12/11/2024
দি স্নোজ অব কিলিমানজারো
কিলিমানজারো ১৯,৭১০ ফুট উঁচু এক পর্বতের নাম। আফ্রিকার সর্বোচ্চ পর্বত বলে পরিচিত। সারা বছরই বরফে মোড়া থাকে সেটার চূড়া। মাসাইরা তার পশ্চিম শৃঙ্গকে বলে “নগেজ গাই (Nagaje Ngai )”। শৃঙ্গের সামান্য দূরে মাদী চিতাবাঘের ঠাণ্ডায় জমাট বাঁধা পুরনো, শুষ্ক একটা কঙ্কাল পড়ে আছে। ওটা অত উঁচুতে কিসের খোঁজে উঠেছিল তা কেউ জানে না যদিও।
*****
‘অবাক কাণ্ড এটায় কোন ব্যথা-ট্যাথা হয় না,’ লোকটা বলল। ‘এরকম হলে বোঝা যায় ব্যাপারটা কখন শুরু হয়েছে।’
‘সত্যি নাকি?’
‘অবশ্যই। গন্ধটার জন্য আমি দুঃখিত যদিও। নিশ্চই তোমার অসুবিধা হচ্ছে।’
‘না! প্লিজ, দুঃখিত হয়ো না!’
‘ওগুলোকে দেখো,’ বলল সে। ‘দৃশ্য দেখে এসেছে, নাকি এই গন্ধ ওদের এভাবে ডেকে এনেছে?’
লোকটা যে কটে শুয়ে আছে, সেটা মিমোজা গাছের প্রশস্ত ছায়ায় ঢাকা। ছায়ার ওপাশের রোদ ঝলসানো সমতলভূমির দিকে তাকাল সে। বিশাল তিনটা পাখি উবু হয়ে, অমার্জিত ভঙ্গিতে বসে আছে। আকাশে আরও ডজনখানেক ভেসে বেড়াচ্ছে মাটিতে নিজেদের বিশাল, দ্রæত চলমান ছায়া ফেলে।
‘আমাদের ট্রাক নষ্ট হওয়ার দিন থেকেই ওগুলো আকাশে ছিল,’ বলল সে। ‘আজই প্রথমবারের মতো মাটিতে পা রাখল। ওগুলোর ওড়াউড়ির দিকে প্রথম থেকেই সতর্ক নজর রেখেছিলাম যদি পরে কখনো কোনো গল্পে লিখতে হয় ভেবে। এখন তা অদ্ভুত লাগে।’
‘ভাবছি না করলেই ভলো হত,’ মহিলা বলল।
‘বলছি আরকি,’ সে বলল। ‘কথা বললে ভালো লাগে আমার। কিন্তু তোমাকে বিরক্ত করতে চাই না।’
‘তুমি জানো এসবে আমি বিরক্ত হই না,’ বলল মহিলা। ‘আসলে আমি কিছু করতে পারছি না বলে ভীষণ নার্ভাস হয়ে পড়েছি। মনে হয় আমাদের সবকিছু যতটা পারা যায় স্বভাবিকভাবে নেয়া উচিত প্লেন পৌঁছানো পর্যন্ত।’
‘অথবা প্লেন যদি না-ই পৌঁছায়, সেই পর্যন্ত।’
‘প্লিজ, আমি কি করতে পারি বলো! নিশ্চয়ই কিছু না কিছু আছে যা করতে পারি আমি।’
‘তুমি আমার পা-টা খুলে নিতে পারো, তাতে হয়ত ওটার ছড়িয়ে পড়া বন্ধ হবে, যদিও আমার সন্দেহ আছে সে ব্যাপারে। অথবা আমাকে গুলি করতে পারো। তুমি তো এখন ভালোই গুলি করা শিখেছ। আমি শিখিয়েছি তোমাকে, তাই না?’
‘প্লিজ, ওভাবে বোলো না। আমি কিছু পড়ে শোনাতে পারি না তোমাকে?’
