মাফ করে দেন।"

ওর কথা শুনে আমি ওকে আমার থেকে একটু ছাড়িয়ে, ওর মুখটা তুলে ধরলাম। ওর ভেজা গাল দুটো আলতো করে মুছে দিয়ে বললাম, "দূর পাগলি! তুমি তো আমার মিষ্টি বউ, আমার পরী বউ। আমার কাছে আবার কিসের মাফ চাওয়া?"

আমার কথা শুনে ও অবাক হয়ে আমার দিকে তাকালো। ওর চোখে অবিশ্বাস।

আমি মৃদু হেসে বললাম, "জীবনে ভুল তো মানুষই করে, তাই না? কিন্তু সেই ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে ফিরে আসার মতো সাহস ক'জনের থাকে?....
অন্যের জন্য, একটা প্রতারকের জন্য নিজেকে কেন শেষ করে দেবে? তোমার জীবনটা কি এতই সস্তা?"
আমার কথায় ও যেন আশ্রয় খুঁজে পেল। ও আমাকে আবার জাপটে ধরে বলল, "আমি আর কোনোদিনও এমন ভুল করবো না।"

আমি ওর চুলে বিলি কাটতে কাটতে বললাম, "কখনো এমন পাগলামি করবে না। কথা দাও।" ও মাথা নাড়ল।

কিছুক্ষণ পর পরিবেশটা একটু শান্ত হলে আমি জিজ্ঞেস করলাম, "আচ্ছা, মা কোথায় গেছেন?"

আমার প্রশ্নে নিতু চমকে উঠলো। ও আমার থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে অপরাধীর মতো মাথা নিচু করে বলল, "আমি... আমিই মাকে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। কারণ আমি জানতাম, মা থাকলে আমি বাড়ি থেকে বের হতে পারতাম না।...
এই মায়ের সাথেই আমার দূরত্বটা তৈরি হয়েছিল রাতুলের জন্য। মা আমাদের সম্পর্কের কথা জেনে গিয়েছিলেন আর বাবাকে বলে দিয়েছিলেন। বাবা কোনো কিছু না ভেবেই আপনার সাথে আমার বিয়েটা দিয়ে দেন, ভেবেছিলেন আমি হয়তো শুধরে যাবো।"

আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। সব জট আজ খুলতে শুরু করেছে। আমি নিতুর হাতটা ধরে বললাম, "যা হওয়ার হয়ে গেছে। এখন আর পেছনের কথা ভেবে লাভ নেই। আজ বিকালেই আমরা মাকে ফিরিয়ে আনতে যাব। একটা নতুন জীবন শুরু করা যাক, কেমন?"

নিতু কৃতজ্ঞতার দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালো। ওর চোখে জল, কিন্তু এবার সেটা অনুশোচনার নয়, ভালোবাসার। ও আমার হাতটা শক্ত করে ধরে রাখলো।

আজ এতদিন পর আমার এই ফ্ল্যাটটাকে আবার একটা বাসা মনে হচ্ছে। যে ঘরে আমি তিন দিন ধরে জীবন্ত লাশ হয়ে পড়েছিলাম, সেই ঘরে এখন প্রাণের সঞ্চার হয়েছে। আমার 'কালো' চেহারাটা হয়তো বদলায়নি, কিন্তু আজ আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আমার নিজেকে আর 'ভূত' বলে মনে হচ্ছে না।...
আমার মনে হচ্ছে, আমি পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ। কারণ আমার পরী বউটা তার ভুল বুঝতে পেরে আমার কাছে ফিরে এসেছে। আমাদের ভালোবাসার গল্পটা হয়তো একটু অন্যরকমভাবে শুরু হয়েছিল, কিন্তু শেষটা আমরা দুজনে মিলেই সুন্দর করে লিখবো।

#কালো_জামাই
#শেষপর্ব
্পর্শ

ভুল ত্রুটিগুলো মাফ করবেন।
নতুন কোনো গল্পে আবার দেখা হবে।

 #বড়ো আপা ২ #শারমিন আঁচল নিপা #পর্ব- ১০/শেষ অংশমারিসা হলো মালিহার ছোটো বোন। সে বিদেশে থেকেই পড়াশোনা করত। মালিহার মৃত্যুর...
30/10/2025

#বড়ো আপা ২
#শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব- ১০/শেষ অংশ

মারিসা হলো মালিহার ছোটো বোন। সে বিদেশে থেকেই পড়াশোনা করত। মালিহার মৃত্যুর পর দেশে আসে। সে বুঝতে পেরেছিল মালিহার মৃত্যুটা পরিকল্পিত ছিল। আর সেটা আনহারিই করেছে কৌশলে। কারণ ওয়াজেদ চৌধুরি এবং মালিহার সম্পর্কের ব্যাপারে সে জানত। সে এটাও জানত আনহারি পরিবারে এখন আনহারি নেই, আছে তার বোন অনন্যা। মালিহা অনন্যার এক্সিডেন্ট করালেও সে বেঁচে গিয়েছিল। সে গাড়িতে অনন্যা এবং আরেকটি মেয়ে ছিল।

আর মৃত্যুটা সে মেয়েরেই হয়। মেয়েটা অনাথ ছিল। তাই কেউ তার খোঁজ করে নি। তবে সবাই ভাবে নিয়েছে অনন্যার মৃ/ত্যু হয়। দুই দুইবার মৃত্যুর কোল থেকে অলৌকিকভাবে অনন্যা বেঁচে ফিরে। এরপর অনন্যার আশ্রয় হয় একটা আশ্রমে। সেখানে অনন্যা বেশ শক্তপোক্তভাবেই নিজেকে গড়ে নিচ্ছিল। আনহারি যখন আনহারি ভবনে ফিরে আসে তখন আনহারিকে অনন্যায় দূর থেকে সাহায্য করছিল যাতে করে আনহারি অনন্যার প্রতিশোধটা সঠিকভাবে নিতে পারে। সব মিলিয়ে তাদের পরিকল্পনা সুন্দরভাবে এগুচ্ছিলো।
শেষদিন অনন্যায় তার স্বামীকে হত্যা করে প্রতিশোধ নেয়। সে চেয়েছিল শেষ প্রতিশোধটা সেই নিবে। তাই আনহারি যেন সে স্পটে গিয়ে প্রতিশোধ নিতে না পারে সজন্য সেই এই আনহারির চোখ বেঁধে আলাদা জায়গায় স্থানান্তরিত করে। এরপর দীপকের গুলি দিয়ে দীপককেই খুন করে। এতে করে ময়না তদন্তের রিপোর্ট জানান দেয় দীপক নিজেই নিজেকে গুলি করে আত্মহত্যা করে। ঠিক যেভাবে অনন্যাকে মেরে সবাই রটিয়েছিল। সেভাবেই অনন্যা চেয়েছিল দীপকও খু'ন হোক৷ সে সময় ফিয়না আর তাদের পরিচিত মহিমা অনন্যাকে দেখলেও চোখের নিমিষে অনন্যা নিজেকে আড়াল করে ফেলে। কারণ তার ফেঁসে যাওয়ার চান্স ছিল। সে মুহূর্তে অনন্যা ফিরে আসতে চায়নি৷ কারণ এতে আইনি জটিলতা বাড়ত। তাই সে নিজেকে আত্মগোপনেই রেখেছিল৷

সেখান থেকে কাহিনির মোড় নেয়। কারণ এদিকে মরিসা জানত মালিহাকে খুন করা হয়েছে। আর সেটা আনহারিই করেছিল। তাই সে অনন্যা জীবিত থাকার বিষয়টা জানতে পেরে অনন্যাকে নিজের কাছে নিয়ে আসে। সে খুব ভালো হিপনোটাইস করতে পারত। তাই সে অনন্যাকে হিপনোটাইস করে নিজের মতো করে তৈরী করছিল।...
সে অনন্যাকে আনহারির বিরুদ্ধে বিষিয়ে দিচ্ছিল। এটা বুঝিয়ে দিচ্ছিল আনহারি আর সে জমজ বোন হওয়া স্বত্ত্বেও তার জীবনে এত কষ্ট। একমাত্র আনহারির জন্যই তার জীবনে এত কষ্ট। আনহারি যদি না থাকত আজকে আনহারির জায়গায় সে থাকত। টাকার অভাবে তার পড়ালেখা বন্ধ হত না৷ টাকার অভাবে তার সংসার ভাঙত না। এসব বলে বলে দিনকে দিন অনন্যাকে বিষিয়ে তুলেছিল।

