
17/07/2025
#তাজমহল
#পর্ব_৪
#প্রিমা_ফারনাজ_চৌধুরী
ছাদে মোটামুটি সুন্দর আয়োজন করা হয়েছে। ফটোগ্রাফি সুন্দর হওয়ার জন্য তৌসিফ, তাসনুভা, তিতলি সব রকমের আয়োজন করেছে। ওদের ছবি তোলার ভীষণ শখ। পারেনা সারাক্ষণ ক্যামেরা নিয়ে বসে থাকতে।
শাইনার শখ নেই এমন না। সে শাওনকে প্রায় সময়ই জ্বালাতো ছবি তুলে দেওয়ার জন্য। কিন্তু আজ তার সব বিরক্ত লাগছে। ইচ্ছে করছে সব ছেড়েছুঁড়ে চলে যেতে। কিন্তু যাওয়া যাবে না। দশ দশটা কথা রটে যাবে।
শারমিলা আর শাবরিন এসেছে তাদের ছেলেমেয়ে নিয়ে। ভাবিও এসেছে। শাইনা তার তিন ভাইকেও দেখলো। মোটামুটি সবাই হাজির।
বাচ্চা বাচ্চা ছেলেমেয়েরা নিচে আতশবাজি ফোটাচ্ছে দেখে বাবা চাচারা গর্জন তর্জন শুরু করে দিয়েছে। এই ছেলেগুলোর আর শান্তি নেই। কিছু হতে না হতেই ঠাস ঠাস করে বাজি ফোটানো শুরু করবে।
দিনের বেলায় যতটা না উচ্ছ্বসিত ছিল সবাই রাতের অনুষ্ঠানে তারচেয়ে বেশি কোলাহল, হৈচৈ বেড়েছে। শাইনার এখনো স্পষ্ট মনে আছে যখন তাদের বাড়িতে কোনো বিয়ে হতো অনুষ্ঠান শেষ হওয়া অব্দি সে বসে থাকতো বিয়েবাড়িতে। আম্মু ডাকলেও যেত না ঘরে।
"রাত বাড়ছে। ওদের আংটি বদলটা হয়ে যাক। তোর আব্বারা ঘুমিয়ে পড়বে। সারাদিন অনেক দখল গিয়েছে।"
রওশনআরা এসে তাসনুভাকে কথাটা বললো। তাসনুভা তিতলিকে বলল,
"ভাইয়াকে ডেকে নিয়ে আয়।"
তাজদার সিদ্দিকী ছাদের এককোণায় তার ভাই বন্ধু আর দুলাভাইদের সাথে দাঁড়িয়ে কথাবার্তায় মগ্ন। তিতলি গিয়ে ডেকে আনলো। তাজদার সিদ্দিকী আসামাত্রই রওশনআরা আংটির বক্স খুলে দিল। বলল "এটা পরিয়ে দাও।"
তাসনুভা হাত নেড়ে বলল,"ক্যামেরা এইদিকে এইদিকে...
ফটোগ্রাফাররা ছুটে এল। শাইনাকে ক্যামেরার দিকে তাকাতে বললে সে তাকাতে পারলো না। লেন্সদুটো তাকে বিপদে ফেলবে সে বুঝতে পারছে।
তাসনুভা বলল,"এভাবে মুখ নামিয়ে রাখলে ছবি ভালো উঠবে না। আশ্চর্য!"
