Papa's princess

Papa's princess Personal Blog

অপরার তখন নয় বছর। স্বভাবে খানিক'টা বোকা। কোথা থেকে যেন ছুটে এসে বলল,"অয়ন ভাইয়া,আমি তোমাকেই বিয়ে করব।"বন্ধুরা পাশেই ছিল। ...
29/06/2024

অপরার তখন নয় বছর। স্বভাবে খানিক'টা বোকা। কোথা থেকে যেন ছুটে এসে বলল,"অয়ন ভাইয়া,আমি তোমাকেই বিয়ে করব।"

বন্ধুরা পাশেই ছিল। শুনেতে পায়নি। শুনে ফেললে রক্ষা নেই। আমি ভাবছি এই টুকু মেয়ে বলে কি! নিচু হলাম। আশে পাশে বন্ধুরা আছে বিধায় ফিসফিসিয়ে বললাম,"আমাকেই বিয়ে করবি?"

"হুম।" সহজ সরল উত্তর। আগ্রহ জাগে। একটু দূরে সরিয়ে আনলাম ওকে। অপরার এক বদ অভ্যেস রয়েছে। নখ কামড়ানো। যা আমায় বিরক্ত করে। টেনে সরিয়ে দিলাম হাতটা। ফের মুখে তুলতেই চোখ রাঙালাম। এবার দমে গেল। নম্র,ভদ্র বাচ্চাদের মতো করে তাকাল। গাল দুটো ফোলা ফোলা। দেখলেই আদর করতে ইচ্ছে হয়। আগ্রহ ধরে রাখতে পারছি না।
"আমাকেই কেন বিয়ে করবি?"

"তোমাকে বিয়ে না করলে আমি খেলতে পারব না।"

"খেলতে পারবি না! ওমা বিয়ের সাথে খেলার কি সম্পর্ক?"

ছোট্ট অপরা হাত উঁচু করে ইশারা করল। দেখলাম আমাদের পাশের বাড়ির নীলাকে। হাসছে মুখ টিপে। বিষয়টা বুঝতে পারলাম। সমবয়সী নই আমরা। তবে এক সাথে খেলতাম আগে। এখন কথা অবধি হয় না! এমনটা হলো আমি স্কুল বদল করার পর। দু বছর আগে ক্লাস নাইনে ভর্তির সময় বাবা স্কুল চেঞ্জ করে দিলেন। কারণ সেই স্কুলে বিজ্ঞান বিভাগ নেই। তখন নীলা সেভেনে পড়ছে। এরপর গত দুবছরে আমাদের কথা হয়নি। কেন হয়নি জানি না। হয়তো চোখের আড়াল হতেই মনের আড়াল হয়ে গিয়েছিলাম। তবে দু বছর পর আজকের ঘটনায় মনটা কেমন করে ওঠল। আমার সতেরো বছরের হৃদয়ের দহনটুকু আরো বৃদ্ধি পেল। তবু সাহস করে কথা বলা হলো না। আর তারপর কেটে গেল অনেক গুলো বছর। এখন আমি অনার্স শেষ বর্ষে। ভালোই চলছে পড়াশোনা। এরই সাথে যেটা বেশি চলছে তার নাম দহন। ছটফট কিংবা চিত্ত চেরা আবেদন। হৃদয় মাঝারে একটি ফুল ফুটেছে। সেই ফুলের নাম নীলা।

গল্পটা এখান থেকেই শুরু। অপরা এবার কলেজে উঠেছে। হৈ চৈ চলছে বাড়িতে। সবাই ভেবেছিল এই বুঝি পা ফঁসকে যাবে ষোড়শী অপরার। রেজাল্ট দেওয়ার আগ মুহূর্ত অবধি প্রায় সকলেই সান্ত্বনা দিচ্ছিল। 'মন খারাপ করিস নারে অপরা। এবার চাঁদ না উঠলেও সামনের বছর ও যে চাঁদ উঠবে না এ কথা তো সত্য নয়।' কেউ কেউ বলল 'এটা কোনো বিষয় নাকি! দেখলি না কি সব ভাইরাল হলো। কত বছরের পর বছর পড়াশোনার পেছনে লেগে থেকে শেষে উত্তীর্ণ। তাছাড়া আদু ভাই ও তো সর্বশেষ প্রমোশন পেয়েছিল। তুই ও পাবি।'

এসব নানান জল্পনা কল্পনার মাঝে অপরা চুপ। শুকনো তার মুখ। অয়ন বসেছিল ফোন নিয়ে। রেজাল্ট পাওয়ার সাথে সাথে জানাল। সকলে বিস্মিত! তাদের বোকা, ব্রেনে গোবর বোঝাই থাকা অপরা নাকি পাশ করেছে। শুধু কি পাশ! একটুর জন্য এ গ্রেটটা মিস হয়ে গেল। হরেক রকমের মিষ্টি আনা হলো। পুরো বাড়িটাই এখন অপরার কব্জায়। এত সময় চুপ ছিল রেজাল্টের টেনশনে। এখন ফুরফুরে তার মেজাজ। একটু নাচতে পারলে শান্তি মিলত। পাড়ার কাকিদের নাকের ডগার সামনে দিয়ে কোমর দুলিয়ে চলতে ইচ্ছে হচ্ছে। তবে সে ইচ্ছে পূর্ণ হলো না। দেখতে দেখতে অপরার কলেজের এডমিশন ও হয়ে গেল। অয়নের কলেজেই! অয়নের কলেজ আর ভার্সিটি এক সাথেই। একটুর জন্য সিট পেল অপরা। নাক ছুঁই ছুঁই বলা চলে। ওর রোল হলো সবার শেষে। এই নিয়েও এক বিস্তর হাসি ঠাট্টা। অপরা তখনো চুপ। মাঝে সাঝে নাক ফুলায়। ক্ষোভ থেকে নয় বরং এটা ওর সহজাত।

জুনিয়রদের নবীনবরণে কি পরবে এ নিয়ে দ্বিধায় পড়ল চব্বিশ বছর বয়সী টগবগে যুবক অয়ন। একের পর এক পাঞ্জাবি সরিয়ে রাখছে। কোনোটাই মিলাতে পারছে না। চা দিতে এসেছিল অপরা। অয়ন খেয়াল করল।

"শোন, এদিকে আয় তো।"

অপরা এগিয়ে এল। মুখটো রাখল ফুলিয়ে। তা দেখে অয়ন বলল,"প্যাঁচার মতো তাকিয়ে আছিস কেন! আজ না তোর নবীণবরন?"

"হুম।"

"যাবি কখন! সেজে গুজে বের হতেই তো তিন ঘন্টা।"

"এই তো যাচ্ছি।"

পাঞ্জাবি গুলো দেখে রাগ হচ্ছে অয়নের। সে বলল,"দেখ তো কোনটাতে আমায় বেশি মানাবে আইমিন খুব হট লাগবে। মেয়েদের লাইন যেন লাগে।"

মাথা ঝাঁকাল অপরা। একটু লক্ষ্য করেই একটা সি গ্রীন কালারের পাঞ্জাবি বের করল। ভীষণ সুন্দর এটা। অয়নের দিকে বাড়িয়ে দিতে দিতে বলল,"এটা আপনাকে খুব ভালো মানাবে।"

হেসে ফেলল অয়ন। অপরা অবশ্য এর কারণ জানে না। সে ঠায় দাঁড়ানো। কিছুই বোধগম্য হলো না। দেখল দুই একবার নাড়াচাড়া করে পাঞ্জাবিটা রেখে দিয়েছে অয়ন।

"তোর চয়েজ কি রে! ব্র্যান্ড সেন্স দেখছি খুব ই খারাপ।"

অপরা কথা বলল না। সে মুখ গোমড়া করে চলে এল। ঘটনাটা দিনের মধ্য ভাগের। নতুন বান্ধবীরা খুব রিকোয়েস্ট করল শাড়ি পরার জন্য। অপরা নিজেও শাড়ি পছন্দ করে বেশ। সময় কম। চটপট শাড়িটা আয়রন করল সে। তারপর রেডি হলো পাঁচ মিনিটে। চোখের নিচে হাল্কা কাজল আর ঠোঁট রাঙাল হাল্কা রঙে। গায়ের রঙ টা অধিক সুন্দর হওয়ায় বেশি প্রসাধনীর দরকার হয় না। একটু মাশকারা দিতেই চোখের পাপড়ি গুলো কেমন বড়ো দেখায়। পুরো মুখের নকশাই বদল!