‘কি পড়বে?’
‘পড়া হয়নি এমন যা আছে বইতে।’
‘আমার শুনতে মন চায় না। কথা বলাই সহজ। আমরা ঝগড়া করব, তাতে সময় কেটে যাবে।’
‘না। আমি ঝগড়া করব না। আমি কখনও ঝগড়া করতে চাই না। আর ঝগড়া করব না যত নার্ভাসই হই না কেন। ওরা হয়তো আজ অন্য ট্রাক নিয়ে ফিরে আসবে। হয়ত প্লেন আসবে।’
‘আমি নড়াচড়া করতে চাই না,’ লোকটা বলল। ‘এখন নড়ার কোনো মানে হয় না, তোমার কাজ সহজ করে দেয়া ছাড়া।’
‘এ তো কাপুরুষোচিত।’
‘যা-তা না বলে একজন মানুষকে শান্তিতে মরতে দিতে পার না? আমাকে বিব্রত করে কি লাভ?’
‘তুমি মরতে যাচ্ছ না।’
‘বোকার মত কথা বোলো না। আমি মরব। ওই বাস্টার্ডগুলোকে জিজ্ঞেস করো,’ যেদিকে কুৎসিত পাখিগুলো পালকবিহীন লাল মাথা দুই পাখার মাঝখানে গুঁজে দাঁড়িয়ে আছে, সেদিকে তাকাল লোকটা। চতুর্থ পাখিটা মাটিতে নেমেই দ্রুত সামনের দিকে ছুটে গেল কয়েক পা, তারপর হেলেদুলে প্রথম তিনটার সাথে যোগ দিল।
‘ওরা প্রত্যেক ক্যাম্পেরই আশেপাশে থাকে। তুমি কখনও বিশেষ লক্ষ করোনি। তুমি আশা ছেড়ে না দিলে মরবে না।’
‘কোথায় পড়েছ এ কথা? তুমি একটা আস্ত বোকা।’
‘তুমি আর কারও কথা ভাবতে পার।’
‘যিশুর কসম,’ বলল সে। ‘ওটা ছিল আমার বৈশিষ্ট্য।’
কিছু সময় চুপ করে শুয়ে থাকল লোকটা, সমতলভূমির মাটি থেকে উঠে আসা উত্তাপের অদৃশ্য ধোঁয়ার কাঁপন দেখল। দূরে কিছু টমি চরে বেড়াচ্ছে। দূরত্বের কারণে অনেক ছোটো আর হলুদের পটভূমিতে সাদা লাগছে ওগুলোকে। আরও দূরে এক পাল জেব্রা দেখতে পেল সে, সবুজ ঝোপঝাড়ের পটভূমিতে সাদা। পাহাড়ের গা ঘেঁষা বড় বড় গাছের নিচের এই ক্যাম্পটা বেশ মনোরম। আশপাশে পরিষ্কার পানি আছে প্রচুর। কাছেই প্রায় শুকনো একটা পানির গর্ত আছে যেখানে সকালে বালীহাঁস এসে পড়ে।
‘তুমি চাও না আমি কিছু পড়ে শোনাই?’ মহিলা জানতে চাইল। কটের পাশে একটা ক্যানভাস চেয়ারে বসে আছে সে। ‘বাতাস শুরু হতে যাচ্ছে।’
‘না, ধন্যবাদ।’
‘হয়ত ট্রাক আসবে।’
‘আমি ট্রাক নিয়ে মোটেও মাথা ঘামাই না।’
‘আমি ঘামাই।’
‘তুমি অনেক কিছু নিয়ে ঘামাও যা নিয়ে আমি পরোয়া করি না।’
‘বেশি কিছু নিয়ে নয়, হ্যারি।’
‘একটা ড্রিঙ্ক হলে কেমন হয়?’
‘তোমার জন্য ভালো হয় না। কালোরা বলে সব ধরনের অ্যালকোহল বর্জন করে চলতে। তোমারও পান করা উচিত না।’
‘মোলো!’ চেঁচিয়ে ডাকল সে।
‘জি, বওয়ানা!’