মারিসায় আনহারিকে কষ্ট দেওয়ার তার মেয়েকে তুলে নিয়ে আসে। মারিসায় ফিয়নার হবু পাত্রকে তুলে এনে আটকে রাখে যাতে করে ফিয়না কষ্ট পায়। কষ্টের মাত্রা বাড়াতে মারিসা অনন্যাকে আনহারির বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেয়। অনন্যাকে ঠিক এমনভাবে প্রস্তুত করে দেখে দুজনকে কেউ আলাদা করতে পারবে না।

তাই সেদিন অনন্যা সে বাড়িতে গিয় ব্যাংক চেক আনার সময় আনহারির ছবিটা নিয়ে আসে। কারণ আনহারির প্রতি রাগ আর ক্ষোভটা সে তার ছবির সাথে মিটিয়েছিল। মারিসার কথা মতেই ব্যাংক থেকে টাকা তুলে আনা হয়। উদ্দেশ্য একটায় ছিল আনহারিকে নাকানি চুবানি খাওয়ানো।

মারিসা জানত ফিয়না আর যুক্তির সম্পর্ক। তাই বিষয়টা আরও থ্রিল করতে সে অনন্যাকে পাঠায় যুক্তির কাছে। আর নতুন একটা নাটক সাজিয়ে অনন্যার মাথায় ঢুকিয়ে দেয়। যাতে করে অন্যনা সেটাই বলে। যেহেতু অনন্যা পুরোপুরি তার কনট্রোলে ছিল তাই সে নিজেকে সেভাবেই উপস্থাপন করে। কারণ অনন্যা তখন নিজেকে বিষাদময় অতীতের ভিকটিম ভাবতে শুরু করে। আর কাকতালীয়ভাবে তাদের কাজের মেয়ে নিরা যুক্তির বাসায় কাজ নেয়। এ ঘটনার সাথে নিরা একদম জড়িত ছিল না। শুধু নিরা পরিস্থিতি আর বিষাদের শিকার কেবল।

এবার প্রশ্ন জাগতে পারে আনহারি বিষয়টি কীভাবে বুঝেছিল। কারণ সেদিন অনিকেত প্রান্তরের কাছে মারিসায় গিয়েছিল। মারিসা হিপনোটাইসে একদম পটু ছিল। তাই অনিকেত প্রান্তরের স্মৃতিতে সে অনন্যার ছবিটা এঁকে দেয়।...
তাই অনিকেত প্রান্তর মারিসাকে অনন্যার মতো করে প্রথম দেখে। এটা ঠিক ততক্ষণ পর্যন্ত স্থায়ী ছিল যতক্ষণ পর্যন্ত আনহারি আর যুক্তি সেখানে পৌঁছেছে। পৌঁছানোর পর অনিকেত প্রান্ত কে মারিসা তার হিপনোটাইসের প্রভাব থেকে মুক্ত করে দেয়। যার দরুণ সবাই তাকে অন্য রূপে দেখে।।আর অনিকেত প্রান্তও তখন বিষয়টি বুঝতে অক্ষম হয়।

কিন্তু একটা সময় পর অনিকেত প্রান্ত নিজেই আনহারির সাথে যোগাযোগ করে বিষয়টি উপস্থাপন করে একটা মেইলে। আর সে মেইল দেখেই সে মারিসার ব্যাপারে খুটতে থাকে। খুটতে খুটতে সে জানতে পারে এ মারিসায় মালিহার বোন। তখন আনহারি বুঝতে পারে এ দুনিয়ায় একমাত্র মারিসার শত্রু সে। কারণ মালিহার মৃত্যুর পেছনে আনহারির হাত ছিল। আর সেখান থেকেই সে মারিসার ঠিকানা উদঘাটন করতে সক্ষম হয়।

আনহারি যখন মারিসার ঠিকানায় পৌঁছে যাচ্ছিল তখন মারিসা বুঝতে পারে আনহারি আসছে। তাই তার ভেতরে ভয় ঢুকাতে পেপার টা পাঠায়। যখন সে ভেতরে পৌঁছায় তখন সে অনন্যার মাথায় গুলি তাক করে একের পর এক অভিযোগ দিতে থাকে। আর একটা পর্যায়ে আনহারিকে কষ্ট দিতেই অনন্যাকে খুন করে।...
তার ইচ্ছা ছিল উপরে উঠে টুলটুলকে খুন করবে আর ফিয়নার হবু স্বামী নুসহাবকে খুন করবে। তবে সে যখন উপরে উঠে তখন আনহারিকে ফেইলর বলে বলে বিব্রত করছিল। আর সেটার ফলস্বরূপ মারিসা নিজেই নিজে গুলি করে আত্মহত্যা করে।

অফিসার আনাম মারিসা এবং অনন্যার লা/শটা নিয়ে গেল। ফিয়না অঝোরে কাঁদতে লাগত। এত বছর পর সে অনন্যার স্পর্শ পেল কিন্তু জীবিত পেল না। শেষ মুহুর্তেও সে শান্তি পেল না। নুসহাবকে দেখে ফিয়না দৌঁড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরল। কাঁদতে কাঁদতে বলল

"আমি সত্যিই বিশ্বাস করতে পারিনি তুমি আমাকে ছেড়ে চলে যাবা। মনের মধ্যে একটা কিন্তু যেন থেকেই গিয়েছিল।
নুসহাব ফিয়নাকে হালকা গলায় বলল

"মাঝে মাঝে জীবনে এডভেঞ্চার না হলে হয় না। অনেক হাঁপিয়ে একটা জিনিস পেলে মূল্য থাকে। আমার মূল্যও আজীবন তোমার কাছে থাকবে। সেভাবে তোমার মূল্যও আমার জীবনে অমলিন হয়ে থাকবে।"

ময়নাতদন্তের পর অনন্যার লা/শ দিলে পরিবারের সবাই মিলে তাকে দাফন করে। এ যেন ঝড়ের পরে এক পশলা বৃষ্টি পড়ে সব কালিমা দূর করার মতো।..
যুক্তি তার মেয়েকে নিয়ে বিদায় নিল। যুক্তির বিদায়ের সময় ফিয়না যুক্তিকে পিছু ডেকে বলল

"আচ্ছা আমি মাঝে মাঝে একটা কালো বিড়াল দেখতাম। যখনই অনন্যার উপস্থিতি টের পেতাম। এটা কেন এমন হয়? "

"অবচেতন মন যখন কোনো বিপদের আর রহস্যের আশঙ্কা করে তখন মানুষ কালো কাক, কালো কুকুড়, কালো বিড়াল এসব দেখতে থাকে। এটা মূলত মানসিক অশান্তির প্রভাবে হয়। তোমারও তাই হয়েছে।"

যুক্তি কথাগুলো বলে চলে গেলো। টুলটুলকে পেয়ে আনহারি যেন তার পুরো জীবন ফিরে পেয়েছে।...
টুলটুলকে পাওয়ার পর তার স্বামী তার নিকট ফিরে আসতে চায়লে আনহারি আর জায়গা দেয় নি। নিজের একমাত্র ভরসা টুলটুল আর লাবন্যজোহাকে নিয়েই পুরো জীবন কাটিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় সে।

এদিকে ফিয়নাও বেশ সাদামাটা ভাবে নুসহাবকে বিয়ে করে সংসার শুরু করে।

তবে প্রতিটা মানুষের মনে এখনও অনন্যা বাস করে। বাস করে বয়ে বেড়াচ্ছে তার স্মৃতি।

সমাপ্ত

 #তাজমহল  #দ্বিতীয়_খন্ড #পর্ব_৯ #প্রিমা_ফারনাজ_চৌধুরী“হবো না রিল্যাক্স। আমার রাগের দাম এই দুই পয়সা? জড়িয়ে ধরে শুধু এক...
29/10/2025

#তাজমহল #দ্বিতীয়_খন্ড
#পর্ব_৯
#প্রিমা_ফারনাজ_চৌধুরী

“হবো না রিল্যাক্স। আমার রাগের দাম এই দুই পয়সা? জড়িয়ে ধরে শুধু একটা চুমু?"