নীলা,ভার্সিটির সেরা সুন্দরীদের একজন। নিজেকে সাজাতে পছন্দ করে। দেখলেই মনে হয় 'ইস কি গোছানো মেয়েটি।' সাথে আপসোস ও হয় 'ওমন সুন্দর মেয়ে নাকি প্রেম করে না! বিশ্বাস করা যায় কি আদৌ?' যায় না। তবে এমনটাই হয়েছে। একুশ বছরের এই যুবতী এখনো সিঙ্গেল ট্যাগ নিয়ে ঘুরে ফিরে। নীলাকে প্রপোজ করা প্রতিটি ব্যক্তিই হৃদয় হাতে করে প্রত্যাখ্যান হয়ে বাড়ি ফিরেছে। জুনিয়র ছেলেগুলো হা হয়ে দেখে। মাঝে সাঝে শোনা যায় আপসোসের সুর 'সিনিয়র আপু গুলো এত সুন্দর হয় কেন! কপাল পো'ড়া!'

প্রতিবারের মতো আজও সেটা কানে এল নীলার। হেসে জবাব দিল।

"প্রায় সকলেরই কপাল পো'ড়া। জুনিয়রদের জন্মগত ক্রাশ হয় সিনিয়র। আর নিজের ক্লাসের মেয়েগুলো ওদের কাছে পেত্নি! তাই আর প্রেম হয়ে ওঠে না। শেষমেশ কপাল হাতে আপসোস করতে হয়।"

শেষ বাক্যে নীলার ঠোঁটটা একটু বেশিই প্রসারিত হলো। জুনিয়র ছেলে গুলোর বুকের বাঁ পাশে হাত। মনের ভেতর ঝড় তুলে দিল সিনিয়র আপুর কণ্ঠটা!

অয়ন অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছে। নীলার এত লেট হচ্ছে কেন! মেয়েটি আজ আসবে তো? এই যে দু মাইল দূরে গিয়ে ফুল আনল। টকটকে তাজা গোলাপ। এসব তো বৃথা যাবে তবে। মনমড়া হয়ে এল। বসল, শব্দহীন। নীলা যখন আসে তখন একটার কাছাকাছি। প্রায় আধ ঘন্টা লেট! বুকের ভেতর উত্তেজনা কাজ করছে। নীলার কলেজ ছিল ভিন্ন। তবে ভার্সিটি এক। গত দু বছরে একটা সাধারণ বন্ধুত্ব হয়েছে। যেমনটা ছিল সেই ছোট্ট সময়ে। অয়নের হাতের ফুল দেখে নীলা বলে, "গোলাপ! স্পেশাল কিছু?"

বিলম্ব করতে চায় না অয়ন। সরাসরি বলে,"আই লাভ ইউ নীলা।"

মুক্তো ঝরার মতো হাসি ঝরে নীলার। এতে অয়নের ভয় হয়। মেয়েটি ওকে ফিরিয়ে দিবে না তো! বন্ধুরা গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে। টান টান উত্তেজনা। এই বুঝি প্রত্যাখ্যান হবে শত নারীর ক্রাশ অয়ন! অথচ ঘটনা ঘটল উল্টো। নীলা ব্যাগ থেকে ফুল বের করে বলল, "আমিও ভালোবাসি অয়ন।"

চারপাশ থেকে আওয়াজ আসতে লাগল। সকলেই বাহবা দিচ্ছে। অয়ন এতটা আশা করে নি। তবে এটা কনফার্ম ছিল নীলার মনে ওর জন্য সফট কর্নার আছে। পুরো দুপুরটা এক সঙ্গে কাটাল ওরা। নবীনবরণ হলো বিকেলে। অন্যদিকে বন্ধুদের যন্ত্রণায় হাজার খানেক ছবি তুলেছে অপরা। মানুষ ইদানীং ছবি তোলার জন্য ব্যাকুল!

ফেরার পথে অপরা দেখল অয়নের বুকে মাথা গুঁজে আছে নীলা। লজ্জায় লাল হয়ে এলো মুখ। অয়ন ভাইয়া নীলাপুর সাথে প্রেম করছে!

অয়নের ফিরতে লেট হলো। বাড়ির সবাই তখন ঘুমিয়ে জল। অপরার নাম্বারে কল করল সে। দু বার কল করার পর ফোন রিসিভ করল মেয়েটি। ঘুমে জড়িয়ে আসা কণ্ঠ।

"হ্যালো।"

"অপরা,ফোন ধরিস না কেন? দরজা খুলে দে জান। আমি বাইরে দাঁড়িয়ে।"

"কোন দরজা?"

ঘুমে ঘুমে জবাব দিল অপরা। আর এতেই অয়নের রাগ বেড়ে হলো আকাশচুম্বী।

"ঠাটিয়ে মা র ব গালে। বললাম না বাইরে দাঁড়িয়ে। দু মিনিটের মধ্যে নিচে নামবি।"

কিছুটা সজাগ হলো অপরা। অয়ন ভাই এত রাতে! তখনই মনে পড়ল নীলাপুর সাথে দেখেছিল আজ। হয়তো ঘুরাঘুরি করে ফিরতে লেট হলো। হাই তুলে অপরা। চোখের ঘুম সরিয়ে বেরিয়ে আসে। অয়ন সবে ফোন তুলেছে। মেজাজ গরম। ওমনি করে কলাপসিবল গেট খোলার শব্দ এল। অপরা জুবুথুবু হয়ে দাঁড়িয়ে। অয়ন বলল,

"এতক্ষণ লাগে!"

কাচুমাচু করছে অপরা। অয়ন ভ্রু নাচিয়ে শুধাল,"কোথায় ছিলি?"

"আমার ঘরে,ঘুমিয়ে ছিলাম।"

"তুই ঘুমেই থাক। যা দরজা লাগা।"

গরম লাগছে। সাথে পেটে ক্ষুধা। শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে অয়ন বলল,"খাবার গরম কর। ক্ষুধায় পেটের ভেতর দৌড় প্রতিযোগিতা চলছে।"

বিনাবাক্যে খাবার গরম করে এনে দিল অপরা। অয়ন হাত মুখ ধুয়ে এসে বসল। ভাত বাড়ার সময় অপরা বলল,"ডালের সাথে লেবু দিব নাকি আচার?"

ফোনে কিছু করছে অয়ন। খুব সম্ভবত চ্যাটিং। অপরা ফের বলল,"অয়ন ভাইয়া।আচার খাবেন নাকি লেবু?"

"আচার ই দে।"

বয়াম এনে দিয়ে চলে যেতে নিলেই অয়নের গলা "ঐ"

"হু?"

"এগুলা কে সরাবে? বোস, খাওয়া শেষ হলে যাবি।"

এবার রাগ হলো অপরার। লোকটা পেয়েছে কি! মগের মুল্লক নাকি শ্বশুরবাড়ি? অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও বসতে হলো তাকে। অয়ন খেল সময় নিয়ে। দু একবার এটা সেটা এনে দিতে ও হলো। ঘুমে টলে যাচ্ছে অপরা। অয়নের ধমকে উঠে দাঁড়াল। সটান হয়ে রইল কিছু সময়। নিজের প্লেট অবধি নিল না অয়ন। হাত ধুয়ে এসে সোজা নিজের ঘরের পথে চলে যাচ্ছে। এদিকে অপরার হতবুদ্ধি হারিয়ে ফেলার উপক্রম! অয়নের এটো প্লেটের দিকে তাকিয়ে ওর মনে হলো ছেলেটা বুয়ার মতো খাটাল তাকে!

চলবে....
#হৃদয়দহন (১)
কলমে ~ #ফাতেমা_তুজ_নৌশি

#হৃদয়দহন (২)

অপরা কলেজ থেকে ফিরল। পোশাকটি একদম ঘামে ভেজা। সদর দরজা দিয়ে প্রবেশ মাত্রই চ্যাঁচিয়ে ওঠল অয়ন। এতে চোখ ছোট ছোট করে চাইল ষোড়শী। অয়ন এগিয়ে এসে বলল,"একি রে, তুই কি কলেজ গিয়ে গোসল করে এসেছিস?"