সে বিরক্তিতে তেতে উঠলো। রওশনআরা চোখের ইশারায় ধমকালো। তারপর তাজদার সিদ্দিকীর দিকে আংটিটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল,"পরিয়ে দাও। শাইনা আঙুল দাও মা।"
শাইনা কোনোদিকে না তাকিয়ে হাতটা বাড়িয়ে দিল। তাজদার সিদ্দিকী হাতটা ধরতেই শাইনা আরও গুটিয়ে গেল। তৌসিফ ক্যামেরা ধরে বলল,
"শাইনা হাতের দিকে তাকাও।"
শাইনা তাকালো না। শাওন ডেকে বলল,"এভাবে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? হাতের দিকে তাকা।"
শাইনা তারপরও সহজ হতে পারলো না। তৌসিফ এসে শিখিয়ে দিল কিভাবে তাকাতে হবে, হাতটা কিভাবে রাখতে হবে ইত্যাদি ইত্যাদি।
শাইনা তার হাতটার দিকে তাকালো। তাজদার সিদ্দিকী আংটি পরিয়ে দিতেই শাইনা হাতটা ছাড়িয়ে নিল দ্রুত। শাওন বলল,"একটু হাস।"
শাইনা অল্প হাসার চেষ্টা করলো কিন্তু চেহারার মলিন ছাপ দূর হলো না তবুও। আনিস এগিয়ে এসে শাইনার হাতে একটা আংটি দিল। তৌসিফ বলল,"ব্রো হাত বাড়িয়ে দাও।"
তাজদার সিদ্দিকী হাত বাড়িয়ে দিল। শাইনা ডান হাত দিয়ে শুধু আংটিটা পরিয়ে দিল দায়সারাভাবে। তৌসিফ চ বর্গীয় শব্দ করে বলল,
"হয়নি।"
সে এগিয়ে এসে শিখিয়ে দিল কিভাবে এক হাতে হাত ধরে অন্য হাতে ধীরেধীরে আংটি পরিয়ে দেবে। আংটিটা আবারও খুলে নিল তৌসিফ। তাজদার সিদ্দিকী খুলতে চাইলো না। তৌসিফ জোরপূর্বক নিয়ে নিল। শাইনা আবারও আংটিটা পরিয়ে দিল সবার মনমতো করে।
তৌসিফ বৃদ্ধাঙ্গুল দেখিয়ে বলল,"পার্ফেক্ট।"
সবার ঠোঁটে হাসি ফুটলো। রওশনআরা শাহিদা বেগম আর আফসার সাহেবকে ডেকে আনলেন। তাজউদ্দীন সিদ্দিকীও এলেন। তৌসিফ মজা করে শাহিদা বেগমকে বলল,
"চাচীমা আজ মেয়ের হাত তুলে দিলে কিন্তু আমাদের বাড়িতে রেখে দেব।"
তৌসিফের মা জোহরা বেগম তাকে ধমকালো। তৌসিফ তা দেখে আরও ঠোঁট এলিয়ে হাসলো। রওশনআরা হেসে বলল,
"কথাটা কিন্তু ভুল বলিসনি। তুলে দিলে রেখে দেব আজকের জন্য।"
শাইনা চট করে বলে উঠলো,"আমি থাকব না।"
সবার মনোযোগ কেড়ে নিল তার কথাটা। তাজদার সিদ্দিকীও তাকালো কথাটা শুনে। শাইনা গম্ভীর মুখে কথাটা বলেছে।
রওশনআরা হেসে ফেললেন,
"ওই দেখো কি বলে মেয়েটা। আচ্ছা বেশ থাকিস না। বিয়ের অনুষ্ঠানের পর তো এমনিই আসবি।"
________
বড় মামা, খালু, ফুপা সবাই উপস্থিত হওয়ার পর বরের হাতের উপর কনের হাতটা তুলে দেয়া হলো। তাজউদ্দীন সিদ্দিকী কনপক্ষকে আশ্বাস দিয়ে বললেন,
"বাড়ির মেয়ে আরেক বাড়িতে এসেছে। এতো ভয় পাওয়ার কিছু নেই। কথাবার্তা তো আমাদের মধ্যে হয়েছে। ভালো রাখার দায়িত্ব শুধু যার হাতে তুলে দিচ্ছেন তার নয়। আমাদেরও। মেয়ে ভালো থাকবে। চিন্তার কিছু নেই। আশরাফের মা, আশরাফের বাপ মেয়েকে নিয়ে একদম চিন্তা করবে না। আমরা বাড়ির মেয়ে এনেছি ভালোর জন্যই।"
শাইনার বড় মামা বললেন,
"আপনি একাই সব বলে দিলেন। আমাদের আর কিছু বলার রইলো না। ছেলেমেয়েরা ভালো থাকলেই আমরা ভালো থাকি।"
শাইনা চোখ নীচে নামিয়ে রেখেছে। নিজের হাতটা ওই হাতের উপর!