তাজদার হতচকিত! এমন কথা শাইনার মুখে সচরাচর শোনা যায় না। সে খুব সাবধানে কথা বলে। শব্দ উচ্চারণ সতর্কতা অবলম্বন করে।
সে অবাক না হয়ে পারছে না।

শাইনা তাকে সরিয়ে দিয়ে দ্রুত কয়েক পা পিছিয়ে গিয়েছে। দেয়ালের দিকে মুখ করে দূরে দাঁড়িয়ে হাঁপাচ্ছে সে। রাগে চোখদুটো দগদগে লাল।

তাজদার অবাক হয়ে শাইনার দিকে তাকাল। সংযত, শান্ত স্বভাবের শাইনা এভাবে কথা বলছে, এমন উন্মুক্ত আবেগ দেখাচ্ছে এটা অবিশ্বাস্য!

তাজদার সাবধানে পা বাড়াতে বাড়াতে নরম সুরে বলল, "আচ্ছা শান্ত হও। এভাবে বললে বাড়ির মানুষ কেউ শুনতে পাবে।"

শাইনা আরও কিছুটা পিছিয়ে গিয়ে প্রায় কঠোরভাবে জবাব দিল, "শুনুক।"

তাজদারের কপালে সূক্ষ্ম ভাঁজ পড়ল। "এইসব বাচ্চামি মমতাজ। তোমাকে মানাচ্ছে না।"

শাইনার কণ্ঠস্বর এবার সামান্য হলেও খাদে নামল।

"না মানাক। আপনি দাদুকে কি কি বলেছেন সব শুনেছি আমি।"

তাজদার এগিয়ে এল। "মুখে যা বললাম তা তো শুনতে পাবেই। মনের কথা তো শুনতে পাওনা। এসো একটু জড়িয়ে ধরো ভালো করে। মনের কথা শোনো। কেন আমি ওরকম বলেছি তার পেছনের কারণটা তো জানতে হবে তোমাকে।"

শাইনা কোনো কথা শুনবে না। সে পালঙ্কের পেছনে গিয়ে এমনভাবে দাঁড়াল যে তাজদার তাকে আর দেখতে পারছে না। তার মাথায় একটি কথাই ঘুরছে। তার ইমোশন ফেইক। সে আর কোনো ইমোশন দেখাবে না। একদম না।

তাজদার কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। তারপর একরাশ হতাশা ঝরে পড়ল তার কণ্ঠে, "তুমি আসবে না তাই তো?"

অন্য পাশ থেকে শীতল উত্তর এলো, "জীবনেও না।"

তাজদার দীর্ঘশ্বাস ফেলল। "ধৈর্যের পরীক্ষা নিচ্ছ?"

শাইনা সুযোগ পেয়েই ফুঁসে উঠল।

"আপনি যে যখন তখন আমাকে ব্লেম করেন তার বেলা?"

তাজদারও এবার একটু কঠিন হলো।

"তুমি যে আমার কাছে থাকতে চাওনা এই সত্যিটা বলে ভুল করেছি আমি?"

"আমি থাকতে চাই না?"

তাজদারের অভিযোগ তীক্ষ্ণ।

"পাঁচ মাস ভিডিও কলে দেখে দিন কাটিয়ে দিয়েছ। তুমি দিব্যি ভালো ছিলে। ছিলে না?"

"হ্যাঁ, সব আমারই দোষ।"

"আবারও কথা ঘোরাচ্ছ। আমি কি জিগ্যেস করেছি?"

"হ্যাঁ, ভালো ছিলাম। বেশ ছিলাম। তো?"

"দাদুকে ওটাই বলছিলাম। যে পাঁচ মাস আমাকে ছেড়ে আরামসে থাকতে পারে, সে পাঁচ বছরও থাকতে পারবে।"

"বসে বসে কাঁদতে বলছেন? কাঁদিনি তারপরও এসে হাসছিলেন এই বলে কাঁদতে কাঁদতে সিদ্দিক বাড়ি বন্যায় ভাসিয়ে দিয়েছি। বেশ করেছি কাঁদিনি।"

শেষ আঘাতটা হানল তাজদার।

"তুমি কত পাষাণ! অথচ বলে বেড়াও আমিই বেশি পাষাণ।"

কথাটা বলার সাথে সাথে দুই পক্ষ নীরব। ঘরের মধ্যে পিনপতন নীরবতা। বাইরে ঝিঁঝিঁ পোকার একঘেয়ে ডাক আর ঘড়ির কাঁটার মৃদু টিক্ টিক্ শব্দ ছাড়া কোনো কিছুর অস্তিত্ব নেই। শাইনার চোখে জল জমছে। সে আবারও তা মুছে ফেলছে। তার চোখের পানি আরেক বেহায়া।

তাজদার শান্তভাবে বলল,"আচ্ছা বাদ দাও। কেউ কারো জন্য কষ্ট পেয়ে লাভ নেই। ওইসব বাদ। মানুষ ছাড়া মানুষ মরে না। একটু কষ্ট হবে। তোমাকে যখন তখন মনে পড়বে। চাইলেই তোমাকে দেখবো না সামনে থেকে। একটু মজা করি, ওসব করতে পারবো না। হাত বাড়ালেই তোমাকে ছুঁতে পারি। এইসব আর পারবো না। এটুকুই। বাদ দাও। আমি যতক্ষণ আছি ততক্ষণ হাসিখুশি থাকো। সামনে এসো।"

শাইনা এল না। তাজদার বলল,"আচ্ছা এসো না। আমিই বেরিয়ে যাচ্ছি। তুমি ঘুমিয়ে পড়লে তখন আসবো।"

বলতে বলতে সে বেরিয়ে গেল। শাইনা উঁকি দিয়ে তার যাওয়ার পথে চেয়ে রইলো।

______

তাজদার যখন পুনরায় ঘরে ফিরল তখন অনেক রাত। বাইরে শীতের ঠান্ডা হাওয়া বইছে তাই তার গায়ে একটা বাদামী রঙের চাদর জড়ানো। সে আলতো করে দরজাটা ভেজিয়ে দিল।

ঘরে প্রবেশ করে দেখল বিছানায় শাইনা নেই। ডিমলাইটের মৃদু আলো অস্পষ্ট কিছু ছায়া তৈরি করেছে ঘরজুড়ে।

তাজদার চোখ কুঁচকে কিছু একটা ভাবল। ডিমলাইটের আলোয় ভুল দেখছে? ও আবার কোথায় যাবে? সে হাত বাড়িয়ে মূল সুইচ বোর্ডের দিকে যেতেই দেয়ালের ঠিক পাশে শাইনাকে দেখল।

শাইনা সেখানে দাঁড়িয়ে তার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। চোখদুটো জ্বলজ্বল করছে। সেই দৃষ্টিতে স্পষ্ট অভিযোগ। চেহারায় এখনও রাগের রেশ লেগে আছে। কিছুক্ষণ আগের ঝগড়ার উত্তাপ এখনও তার চোখে-মুখে জমাট বেঁধে আছে।

সবচেয়ে অবাক হওয়ার মতো বিষয়। তার পরনে সেই শাড়িটা! যেটা তাজদার তাকে উপহার দিয়েছিল। অন্ধকারে আবছা হয়েও শাড়িটার জমকালো লাল রং আর সোনালী কাজ তাজদারের চোখ এড়ালো না।

শাইনা নড়ল না। শুধু রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো।
তাজদার চাদরটা একপাশে রাখতে গিয়েও থামল। কথা না বলে এখন এগিয়ে যাওয়া মানে পরিস্থিতিকে আরও জটিল করা। সে বলল,"তুমি এখনো ঘুমোওনি কেন?"

শাইনা পাল্টা প্রশ্ন করলো,"কে যেন আমি ঘুমোনোর পর আসবে বলেছিল?"

তাজদার ঠোঁটের কাছে হাত রেখে হাসি আড়াল করলো। শাইনা তা বুঝতে পেরে তার দিকে জোরে একটা শপিং ব্যাগ ছুঁড়ে মেরে সেখান থেকে যেতে যেতে বলল,"চুড়িগুলো আমার হাতে হচ্ছে না। এত ছোট সাইজের চুড়ি আমার হাতে হয় না। আমি বড়ো মানুষ। দেখে মনে হচ্ছে বাচ্চাদের জন্য চুড়ি এনেছে।"

তাজদার শপিং ব্যাগটা খপ করে ধরে ফেললো। তারপর শাইনার দিকে চেয়ে বলল,

"আমি বললাম চুড়ি দিতে। ওরা দিল। এখন তোমার হাতে না হলে আমার দোষ?"

"অবশ্যই আপনার দোষ। আপনি আপনার বউয়ের হাতের সাইজ জানবেন না?"