মেয়েটি ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে আছে। মানুষটা সর্বদা উল্টোপাল্টা কথা বলে।
"কলেজে কেউ গোসল করতে যায় না অয়ন ভাই।"

"তোকে দেখলে মনে হয় গোসল করতেই গিয়েছিস। এভাবে ভিজে একাকার।"

সরল চোখে তাকাল অপরা। রিকশা পায় নি। এতটা পথ তাই হেঁটে আসতে হয়েছে।

"পাড়ায় কি সব ঝামেলা হয়েছে। তাই রিকশা আসছে না।"

"কীসের ঝামেলা?"

"আমি তো জানি না।"

অপরা ব্যাগ নিয়ে নিজ রুমের দিক এগোল। অয়নের হাতে পেয়ারা ছিল। মাত্রই ছাদ বাগান থেকে পেরে এনেছে। সেটায় কামড় দিয়ে বলল,"মা, আমি বের হলাম।"

"এই ভর দুপুরে কোথায় যাচ্ছিস?"

ভেতরের ঘর থেকে জবাব দিলেন মা। অয়ন বলল,"পাড়ায় নাকি রিকশা আসছে না। দেখি কি সমস্যা।"

অয়ন চলে গেল। অপরা নিজ ঘর থেকে উঁকি দিয়ে দেখল সেটা। সে মূলত একটু মিথ্যে বলেছে। রিকশা আসছিল না এটা ঠিকই। তবে গোপন কারণে ছুটে আসতে হয়েছে তাকে। সেই জন্যই ঘেমে গেছে। আর বিষয়টি আপাতত কাউকে বলা যাবে না।

ড্রেস বদল করে এল অপরা। তারপর রান্না ঘর থেকে খাবার নিতে নিতে শুধাল,"বড়ো মা, পুঁইশাক কেন রান্না করেছ? আমি তো খেতে পারি না।"

বড়ো মা ছোট ছোট চিংড়ি দিয়ে পুঁইশাক রান্না করেছেন। মোটামুটি বাড়ির সবাই এটি পছন্দ করে থাকেন। এই অপরা ই একমাত্র ব্যক্তি যে পুঁইশাক খায় না। তার নাকি ভালো লাগে না। কেমন গলা দিয়ে নামে না।

"মাঝে মধ্যে শাক খেতে হবে আম্মা। না হলে তো আপনার শরীর আরো শুকিয়ে যাবে। যেভাবে দিন কে দিন শুকিয়ে যাচ্ছিস।"

অপরা কথা বলল না। সে আপন মনে ফ্লিজ থেকে ডিম নিয়ে ভাজতে লাগল। বড়ো মা ক্লান্তির নিশ্বাস ফেলে বললেন,"গোসল করে নিতি।"

"ক্ষুধা লেগেছে খুব। ক্যান্টিনে কি সব বিক্রি করা হয়। একদমই খেতে পারি না।"

মেয়েটির কথা বার্তায় কেমন একটা মায়া মিশে আছে। দেখলেই ভেতরটা কেমন করে ওঠে। বড়ো মা অপরার কোমড় অবধি খোলা চুল গুলো খোঁপা করে দিলেন। তারপর পুঁইশাক থেকে কিছু চিংড়ি মাছ ওঠিয়ে প্লেটে দিলেন। অপরা প্লেট নিয়ে যেতে যেতে বলল‍,"দাদিজান খেয়েছে?"

"খেয়েছে, জোর করে খাওয়ালাম। তোকে ছাড়া খেতেই চায় না। শেষে বললাম, অপুকে তো বিয়ে দিতে হবে। তখন কী করবেন। এরপর কিছু সময় চুপ করে থেকে, খাবার খেল।"

অপরা হেসে ফেলল। এই বাড়ির প্রতিটা মানুষ ওর ভীষণ আপন। তবে দাদিজান সবথেকে বেশি। এই মানুষটার জন্যই কী না সে বেঁচে আছে।

অয়ন পাড়ার ক্যারামের দোকানে এসে বলল,"কী রে, পাড়ায় রিকশা কেন আসছে না?"

একজন বলল‍,"আসছে তো। তবে সোলাইমান বড়ো ঝামেলা করছে। তাই একটু গণ্ডগোল লেগেছিল। তখন অফ ছিল।"

অয়ন বুঝল বিষয়টা মোটেও সহজ নয়। সোলাইমান, পাশের পাড়ার ছেলে। একদমই বিগড়ে যাওয়া যাকে বলে। প্রায় সময়ই এই পাড়ায় এসে ঝামেলা করে। এই নিয়ে দুই পাড়ায় কতবার যে বিচার বসল। তবু শোধরায় না সোলাইমান।

ক্যারাম খেলতে খেলতে হঠাৎ চোখ পড়ল দোকানে। নীলা এসেছে। জিনিসপত্র কিনবে বলে। দুজন ইশারায় কথা বলল। তারপর জিনিসপত্র কেনা হলে,একটু আগে পরে করে চলতে লাগল। দোকান থেকে বেশ কিছুটা দূরে এসে অয়ন বলল,"তোমায় না বলেছি, একা একা দোকানে আসবে না।"

ওর কথায় মুখ টিপে হাসল নীলা। তারপর বলল,"আসলে কী সমস্যা?"

"কী সমস্যা মানে, বিরাট সমস্যা। দোকানের পাশেই ক্যারাম খেলা হয়। কত ছেলে'রা এখানে বসে থাকে। ওরা তো চোখ দিয়ে গিলে খাবে।"

আরেক দফায় হাসল নীলা। তারপর বলল,"কতবছর ধরে এই পাড়ায় আছি। কেউ কিছু বলার সাহস পায় নি।"

অয়ন পুরো হতাশ হলো। মেয়েটাকে বোঝাতে পারছে না। ও খপ করেই যুবতীর হাত ধরে ফেলল। চোখে চোখ রেখে বলল,"তুমি বুঝতে পারছ না, হয়তো সবাই সামনে ভালো ব্যবহার করে,কিন্তু আড়ালে ওদের কথা বার্তার শেষ নেই।"

"আচ্ছা, বুঝেছি মশাই। এত চিন্তা কোরো না তো।"

"কেন চিন্তা করব না? চিন্তা তো করবই। পাড়ার সবথেকে সুন্দরী আমার গার্লফ্রেন্ড। চিন্তা তো করতেই হবে।"

ওর এহেন কথায় না হেসে পারল না নীলা। ও শব্দ করে হেসে ফেলল। আর সেই হাসির দিকে তাকিয়ে রইল অয়ন। কোনো মানুষের হাসি এত সুন্দর কেন হবে?

ছোট চাচার মেয়ের নাম কথা। অপরার থেকেও দু বছরের ছোট। স্কুলে পড়ছে। ক্লাস এইট। মেয়েটির একটি স্বভাব রয়েছে। পুরো পাড়া ঘুরেফিরে খবর নিয়ে আসা। অপরা পেয়ারা মাখা করেছে। সেটা নিয়েই বসেছে ওরা। এক টুকরো পেয়ারা নিয়ে শুধাল,"বল, তোর কাছে আজকে কী খবর আছে।"

কথা সিরিয়াস হয়ে বসল। যেন সংবাদ পাঠ করবে। তারপর বলল,"খবর আছে গো অপুবু, খবর ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ।"

"তাই? বলে ফেল। দেরি করিস না।"

"সোলাইমান ভাই, পাড়ায় এসেছিল। এসে পাড়ার ছেলেদের সাথে ঝামেলা করেছে। আর সেই নিয়েই প্রায় মারামারি হতে গিয়েও হয় নি।"

এই খবর জানে অপরা। আসার পথেই দেখে এসেছে। তাই জমল না বিষয়টা। ও মুখ বাঁকিয়ে শুধাল,"ভালো কোনো খবর নেই? এটা তো জানি।"

"আরো আছে। পাশের বাসার রুবিনাবুকে বিকেলে দেখতে আসবে। ছেলে নাকি বিশাল ব্যবসায়ী। টাকা পয়সার কোনো কমতি নাই।"

এই খবরটা পছন্দ হলো অপরার। রুবিনাবু এবার এইচ এস সি দিয়েছে। মোটামুটি সুন্দরী এক মেয়ে। অনেক মাস ধরেই বিয়ের কথা বার্তা চলছে। তবে কোনো এক কারণে হচ্ছে না। আজ আবার ছেলেপক্ষ দেখতে আসবে। ভালোই হলো, বিকেলটা ঘুরে আসা যাবে। ওরা দুজনই পেয়ারা মাখা শেষ করে বের হচ্ছিল। অয়ন ডেকে ওঠল,"কোথায় যাচ্ছিস?"