ওইরকম একটা মানুষ কাউকে ভালো রাখতে পারে? যাকে দেখলেই রাগে, ঘৃণায় তার আপাদমস্তক জ্বলতে থাকে সে রাখবে তাকে ভালো? এই বোকার দলগুলো কি জানে এই লোকটা কত ছোটলোক? পয়সা, প্রতিপত্তি দিয়ে মানুষকে মূল্যায়ন করে? তারা যদি আজও দরিদ্র থেকে যেত তাহলে এরা তাদের দিকে ফিরেও তাকাতো না। খান্দানি পরিবারের, সুন্দরী, শিক্ষিত মেয়েকে বউ করে আনতো ঢোল পিটিয়ে। এদের সে হাড়ে হাড়ে চেনে। তার পরিবার এদের সাথে ভালো মানুষি দেখাতে পারে। কিন্তু সে পারবে না। তার মন থেকে ঘৃণা না সরলে সে কোনোদিন এদের মন থেকে মেনে নিতে পারবেনা। তাজদার সিদ্দিকীকে সে কখনো মাফ করবে এটার কথা ভাবতেও পারেনা।
হাতটা অনেক্ক্ষণ ওই হাতটার উপর ছিল। নামিয়ে নিতেই মনে হলো শাইনা বেঁচে গেল। সারাজীবন কি করে সে এই লোকটার সাথে থাকবে? শুধু হাতে হাত রেখেছে এতেই তার দমবন্ধ লাগছে।
মুরব্বিরা সবাই চলে যেতেই তাজদার সিদ্দিকী জোর দিয়ে তিতলিকে বলল,"তোকে বলেছিলাম না লেন্সটা খুলে নিতে?"
তিতলি ভয়ে ভয়ে এগিয়ে এসে শাইনাকে বলল,"তোমাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম অসুবিধা হচ্ছে কিনা।"
তাজদার সিদ্দিকী আবারও গর্জে উঠলো,
"আমি কি বলেছি শুনিসনি?"
তিতলি শাইনাকে চেয়ারে বসিয়ে লেন্স দুটো আস্তে করে খুলে নিল। শাইনার গাল ভিজে গেল চোখের জলে। অসম্ভব পরিমাণে জ্বলছে। তিতলি তার দিকে ফ্যানটা ঘুরিয়ে দিল। তারপর টিস্যু দিয়ে আলতো করে গাল মুছে দিতে লাগলো।
তাসনুভা অসম্ভব বিরক্ত হয়ে বলল,
"লেন্স পড়লেও নাকি কারো চোখ জ্বলে। অদ্ভুত!"
শাইনাকে কথা শুনিয়ে সরে গেল সে। শাইনা একটু পানি খেয়ে জিরিয়ে নিল। তৌসিফ বলল,
"শাইনা আজ কিন্তু ঘুমাতে পারবে না। অনেক ফটোশুট হবে।"
শাইনা চুপ করে বসে রইলো। তৌসিফ ভাইয়ের সাথে সে এখন মোটামুটি টুকটাক কথা বলে। আগে বলতো না। তৌসিফ ভাইও বলতেন না। ওই লোকটা তাদের সাথে কাউকে কথা বলতে দিত না।
______
সবার জন্য ঝাল মিষ্টি জাতীয় খাবারের ব্যবস্থা হয়েছে। জুসের বোতলও আনা হয়েছে। এসব দেখে আশরাফ আপত্তি জানাতেই তাসমীনের স্বামী জাহিদ বলল,
"আমার সম্মন্ধির একটামাত্র বউ। থাক, টাকা খরচ করতে দেন।"
সবাই হেসে উঠলো সেকথা শুনে। তাজদার সিদ্দিকী কিছু বললো না। শাইনার বোনের জামাইরা কত কি বললো। তাজদার সিদ্দিকী জবাবে কিছুই বলেনি। চুপচাপ সবার হাসিঠাট্টা শুনে যাচ্ছে।
বড় বড় বাক্স আনা হচ্ছে। শাইনা একপাশে চুপ করে বসে রইলো। শাওন বাক্স রেখে এসে বলল,"ওই কিছু খাবি?"