"মারাত্মক ভুল হয়ে গিয়েছে।"

তাজদার বাকিটা বলার আগে শাইনা বলল,"মাফ নেই। সবকিছুর মাফ হয় না।"

"তুমি বড়ো মানুষ। বড়ো মানুষরা ছোটোমানুষকে মাফ করে দেয় জানতাম।"

"ছোটমানুষকে মাফ করে। যে ছোটোমানুষ সাজার চেষ্টা করে তাকে নয়।"

শাইনাকে আবারও আগের মতো জেদি হিসেবে ফিরে পেয়ে তাজদারের আনন্দ হচ্ছে। আবার চিন্তাও হচ্ছে কিভাবে একে শান্ত করানো যাবে।

শাইনা বিছানাটা এলোমেলো করে ফেলেছিল ব্লাউজ খুঁজতে খুঁজতে। কোমরে শাড়ির আঁচল গুঁজে সেগুলো গোছগাছ করতে করতে বলল,

"বাইরে আমার জন্য গিয়েছে নাকি নিজেকে সময় দিতে?"

তাজদার বাধ্য স্বামীর মতো উত্তর দিল,

"কুকুর তাড়াতে। বেশি ডাকাডাকি করছিল।"

শাইনা তার দিকে ফিরে তাকালো।

"আপনার জবাব কে চেয়েছে?"

তাজদার শব্দ করে হেসে ফেললো। শাইনা তেড়ে এসে বলল,"আবার হাসছেনও? আমাকে বিপাকে ফেলে আপনার তো খুব আনন্দ হচ্ছে। গোটা গোটা পাঁচ মাস! যে সময়টায় মেয়েরা স্বামীর কাছে যত্ন খুঁজে সেই সময়টা আপনি হাসপাতালে কাটিয়েছেন। যখন দেখলেন ওখানে আমি নেই তখন...

"আমি তোমাকে..

শাইনা বাঁধা দিয়ে বলল,"আগে আমার কথা শেষ করতে দিন। যখন ওখানে আমাকে দেখতে পেলেন না তখন আপনার ভীষণ রাগ হলো। কিন্তু আপনি সেটা কাউকে দেখালেন না। এমনকি ভিডিওকলে আমার সাথে কথা বলার সময়ও না। কারণ আপনি জানেন আমার শাস্তি হলো পাঁচ মাস আমি এখানে পড়ে থাকবো আর আপনি ঢাকায়।"

"আমি কিন্তু.

"আমার কথা শেষ হোক আগে।"

তাজদার পেছনে হাত ভাঁজ করে গলা হালকা কাত করে দাঁড়িয়ে মাথা নাড়তে নাড়তে বলল,"আচ্ছা তুমি বলো।"

শাইনা রাগ সামলে নিয়ে বলল,"আপনার মনে হয়েছে আমি ইচ্ছে করে ওখানে যাইনি। তাই নিজ থেকে একবারও আমাকে যেতে বলেননি। আপনার নীরবতা দেখে আপনার পরিবারও ভেবে নিয়েছে আপনি চান না আমি ঢাকায় যাই।"

তাজদার গম্ভীর হয়ে গাল চুল্কাতে চুল্কাতে বলল,"ভয়ানক ষড়যন্ত্র দেখছি।"

শাইনা রাগে দুঃখে তার গায়ের চাদর খামচে ধরে তাকে ঠেলে সরিয়ে দিল। মজা করছে এখনো তার সাথে? সে এখানে একটা কথাও মিথ্যে বলেছে? সবকিছুর দোষ তার? সামনে তার ডেলিভারি। বাঁচা মরা আল্লাহর হাতে। এমন একটা সময়ে সে চাইবে না তার সন্তানের বাবা তার পাশে থাকুক? এরা তাকে কি মনে করেছে? নিজেদের সব ভাবনা তার উপর চাপিয়ে দিয়ে যে যার সিদ্ধান্ত নেয়। তার কথা কে ভেবেছে ঠান্ডা মাথায়? রাগে তার মাথার চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করছে। এবার রাগগুলো জল হয়ে ঝরে পড়তে লাগলো গাল বেয়ে। রাগ যদিও একফোঁটা কমেনি।

তাজদারকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে সে চোখ মুছতে মুছতে বিছানার দিকে চলে যাচ্ছিল ঠিক তখুনি তাজদার তাকে পেছন থেকে জাপ্টে জড়িয়ে ধরে ঘাড়ে চেপে একটা চুমু খেয়ে বলল,"এনাফ! অনেক রাগরাগি হয়েছে আজকের জন্য। অতিরিক্ত হয়ে গিয়েছে। এসো।"

বলতে বলতে সে শাইনাকে তার গায়ের চাদরটার মধ্যে আড়াল করে নিয়ে সামনে ফিরিয়ে নিল। শক্ত করে জড়িয়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,"এমন শীতে একটা সোয়েটার অন্তত গায়ে দিতে হয় মমতাজ।"

"দেব না। আমার একটু শীত করছে না।"

তার মুখের উপর তপ্ত শ্বাস ছেড়ে তাজদার বলল,"আচ্ছা? তাহলে আমি যাকে জড়িয়ে ধরেছি তার শরীর কাঁপছে সেটা ভুল?"

"আমি মোটেও কাঁপছি না মিস্টার তাজদার সিদ্দিকী।"

তাজদার তার মুখের উপর ঝুঁকে কপালে চুমু খেতে খেতে বলল,"আচ্ছা! আমি ছুঁয়েছি বলে হয়তো কাঁপছো।"

শাইনা বলল,"মোটেও না।"

তাজদার তার ডান গালে আলতো করে চুমু খেয়ে বলল,"আমি আদর করলাম তাই হয়তো।"

শাইনা শক্তপোক্ত আবরণ একটু একটু সরছে। সে কম্পিত গলায় বলল,"একদম না।"

তাজদার সিদ্দিকী তার বাম গালে মুখ ডুবিয়ে চুম্বন করে বলল,"আমি তোমাকে ছুঁবো, আর তুমি কাঁপবে না তা কখনো হয়?"

শাইনা ক্ষীণ কণ্ঠে বলল,"বললাম তো কাঁপছিনা।"

"তুমি যে কাঁপছো না তার প্রমাণ কি? আমার কাছে প্রমাণ আছে যে তুমি কাঁপছো।"

বলতে বলতে সে শাইনার কানে একটা চুমু খেল। শাইনার শরীরটা এবার দুলে উঠলো। সাথে সাথে সে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,"আমাকে ছেড়ে দিন। আমি আপনার সাথে অভ্যস্ত হতে চাই না।"

"কেন অভ্যস্ত হতে চাও না?"

"নতুন করে কোনো কষ্ট পেতে চাই না।"

"তুমি বলতে চাইছো আমি যা ছুঁই সব দুঃখ হয়ে যায়?"

"আপনি আমাকে দুঃখ ছাড়া কি দিয়েছেন?"

"তুমি এত অভিযোগ রাখলে আমার কিন্তু যাওয়া হবে না।"

"অভিযোগের এখনো দেখেছেন কি?"

"থাক, আর দেখতেও চাই না। আমাকে যেতেই হবে। উপায় নেই।"

শাইনা তার কলার জাপ্টে ধরে তাজদারকে নিজের দিকে টেনে এনে বলল,"তাহলে এইসব আলগা পিরিত দেখাবেন না। এইসব ভুলতে না পারলে ভুগতে হবে।"

"ভুগতে ভুগতে ভুলে যাবে।"

শাইনা অদ্ভুতভাবে ক্ষীণ শব্দে একটা চিৎকার করে প্রতিবাদ করে উঠলো। তাজদার তার গায়ে চাদরটা ভালো করে তাকে জড়িয়ে ধরে বলল,"এইসব রীতিমতো অত্যাচার। তুমি শাড়ি পরেছ, আমি মন ভরে দেখবো। কিন্তু তা না। তুমি করছো ঝগড়া?"

"আমি ঝগড়া করছি?"

"না আমিই ঝগড়া করছি। তুমি কখনো ঝগড়া করতে পারো?"

"খোঁচা মারছেন!"

"আরেহ না। কে বললো খোঁচা মারছি?"

"আপনি মশকরা করছেন? এইমুহূর্তেও তামাশা করছেন।"

"তুমি কাঁদছো আর আমি তামাশা করবো বলে তোমার মনে হয়?"

"হয়। কারণ আপনি আমাকে কাঁদতে দেখলে সুখ পান।"

"পরের মতো কথা।"

"আপন কখন ভেবেছেন, নিজের কখন ভেবেছেন?"