অপরা চুপ। কথা বলল‍,"রুবিনাবুদের বাসায়।"

"ও, তার আগে আমাকে কিছু কাজ করে দে তো।"

কথার মুখ চুপসে গেল। অপরা নিজেও বিরক্ত। এই লোক সবাইকে দিয়ে কাজ করায়। নিজে কিচ্ছু করে না। যেন বাড়ির একমাত্র রাজপুত্র। অথচ ছোট চাচার ছেলে, কিয়ান ভাই। সে তো সবার বড়ো। সব কাজ নিজে করে। কাউকে দিয়ে করায় না।

কথা গেল চিলেকোঠার ঘরে। ওখানেই ভাইয়াদের খেলার জিনিসপত্র আছে। মার্বেল, লাটিম, ব্যাট বল, আরো কত কি। এসব নিজেই খুঁজে আনতে পারত অয়ন। অথচ সে গেল না। অন্যকে খাটাতে তার মজা লাগে। অপরা তো মুখ ফুটে বলেই ফেলল,"নিজে গিয়েই তো আনতে পারতেন।"

অয়ন ঘাড় ঘুরিয়ে চাইল। মেয়েটা বড়ো চ্যাটাং চ্যাটাং কথা বলে। তারপর ওঠে এসে একদম বর‍াবর দাঁড়াল।

"কথা কে না পাঠিয়ে,তোকে পাঠানো উচিত ছিল।"

মেয়েটার মুখ র'ক্তশূন্য হয়ে গেল। ভ্রু কুঞ্চিত করে বলল‍,"আমি কেন যাব?"

"তুই যাবি না মানে। তুই তো যাবি। সব কাজ তোকে করতে হবে। আমি না তোর বর হব? আর বরে‍র সেবা করা তো স্ত্রী'র ধর্ম।"

অয়নের কথায় অপরার চোয়াল ভাঙার উপক্রম। কোন ছোটবেলায় সে বলেছিল অয়ন ভাই তোমাকে বিয়ে করতে চাই। সে ঘটনা টেনে হিঁচড়ে লোকটা ওকে খাটাতে থাকে। অপরা হতাশ। তার বলার ভাষা নেই। এক বাক্স জিনিস নিয়ে নামল কথা। সে পুরো ঘেমে গেছে।

"গুড, কথাকলি তোর জন্য চকলেট আছে।"

চকলেটের কথা শুনে কথার মুখশ্রীতে আলো এসে ধরা দিল। হাসি হাসি মুখে চাইল সে। অয়ন চকলেট বের করে দিল। অপরা তাকিয়ে আছে দেখে ভ্রু নাচিয়ে শুধাল,"কী? তোর জন্য আনি নি। এগুলো শুধু কথাকলির। তোর জন্য লবডংঙ্কা।"

বয়েই গেছে, ওনার চকলেটের। অপরা ভেংচি কেটে চলে গেল। কথা পেছন থেকে বলল,"আমার থেকে ভাগ দিব তোমায়। অপুবু রাগ কোরো না।"

অয়ন পেছন দিকে চেয়ে হেসে ফেলল। এই মেয়েটা আস্ত এক বোকা। অল্পতেই রেগেমেগে অস্থির হয়ে যায়। তবে বলা বাহুল্য অপরা'র ভেতর মায়া একটু বেশি। তার রাগ যত দ্রুত ওঠে, তার প্রশমন হয় তার থেকেও বেশি দ্রুত।

চলবে...
কলমে ~ #ফাতেমা_তুজ_নৌশি

| পাঠক অস্থির হবেন না,সব কিছুই খোলসা হবে। সবাই বেশি করে রেসপন্স করেন তো। |

পর্ব (৩)
https://www.facebook.com/100076527090739/posts/476876581539908/

09/05/2024

আমি পদ্মজা - ২
___________
বাড়িটা মোড়ল বাড়ি নামে পরিচিত। পদ্মজার দাদার নাম ছিল মিয়াফর মোড়ল। তিনি গ্রামের একজন সম্মানিত লোক ছিলেন। ছয় কাঠা জমির উপর টিনের বিশাল বড় বাড়ি বানিয়েছিলেন চার ছেলের জন্য। দুই ছেলে ষোল বছর আগে ১৯৭১ সালের যুদ্ধে নিহত হয়েছে। দুজনই টগবগে যুবক ছিল। আর একজন আট বছর বয়সে কলেরা রোগে গত হলো। বাকি রইল মোর্শেদ মোড়ল। বর্তমানে এই বাড়ি মোর্শেদের অধীনে। যদিও তিনি থাকেন না সবসময়। পুরো বাড়ির চারপাশ জুড়ে গাছগাছালি। বাড়ির পিছনে নদী। রাত নয়টা বাজলেই পরিবেশ নিশুতি রাতের রূপ ধারণ করে। রাতের এই নির্জন প্রান্তর ঝিঁঝিঁ পোকার ডাকে ছেয়ে গেছে। ঝিঁঝিঁ পোকার সাথে পদ্মজার ভাঙ্গা কান্না মিলেমিশে ভৌতিক পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। মনে হচ্ছে, কোনো আত্মা তার ইহজীবনের না পাওয়া কোনো বস্তুর শোকে এমন মরা সুর ধরেছে। হেমলতা পদ্মজাকে টেনে পাশে বসান। পদ্মজা ডান হাতের উল্টো পাশ দিয়ে চোখের জল মুছে হেমলতাকে বলল, 'মামা সৌদিতে যাওয়ার আগের দিন আমাদের সবার দাওয়াত ছিল না নানাবাড়ি? খালামণি, ভাই-বোনেরা এসেছিল। সেদিন ঢাকা থেকে যাত্রার লোক আসছিল স্কুলে মনে আছে আম্মা?'

'আছে।'

উঠোনে ধপ করে একটা আওয়াজ হয়। হেমলতা,পদ্মজা কেঁপে উঠল। পূর্ণা, প্রেমা দরজায় কান পেতে রেখেছিল মা-বোনের কথা শুনতে। হুট করে কিছু পড়ে যাওয়ার আওয়াজ হওয়াতে দুজন ভয় পেয়ে যায়। দরজা ঠেলে হুড়মুড়িয়ে রুমে ঢুকে পড়ে। হেমলতা বড় মেয়ের সাথে গোপন বৈঠক ভেঙে দ্রুত পায়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ান।
উঠানে বিদ্যুৎ নেই। হারিকেন জ্বালান। পিছনে তিন মেয়ে এসে দাঁড়িয়েছে। একজন মায়ের তিন মেয়ে নিয়ে একা এতো বড় বাড়িতে বাস করাও যুদ্ধ বটে! হেমলতা গলা উঁচিয়ে প্রশ্ন করলেন, 'কে? কে ওখানে?'

'আমি।'

চির পরিচিত এই কণ্ঠ চিনতে হেমলতার বিড়ম্বনা হলো না। তিনি ব্যস্ত পায়ে উঠোনে নেমে আসেন। গেইটের পাশে মোর্শেদ মোড়ল পড়ে রয়েছেন। গায়ে চাদর। হাঁপড়ের মতো বুক উঠা-নামা করছে তার। যেন দম ফুরিয়ে যাচ্ছে। হেমলতা দু'হাতে মোর্শেদকে আঁকড়ে ধরলেন। পদ্মজা,পূর্ণা, দৌড়ে আসে। মোর্শেদের এমফাইসিমা রোগ আছে। এ রোগে অল্প চলাফেরাতেই শ্বাসটানের উপক্রম হয় এবং দম ফুরিয়ে যায়। শ্বাস নেবার সময় গলার শিরা ভরে যায়। তিন মা-মেয়ে মোর্শেদকে ধরে রুমে নিয়ে আসে। মোর্শেদ এভাবেই হুটহাট করে বাড়ি ফেরে। কখনো কাকডাকা ভোরে, কখনো নিশুতি রাতে বা কখনো কাঠফাটা রোদে।