শাইনা বলল,"বাড়ি যাব।"
"এটাই তো তোর বাড়ি।"
এরচেয়ে বড় মিথ্যে কথা আর হয় না। এই বাড়িকে তার একটুও আপন লাগছেনা। শাওনের কথার জবাবে সে কিছু বললো না। শুধু বলল,"একটু ঠান্ডা পানি খাব ভাইয়া।"
"ঠিক আছে দাঁড়া।"
তাজদার সিদ্দিকী তৌসিফকে জিজ্ঞেস করছিল প্যাকেজিংগুলো ঠিকঠাক আছে কিনা। সম্ভবত সেখানে বড়সড় চিকেন বার্গার, পেস্ট্রি, জিলাপি, সেভেনআপ আর জুসের বোতল আনা হয়েছে সবার জন্য। আরও কয়েক রকমের খাবার এসেছে। ফুরিয়ে এলে ওই বাক্সগুলো খোলা হবে। শাওন এতসব দেখলো না। তৌসিফকে বলল,
"শাইনার জন্য একটা জুসের বোতল দাও তো।"
তাজদার সিদ্দিকী বার্গার, পেস্ট্রিবক্সসহ বাড়িয়ে দিল। শাওনা শাইনাকে সেখান থেকে ডেকে বলল,
"মণি বার্গার খাবি?"
শাইনা মনে মনে তাকে বকা দিল। একঝাঁক মানুষের সামনে জিজ্ঞেস করছে বার্গার খাবে কিনা। সবাই তার দিকে তাকিয়ে আছে। শাইনা কিছু বললো না। শাওনা তারজন্য একগাদা খাবার নিয়ে এল। শাইনা শুধু জুসের বোতলটা নিল। আর কিচ্ছু নিল না।
জুসটা পুরোটা খেল সে। ঠান্ডা হওয়ায় খেতে ভালো লাগছিল। তার গলা শুকিয়ে আসছে বারবার। আজ এত তেষ্টা পাচ্ছে তার।
জুসটা খাওয়া শেষে মনে হলো লিপস্টিক সরে গেছে। ফোনের সেলফি ক্যামেরা অন করে ঠোঁট দেখতে যাবে তখুনি ক্যামেরায় তাজদার সিদ্দিকীকে দেখা গেল। তার কিছুটা পেছনে চেয়ারে বসে ফোন দেখছে। ফোনের ব্রাইটনেস হাই। আঙুল নেড়ে নেড়ে ফেসবুকের নিউজফিড স্ক্রল করছে সম্ভবত।
সে ক্যামেরা অন করেছে মনে হতেই চোখ তুলে তাকালো এদিকে। শাইনা চট করে ক্যামেরা নামিয়ে নিয়ে ঘাড় ফিরিয়ে তাকালো। তারপর গম্ভীরমুখে সরে পড়লো সেখান থেকে।
বড় আপা বলল,"তুই চলে এলি কেন? উনি বোধহয় তোর সাথে কথাটথা বলার জন্য ওদিকে গিয়ে বসেছে। তুই ইশারা টিশারাও বুঝিস না?"
শাইনা আকাশ থেকে পড়লো। অবাক হয়ে বলল,
"আমি কথা বলব?"
মেঝ আপা দ্বিগুণ অবাক হয়ে বলল,"আজব! তুই কথা বলবি না তো কে বলবে? তোর জামাই না?"
"জামাই হয়ছে তো কি হয়ছে? কোলে নিয়ে নাচব?"
বড় আপা আর মেঝ আপা জমে গেল। একে অপরের দিকে তাকালো অবাক চোখে। শাইনা এককোণায় গিয়ে বসলো যাতে তাজদার সিদ্দিকী তাকে না দেখে আর সেও তাজদার সিদ্দিকীকে না দেখে।
খাওয়াদাওয়া পর্ব শেষ হতেই আবারও ফটোশুট শুরু হলো। তৌসিফ আবারও দুজনকে এক জায়গায় নিয়ে এল। ছাদে মিড ভলিউমে গান চলছে। এতক্ষণ হিন্দি গান চলছিল। এবার হাবীব ওয়াহিদের কন্ঠে গাওয়া সেই গানটা চলছে.
গোধূলির আকাশ লাজুক লাজুক..