"সবসময়। তোমাকে লাল শাড়িতে দেখার পর থেকেই নিজের নিজের লাগে। আজ একদম লাল টমেটো লাগছে। চলো, নুপুরটার একটা বিহিত করি। যাওয়ার আগে কিছু মহৎ কাজ না করলে চলে?"

"দরকার নেই।"

"খুব দরকার। চলো চলো। আচ্ছা একটু কোলেটোলে তুলি।"

"একদম না।"

তাজদার তাকে কোলে তুলে নিল। শাইনা তার গলা জাপটে জড়িয়ে ধরে রেখে বলল,"আমাকে কোলে নিয়ে কি প্রমাণ করতে চাইছেন?"

"তোমাকে কোলে নিলাম কে বললো? নিলাম জুনিয়রকে। ওর জন্মের সময় আমি থাকবো না। তাই এখন এভাবে নিয়ে নিলাম। ক্লিয়ার?"

শাইনার রাগ আরও বাড়িয়ে দিল সে। মনে মনে হাসলো ভীষণ। শাইনাকে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে শপিং ব্যাগ থেকে নুপুরটা বের করে তার সামনে বসলো। শাইনা বলল,"এইসব আপনি ইচ্ছে করে করছেন তাই না?"

তাজদার তার দিকে তাকালো। কিন্তু কোনো জবাব দিল না। পায়ে হাত দিতেই শাইনা শরীরে শিহরণ বয়ে গেল। তাজদার তার পা টেনে এনে নুপুরটা পরিয়ে দিতে লাগলো। শাইনা তার মুখের দিকে চেয়ে বলল,"বোবা হয়ে গেলেন কেন?"

তাজদার এবার ভাবলো আর কোনো কথা বলবে না। কথার পিঠে কথা বাড়বে। তাকে শান্ত করাতে হলে তার চুপ থাকাটা জরুরি। এইসময় অনেক রকম মুড সুয়িং হয় মেয়েদের। সে বালিশে মাথা রেখে শুয়ে পড়লো। বলল,"কিছুক্ষণ পর সকাল হয়ে যাবে।"

"শীতের রাত অনেক বড়ো।"

"ঘুমাও।"

শাইনা ধমকে বলল,"আপনি ঘুমান।"

"ওকে।"

শাইনা বিছানায় বসে প্রলাপ বকতে লাগলো। তারপর কিছুক্ষণ পরপর তাজদারের দিকে তাকাতে লাগলো। এই মানুষ কি চায় নিজেও জানেনা। সারাদিন তার সাথে সবার সাথে রাগ দেখালো চলে যেতে হবে বলে এখন আবার এমন ভাব দেখাচ্ছেন যেন উনি কখনোই রাগ দেখাননি। সব রাগ সে দেখিয়েছে।

সে আবারও চোখ মুছলো। আবারও দরজার দিকে তাকালো। কিছুক্ষণ পর আবারও তাজদার সিদ্দিকীর দিকে। শেষমেশ আর না পেরে বলল,

"কাল সকালেই আমি বাড়িতে চলে যাব। আর আসবো না। দুইদিন পর ঘরটা তো এমনিতেই খালি হবে।"

তাজদার চোখ খুলছেনা দেখে শাইনা তার দিকে চেয়ে রইলো। তাজদার সিদ্দিকী নিজ থেকে তাকে কষ্ট না দিলে তার এত কষ্ট পাওয়ার কথা ছিল না। অথচ যখন সত্যিই কষ্ট দিয়েছিল তখন সে এতটা ব্যথা অনুভব করেনি। তখন তো তার মনে হয়নি তাজদার সিদ্দিকী কষ্ট না দিলেও, তার কষ্ট হবে। তাজদার চোখ খুলতেই দুজনেই চোখাচোখি! সে পেটে চেপে হেসে উঠলো।

শাইনা করুণ সুরে কেঁদে উঠে আবারও সাথে সাথে তা গিলে ফেলে বলল,"আপনি আমাকে কাঁদিয়ে মজা পান।"

তাজদার তাকে টেনে এনে জড়িয়ে ধরলো। তারপর তার গালের এপাশে ওপাশে নিজের খসখসে গালে চেপে ঠোঁট ছোঁয়াতে ছোঁয়াতে বলল,"তুমি বুঝবে না। এই কান্না আমার অর্জন। তুমি আগে কাঁদতে আমি কষ্ট দিতাম বলে। এখন কাঁদছো আমার জন্য কষ্ট হচ্ছে বলে। শাইনা মমতাজ আমি তোমাকে নিজের করেই ফেললাম। দেখলে?"

শাইনার ঠোঁটের কাছে তার কানটা ছিল। কানে ঠোঁটের স্পর্শ খুব গাঢ়ভাবে লাগছিল ঠিক ভালোবেসে রাখা স্পর্শের মতোই।

___________

তাজদারের স্যুটকেস গোছানো হচ্ছে। শাইনা এককোণায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তা দেখছে। তাজদার খুব মনোযোগ দিয়ে জরুরি জিনিসপত্র গুছিয়ে নিচ্ছে।

শাহিদা বেগম সকাল সকাল ভাপা পিঠা আর খেজুরের রস পাঠিয়েছে। তাজদার বলেছে বেলা হলে খাবে। গরম ভাপা পিঠা শাইনার পছন্দ তাই সে গরম গরম খেয়ে নিয়েছে। তাজদারের পছন্দ ঠান্ডা ভাপা পিঠা। শাইনা বুঝলো না এটা কেমন পছন্দ? অবশ্য এই প্রশ্নটা সে করেনি।

রওশনআরা কিছুক্ষণ পর পর এসে জিগ্যেস করছেন, এটা ওটা দেবেন কিনা।

তাজদার শান্তভাবে উত্তর দিচ্ছে। তিতলিও ঘুরঘুর করছে ঘরের আশেপাশে। সকালে সে একটা কান্ড ঘটিয়ে বসেছে। ভাপা পিঠার মাঝখানে যতটুকুতে মিঠা আছে ততটুকু খেয়ে বাকিগুলো তৌসিফের হাতে ধরিয়ে দিয়েছে। তাই তৌসিফের মার খেয়েছে। বড়ো ভাইয়ের সাথে বেয়াদবির ফল তৌসিফ তাকে হাড়ে হাড়ে বুঝিয়ে দিয়েছে।