______________
মোর্শেদ মোড়লেই এমফাইসিমা রোগটা ধরা পড়ে সাত বছর আগে। মোর্শেদের অ্যাজমা ছিল। আবার ধূমপানে খুবই আসক্ত ছিলেন। ফলে ফুসফুসের এই রোগটি খুব দ্রুত আক্রমণ করে বসে। মোর্শেদ খানিকটা সুস্থ হয়ে রাত একটার দিকে ঘুমালেন। পূর্ণা, প্রেমা রুমে গিয়ে শুয়ে পড়েছে। পদ্মজা বারান্দার রুমে ঝিম মেরে বসে আছেন। জানালার বাইরে চোখের দৃষ্টি। জোসনা গলে গলে পড়ছে! কি সুন্দর দৃশ্য! পদ্মজার মন বলছে, মা আসবে তাঁর খোঁজে। পুরোটা ঘটনা শুনতে আসবেই। সত্যি তাই হলো। কিছুক্ষণ পরই হেমলতা আসলেন।

'আম্মা, বাতিটা নিভিয়ে দাও।' বলল পদ্মজা। কণ্ঠ খাঁদে নামানো। হেমলতা বাতি নিভিয়ে পদ্মজার পাশে বসেন। পদ্মজা তৈরি ছিল তবুও অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। খুব অস্বস্তি হচ্ছে। সে গোপনে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল।

পদ্মজা তখন চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্রী। বয়স দশ ছিল। খুব কম বয়সেই তাকে স্কুলে পাঠানো শুরু করেন হেমলতা। সেদিন, নানাবাড়িতে সবার দাওয়াত পড়ে। হানিফ চলে যাবে সৌদিতে। তাই এতো আয়জন। পরিবারের মিলন আসর বসে। স্কুল মাঠেও সেদিন নাচ-গান অনুষ্ঠিত হয়। বাড়ির সবাই সেখানেই চলে যায়। বাড়িতে থাকে শুধু পদ্মজা, পদ্মজার বৃদ্ধ নানা, আর হানিফ। পদ্মজা ঘুমে ছিল তাই বাকিদের সাথে যেতে পারেনি। যখন ঘুম ভাঙে আবিষ্কার করল বাড়িতে কেউ নেই। মোর্শেদ হঠাৎ করে অসুস্থ হওয়াতে হেমলতা বাপের বাড়িতে উপস্থিত ছিল না।

' পদ্ম নাকি?'
পদ্মজা বাড়ি থেকে বের হওয়ার উপক্রম হতেই কানে আসে হানিফের ডাক। পদ্মজা মিষ্টি করে হেসে মাথা নাড়াল। হানিফের লোলুপ দৃষ্টি তখন পদ্মজার সারা শরীর ঘুরে বেড়াচ্ছে। এইটুকু মেয়ের ফর্সা চামড়া বিকৃত মস্তিষ্কের হানিফকে যেন বড্ড টানে!

'আয় তো, আমার ঘরে আয়।'

সহজ সরল শিশুসুলভ পদ্মজা মামার ডাকে সাড়া দিল। সে শুনেছে, মামা-ভাগনে যেখানে আপদ নেই সেখানে। অথচ, সেদিন সে মামাকেই ঘোর বিপদ হিসেবে জানল।

পদ্মজা রুমে ঢুকতেই হানিফ দরজা লাগিয়ে দিল।পদ্মজার মন কেমন করে উঠে হানিফের অদ্ভুত চাহনি আর দরজা লাগানো দেখে। হানিফ কুৎসিত অঙ্গভঙ্গি প্রদর্শন করতে থাকে। পদ্মজার দেখতে খুব খারাপ লাগছে। ভয় করছে।

' এদিকে আয় তোর লগে গল্প করি।'

হানিফ বিছানায় বসে পদ্মজাকে কাছে ডাকে। পদ্মজা কাছে যেতে সংকোচ বোধ করে। হানিফ পদ্মজার ডান হাতে ধরে টেনে কোলে বসায়।

' তুই জানোস? তুই যে সবার থাইকা বেশি সুন্দর?'

হানিফের প্রশ্ন পদ্মজার কানে ঢুকেনি। সে মোচড়াতে থাকে হানিফের কোল থেকে নামার জন্য। আপত্তিকর স্পর্শ গুলো পদ্মজার খুব খারাপ লাগছে। কাঁদতে ইচ্ছে হচ্ছে।

'মোছড়াস ক্যান রে ছেড়ি। শান্তিমত বইয়া থাক। মামা মেলা থাইকা সাজনের জিনিষ কিইননা দিমু।'

হানিফ শক্ত করে দু'হাতে ধরে রেখেছে পদ্মজাকে। পদ্মজা কিছুতেই নামতে পারছে না।

'মামা, আমি চলে যাব।' কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল পদ্মজা।

'কই যাবি? মামার ধারে থাক।' বলল হানিফ।

হানিফের শক্তপোক্ত হাতের স্পর্শগুলো শুধু অস্বস্তি দিচ্ছে না,স্পর্শকাতর জায়গাগুলো ব্যাথায় বিষিয়ে উঠছে। পদ্মজা কেঁদে উঠে। ভেজা কণ্ঠে বলল,
' বাড়ি যাব আমি। ব্যাথা পাচ্ছি মামা।'

হানিফ হাতের বাঁধন নরম করে আদুরে গলায় বলল,
' আচ্ছা, আর ব্যাথা দিতাম না। কান্দিস না।'

পদ্মজা চট করে কোল থেকে নেমে পড়ে। হানিফকে তার আজরাইল মনে হচ্ছে। মায়ের কাছে সে আজরাইলের অনেক গল্প শুনেছে। আজরাইল যখন জান নিতে আসবে তখন শরীরে খুব কষ্ট অনুভব হবে। এই মুহূর্তে যেন ঠিক তেমনই অনুভূতি হলো। তাহলে তার হানিফ মামাই আজরাইল। পদ্মজা দরজা খুলতে পারবে না। তাই হানিফকে ভীতিকণ্ঠে অনুরোধ করল,
' মামা দরজা খুলে দাও।'
'ক্যান? আমি তোরে যাইতে কইছি?'

হানিফের কর্কশ কণ্ঠের ধমকে পদ্মজা ভয়ে কেঁপে উঠল। তার চোখ বেয়ে জল পড়তে থাকে। হানিফ পদ্মজাকে জোর করে কোলে তুলে নেয়। পদ্মজা কাঁদছে। তার খুব ভয় লাগছে। বার বার বলছে, 'মামা আমি বাড়ি যাব।'

হানিফের তাতে বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ নেই। বাড়িতে কেউ নেই। বৃদ্ধ সৎ বাবা কানে শুনে না। পদ্মজা হানিফকে কিল,ঘুষি দিতে থাকে। সেই সাথে জোরে জোরে কান্না শুরু করে। এভাবে কাঁদলে পাশের বাড়ির যে কেউ চলে আসবে। হানিফের রক্ত টগবগ করছে উত্তেজনায়। সে দ্রুত ওড়না দিয়ে পদ্মজার মুখ, হাত, পা বেঁধে ফেলল। পদ্মজার দু'চোখের পানি হানিফের চোখে লাগেনি। হানিফ ভীষণ আনন্দ পাচ্ছে। পৈশাচিক আনন্দ পাচ্ছে! সে সিগারেট জ্বালায়। খুব আনন্দ হলে তার সিগারেট টানতে ইচ্ছে হয়। সিগারেট টানতে গিয়ে মাথায় আসে নৃশংস ইচ্ছে। নাক,মুখ দিয়ে ধোঁয়া উড়িয়ে সিগারেট দুই আঙ্গুলের মাঝে রেখে পদ্মজার বাম পায়ের তালুতে চাপ দিয়ে ধরে রাখে।

পদ্মজা হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। হেমলতা দু'হাতে শক্ত করে মেয়েকে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরেন। পদ্মজা কাঁদতে কাঁদতে বলল, ' আম্মা, তখন আমার খুব কষ্ট হচ্ছিল। আমার দমটা বেরিয়ে যাচ্ছে মনে হচ্ছিল। আমি তোমাকে খুব ডাকছি আম্মা। তুমি আসোনি। '

পদ্মজার কথাগুলো হেমলতার বুক রক্তাক্ত করে দেয়। এ যেন ১৯৭১ সালের পাকিস্তানিদের নৃশংসতা। নিজের চোখে তিনি দেখেছেন পাকিস্তানিদের নিষ্ঠুরতা। হানিফ আর তার দেখা অত্যাচারী পাকিস্তানিদের মধ্যে কোনো তফাৎ নেই। হেমলতা নির্বাক,বাকরুদ্ধ। শুধু অনুভব হচ্ছে, তার বুকে পড়ে আদরের পদ্মজা হাউমাউ করে কাঁদছে। সর্বাঙ্গ যেন কাঁপছে। হানিফকে ক্ষত-বিক্ষত করে দিতে হাত নিশপিশ করছে। সেদিন একটুর জন্য পদ্মজা ধর্ষণ হয়নি। বাড়িতে সবাই ফিরে এসেছিল। পদ্মজা পোড়া স্থানের যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে অচেতন হয়।

বাকিটুকু আর পদ্মজাকে বলতে হয়নি,হেমলতা জানেন। পদ্মজার গা কাঁপিয়ে জ্বর আসে। একুশ দিন বিছানায় ছিল। ততদিনে হানিফ দেশ ছেড়ে চলে যায়। পদ্মজা ভয়ে, লজ্জায় ঘটনাটি কাউকে বলেনি। পায়ের পোড়া দাগ দেখে যখন হেমলতা প্রশ্ন করেছিল, 'পা এমনভাবে পুড়ল কি করে?'

