11/07/2025
প্যারিসের ঘড়ির কাঁটায় তখন ম্যাচের ৫৮তম মিনিট। নিজেদের অর্ধে বল পেয়ে একটু আকিঁবুকিঁ করলেন ক্রোয়াট ম্যাজিশিয়ান লুকা মদ্রিচ। এরপর তিনি তিনজন লিভারপুল খেলোয়াড়কে বোকা বানিয়ে সোজা বল ছাড়লেন কার্ভাহালের উদ্দেশ্যে, স্প্যানিশ রাইটব্যাক হালকা ডান বামে তাকিয়ে বল দিলেন সেন্টার লাইনের উপরে দাঁড়িয়ে থাকা ব্রাজিলিয়ান ট্যাংক ক্যাসেমিরোর পায়ে। রাইট ফ্লাংকের একদম লাইন ঘেঁষে বলের জন্য অপেক্ষা করা উরুগুয়াইন মিডফিল্ডার ভালভার্দের উপর চোখ পড়লো তার, এক মুহুর্ত চিন্তা না করেই বল বাড়ালেন তার উদ্দেশ্যে। বল পায়ে আসতেই লাগালেন ছুট, ডিবক্সের কাছে গিয়ে এক সেকেন্ড বা তার কম সময় থামলেন তারপর সজোরে বলে কিক করলেন। বল ফাঁকি দিলো একে একে ভার্জিল ভ্যান ডাইক আলেক্সান্ডার আর্নল্ডকে, স্ব-মহিমায় খুঁজে নিলো এক ব্রাজিলিয়ান বিজয়ীকে। যার আলতো পায়ের ছোঁয়ায় বল জড়িয়ে গেলো জালে। লিভারপুল গোলকিপার অ্যালিসন বেকার স্বদেশী তরুনের শট ঠেকানোর যে চেষ্টা করলেন সেটা ব্যর্থতায় পরিণত হলো।
সেদিন সেই তরুনের একমাত্র গোলে রেকর্ড ১৪ তম বারের মতো ইউরোপ সেরার মুকুট পড়েছিলো স্প্যানিশ ক্লাব রিয়াল মাদ্রিদ। সিজনের লীগ শিরোপা ঘরে তুলতেও ছেলেটার অবদান ছিলো অনেক বেশী। এক সিজনেই ছেলেটা বনে গেলো দলটার নায়ক! কিন্তু ক'দিন আগেও যে ছেলেটা ছিলো ভিলেন।
ফুটবল খেলার শুরু বাবার হাত ধরে। তার বাবা ৬ বছর বয়সে তাকে ভর্তি করে দেন ব্রাজিলের স্বনামধন্য ক্লাব ফ্লামেংগোর একটা শাখায়। সেখানে নিজেকে প্রস্তুত করে থাকেন, প্রাথমিকভাবে তাকে রেজিস্টার করা হয় একজন লেফটব্যাক হিসেবে । ৯ বছর বয়সে ক্যারিয়ার ফুটসালের দিকে নিয়ে যাওয়ার সুযোগ থাকলেও ছোট্ট ছেলেটা ফুটবলেই ক্যারিয়ার গড়তে চেয়েছিলো। অপেক্ষা করতে তার আপত্তি ছিলো না। ২০১৭ সালে ১৬ বছর বয়সে অভিষেক হয় প্রফেশনাল খেলোয়াড় হিসেবে, মাত্র ৮ মিনিট খেলার সুযোগ পান ফ্লামেংগোর জার্সি গায়ে। সেবছরেই তাকে কিনে নেয় স্প্যানিশ জায়ান্ট রিয়াল মাদ্রিদ।
রিয়াল মাদ্রিদ যখন তাকে ৪৬ মিলিয়ন ইউরো বিনিময়ে কিনেছিলো তখন সবাই কটাক্ষ করেছে,সমালোচনা করেছে। অপরীক্ষিত একটা বাচ্চার পিছনে এত টাকা খরচ করা কেনো? প্রথম তিন সিজন নিন্দুকেরা হেসেছে, তাদের জয়জয়কার চলেছিলো। ছেলেটা যে তখন ভীষণরকম ব্যর্থ। হওয়াটা তো স্বাভাবিকই ছিলো, বয়স তো তখনো তার ২০ এর কোটায়!
মিস পাস, দূর্বল ও অতিরিক্ত ড্রিবলিং আর গোলমুখে শিশুসুলভ মিসের কারণে কতবার যে সমালোচিত হয়েছেন, সামাজিক মাধ্যমে ট্রলের শিকার হয়েছেন তার ইয়াত্তা নেই। তার এসব মিসের কারণে স্বয়ং তার সতীর্থ করিম বেঞ্জেমা ফরাসী লেফটব্যাক ফারল্যান্ড মেন্ডিকে বলেছিলো " তাকে বল দিও না, সে আমাদের বিপক্ষে খেলছে।" কি দুদার্ন্তভাবে ফিরে আসলে পরের সিজনে বেঞ্জেমা বলতে বাধ্য হয়েছে- "তাকে বল দাও সে আমাদের নায়ক।"
রিয়াল মাদ্রিদের লিজেন্ডারি কোচ জিনেদিন জিদানের সময় অনেক সুযোগ পেলেও খুব একটা পরিবর্তন আসে নি তার খেলায়। কোচ হিসেবে কার্লো আনচেলত্তি এসে ডেভিড কপারফিল্ডের জাদুর কাঠির মতো পুরোপুরি বদলে দিয়েছিলো তাকে। যেখানে আগের তিনসিজনের গোল করেছিলেন মোটে ১৫ টা, সেখানে গত সিজনেই গোল করলেন ২২ টি, করালেন প্রায় আরো ২০ টি। ড্রিবলিং,পাসিং, ফিনিশিং দিয়ে মুগ্ধ করালেন ভক্তদের, সমালোচকদের। এরকম পারফর্মেন্সের পর এবারের ব্যালন ডি অরের সেরা পাঁচ কিংবা ছয়ে জায়গা হবে তার। এবার তো ছাড়িয়ে আগের সব রেকর্ডকে, ব্যালন ডি'অরের দৌড়ে আছেন সবার উপরে। যদিও কোপায় ভালো করতে পারেন নি তবুও ভিনি এই সিজনে ছিলো যেকোন ফুটবলারের থেকে সেরা। ছেলেটা এখন এতোটাই ভালো যে নিন্দুকেরাও এখন প্রশংসা করে তার! ছেলেটা প্রমাণ করে ছেড়েছে, এভাবেও ফিরে আসা যায়।
রিও ডি জেনেরিওর সাও গোসালোর ছেলে ভিনিসিয়াস জুনিয়র ব্যর্থতার সমুদ্রে ডুবতে ডুবতে সফলতার ছোট্ট এক দ্বীপে এসে পৌঁছাতে পেরেছেন। তাকে আবার পাড়ি দিতে হবে সেই উত্তাল সমুদ্র, সফলতা নামক তীরের সন্ধান পেতে গেলে লড়াই করতে হবে পাহাড়সম উঁচু ঢেউয়ের সাথে। শক্তি, সার্মথ্য, প্রতিভা সবই আছে তার। কাজে লাগাতে পারলেই হতে পারবেন বিশ্বসেরাদের একজন।
২৫ তম জন্মদিনের শুভেচ্ছা ভিনিসিয়াস জুনিয়র 🖤
[ তিন বছরের আগের লেখা, আংশিক সংযোজিত]