সন্ধ্যা এখনো জেগে।
তোমার..জন্য শুধু তোমার জন্য।
শাইনার পছন্দের গান। তৌসিফ এসে একটা কাপল ছবি দেখালো। যেখানে বরটা কনের হাত ধরে হাতের উপর ঝুঁকেছে। শাইনার আপাদমস্তক শিউরে উঠলো। সে বেঁকে বসলো। সে এই ধরণের ছবি তুলবে না। তৌসিফ বলল,
"আরেহ ভাবিমণি এইসব কাপল পোজ। এখন প্র্যাক্টিস করে নাও। বিয়ে আর গায়ে হলুদের সময় লাগবে। তখন আর শিখিয়ে দিতে পারব না।"
শাইনা রাজী হলো না। এই মুহূর্তে তাকে রাজী করানো সাধ্যও নেই। সে বেঁকে বসতেই তাজদার সিদ্দিকীও বেঁকে বসলো। তৌসিফ আর শাওন একে অপরের দিকে হতাশ চোখে তাকালো। তৌসিফ শেষমেশ কিছু সাদামাটা পোজ দেখালো যেখানে হালকা দূরত্বে আছে। তাজদার সিদ্দিকী চুপচাপ দেখলো কপাল কুঁচকে। তৌসিফ সেগুলো শাইনাকেও দেখালো। বলল,
"এভাবে দাঁড়াতে নিশ্চয়ই সমস্যা হবেনা?"
শাইনা নীরবে সম্মতি দিল শাওনের চোখ রাঙানি দেখে। প্রথম দিন থেকে ত্যাড়ামি শুরু করে দিয়েছে।
ফটোশুট শুরু হলো আবারও। তাজদার সিদ্দিকীর ঘড়ির সাথে শাইনার ঘোমটা একটা কোণা আটকে দেয়া হলো। শাইনা অনেকটা দূরে দাঁড়িয়ে। তৌসিফ বলল,
"ওড়নাটা ভাইয়ের হাতে আটকানো থাকবে। তুমি ঘাড় ফিরিয়ে তাকিয়ে থাকবে ভাইয়ের দিকে। আর একটুখানি হাসবে।"
শাইনা সাথে সাথে ঘোমটা টান দিয়ে বলল,"এটাও হবে না।"
তৌসিফ, শাওন সবাই হতাশ। শাইনার বড় দুলাভাই জামিল বলল,
"মনে হয় আমাদের লজ্জা পাচ্ছে। আমরা তাহলে নিচে যাই। তাজদার সাহেব আমরা নিচে আছি।"
তাজদার সিদ্দিকী মাথা নাড়লো অল্প করে। তারপর তৌসিফকে বলল,
"আমাকে ছাড়বি কখন?"
"আরেকটু দাঁড়াও।"
সে শাইনার কাছে এগিয়ে এসে বলল,"শাইনা কথাটা শোনো। ভাইকে অনেকদিন ধরে রাজী করিয়েছি। তুমি এভাবে বেঁকে বসলে কিভাবে হবে?"
শাইনা বলল,"আমি ওভাবে তাকিয়ে ছবি তুলব না।"
একদম কাঠকাঠ ভাষায় কথাটা বলে দিল সে। তৌসিফের আর কি বলার থাকে? তারা সবাই হতাশ।
শেষমেশ দুজনকে দু'দিকে মুখ করে দাঁড় করিয়ে ছবি তুলে তৌসিফ বলল,
"এবার মনে হচ্ছে বিরোধী দলের নেতা নেত্রী। পার্ফেক্ট!"