পদ্মজা সহজভাবে জবাব দিয়েছিল, ' চুলার কাছে গিয়েছিলাম। চুলার লাকড়ির আগায় পা লাগছিল।'

কথাটা পদ্মজা সাজিয়েই রেখেছিল। সাথে অনেক যুক্তি। তাই মিথ্যে বলতে একটুও কাঁপেনি। পুরো ঘটনাটা পদ্মজার বুকে তাজা হয়ে আছে। এই ছয় বছরে লুকিয়ে কতবার কেঁদেছে সে। সবসময় চুপ করে কোথাও বসে থেকেছে। হেমলতা মেয়ের নিশ্চুপতা দেখে মাথা ঘামাননি। কারণ,পদ্মজা ছোট থেকেই চুপচাপ ছিল। কিন্তু আজ হেমলতার খুব আফসোস হচ্ছে। নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে। তিনি ভেবেছিলেন, তার তিনটা মেয়েই তার কাছে খোলা বইয়ের মতো। চাইলেই পড়া যায়। বিশেষ করে পদ্মজাকে বাড়ির পিছনের নদীর বুক দিয়ে তরতর করে বয়ে যাওয়া স্বচ্ছ টলটলে পানির মতো মনে হতো। যার জীবনে অস্বচ্ছ বলতে কিছু নেই। সবই সাদামাটা, সহজ সরল। অথচ, পদ্মজার জীবনেই কত বড় দাগ জ্বলজ্বল করে জ্বলছে! কতবড় ঘটনা লুকিয়ে ছিল! মেয়েরা কথা লুকিয়ে রাখার সীমাহীন ক্ষমতা নিয়ে জন্মায়। কথাটি নিজের মেয়েদের ক্ষেত্রে মাথায়ই আসেনি। পদ্মজা শান্ত হলে হেমলতা বললেন, 'পা টা দেখি।'

পদ্মজা বাঁ পা বিছানায় তুলল। হেমলতা পদ্মজার পা কোলে নিয়ে পোড়া দাগটা দেখেন মনোযোগ দিয়ে। রক্ত টগবগ করে উঠে। রন্ধ্রে রন্ধ্রে হিংস্রতা যেন লুটোপুটি খাচ্ছে।

'এই পোড়া দাগ হানিফের রক্ত দিয়ে মুছবো।'

কথাটি কত সহজ করে বলেছেন হেমলতা। তবুও পদ্মজা কেঁপে উঠল। কী যেন ছিল কথাটিতে! শরীরের পশম দাঁড়িয়ে পড়ে। হেমলতা বারান্দার রুম ছেড়ে বড় ঘরে ঢুকেন। মিনিট কয়েক পর, রামদা, ছুরি হাতে নিয়ে উঠোনে যান। উঠোনের এক পাশে শক্ত পাথর আছে। ছুরিটা পাথরে ঘষতে থাকলেন সাবধানে। ঘষতে ঘষতে পাথর গরম হয়ে আগুনের স্ফুলিঙ্গ দেখা দেয়। মানে ধার হয়ে গেছে। পদ্মজা বারান্দা থেকে দেখছে। অজানা আশঙ্কায় তার বুক কাঁপছে। হেমলতা বারান্দা পেরিয়ে রুমে ঢুকতে যাবে তখন পদ্মজা উৎকণ্ঠিত গলায় ডাকল, 'আম্মা!'

'আন্নার চাচার এক মেয়ে নিখোঁজ শুনেছিস তো বড়দের মুখে? সেই মেয়ের ধর্ষক হানিফ। ধর্ষণের পর পুঁতে ফেলেছে। অলন্দপুরের এই একটা মানুষই এতোটা নৃশংস। আমি তখন ঢাকা পড়তাম। বাড়ি এসে জানতে পারি ঘটনা। আম্মার অনুরোধ আর কান্নায় আমি সেদিন মুখ খুলিনি। এত বড় পাপ চেপে যাই। সেই শাস্তি আমি ধীরে ধীরে পাচ্ছিলাম। আজ পুরোপুরি পেয়ে গেলাম। আমার পাপের শাস্তি শেষ হয়েছে।'

হেমলতা কথা শেষ করে জায়গা ত্যাগ করলেন। কী ধারালো প্রতিটি বাক্য! হেমলতার মুখ দিয়ে যেন আগুনের স্ফুলিঙ্গ বের হচ্ছে। পদ্মজার মস্তিষ্ক শূন্য হয়ে পড়ে।

চলবে....
®ইলমা বেহরোজ

09/05/2024

আমি পদ্মজা - ১
___________
ফাহিমা ক্লান্ত হয়ে ধপ করে ফ্লোরে বসে পড়ল। হাত থেকে লাঠি পড়ে গিয়ে মৃদু আওয়াজ তুলে। তার শরীর ঘেমে একাকার। কপালের বিন্দু বিন্দু ঘাম হাতের তালু দিয়ে মুছে, বার কয়েক জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলল। এরপর চোখ তুলে সামনে তাকাল। রিমান্ডে কোনো পুরুষই টিকতে পারে না,সেখানে একটি মেয়ে আজ চার দিন ধরে রিমান্ডে। তাঁর সামনে চেয়ারে বাঁধা অবস্থায় ঝিমুচ্ছে। চার দিনে একবারও মুখ দিয়ে টু শব্দটি করল না। শারিরীক, মানসিক কত নির্যাতন করা হয়েছে তবুও ব্যথায় আর্তনাদ অবধি করেনি! মনে হচ্ছে, একটা পাথরকে পিটানো হচ্ছে। যে পাথরের রক্ত ঝড়ে কিন্তু জবান খুলে না। তখন সেখানে আগমন ঘটে ইন্সপেক্টর তুষারের। তুষারকে দেখে ফাহিমা কাতর স্বরে বলল, 'সম্ভব না আর। কিছুতেই কথা বলছে না।'
তুষার অভিজ্ঞ চোখে মেয়েটিকে দুয়েক সেকেন্ড দেখল।এরপর গম্ভীর কণ্ঠে ফাহিমাকে বলল, 'আপনি যান।'

ফাহিমা এলোমেলো পা ফেলে চলে যায়। তুষার একটা চেয়ার নিয়ে মেয়েটির সামনে বসল। বেশ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, 'আপনার সাথে আজ আমার প্রথম দেখা।'

মেয়েটি কিছু বলল না। তাকালও না। তুষা মেয়েটির দিকে সূক্ষ্ম দৃষ্টি মেলে তাকাল। বলল,'মা-বাবাকে মনে পড়ে?'

মেয়েটি চোখ তুলে তাকায়। ঘোলাটে চোখ। কাটা ঠোঁট থেকে রক্ত ঝরছে। চোখের চারপাশ গাঢ় কালো। চোখ দু'টি লাল। মুখের এমন রং রিমান্ডে আসা সব আসামীর হয়। তুষার মুখের প্রকাশভঙ্গী আগের অবস্থানে রেখেই আবারও প্রশ্ন করল, 'মা-বাবাকে মনে পড়ে?'