‘হুইস্কি আর সোডা নিয়ে এসো।’
‘জি, বওয়ানা!’
‘উচিত হবে না,’ আবার বলল মহিলা। ‘হাল ছেড়ে না দেয়া বলতে আমি এটাই বোঝাতে চেয়েছিলাম। ওসব তোমার জন্য খারাপ। আমি জানি তোমার জন্য খারাপ।’
‘না, আমার জন্য ভালো।’
তাহলে সব শেষ হয়ে গেল, ভাবল সে। কাজটা শেষ করার সময় আর হবে না। পান করা নিয়ে ঝগড়া, তারপরই সব শেষ। ডান পায়ের আঘাতটা গ্যাংগ্রিনে রূপান্তরিত হওয়ার পর থেকে আর কোনো ব্যথা অনুভব করছে না সে। আতঙ্কবোধটাও বিদায় নিয়েছে ব্যথার সাথে। এখন নিজেকে তার অসম্ভব ক্লান্ত লাগছে। আর খুব রাগ হচ্ছে সবকিছু এভাবে ফুরিয়ে গেল বলে। এ জন্য, যেটা এখন আসছে, খুব সামান্যই কৌতূহল ছিল তার।
বহু বছর থেকে বিষয়টা তাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল, কিন্তু এখন ওসব অর্থহীন হয়ে গেছে। ভাবতে অদ্ভুত লাগে কত সহজে একজন ক্লান্ত হয়ে উঠতে পারে।
সে যেসব বিষয় সম্পর্কে ভবিষ্যতে আরও ভালো করে জেনে-বুঝে লিখবে বলে তুলে রেখেছিল, সেসব আর কখনও লেখা হবে না। অবশ্য লেখার চেষ্টা করার ক্ষেত্রে ব্যর্থ হওয়াও উচিত হয়নি তার।
হয়ত তুমি কখনও সেসব লিখতে পারতে না, তাই একটা যেন-তেন বাহানা বানিয়ে লেখা শুরু করতে দেরি করেছ। এখন আর তা জানার কোন উপায় রইল না তার।
‘যদি আমরা এখানে না আসতাম,’ মহিলা বলল। সঙ্গীর দিকে চেয়ে ঠোঁট কামড়াচ্ছে। হাতে গ্লাস। ‘প্যারিসে থাকলে আজ এই অবস্থা হত না। তুমি সব সময় বলতে তুমি প্যারিসকে ভালবাসো। আমরা প্যারিসেই থেকে যেতে পারতাম অথবা আর কোথাও যেতে পারতাম। আমি আর কোথাও যেতে পারতাম। আমি বলেছি তুমি যেখানে চাও সেখানে যেতে রাজি আছ আমি। তুমি শিকার করতে চাইলে আমরা হাঙ্গেরিতে গিয়ে শিকার করতে পারতাম। আরামে থাকতে পারতাম।’
‘তোমার টাকায়,’ সে বলল।
‘ঠিক বললে না। ও টাকা যেমন আমার, তেমনি তোমারও। আমি সব ছেড়ে এসেছি, তুমি যেখানে চেয়েছ সেখানে গিয়েছি। তুমি যা যা করতে বলেছ তাই করেছি। কিন্তু এখানে যদি না আসতাম।’
‘তুমি বলেছ এ জায়গা তোমার ভালো লেগেছে।’
‘তুমি যখন সুস্থ ছিলে তখন বলেছি। কিন্তু এখন ঘৃণা হচ্ছে। আমি বুঝি না এটা কেন তোমার পায়েই হলো। এটা হওয়ার মত কি এমন করেছি আমরা?’