তাসনুভাও ভাপা পিঠা খেয়েছে। খাওয়ার পর বলেছে, এটা কোনো খাবারের পর্যায়েই পড়েনা।

সে আজ খুব চিন্তিত। কাল এয়ারপোর্টে তাকে নিয়ে যাবে না বলেছে ছোটো ভাইয়া। কিন্তু সে যাবেই। এইদিকে সে গেলে তিতলিও বায়না করছে সেও যাবে। ও যেতে পারলে সে যেতে পারবে না কেন এই ধরণের ফালতু লজিক দেখাচ্ছে।...
তিতলি আজকাল খুব বেয়াদব হয়েছে। আগে এমন ছিল না। শাইনার সাথে মিশে মিশে এমন হয়েছে। এখন কথায় কথায় বিয়ে বিয়ে করে। কি কারণে মেয়েরা বিয়ে বিয়ে করে এটা নিয়ে ভাবতে গিয়ে তাসনুভা খুব বাজে একটা কারণ খুঁজে পেয়েছে। তারপর তিতলির উপর অসম্ভব রাগ হয়েছে। বিয়ের কি বোঝে ও? ও জানে মেয়েদের বিয়ে পরবর্তী জীবন কেমন হয়? তিতলি এখনো ফ্যান্টাসির জগতে বসবাস করছে। সময়মতো মার পড়লে ঠিক হয়ে যাবে।

~~~

স্যুটকেস গোছগাছ শেষ করে তাজদার শাইনার দিকে তাকিয়ে,"ওই ছবিটা আমি নিয়ে যাচ্ছি।"

দেয়ালের টাঙিয়ে রাখা ছবিটা দেখিয়ে দিল সে। বউ সাজে শাইনা মমতাজ আর বর সাজে তাজদার সিদ্দিকী। শাইনা বলল,"ছবি দিয়ে কি করবেন?"

"রুমে রাখবো।
"নিচ্ছি।
শাইনা আস্তে করে বলল,"হু।"

তাজদার ছবিটা নিয়ে এসে প্যাক করতে লাগলো। শাইনা বলল,"ছবি দিয়ে মানুষ আরও অনেক কিছুই করে।"

"হ্যাঁ জাদু করে।"

শাইনা হঠাৎই শব্দ করে হাসলো তার কথার ধরণে।

"আপনিও জাদু করবেন?"

"হু।
"কীসের জন্য?
"যাতে ভুলে না যাও।"

"আপনাকে ভুলে যাওয়া সম্ভব বলছেন?"

"তোমার দ্বারা অসম্ভব কিছু আছে?"

"আপনি আবারও আমাকে রাগিয়ে দিচ্ছেন। অথচ কাল রাতে বলেছেন যাওয়ার আগে আর কোনো রাগারাগি হবে না।"

"তোমার জন্য এইমুহূর্তে রাগ করা ফরজ। করো ইচ্ছেমতো।"

"রাগ করতে বলছেন আমাকে। কিন্তু রাগ আপনার কথায় প্রকাশ পাচ্ছে।
"রাগ হবে না? তুমি অকারণে হাসছো কেন?"

"আপনি কাল রাতে আমাকে কাঁদতে দেখে হেসেছেন তাই।"

"তুমি মানুষ হওনি।...
শাইনা হেঁটে এসে তার শার্ট খামচে ধরে কাছে টেনে নাকে নাক ঠেকিয়ে বলল,"আপনাকে রাগ করলে কিন্তু মন্দ লাগে না। ছোটবেলায় ঘৃণা লাগতো। এখন হাসি পায়।"

"হাসি পায়?"

শাইনা হাসিমুখে বলল,"মানে আপনি বাচ্চাদের মতোই রাগ করেন তাই আর কি।"

"সব রাগ গোসসার অবসান ঘটিয়ে আমি গেলাম। তুমি হাসতে থাকো।"

শাইনা হাসতে লাগলো। হাসির আড়ালে যত্ন করে সে যে কি লুকিয়ে রাখলো তা তাজদার সিদ্দিকী টেরই পেল না। একেবারে পায়নি তা ভুল। পেয়েছে। ওইটুকু। যতটুকু গতরাতে চোখের পানিতে লেখা ছিল। চোখের পানি কতটুকু মনের ব্যাথা প্রকাশ করে?



চলমান...

বিয়ের পর ধ্রুবর সাথে বেলার সেভাবে সংসার গড়ে ওঠেনি। বিয়ে কারও অমতে না হলেও এমনটাই হয়েছিল। বিয়ের কিছুদিন পরই ধ্রুব বিদেশ চ...
29/10/2025

বিয়ের পর ধ্রুবর সাথে বেলার সেভাবে সংসার গড়ে ওঠেনি। বিয়ে কারও অমতে না হলেও এমনটাই হয়েছিল। বিয়ের কিছুদিন পরই ধ্রুব বিদেশ চলে যায় তাকে রেখে। তাদের যোগাযোগ তো হতো কিন্তু কাছে থাকলে, সাথে থাকলে যে মায়া, ভালোবাসা তৈরি হয় সেটা শত মেইল দূর থেকে সম্ভব হয় না।

বেলার আর ধ্রুবর বৈবাহিক সম্পর্ক বলতে ফোনালাপে কোন কোন সময় মৃদু গলায় কথোপকথন, বাড়িতে কার কী প্রয়োজন এতটুকুতেই সীমাবদ্ধ। বিয়ের পর ধ্রুব যখন প্রবাস জীবনে পা রাখল তখন প্রথমদিকে বেলার সাথেই কথা বলে তার সময় কাটতো৷ কয়েক বছরে তা কমতে কমতে শুধু প্রয়োজনে এসে দাঁড়িয়েছে।

বেলার যেটুকু সংসার হয়েছে সেটা শ্বশুরবাড়ির সাথে। ধ্রুবকে তো সে পায়ইনি বলতে গেলে। তবুও মেয়েটা শ্বশুরবাড়িতে একমাত্র বউ হিসেবেই দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে, নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছে।

কয়েকদিন আগেই ধ্রুব বেলাকে কল করে জানালো সে দেশে ফিরবে। বেলার মনে হয়েছে এবার স্বামীর সাথে সংসারটা ভালোভাবে করা উচিত। বেলা মনে মনে ভেবে রেখেছে এবার ধ্রুব বাড়ি ফিরলে তাকে আর বাহিরে যেতে দেবে না। দুই মুঠো ভাত কম হলেও সে ধ্রুবকে আর যেতে দেবে না।

ধ্রুব বাড়ি ফিরবে বলে বেলা নিজ হাতে কয়েকদিন হলো বাড়ি-ঘর পরিষ্কার- পরিচ্ছন্ন করা শুরু করেছে। এই কাজ তার ধ্রুব আসা অবধি চলতে থাকবে।

সকাল এগারোটা। সূর্যের তাপ ধীরে ধীরে বাড়ছে৷ সকালটা কিছু সময়ের মধ্যেই দুপুরের এসে পৌঁছবে। গরম ধীরে ধীরে প্রচন্ড বাড়ছে। কখনো গাছের পাতা মৃদু হাওয়ায় দুলছে আবার কখনো স্থির থাকছে।

বেলা সকালের রান্নাবান্না শেষ করে শাশুড়ি আর ননদের সাথে খেয়ে কাজে নেমে পড়েছে৷ বর আজ বিদেশ থেকে আসবে এতগুলো বছর পর। যে কাজটুকু আছে সেটা শেষ করে তাড়াতাড়ি গোসল করে নতুন শাড়িটা পরবে বলে ঠিক করে রেখেছে সে।

স্বামী বিদেশ থেকে আসবে বলে বাড়ির কাজে হাত দিয়েছিল বেলা। শাশুড়ির রুমটা পরিষ্কার করা শুধু বাকি। সেটাই মন দিয়ে করছিল। খাটের আড়ালে মেঝেটুকু থেকে ময়লা ঝুড়িতে তুলছিল সে। হঠাৎ দরজা আটকানোর শব্দে পেছনে ঘুরে তাকালো।

“ধ্রুব নাকি গতকাল আইছে বিদেশ থেইকা। ওয় এহনো বাড়িত আইলো না, বাড়িত কয়-ও নাই আসার কথা। সুমু কইল কাইল নাকি তারে দেখছে কোন এক মাইয়ার লগে। কইল যে দেইখা নাকি মনে হইছে জামাই-বউ। এইডা কোন কথা হইল ক'? ওই ছ্যাড়া কারে লইয়া শহর ঘুরতাছে ক' তো? কাউরে না জানাইয়া আরেকখান বিয়া করে নাই তো? এই পোলারে লইয়া আমি কী করুম, মা’বুদ!”

জাহিদা বেগম তার মেয়ে রিমিকে ডেকে নিয়ে কথাগুলো বলছিলেন। শাশুড়ির কথা শুনে বেলা মুহূর্তের মধ্যে দমে গেল। আনন্দের সাথে কাজ করা যেন থেমে গিয়ে হাতটা স্থির হলো। হৃৎস্পন্দনও যেন তার গতি হারালো। শাশুড়ির মুখে নিজের স্বামীকে নিয়ে এরকম কথা শুনে হাতে যেন আর কোনভাবেই শক্তি পাচ্ছিল না সে। চারপাশের সব যেন থেমে গিয়েছে।

রিমি সহাস্য বলে ওঠে," আম্মা, ভাই বিদেশি মেয়ে বিয়ে করে নিয়ে আসছে? দেখতে কেমন? কিছু বলছে সুমু? নিশ্চয়ই সুন্দরী কোন বিদেশিনিরে ভাই নিয়ে আসছে। আমার তো শুনেই নতুন ভাবিকে দেখতে ইচ্ছে করছে, আম্মা।"