মেয়েটি মাথা নাড়ায়। মনে পড়ে তার! তুষার একটু ঝুঁকে। মেয়েটি অসহায় দৃষ্টি মেলে তাকায়। তুষার মেয়েটির হাতের বাঁধন খুলে দিয়ে নির্বিকার ভঙ্গিতে প্রশ্ন ছুঁড়ল, 'নাম কী?'

যদিও তুষার মেয়েটির নাম সহ পুরো ডিটেইলস জানে।তবুও জিজ্ঞাসা করল। তার মনে হচ্ছে,মেয়েটি কথা বলবে। সত্যি তাই হলো। মেয়েটি ভারাক্রান্ত কণ্ঠে নিজের নাম উচ্চারণ করল, 'পদ্ম...আমি...আমি পদ্মজা।'

পদ্মজা হেলে পড়ে তুষারের উপর। তুষার দ্রুত ধরে ফেলল। উঁচু কণ্ঠে ফাহিমাকে ডাকল,'মিস ফাহিমা। দ্রুত এদিকে আসুন।'
ফাহিমা সহ আরো দুজন দ্রুত পায়ে ছুটে আসে।

___________

১৯৮৯ সাল। সকাল সকাল রশিদ ঘটকের আগমনে হেমলতা ভীষণ বিরক্ত হোন। তিনি বার বার পইপই করে বলেছেন, 'পদ্মর বিয়ে আমি এখুনি দেব না। পদ্মকে অনেক পড়াবো।' তবুও রশিদউদ্দিন প্রতি সপ্তাহে, সপ্তাহে একেক পাত্রের খোঁজ নিয়ে আসবেন। মেয়ের বয়স আর কতই হলো? মাত্র ষোল। শামসুল আলমের মেয়ের বিয়ে হয়েছে চব্বিশ বছর বয়সে। পদ্মর বিয়েও তখনি হবে। পদ্মর পছন্দমতো। হেমলতা রশিদকে দেখেও না দেখার ভান ধরলেন। রশিদ এক দলা থুথু ফেললেন উঠানে। এরপর হেমলতার উদ্দেশ্যে বললেন, 'বুঝছো পদ্মর মা,এইবার যে পাত্র আনছি,এক্কেরে খাঁটি হীরা।'
হেমলতা বিরক্তভরা কণ্ঠে জবাব দিলেন, 'আমি আমার মেয়ের জন্য পাত্র চাইনি। তবুও বার বার কেন আসেন আপনি?'
'যুবতী মাইয়া ঘরে রাহন ভালা না।'
'মেয়েটা তো আমার। আমাকেই বুঝতে দেন না।' হেমলতার কণ্ঠে বিরক্তি ঝরে পড়ছে।

রশিদ অনেক চেষ্টা করেও সুবিধা করতে পারলেন না।ব্যর্থ থমথমে মুখ নিয়ে সড়কে পা রাখেন। প্রতিদিনই কোনো না কোনো পাত্রপক্ষ এসে হাতে টাকা গুঁজে দিয়ে বলবে, 'মোর্শেদের বড় ছেড়িডারে চাই।'

রশিদ নিজে নিজে বিড়বিড় করে আওড়ান, 'গেরামে কি আর ছেড়ি নাই? একটা ছেড়িরেই ক্যান সবার চোক্ষে পড়তে হইব? চাইলেই কি সব পাওন যায়?'

পূর্ণা স্কুল জামা পরে পদ্মজাকে ডাকল, 'আপা? এই আপা? স্কুলে যাবি না? আপারে..."
পদ্মজা পিটপিট করে চোখ খুলে কোনোমতে বলল, 'না।' পর পরই চোখ বুজে ঘুমে তলিয়ে গেল। পূর্ণা নিরাশ হয়ে মায়ের রুমে আসে।

'আম্মা,আপা কী স্কুলে যাইব না?'

হেমলতা বিছানা ঝাড়া রেখে পূর্ণার দিকে কড়াচোখে তাকান। রাগী স্বরে বললেন, 'যাইব কি? যাবে বলবি।'

পূর্ণা মাথা নত করে ফেলল। হেমলতার কড়া আদেশ, মেয়েদের পড়াশোনা করাচ্ছি অশুদ্ধ ভাষায় কথা বলার জন্য নয়। শুদ্ধ ভাষায় কথা বলতে হবে। পূর্ণাকে মাথা নত করতে দেখে হেমলতা তৃপ্তি পান। তার মেয়েগুলো মান্যতা চিনে খুব। খুবই অনুগত। তিনি বিছানা ঝাড়তে ঝাড়তে বললেন, 'পদ্মর শরীর ভালো না। সারারাত পেটে ব্যাথায় কাঁদছে। থাকুক,ঘুমাক।'

পূর্ণার কিশোরী মন বুঝে যায়,পদ্মজা কীসের ব্যাথায় কেঁদেছিল। সে রাতে নানাবাড়ি ছিল বলে জানতো না।ভোরেই চলে এসেছে। নানাবাড়ি হেঁটে যেতে পাঁচ মিনিট লাগে। পূর্ণাকে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে হেমলতা বললেন, 'তুই যা। মাথা নীচু করে যাবি মাথা নীচু করে আসবি।'
'আচ্ছা,আম্মা।'

পূর্ণা রুমে এসে আয়নার সামনে দাঁড়াল। নিজেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল। এরপর গত মাসে মেলা থেকে আনা লাল লিপস্টিক গাঢ় করে ঠোঁটে মাখে। চৌদ্দ বছরের পূর্ণার ইদানীং খুব সাজতে ইচ্ছে করে। হেমলতা সেজেগুজে স্কুলে যাওয়া পছন্দ করেন না বলে,পূর্ণা আগে লিপস্টিক মাখেনি।

___________

টিন দেয়ালের কাঠের ঘড়ির কাঁটায় সকাল দশটা বাজল মাত্র। এখনো পদ্মজা উঠল না। হেমলতা মেয়েদের রুমে ঢুকেন। পদ্মজা দু'হাত ভাঁজ করে ঘুমাচ্ছে। জানালার পর্দা ভেদ করে আসা আলতো পেলব রোদ্দুরের স্পর্শে পদ্মজার মসৃণ, পাতলা ঠোঁট, ফর্সা ত্বক চিকচিক করছে। হেমলতা বিসমিল্লাহ বলে,তিনবার ফুঁ দেন মেয়ের শরীরে। গুরুজনরা বলেন, মায়ের নজর লাগে বেশি। নজর কাটাতে বিসমিল্লাহ বলে ফুঁ দিতে হয়। হেমলতার মায়া লাগছে পদ্মজার ঘুম ভাঙ্গাতে। তবুও আদুরে গলায় ডাকলেন, 'পদ্ম। এই পদ্ম...'

পদ্মজা চোখ খুলে মাকে দেখে দ্রুত উঠে বসে। যেদিন ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয় সেদিনই হেমলতা ডেকে তুলেন। পদ্মজা অপরাধী কণ্ঠে প্রশ্ন করল, 'বেশি দেরি হয়ে গেছে আম্মা?'
'সমস্যা নেই। মুখ ধুয়ে খেতে আয়।'

পদ্মজা দ্রুত কলপাড়ে গিয়ে ব্রাশ করে,মুখ ধৌত করে। হেমলতা শিক্ষকের মেয়ে। তাই তাঁর মধ্যে নিয়ম-নীতির প্রভাব বেশি। মেয়েদের শক্তপোক্ত নিয়মে রেখে বড় করছেন। পদ্মজা রান্নাঘরে ঢুকে দেখল প্লেটে খাবার সাজানো। সে মৃদু হেসে প্লেট নিয়ে টেবিলে গিয়ে বসল। তখন হেমলতা আসেন। পদ্ম দ্রুত ওড়না দিয়ে মাথা ঢাকে। হেমলতার দেওয়া আরেকটা নিয়ম, খাওয়ার সময় মাথা ঢেকে খেতে হবে। পদ্মজা নিশ্চুপ থেকে শান্তভঙ্গিতে
খেতে থাকল । হেমলতা মেয়েকে সহজ কণ্ঠে বললেন, 'তাড়াহুড়ো করছিস কেন? মুখ ধুতে গিয়ে চুল ভিজিয়ে এসেছিস।খেয়ে রোদে বসে চুলটা শুকিয়ে নিবি ।'
'আচ্ছা,আম্মা।'
'আম্মা, পূর্ণা, প্রেমা আসে নাই?'
'পূর্ণা আসছে। স্কুলে গেছে। প্রেমা দুপুরে আসব।'
'আম্মা,আব্বা কবে আসবেন?'

