22/10/2025
"USE MASK WHEN YOU ARE IN YOUR PIGEON LOFT "
শান্তিপুরের এক পুরনো টালির বাড়িতে থাকে অরিন্দম—হাসিখুশি, সহজ-সরল মানুষ। পেশায় স্কুল মাস্টার। সকাল শুরু হয় মন্দিরের ঘণ্টার শব্দে, শেষ হয় ছাদের পায়রার ডানার আওয়াজে।
বছর কুড়ি আগে ওর ঠাকুরদা প্রথম পায়রা পোষার নেশা ধরিয়েছিল। তখন থেকেই অরিন্দমের জীবনে পায়রা মানে শান্তি, ভালোবাসা, ঘরের প্রাণ। এখন তার ছাদে প্রায় আশিটা পায়রা—সাদা, ধূসর, বাদামী, রঙে রঙে ভরা।
প্রতিদিন ভোরে সে দানার হাঁড়ি হাতে ছাদে যায়।
মুহূর্তের মধ্যে আকাশ ভরে যায় ডানার শব্দে।
ও ওদের নাম রেখেছে “মেঘ”, “ঝড়”, “সাদা রাজা”, “গোলাপি রানী”—যেন নিজের সন্তানদের মতো। এমনকি ওদের জন্য বানিয়েছে বাঁশের খোপ, খড়ের বিছানা, জলের হাঁড়ি।
সব নিজের হাতে।
একদিন হঠাৎ রাতে হালকা কাশি সবকিছু বদলে দিল। প্রথমে ভেবেছিল ঠান্ডা লেগেছে। হোমিওপ্যাথির বড়ি খেলে ঠিক হবে।
কিন্তু ঠিক হলো না। কাশি দিন দিন ঘন হল। হাঁটলে হাঁপাচ্ছে, রাতে ঘুমের মধ্যে বুক ধড়ফড় করছে।
স্ত্রী একদিন বলল, “তুমি সারাদিন ওই পায়রার ধুলো-মল-এর মধ্যে থাকো, কিছু হবে না?”
অরিন্দম হেসে বলল, “ওরা তো আমার বাচ্চা, ওদের দ্বারা আমার কেনো ক্ষতি হবে?”
কিন্তু কাশি থামল না। একদিন স্কুলে ক্লাস নিতে গিয়ে এত জোরে কাশল যে ছাত্ররা ভয় পেয়ে গেল। সহকর্মীরা সবাই মিলে ধরে নিয়ে গেল হাসপাতালে।
এক্স-রে, HRCT, রক্তপরীক্ষা—সব দেখে ডাক্তার ভ্রু কুঁচকে বললেন, “Mr. Arindam, you have chronic hypersensitivity pneumonitis. Likely from bird exposure.”
অরিন্দম স্তব্ধ।
“মানে? আমার পায়রার জন্য?”