‘মনে হয় প্রথমবার ক্ষতটা চুলকানোর পর ওখানে আয়োডিন লাগাইনি বলে না এটা ঘটেছে,’ লোকটা বলল। ‘আগে কখনও ইনফেকশন হয়নি বলে ব্যাপারটাকে পাত্তা দেইনি। পরে অন্যসব অ্যান্টি সেপটিক ফুরিয়ে যেতে কার্বলিক সলিউশন ব্যবহার করেছিলাম। মনে হয় তাতেই অবস্থা খারাপের দিকে মোড় নিয়েছে, কারণ এর ফলে ছোটো ছোটো রক্তনালীগুলো প্যারালাইজড্ হয়ে যেতে রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। তারপর গ্যাংগ্রিন তার কাজ শুরু করেছে,’ সঙ্গিনীর দিকে তাকাল সে। ‘আর কি?’
‘আমি তা বোঝাতে চাইনি।’
‘আমরা যদি অল্প বিদ্যার কিকুউ ড্রাইভারের বদলে একজন ভালো মেকানিককে ভাড়া করতাম, তাহলে সে তেল চেক করত এবং ট্রাকের বিয়ারিং কখনও জ্বলে যেত না।’
‘আমি তা বোঝাতে চাইনি।’
‘যদি তুমি আমার জন্য আপনজনদের ছেড়ে না আসতে, তোমার বাজপড়া ওল্ড ওয়েস্টবিউরি, সারাটোগা, পাম বিচের লোকদের।’
‘আমি তোমাকে ভালবেসেছি বলে এসেছি। এভাবে বলা উচিত না। আমি তোমাকে ভালবাসি। সব সময়ই ভালবেসেছি। তুমি আমাকে ভালবাসো না?’
‘না,’ লোকটা বলল। ‘মনে হয় না। কখনও বাসিনি।’
‘হ্যারি, এসব কি বলছ? তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে।’
‘না। খারাপ হওয়ার মতো মাথাই আমার নেই।’
‘আর খেয়ো না,’ মহিলা বলল। ‘ডার্লিং, আর খেয়ো না। আমাদেরকে যতদূর সম্ভব করতে হবে।’
‘তুমি করো গিয়ে,’ লোকটা বলল। ‘আমি ক্লান্ত।’
*****
মনের পর্দায় কারাগাচ রেলওয়ে স্টেশন দেখতে পেল লোকটা। কাঁধে প্যাক নিয়ে অপেক্ষায় আছে সে, সামনে সিম্পলন-ওরিয়েন্টের হেডলাইটের তীব্র আলো গাঢ় আঁধারের দেয়াল ফুঁড়ে এগিয়ে গেছে। রিট্রিটের পর থ্রেস ছেড়ে চলে যাচ্ছে সে। এটা ছিল সেইসব ঘটনার একটা, যা নিয়ে সে পরে; সকালবেলা জানালা দিয়ে দূরে, বালগেরিয়ার পর্বতমালার চূড়ায় জমাট বাধা তুষারের ওপর দৃষ্টি রেখে নাস্তা খাওয়ার সময় লিখবে বলে জমিয়ে রেখেছিল। নানসেনের সেক্রেটারি বৃদ্ধের কাছে জানতে চাইবে ওগুলো তুষার কি না, বৃদ্ধ সেদিকে চোখ বুলিয়ে জবাব দেবে, না, তুষার না। তুষার পড়ার সময় এখনও আসেনি। সেক্রেটারি তখন অন্য মেয়েদের উদ্দেশে পুনরাবৃত্তি করবে, না। ওগুলো তুষার না। তখন মেয়েরাও একযোগে বলবে, ওগুলো তুষার না। আমাদের ভুল হয়েছে। কিন্তু ওগুলো আসলেই তুষার ছিল এবং সে তাদেরকে ওর মধ্যে পাঠিয়ে দিয়েছিল। সেবারের শীতে মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত তুষারের মধ্যেই ছিল তারা।