পদ্মজার প্রশ্নে হেমলতা দাঁড়িয়ে পড়লেন। শুকনো গলায় জবাব দেন, 'জানি না। খাওয়ার সময় কথা বলতে নেই।'

হেমলতা চলে যেতেই পদ্মজার চোখ থেকে টুপ করে এক ফোঁটা জল পড়ে পাতে। পদ্মজা দ্রুত হাতের উল্টো পাশ দিয়ে চোখের জল মুছে। পদ্মজার জীবনে জন্মদাতা আছে ঠিকই। কিন্তু জন্মদাতার আদর নেই। সে জানে না তাঁর দোষটা কী? কেন নিজের বাবা বাকি বোনদের আদর করলেও তাকে করে না? কথা অবধিও বলেন না। দুইবার মাকে জিজ্ঞাসা করেছে সে, 'আমি কী তোমাদের সত্যিকারের মেয়ে আম্মা? সন্তান হয় না বলে কি দত্তক এনেছিলে? আব্বা কেনো আমাকে এতো অবহেলা করেন? ও আম্মা বলো না?'

হেমলতা তখন নিশ্চুপ থাকেন। অনেকক্ষণ পর বলেন, 'তুই আমার গর্ভের সন্তান। আর তোর বাবারই মেয়ে। এখন যা,পড়তে বস। অনেক পড়তে হবে তোর।'

ব্যস এইটুকুই! এর বেশি কিছু বলেন না হেমলতা। পদ্মজার কেন জানি মনে হয়,একদিন হেমলতা নিজ থেকে খুব গোপন কোনো কথা বলবেন। তবে সেটা যেন সহ্য করার মতো হয়। এই দোয়াই সারাক্ষণ করে সে।

'এতো কী ভাবছিস? তাড়াতাড়ি খেয়ে উঠ।'

হেমলতার কথায় পদ্মজার ভাবনার সুতো ছিড়ল। দ্রুত খেয়ে উঠে। আজ আমের আচার বানানোর কথা ছিল।

___________

সন্ধ্যা কাটতেই বিদ্যুৎ চলে গেল। কয়েক মাস হলো গ্রামে বিদ্যুৎ এসেছে। আট গ্রাম মিলিয়ে অলন্দপুর। তাঁদের গ্রামের নাম আটপাড়া। প্রতিদিন নিয়ম করে সন্ধ্যারাত থেকে তিন ঘন্টা গ্রাম অন্ধকারে তলিয়ে থাকে। আর সারাদিন তো বিদ্যুৎ-এর নামগন্ধও থাকে না। বিদ্যুৎ দিয়ে লাভটা কী হলো? পদ্মজা,পূর্ণা,প্রেমা তিন বোন একসাথে পড়তে বসেছিল। বাড়ি অন্ধকার হতেই নয় বছরের প্রেমা খামচে ধরে পদ্মজার ওড়না। পদ্মজা মৃদু স্বরে ডাকল,
' আম্মা? আম্মা..."
' আয়,টর্চ নিয়ে যা।'

হেমলতার আহ্বানে পদ্মজা উঠে দাঁড়াল। প্রেমা অন্ধকার খুব ভয় পায়। পদ্মজার ওড়না ছেড়ে পূর্ণার হাত চেপে ধরে। টর্চ নিয়ে রুমে ঢোকার মুহূর্তে পদ্মজা গেইট খোলার আওয়াজ পেল। উঁকি দিয়ে হানিফকে দেখে সে দ্রুত রুমে ঢুকে পড়ল। হানিফ পদ্মজার সৎ মামা।

' বুবু...বাড়ি আন্ধার ক্যান!বাত্তি-টাত্তি জ্বালাও।' হানিফের কণ্ঠ।
' হানিফ আসছিস?'হেমলতা রুম থেকে বেরিয়ে বলেন। হাতে হারিকেন। হানিফ সবকটি দাঁত বের করে হাসল। বলল, 'হ,আমি।'
'আয়,ভেতরে আয়।'
হানিফ বারান্দা পেরিয়ে বড় ঘরে ঢুকে বলল, 'তোমার ছেড়িগুলান কই তে?'
'আছে রুমেই। পড়ছে।'
'এই আন্ধারেও পড়ে!'

হেমলতা কিছু বললেন না। হানিফ এই বাড়িতে আসলে কেন জানি খুব অস্বস্তি হয়। অকারণেই!

'ওদের খাওয়ার সময় হয়েছে। তুইও খেয়ে নে?'
'এইহানেই খামু? না তোমার সরাইখানাত যাইতে হইবো?'

কথাটায় রসিকতা ছিল। গ্রামে থেকেও হেমলতা খাওয়ার জন্য আলাদা রুম নির্বাচন করেছেন সেটা হানিফের কাছে রসিকতাই বটে! হেমলতা প্রশ্নের জবাব সোজাসাপটা না দিয়ে বললেন, 'খেতে চাইলে খেতে আয়।'

পদ্মজা কিছুতেই খেতে আসল না। কেমন জড়োসড়ো হয়ে আছে। মনে হচ্ছে, হানিফকে ভয় পাচ্ছে বা অবহেলা করছে। হানিফ ছয় বছর সৌদিতে ছিল। তিন মাস হলো দেশে ফিরেছে। তিন মাসে যতবার হানিফ এই বাড়িতে পা রেখেছে ততবারই পদ্মজা অজুহাত দিয়ে দূরে দূরে থেকেছে। হেমলতার বিচক্ষণ মস্তিষ্ক মুহূর্তে ভেবে নিল অনেক কিছু। তাই জোর করলেন না। আজই এই লুকোচুরির ফয়সালা হবে। হানিফ পদ্মজাকে দেখার জন্য অনেক ছলচাতুরী করল। কিছুতেই সুযোগ পেল না। বিদ্যুৎ আসার ঘন্টাখানেক পর হানিফ চলে যায়। পূর্ণা, প্রেমা রুমে ঢুকতেই পদ্মজা ঝাঁপিয়ে পড়ে। রুদ্ধশ্বাস কণ্ঠে বলল, 'কতবার না করেছি? লোকটার পাশে বেশিক্ষণ না থাকতে? তোরা কেনো শুনিস না আমার কথা?'

পূর্ণা ও প্রেমা বিস্ময়ে হতবিহ্বল। পদ্মজা কখনো তাদের এমন নিষেধ দেয়নি। তাহলে এখন কেন এমন বলছে?হেমলতা রুমে ঢুকতেই পদ্মজা চুপসে গেল।
'পদ্ম আমার রুমে আয়।'

মায়ের এমন কঠিন কণ্ঠ শুনে পদ্মজার কলিজা শুকিয়ে আসে। হেমলতা নিজের ঘরে চলে যান।

হেমলতা মেয়ের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। পদ্মজা নতজানু হয়ে কাঁপছে। সুন্দরীরা ভীতু আর বোকা হয় তার দৃষ্টান্ত প্রমাণ পদ্মজা। হেমলতার খুব মায়া হয় পদ্মজার সাথে উঁচুকণ্ঠে কথা বলতে। পদ্মজা রূপসী বলেই হয়তো! গোপনে আবেগ লুকিয়ে তিনি বজ্রকণ্ঠে প্রশ্ন করলেন, 'কী লুকোচ্ছিস? হানিফের সামনে কেন যেতে চাস না? সে কী করেছে? '

পদ্মজা ফোঁপাতে থাকে। হেমলতা সেকেন্ড কয়েক সময় নিয়ে নিজেকে সামলান। কণ্ঠ নরম করে বললেন, 'হানিফ ধড়িবাজ লোক! সৎ ভাই বলে বলছি না। আমি জানি। তাঁর ব্যাপারে যেকোনো কথা আমার বিশ্বাস হবে। তুই বল কী লুকোচ্ছিস?'

মায়ের আদুরে কণ্ঠে পদ্মজা আচমকা বাঁধ ভাঙ্গা নদীর মতো হু হু করে কেঁদে উঠল।

চলবে....
®ইলমা বেহরোজ

Address

Dhaka

Website

Alerts

Be the first to know and let us send you an email when Papa's princess posts news and promotions. Your email address will not be used for any other purpose, and you can unsubscribe at any time.

Share

Category