বলেই হতাশ হয়ে সে ক্যামেরা রেখে দিল। চেয়ারে বসে জুসের বোতলে খুলে গলা ভিজালো। শাইনা বাকি ক্যামেরা ম্যানকে বলল,
"আর ছবি তুলব না। এটা নামান।"
তিতলি বলল,"মিমি আর ঝুমুরা নাচবে। এখন বাড়ি যেতে পারবে না তুমি।"
শাইনা না করলো না। তাজদার সিদ্দিকীও কিছুক্ষণের জন্য সরে গেছে।
ছাদে মোটামুটি কিশোর কিশোরী, তরুণ তরুণীরা আছে। যারা নাচবে তারা প্রস্তুতি নিয়ে এসেছে। শাইনার একটু ভালো লাগলো এবার। মন খারাপটা ক্ষণিকের জন্য দূর হয়ে গেল।
কিন্তু নাচ শুরু হওয়ার পর ছাদে আবারও ভীড় জমতে লাগলো। বড় আপা আর মেঝ আপার ছেলেমেয়েরাও নাচছে। সবাই মিলে আনন্দ করছে। সাত আট বছরের কাজিনরা সবাই মিলে শাইনাকে মাঝখানে টেনে নিয়ে এল। বড় আপার মেয়ে নাচছে কোমর দুলিয়ে। মেঝ আপার ছেলে নাচতে নাচতে পড়ে গেল।
শাইনা তাকে তুলে নিয়ে গালে আদর দিয়ে বলল,"হয়েছে কাঁদেনা।"
"কালামুনিল বিয়ে।"
শাইনা বলল,"আমার মাথা। ব্যাথা পেয়েছ?"
"না না।"
শাইনা মেঝ আপাকে বলল,"ওকে এখানে ছেড়ে দিয়েছ কেন?"
মেঝ আপা বলল,"থাক নাচুক।"
শাইনাকে ঘিরে সবাই নাচছে। বাকিরা ছবি ভিডিও তুলছে। গানের তালে যারা নাচতে লজ্জা পায় তারাও নাচছে। বড় দুলাভাইকে টেনে নিয়ে এসেছে শাওন। দুলাভাই বলল,
"আমাকে ছাড়, ছাড়। আমি নাচতে জানিনা।"
শাওন বলল,"আমার বোন তোমাকে এতদিনেও নাচটা শেখাতে পারলো না? আফসোস।"
সবাই একসাথে হো হো করে হাসলো। শাইনাও সবার তালে হেসে ফেলেছিল। বিয়ে, তাজদার সিদ্দিকী এইসব সে ভুলে গিয়েছিল একদম। মনে হচ্ছিল এটা তাদেরই বাড়ির কোনো অনুষ্ঠান। সবাই যখন তাকে ঘিরে নাচছিল, তখন শাইনাও অল্প অল্প করে হাততালি দিচ্ছিল ঠিক সেসময় বড় ভাইয়া, মেঝ ভাইয়াদের সাথে তাজদার সিদ্দিকীকে দেখা গেল। চোখাচোখি হতেই শাইনা ধীরেধীরে ঘুরে দাঁড়ালো। পিঠ করে দাঁড়ালো। নাচনেওয়ালীদের ভীড়ের মধ্যে সরে সরে থাকলো যাতে তাজদার সিদ্দিকীকে চোখে না পড়ে। তার হাসিমাখা চেহারা মলিন হয়ে এসেছে আবারও।
নাচগান শেষ হতে হতে প্রায় রাত আড়াইটা পার হয়ে গিয়েছে। বাচ্চাদের নিয়ে বাচ্চার মায়েরা চলে গেল। ধীরেধীরে ছাদ হালকা হতে লাগলো। শাইনা এককোণায় বসেছিল ভাইবোনের সাথে। ছাদে তখন শুধু বড় বউয়ের ভাইবোন, ভাবি আর দুলাভাইরা। তারা সবাই বসে আগাম পরিকল্পনা করছে গায়ে হলুদে সবাই কি রঙের গ্রুপ ড্রেস কিনবে, আর কি কি করবে ইত্যাদি ইত্যাদি। শাইনা চুপচাপ। তাজদার সিদ্দিকী মাঝেমধ্যে কথা বলছে ভাইদের সাথে। তখন সবাই উচ্চস্বরে হেসে উঠছে।
সবাই শলাপরামর্শ করে বেরিয়ে যেতে লাগলো একে একে। শাইনাকে রেখে সবাই চলে যাচ্ছিল। শাইনা শাড়ির কুঁচি ধরে লম্বা লম্বা পায়ে হেঁটে দরজা অব্দি যেতেই বড় আপা চোখ রাঙিয়ে বলল,
"কথা বল। বসে আছে ওখানে। ঠাস ঠাস করে চড় মারব সব শিখিয়ে দিতে হলে।"
শাইনার নিঃশ্বাস ফেঁপে উঠছে। হাতের তালু, পায়ের তালু ঘামছে। ছাদের দরজা টেনে বন্ধ করে দিল বড় আপা। তাজদার সিদ্দিকী দূরে একটা চেয়ারে বসেছে পিঠ কুঁজো করে হাঁটুতে কনুইয়ের ভর রেখে। চোখদুটো শাইনার দিকেই।
শাইনা একবার ঘাড় ফিরিয়ে তাকালো। তাজদার সিদ্দিকীকে তার দিকে তাকাতে দেখে, এই প্রকান্ড ছাদে সে এই লোকটার সাথে একা এইসব ভাবতেই সে আগপাছ কিছু না ভেবে অনবরত দরজায় ধাক্কা দিয়ে চেঁচিয়ে উঠলো।
অনেকগুলো পায়ের শব্দ একসাথে শোনা গেল। ছাদের দরজা খুলে দিতেই শাইনা সশব্দে কেঁদে উঠে বড় আপার উপর মেজাজ দেখিয়ে নেমে যেতে লাগলো বকতে বকতে।
"গোটা গুষ্ঠি মিলে নাটক শুরু করেছে আমার সাথে। সরো সামনে থেকে। আরেকটা কথা বললে কেয়ামত ঘটবে এখানে।"
শারমিলা আর শাবরিন একে অপরের দিকে তাকালো। বলল,
"উনি কি মনে করবেন বল তো?"
শাইনা ঘরে এসে আবারও চেঁচামেচি জুড়ে দিল। সবাই জড়ো হয়েছে তার ঘরে। বড় আপা বলল,
"আশ্চর্য, তোদের কথাবার্তা হয়নি তাই কথা বলার সুযোগ করে দিয়েছিলাম।"
শাইনা বলল,"কীসের কথাবার্তা? দরজা বন্ধ করে দিয়েছ কোন সাহসে?"
দাদীমা বললেন,"ওমা! ও ভুল কি করলো? একছাদে দাঁড়াতে না পারলে একঘরে থাকবি কেমনে?"
কথাটা শুনে মা চাচীরা সরে যাওয়ার পর আপা আর ভাবিরা সবাই হাসতে লাগলো। শাইনা দাদীর উপর খেপে বলল,
"সবাই যাও তো এখন। বের হও আমার ঘর থেকে। ফালতু প্যাঁচাল করতে আসে কানের কাছে।"
সবাইকে বের করে দিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল সে।
তারপর শাড়ি সাজ খুলে বিছানায় হাত পা ছড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়লো। সকালে ঘুম থেকে দেরী করে উঠলো সে। দাদীমা ঠেস মেরে বলল,
"নতুন বউ দেরী করে ঘুম থেকে উঠছে। সবাই সরে দাঁড়াও।"
হাসাহাসি করতে লাগলো তারা। শাইনা দাঁতে ব্রাশ চালাতে চালাতে বাইরে বেরিয়ে এল। পুরোনো অভ্যাস। পুকুরে মুখ ধোয়ার টানটা এখনো যায়নি। ঘাটে বসে ব্রাশ করতে লাগলো সে। চুলগুলো এলোমেলো হয়ে আছে। ওড়নাটা কোনোমতে বুকের সামনে ভাঁজ করে পড়েছে। চোখে রোদ পড়ায় চোখদুটো কুঁচকে আছে।
ব্রাশ শেষে পুকুরঘাটের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে তার চোখে পড়ল তাজউদ্দীন ভিলার ছাদে একটা লম্বা ছায়া। কানে ফোন চেপে ধরা। পাশে থুতু ফেললো এদিকে তাকাতে তাকাতে।
শায়না কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ছায়াটার দিকে তাকিয়ে থাকল ব্রাশ হাতে স্থির হয়ে। থুতু ফেলতে দেখে প্রচন্ড ক্ষোভ নিয়ে আরেক পা বাড়াতেই পা পড়ল শ্যাওলা ভেজা ঘাটে। হঠাৎই পায়ের নিচের জমিন সরে গেল। সে ছিটকে গিয়ে পুকুরে পড়ে গেল জল ছিটিয়ে।
চলমান.....❤️