সেবার গয়েরটালেও গোটা ক্রিসমাস সপ্তাহ জুড়ে তুষারপাত হয়, যে বছর এক কাঠুরিয়ার বাড়িতে ছিল তারা যেখানে রুমের অর্ধেকটাই দখল করে ছিল চারকোনা বিশাল এক পোরসেলিন স্টোভ। তারা ঘুমাত বিচ পাতা বোঝাই ম্যাট্রেসের ওপরে। যখন ডেজার্টার (সেনাবাহিনী থেকে পলাতক) এসে জানায় যে তার পিছনে পুলিশ লেগে আছে, তখন তুষারের আঘাতে তার পা রক্তাক্ত। লোকটাকে তারা উলের মোজা পরতে দেয় এবং নতুন তুষারের তলায় তার পায়ের ছাপ চাপা না পড়া পর্যন্ত এ-কথা সে-কথায় আটকে রাখে তাড়া করে আসা পুলিশদের।
সেই ক্রিসমাসের দিন সকালে শ্রানজ-এ এত উজ্জ্বল, ধপধপে তুষার পড়েছিল যে ভাইনস্টুবার জানালা দিয়ে গির্জা থেকে প্রার্থনা সেরে বাড়ি ফেরা লোকজনের দিকে তাকাতেও কষ্ট হচ্ছিল। হেঁটে সেখানে পৌঁছায় তারা, কাঁধে স্কি-র ভারী বোঝা নিয়ে। ¯স্লেজ চলাচলের কারণে সেখানকার রাস্তা ছিল সমতল, প্রস্রাবের মত হলুদাভ বরফে মোড়া। নদীর তীর ধরে চলে গেছে। পথের পাশে পাইন গাছে ঢাকা খাড়া পাহাড়। সেই পাহাড়ে উঠেছিল তারা লম্বা ম্যাডলেনার-হস গেøসিয়ারে স্কি করতে। সেখানকার তুষার এত মসৃণ ছিল যেন কেক ফ্রস্ট করা হচ্ছে, এত হালকা ছিল যেন ওগুলো পাউডার। মনে আছে তাদের সেই দীর্ঘ, নিম্নমুখী স্কি-যাত্রা ছিল নিঃশব্দ, ডানা মেলা পাখির দ্রুত অবতরণের মতো।
ম্যাডলেনার-হসে প্রবল তুষারঝড়ের মধ্যে লণ্ঠনের আলোয় তাস খেলে কাটত তাদের। চড়া দানে খেলত তারা এবং হের লেন্ট বেশি হারতেন। এক সময় সবকিছু খোয়ান তিনি। সবকিছু। স্কিশুলের টাকা, গোটা মওসুমের লাভের টাকা এবং তারপর পুঁজি, সব। তখনকার দিনে সব সময়ই জুয়া খেলা চলত। যখন তুষার পড়ে না তখনও চলত, যখন খুব বেশি তুষার পড়ে তখনও চলত। সারা জীবন সে জুয়া খেলেই কাটিয়েছে।
কিন্তু কখনও তা নিয়ে একটা লাইনও লেখেনি। লেখেনি প্রচÐ ঠাÐা সেই বড়দিন নিয়েও, যেদিন সমভূমির অপর প্রান্ত থেকে পর্বতমালা দেখা যাচ্ছিল; যেদিন বারকার প্লেন নিয়ে লাইন অতিক্রম করে অস্ট্রিয়ান অফিসারদের ট্রেনে বোমা ফেলতে গিয়ে পালাতে থাকা অফিসারদের অনেককে মেশিন গানের গুলিতে ঝাঁঝরা করে দিয়েছিল। বারকার পরে মেসে এসে তাদেরকে সেই গল্প শোনাতে চুপ হয়ে গিয়েছিল সবাই। তারপর কে যেন বলে উঠল: ‘ইউ ব্লাডি মার্ডারাস বাস্টার্ড!’