ডাক্তার শান্ত গলায় বললেন, “আপনি বছরের পর বছর পায়রার পালক, মল, ধুলো—এসবের microscopic কণায় ঘেরা থেকেছেন। আপনার শরীরের ইমিউন সিস্টেম এগুলোকে শত্রু ভাবে। প্রথমে সামান্য অ্যালার্জি, তারপর lung-এ প্রদাহ। সময়ের সঙ্গে সেই প্রদাহ ফুসফুসের টিস্যুকে শক্ত করে ফেলে—fibrosis। একবার শুরু হলে ফেরে না।”
অরিন্দম কিছু বলতে পারল না। সে জানত না, তার এত ভালোবাসার পাখিরাই তার নিঃশ্বাস কেড়ে নিচ্ছে।
বাইরে তখন সন্ধ্যা নামব নামব ভাব। জানালার বাইরে কয়েকটা পায়রা উড়ছে—ওদের চোখে সেই চেনা বিশ্বাস।
তখনই ছাদে উঠল অরিন্দম।
খোপের ভেতর ওরা গুটিসুটি মেরে বসে আছে।
অরিন্দম নিচু গলায় বলল, “তোরা জানিস না, আমি তোদের কত ভালোবাসি… কিন্তু তোরা আজ আমাকে ছেড়ে উড়ে যা।”
এক এক করে সব খোপ খুলে দিল।
পায়রাগুলো আকাশে উঠল। সাদা মেঘের মতো ছড়িয়ে পড়ল আলো-আঁধারির আকাশে।
ডানার শব্দ মিশে গেল বাতাসে।
অরিন্দমের বুকের ভেতরও যেন কিছু দুমড়ে মুচড়ে ভেঙে গেল—অদৃশ্য কিছুর আঘাতে।
তারপর থেকে ছাদ ফাঁকা। ও বুঝল, ওদের ছাড়াই বাঁচতে হবে, কিন্তু প্রতিদিন সকালে জানালার বাইরে যখন ডানার শব্দ শোনে, বুকটা হু হু করে ওঠে—যেন ফুসফুসের কোথাও এখনো একটা পালক আটকে আছে।
রোগ বাড়ল।
স্টেরয়েড, ইনহেলার, অক্সিজেন সিলিন্ডার—সবই এল জীবনে।
কিন্তু fibrosis আর ফেরে না। শেষ দিকে কথা বলাও কষ্টকর হয়ে উঠল।
তবুও মুখে একই কথা, “ওরা খারাপ না, আমিই ওদের অত ভালোবেসেছি।”
এক সকালে স্ত্রী ঘরে ঢুকে দেখে—অরিন্দম জানালার পাশে বসে, চোখ বন্ধ, হাতে একটা সাদা পালক ধরা, ঠোঁটে হালকা হাসি।
ওর বুক আর ওঠানামা করছে না।
বাইরে পায়রার ডাক ভেসে আসছে।
মনে পড়ে গেল ডাক্তারবাবুর কথা— “যখন ভালোবাসা সীমা ছাড়ায়, তখন শরীর বুঝে না—কি বিষ, কি প্রেম।”
এই গল্প শুধু অরিন্দমের নয়। আমাদের চারপাশে এরকম অনেক অরিন্দম আছে—যারা ভালোবাসা আর অভ্যাসের টানে নিজের শরীরকে ধীরে ধীরে ক্ষয় করে ফেলছে।
মেডিক্যালে এই রোগের নাম Bird Fancier’s Lung — একধরনের ক্রনিক হাইপারসেন্সিটিভ নিউমোনাইটিস। এর কারণ পাখির পালক, মল, শুকনো ধুলো—যেগুলো চোখে দেখা যায় না, কিন্তু নিঃশ্বাসের সঙ্গে ঢুকে ফুসফুসের টিস্যুতে ক্ষতি করে।
পায়রা, টিয়া, বাজরিগার, এমনকি ঘরের বারান্দার কাক বা চড়ুই—যে কোনও পাখির সঙ্গে দীর্ঘ সংস্পর্শেই এই রোগ হতে পারে।
শুরুতে সামান্য কাশি বা জ্বর দিয়ে বোঝা যায় না, কিন্তু সময়ের সঙ্গে তা স্থায়ী হয়ে যায়—যেখান থেকে আর ফেরার পথ নেই।
©ভালোবাসা থাকুক, কিন্তু দূরত্বও থাকুক।
নিজেকে বাঁচিয়ে রাখাই ভালোবাসার সবচেয়ে গভীর রূপ।
✍️ ডাঃ সৌভিক মহাপাত্র
সংগ্রহে : An Animesh (পরিমার্জিত)
📷 প্রতীকী
পোস্ট ভালো লাগলে লাইক, কমেন্ট, শেয়ার করবেন 🙏
#পায়রারডাক #অরিন্দমেরগল্প #পাখিপ্রেম #মানুষওভালোবাসা