জাহিদা বেগম মেয়ের দিকে কটমট করে তাকান। চোখ দেখেই বোঝা যায় তিনি মেয়ের কথায় সন্তুষ্ট হতে পারেননি। মেয়ের হাত ধরে ঝাঁকি দিয়ে বলে ওঠেন,

“কী কইতাছস খেয়াল আছে? মাগি সোয়ামির ভাত খাওয়া লাগত না চিন্তাভাবনা এমন দূষিত হইলে। ভাই একটা অকাজ কইরা বইয়া আছে, সেই ভাই আর নতুন কোন বেশ্যা আইতাছে তারে নিয়া আবার তোর মনে লাড্ডু ফুটতাছে, না?”

রিমি মায়ের কাছে থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বিছানায় এসে বসে। বিলম্ব না করে বলে ওঠে,

“ তোমার ছেলের বউকে দেখছ? খেয়াল করছ চেহারা কেমন হয়ে গেছে? আগে দেখতে সুন্দর ছিল কিন্তু এখন কাজের মহিলাদের মতোই লাগে। আর আমার ভাই! কী তার গায়ের রঙ, কী তার হাইট, চেহারা! তোমার কি মনে হয় আমার ভাই এই মহিলার সাথে থাকবে? জীবনেও না। সুমুর দেখা যদি সত্যি হয় তাইলে আমি হেব্বি খুশি। বিদেশি ভাবি আসবে, পাড়া-মহল্লার লোকজন দেখতে আসবে, আহা, আহা!”

বেলা আর বসে থাকতে পারে না। উঠে দাঁড়িয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় বলে,

“আমার চেহারা এমনিতে নষ্ট হয় নাই, রিমি। তিনবেলা মাটির চুলায় রান্না করা, বাড়িঘর পরিষ্কার রাখা, বাড়িতে ছেলেমানুষ না থাকায় বাজারটাও করতে হয়, আম্মার শাড়ি,জামাকাপড় প্রতি এক সপ্তাহ অন্তর অন্তর আমার ধুয়ে দিতে হয়, কোনো কোনদিন তো তোমারটাও ধুতে হয়, সকালে শুধু নামাজটা পড়ি তারপর তো দম ফেলার সময়টাও পাই না, গরুর দেখাশোনা করতে হয়, তোমাদের জন্য এই সংসারের জন্য আমি আমার পড়াশোনাটাও ভালোভাবে শেষ করতে পারিনি, হাত লাগাও কোন কাজে? সারাদিন তো ফোনটা নিয়েই পড়ে থাকো। চেহারা তাহলে আমার নষ্ট হবে না তো কার হবে?”

বেলার কথা শুনে পিছনে ঘুরে তাকায় রিমি। বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। জাহিদা বেগম অসহায় চোখে বেলাকে দেখছে। তিনি বেশ বুঝতে পারছেন মেয়েটা সব কথা শুনেছে কিন্তু সে যে রুমে ছিল এটা তিনি বুঝতে পারেননি।

বেলা আবার বলে ওঠে,

“তোমার ভাইয়া যদি সত্যিই বিয়ে করে না? আমি এ বাড়ি আজই ছাড়ব। ত্যাগ করব তোমার ভাইকে। আমি স্বামীর ভাগ দেওয়ার মতো মেয়ে নই, সতীনের সাথে এক সংসারে থাকার মেয়েও নই। আমি বেলা এত মূল্যহীন মেয়ে নই।”

রিমি তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে। বেলার কথায় যেন সে খুব মজা পাচ্ছে। সে সহাস্যমুখে বলে,

“কোথায় যাবেন শুনি? সৎভাইয়ের সংসারে? আপনাকে বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার জন্য তারা বসে আছে দেখুন গিয়ে। থাকলে এখানেই থাকতে হবে নইলে রাস্তায় রাস্তায় অথবা...”

জাহিদা বেগম মেয়ের দিকে তেড়ে আসেন। রাগে চোয়াল শক্ত হয়ে এসেছে উনার। রিমি সরে দাঁড়ায়।

রিমির কথায় রীতিমতো তীরবিদ্ধ হয় বেলা। মুহূর্ত কয়েক স্থির-চোখে তাকিয়ে থাকে তার দিকে। রিমি আগে থেকেই কটুভাষী সেটা সবারই জানা। বেলার সাথে সেটা মাত্রাতিরিক্ত।

বেলা টলমল চোখে শাশুড়ীকে উদ্দেশ্য করে বলে,

“ আম্মা আপনি যা বললেন তা কি সত্যি? আপনার ছেলে সত্যিই আরেকটা বিয়ে করেছে?”

জাহিদা বেগম বেলাকে সাহস দিয়ে বলেন,

“তুমি একদম চিন্তা কইরো না তো, বেলা। সুমু এহন দূর থেইকা কী দেখছে না দেখছে! ধ্রুব আইলে তো বাড়িত জানাতোই। তাছাড়া আরেকটা বিয়া করা কি মুখের কথা? কী যে কও তুমি!”

বেলা শুধু মুখ গম্ভীর করে বলে,

“ আম্মা, দোয়া করেন সুমুর দেখা যেন ভুল হয়। ও যদি সঠিক দেখে তাহলে আপনারা খুব পস্তাবেন। আমি একা মেয়ে, আমার বাচ্চা হয়নি, আমি যেখানে সেখানে চলে যেতে পারব। আপনার ছেলে সত্যি বিয়ে করলে বা কাউকে নিয়ে এমন কিছু করলে আমি সত্যিই এখানে থাকব না। বাড়ি থেকে আজকের মধ্যে চলে যাব। আপনার মেয়ে যদি ভাবে আমার যাওয়ার কোন জায়গা নাই তাহলে আপনার মেয়ে ভুল ভাবছে। মস্তবড় পৃথিবীতে আমার থাকার জায়গা ঠিক হয়ে যাবে।”

বেলার কথা শুনে রিমি তাচ্ছিল্যের সাথে বলে,

“পুরুষ মানুষ রাগ করে বাড়ি থেকে বের হলে হয় রাজা আর মেয়ে-মানুষ রাগ করে বাড়ি থেকে বের হলে হয় বেশ্যা। আপনার কপালেও ওটা আছে।"

বেলা আর সহ্য করতে পারে না রিমির কথা। এই মেয়ের কথাবার্তার ধরণ অনেক বাজে। সে এতদিন চুপচাপ থাকেনি আজও চুপ থাকার প্রশ্নই ওঠে না।

এই মেয়েকে কীভাবে চুপ করাতে হয় সেটা বেলার জানা আছে। সে এগিয়ে গিয়ে রিমির গালে সজোরে চড় বসিয়ে দেয়৷ দাঁতে দাঁত চেপে বলে,

“আমার যাওয়ার জায়গা আছে৷ পতিতাপল্লীতে যাওয়ার প্রয়োজন হবে না। নিজের ব্যবহার আচরণ ভালো করো, মস্তিষ্কের অসুখ সারাও নইলে তোমার আরও অনেক জায়গায় যেতে হতে পারে। ”

জাহিদা বেগম নিজেও এবার ছেলের বউ এবং মেয়ের মাঝেকার ঝামেলা কমাতে মেয়ের হাত টেনে দূরে সরিয়ে আনেন। আঙুল উঁচিয়ে বলেন,

“মুখে একটু তালা দে। মুখ দিয়ে যা বাইর হচ্ছে, আমিই না মুখখান ভাইঙ্গা দেই। একে তো ঝামেলার শ্যাষ নাই তার ওপর মনে যা আসতেছে তাই বাইর কইরা যাইতেছিস।”

মেয়েকে শাসন করতে থাকেন৷ বেলা সেদিকে পাত্তা না দিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে যায়। এই মেয়ের বাজে ইঙ্গিতপূর্ণ কথা এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শোনার কোন মানেই হয় না। কোন মানে হয় না এসব শুনে মাথা নষ্ট করার।

বিকেল চারটা। বেলা তার ঘরে থাকা ফুলদানি দুইটাতে তাজ ফুল রাখে। পাশের বাড়ির একজনকে দিয়ে আনিয়েছে সে। কিছুক্ষণ আগেই গোসল দিয়ে নামাজটা শেষ করে খাবার টেবিল থেকে খাবার নিয়ে ঘরে এসেছে। মাথায় তখনও তোয়ালে জড়ানো৷ চুলটা ভালোভাবে মুছে খেতে বসে সে। দুই-তিনবার খাবার মুখে নিতেই রিমি এসে হাজির হয়।

রুমের এপাশ থেকে ওপাশ চোখ বুলিয়ে নিয়ে এগিয়ে এসে বলে,

“সতীনের জন্য বাসর সাজালেন নাকি, বড়ভাবি? তাজা ফুল দেখছি।”

বেলা প্রত্যত্তরে সাগ্রহে জবাব দেয়,