ওরা ছিল সেই অস্ট্রিয়ান অফিসার যাদের সাথে পরে স্কি করেছে সে। অস্ট্রিয়ান না, তারা ছিল হানস (জার্মান)। সেবার সারা বছরই তাদের সাথে স্কি করেছে সে। কাইজার-জ্যাগার্সে একসাথে খরগোশ শিকার করতে গেছে। তখন তারা পাসুবিওর যুদ্ধ এবং পের্টিকা ও আসালোনে হামলার প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা করেছে অথচ তা নিয়ে কখনও একটা শব্দও সে লেখেনি। মন্টি কর্নো নিয়ে লেখেনি, সিয়েট কমান নিয়ে লেখেনি, আরসিয়েডো নিয়েও লেখেনি।
ভরার্লবার্গ আর আর্লবার্গে কয়টা শীতকাল কাটিয়েছে সে? চারটা। তারা হেঁটে বøান্ডেজে যাওয়ার পর যে লোকটা শিয়াল বিক্রি করতে এসেছিল, তার কথা মনে আছে। উপহার কিনতে গিয়েছিল তারা, চেরির রসে তৈরি অ্যালকোহল খেতে, পাউডারের মতো তুষারের ওপর স্কি করতে। ইনের উষ্ণ পরিবেশে অ্যাকর্ডিয়ান বাজিয়েছে তারা।
‘আমরা প্যারিসে কোথায় থাকতাম?’ আফ্রিকায়, পাশের ক্যানভাস চেয়ারে বসা মহিলাকে জিজ্ঞেস করল সে।
‘ক্রিলনে। তুমি জানো।’
‘আমি জানব কেন?’
‘কারণ ওখানেই আমরা সব সময় থেকেছি।”
‘না। সব সময় না।’
‘ওখানে থেকেছি। সেইন্ট জার্মেইনের প্যাভিলন হেনরি-কোয়ার্ট্রেিত থেকেছি। তুমি বলেছ ওখানে ভালো লাগে তোমার।’
‘গোবরের গাদায় প্রেম,’ বলল হ্যারি। ‘আর আমি হলাম মোরগ যে সেই গাদায় উঠে ডাক ছাড়ে।’
‘যদি তোমাকে যেতেই হয়,’ মহিলা বলল, ‘তাহলে কি পিছনের সবকিছু গলা টিপে মেরে রেখেই যেতে হবে? বলতে চাইছি, সবকিছু তোমাকে নিয়ে যেতে হবে। তোমার ঘোড়া, তোমার স্ত্রীকে মেরে রেখে যেতে হবে? স্যাডল, বর্ম পুড়িয়ে ছাই করে রেখে যেতে হবে?’
‘হ্যাঁ,’ বলল সে। ‘তোমার টাকা আমার বর্ম। আমার সুইফট এবং আমার বর্ম।’
‘আর বোলো না।’
‘ঠিক আছে। এই চুপ করলাম। আমি তোমাকে কষ্ট দিতে চাই না।’
‘একটু দেরি হয়ে গেছে।’
‘ঠিক আছে। তাহলে কষ্ট দিতে থাকব তোমাকে। কাজটা মজার। তোমার সাথে যে কাজটা করে আমি মজা পাই তা এখন করতে পারছি না।’
‘না, কথাটা ঠিক না। তুমি অনেক কিছুতেই মজা পাও। তুমি যা যা চেয়েছ তার সবই আমি করেছি।’
‘ওহ্, যিশুর দোহাই, বড়াই করা বন্ধ করো!’
তাকিয়ে দেখল মহিলা কাঁদছে।
‘শোনো,’ সে বলল। ‘তোমার কি মনে হয় এসব করে আমি আনন্দ পাই? আমি জানি না এসব আমি কেন করছি। হয়ত করছি তোমার বেঁচে থাকার চেষ্টাকে খতম করতে। যখন আমরা আলোচনা শুরু করি তখন ঠিকই ছিল। আমি এসব শুরু করতে চাইনি। এখন কুট পাখির মত ঝগড়া করছি, তোমার সাথে যারপরনাই নিষ্ঠুর আচরণ করছি। আমি কি বলি না বলি সেদিকে বেশি আমল দিয়ো না, ডার্লিং। আমি তোমাকে ভালোবাসি। তুমি জানো আমি তোমাকে ভালোবাসি। তোমাকে যেমন ভালোবাসি, তেমন ভালো আর কাউকে বাসিনি।’
নিজের রুটি-রুজির উপায়, চিরাচরিত মিথ্যার আশ্রয় নিল লোকটা।
‘আমার প্রতি তুমি খুবই নরম।’
‘তুমি যৌনাবেদনময়ী নারী। ধনী যৌনাবেদনময়ী। এটা কবিতা। আমি এখন কবিতায় পূর্ণ। পচন ও কবিতা। পচা কবিতা।’
‘থামো, হ্যারি। আবার কেন নিষ্ঠুর হয়ে উঠলে?’