“ হ্যাঁ, সতীন আসছে তার জন্য বাসর সাজাব না? ননদ হয়ে তো কোন কাজের কাজই করলে না। সতীন হয়ে সব আমারই করতে হলো। তবে তোমার ভাই যদি নতুন বউ নিয়ে না আসে তাহলে এখানে আমারই থাকতে হবে আর সত্যিই যদি নিয়ে আসে তাহলে সে-ই থাকবে। তোমার হয়তো এরকম কিছু ভাগ্যে জুটবে না, যেই মস্তিস্ক নিয়ে চল, তোমার কপালে সংসার আছেই কি না আর থাকলেও সেটার কী যে হাল করবে সেটা আল্লাহ ভালো জানেন।"

রিমি যেন তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠে। দাঁত কিড়মিড় করে বলে,

“তোমার এই বেশি বেশি তর্কের জন্য সব হারাবে। আমিও মনেপ্রাণে চাই তুমি এই বাড়ি থেকে বিদেয় হও। তোমাকে আমার আর সহ্য হচ্ছে না।”

বেলা মুচকি হেসে বলে,

“যদি বাড়ি থেকে চলে যেতেই হয় তাহলে তোমাদেরই একদিন মনেপ্রাণে আমাকে চাইতে হবে, চাইতেই হবে দেখে নিও। দাঁত থাকতে বেশিরভাগই দাঁতের মর্ম বোঝে না। তোমাদের হবে তাই।”

“এত খারাপ দিন আসবে না। ”
“অপেক্ষায় থাকো।”

দুজনের কথাবার্তার মাঝে বাহিরের দরজায় ঠকঠক আওয়াজ হয়। দুজনের কানেই শব্দ পৌঁছায়। রিমি ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে চারটা পনেরো। রিমি মুচকি হাসে। সে নিশ্চিত এবার তার ভাই এসেছে। মুচকি হেসে বেলাকে উদ্দেশ্য করে বলে ওঠে,

“এবার তোমার কপাল পুড়লো।” বলেই দ্রুত গতিতে রুম থেকে বেরিয়ে গেল সে।

বেলা খাবারের প্লেটটা নিয়ে বাহিরে এসে খাবার টেবিলে সেটা রেখে হাতটা ধুয়ে তাড়াতাড়ি বাহিরের দরজার দিকে যেতে থাকে।

দরজার কাছাকাছি যেতেই দেখে বাহিরের উঠোনে ভিড় জমেছে। বেলার বুক যেন ভার হতে থাকে। বাহিরে কথাবার্তা আবছা আবছা কানে আসছে। যতটুকু বোঝা যাচ্ছে শাশুড়ীর কথাটা মিথ্যে নয়।...
বেলা একপা দু'পা করে এগোতে থাকে৷ তাকে দেখে সবাই তার দিকে ভূত দেখার মতো তাকিয়ে আছে। বেলা এদিক ওদিক সবাইকে তাকিয়ে দেখে তাদের উপেক্ষা করে ধ্রুবর সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। ধ্রুবর পাশে লালশাড়ি পরিহিতা এক রমনী দাঁড়িয়ে। গায়ের রঙ যেন ধবধবে সাদা। বেলার চোখ টলমল করছে। শেষমেশ তার ভয়টাই সত্যি হলো!

বরের পাশে লালশাড়িতে নতুন বউকে দেখে ভাঙা ভাঙা গলায় বেলা বলে ওঠে," আমার জামাই আমার জন্য বিদেশ থেকে সতীন নিয়ে আসছে!”

বেলার কথায় ধ্রুবর মুখটা যেন চুপসে যায়। পাশে দাঁড়ানো নতুন বউয়ের দিকে একবার আর বেলার দিকে একবার করে তাকায় সে।

নতুন বউ লিলি পাশে থেকে বলে ওঠে,

“ধ্রুব, কে উনি? তোমার বউ? ধ্রুব, এসব কী?”

ধ্রুব নতুন বউয়ের হাত ধরে বলে, “ বাড়ির মধ্যে চল একটু বিশ্রাম নাও তারপর সবকিছু বলছি।”

বাড়ির বাহিরের উঠোন মানুষ দিয়ে ভরতি। সবার সামনে থেকে ধ্রুব তার নতুন স্ত্রী লিলির হাত ধরে বাড়ির মধ্যে থেকে নিয়ে যেতে থাকে। এক হাতে একটা ব্যাগ নিয়ে আরেকটা রিমিকে নিতে বলে বাড়ির ভেতরে চলে যায়।

সবাই বেলাকে দেখছে আর তাদের মধ্যে ঘটে যাওয়া ঘটনা নিয়ে বলাবলি করছে। এদিকে নিজের স্বামী অন্য একটা মেয়ের হাত ধরে বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছে সেটা বেলার তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতে হচ্ছে। বুকের ভেতর ঝড় শুরু হয়েছে তার। ছলছল চোখে এক পলকে দুজনের যাওয়া দেখছে।..
বেলাকে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে পাশে থেকে একজন বলে ওঠে,

“নিজের স্বামীকে ধরে রাখতে পারলে না? কেমন বউ তুমি? সারাদিন- রাত সংসারের পিছনে সময় দিয়েছ কিছু সময় যদি স্বামীরে দিতে তাহলে আর এরকম হতো না।”

কথাটা শুনে যেন বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে ওঠে বেলার।
ধ্রুবকে সে সময় দেয়নি? ধ্রুবকে ঠিক কতটা সময় দিয়েছে সেটা সে জানে। ধ্রুব নিজেই তো ব্যস্ততা দেখিয়েছে, বেলাও বিশ্বাস করেছে। সংসারটা করার জন্যই দিন-রাত এক করে খেটেছে সে। সে পিছন ফিরে মহিলাকে চুপচাপ কিছুক্ষণ দেখে ল বলে ওঠে,

“ সে আমাকে ঠকিয়ে অন্যকাউকে বিয়ে করেছে এটাও আমার দোষ? মেয়ে হয়ে মেয়ে মানুষের ভুল ধরতে এত মরিয়া কেন আপনারা? আমি যদি এখানে থেকে অন্যকারো সাথে সম্পর্কে জড়াতাম তাহলে তো আমাকেই দোষ দিতেন তখন কেউ বলতেন না যে স্বামীর কারণে বউ এমন করছে। স্বামী সময় দেয় না বা কাজ বেশি করে বলে বউ এমন করেছে৷ তখন ঠিকই বলতেন যে, স্বামী বউ, পরিবারের জন্য বিদেশ-বিভুঁইয়ে কামলা খাটছে আর বউ এদিকে এসব অন্যায় করে বেড়াচ্ছে। এখানে এত ভিন্নতা কেন?....
আল্লাহ আপনাদের জবান দিয়েছে মেয়েজাতিকে কথায় আহত করে কবরস্থ করার জন্য তাই না? স্বামী বিয়ে করে নিয়েছে এসময় আগের স্ত্রীর মনের অবস্থা কেমন হতে পারে বুঝতে পারেন না আপনারা? আপনাদের মতো পাশের বাসার আন্টিরা রেডি থাকেন কখন কোথায় কী ঘটবে আর আপনাদের জবান ছাড়বেন, ননস্টপ বকে চলবেন। বয়স হচ্ছে, ভালো হয়ে যান। ব্রেইনকে কিছু খেতে দেন। এরকম নারী বিমুখী হলে শেষ বয়সে পস্তাতে হবে। নিরপেক্ষ হতে শিখুন। যেটা ভুল সেটাকেই ভুল বলুন।”

বেলার এতগুলো কথা শুনে মহিলা রাগে চোয়াল শক্ত করে বলে ওঠে,

“কথা না বলে থাকতে শেখোনি না? মুখ থেকে এরকম কথা বের হইলে জামাই টিকবে কীভাবে?.. ধ্রুব তো মনে হয় এমনিতে আর বিয়ে করে নাই তোমার এই মুখের এমন ভাষার জন্যই বিয়ে করছে।”

“শুনেছি আপনিও ডিভোর্সি। আপনি জামাই টিকিয়ে রাখতে পারেন নাই কেন? আমি আর আপনি একই ধরনের হলাম না?”

মহিলা আর কোন কথা খুঁজে পায় না বলার জন্য। বেলা আর কথা না বাড়িয়ে সেখান থেকে চলে আসে। বড়ো উঠোন পেরিয়ে বাড়ির সদর দরজা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে।

#মেঘ_বিয়োগের_মৌসুম
#তানিয়া_মাহি
#০১

আসসালামু আলাইকুম। পোস্ট সামনে গেলে রেস্পন্স করার অনুরোধ রইল।🥀

প্রচার অংশ।

Address

Dhaka

Alerts

Be the first to know and let us send you an email when Niamot Al Hasan posts news and promotions. Your email address will not be used for any other purpose, and you can unsubscribe at any time.

Contact The Business

Send a message to Niamot Al Hasan:

Share