‘আমি পিছনে কিছু রেখে যেতে চাই না,’ লোকটা বলল। ‘পছন্দ করি না।’
*****
সন্ধ্যা হয়েছে। লোকটা ঘুমিয়ে আছে। সূর্য পাহাড়ের পিছনে চলে গেছে বলে সমতলভূমির পুরোটা ছায়ায় ঢেকে গেছে। ছোটো প্রাণীগুলো ক্যাম্পের আশপাশে খাচ্ছে; দ্রæত মাথা নামিয়ে খাবার তুলছে, লেজ উঠছে-নামছে। ঝোপ থেকে বেশ কিছুটা দূরে চরছে ওগুলো, লক্ষ করল সে। পাখিরা মাটি ছেড়ে উঠে পড়েছে। একটা বড় গাছের ডালে গিয়ে বসেছে সবগুলো। প্রচুর পাখি। তার ব্যক্তিগত বালক পরিচারক কটের পাশে বসা।
‘মেমসাহেব শিকার করতে গেছে,’ ছেলেটা বলল। ‘বওয়ানার কি লাগবে?’
‘কিছু না।’
মাংসের জন্য শিকারে গেছে মহিলা। তার সঙ্গী পাখি দেখতে ভালোবাসে বলে দূরে কোথাও গেছে যাতে বন্দুকের আওয়াজে গাছে বসা পাখিগুলো পালিয়ে গিয়ে তার দেখার মজা নষ্ট করে না দেয়। মহিলা বেশ চিন্তাশীল, ভাবল লোকটা। সবদিক বিবেচনা করে কাজ করে। যা ও জানে, বা পড়েছে, বা কারও মুখে শুনেছে, সব।
হ্যারি যখন তার কাছে যায়, তখন যে সে ভেতরে ভেতরে শেষ হয়ে গেয়েছিল, সে দোষ তো মেয়েটার নয়। একটা মেয়ে কি করে বুঝবে তুমি যা বলছ তার সবই ভুয়া? অভ্যাস থেকে মিথ্যা বলছ আরাম-আয়েশে থাকার জন্য? তার কথাবার্তা অর্থহীন প্রমাণিত হলেও মেয়েদের কাছে বরং সেসবই বেশি সাফল্য পেয়েছে সত্যের চেয়ে।
তবে এটাও ঠিক নয় যে লোকটা যা কিছু বলেছে মিথ্যাই বলেছে, তার মধ্যে কোনো সত্যি ছিল না। সে তার জীবন কাটিয়েছে এবং যখন সবকিছু শেষ হয়ে গেছে, তখন সে অন্যদের সাথে বাস করেছে আরও বেশি টাকার জন্য। বেশিরভাগ সময় প্রায় একই জায়গায়, তবে নতুনদের সাথে।
তুমি চিন্তা-ভাবনা করা থেকে বিরত থাকলে সব ঠিক থাকবে। তোমার অন্তরটা ভালো দিয়ে ঠাসা ছিল যাতে তুমি ভেঙে খান্ খান্ হয়ে না যাও, বেশিরভাগ মানুষের ক্ষেত্রে যা ঘটেছে, আর তুমি এমন ভাব দেখিয়েছ, তুমি যা কিছু করে অভ্যস্ত, যেসবের ক্ষেত্রে কিছু পরোয়া করতে না, এখন আর সেসব করতে পারছ না। কিন্তু তুমি মনে মনে বলেছিলে, এইসব মানুষকে নিয়ে তুমি লিখবে। খুব ধনীদের ব্যাপারে; যে তুমি তাদের দলের নও, তাদের দেশে একজন স্পাই। তুমি সে দেশ ছেড়ে গিয়ে তাদের নিয়ে লিখবে এবং একবারের মত সেটা এমন একজনের লেখা হবে, যে জানে সে কি লিখেছে। কিন্তু সে আর কখনও তা করতে পারবে না। কেননা নিয়মিত না লেখার কারণে, বেশি আরাম-আয়েশে থেকে, যা সে ঘৃণা করে তাই হয়ে নিজের ক্ষমতাকে ভোঁতা করে ফেলেছে সে। কাজ করার মনোবল এতটাই হারিয়ে ফেলেছে যে, শেষ পর্যন্ত সে আর কোনো কাজই করেনি। কাজ না করায় যাদেরকে সে একদিন চিনত, তারা এখন অনেক মৌজে আছে। আফ্রিকা ছিল সেই জায়গা যেখানে সে তার জীবনের বেশিরভাগ সময় সবচেয়ে সুখে কাটিয়েছে। তাই সে আবার এখানে এসেছে নতুন জীবন শুরু করতে। যে কারণে এই সাফারিতে বেশি আরাম-আয়েশের আয়োজন করা হয়নি। বেশি কষ্টের কিছু নেই, বেশি বিলাসিতাও নেই। সে ভেবেছিল এভাবেই ফিরে যেতে পারবে ট্রেনিংয়ে। ফাইটার যেভাবে পাহাড়ে চড়ে কাজ করতে এবং গতরে জমে ওঠা চর্বি গলাতে, সে-ও নিজের আত্মায় জমে ওঠা চর্বি একই কায়দায় ঝরাবে।
ব্যাপারটা সঙ্গিনীর ভালো লেগেছে। বলছিল, ও নিজেও এসব পছন্দ করে। উত্তেজনাকর সবকিছুই পছন্দ করে মেয়েটা, বিশেষ করে যেখানে দেখার মত নতুন নতুন জিনিস আছে, নতুন মানুষ আছে এবং যেখানকার সবকিছু সুখকর, মনোরম। তার সঙ্গীরও বিভ্রম ঘটেছিল যে এভাবে নিজের কর্মদক্ষতা ফিরিয়ে আনতে পারবে। এখন যদি এভাবেই সে সম্ভাবনার ইতি ঘটে; সে জানে যা ঘটার ঘটে গেছে, তাহলে অবশ্যই বিশেষ প্রজাতির সাপের মত নিজেকে কামড় দেবে না সে কারণ তার মেরুদÐ আগেই ভেঙে গেছে। সেটা তার সঙ্গিনীর দোষে নয়। এখানে এই মেয়ে না হয়ে আর কেউ হতে পারত। একটা মিথ্যার ওপর ভর করে যদি সে বাঁচতে পারে, তাহলে তার ওপর নির্ভর করেই তার মরার চেষ্টা করা উচিত। পাহাড়ের ওপাশে একটা গুলির শব্দ হল।
ও খুব ভালো একজন লক্ষ্যভেদী, এই ধনী যৌনাবেদনময়ী, দয়ালু কেয়ারটেকার এবং তার প্রতিভা ধ্বংসকারিনী। নির্বোধ কোথাকার। তার প্রতিভা সে নিজহাতে নষ্ট করেছে। মেয়েটাকে দোষ দেয়া কেন, সে তাকে সুখে রেখেছে বলে? সে নিজের প্রতিভা নষ্ট করেছে ব্যবহার না করে, নিজের সাথে এবং যা সে বিশ্বাস করে তার সাথে প্রতারণা করে। অতিরিক্ত মদ পান করে নিজের উপলব্ধির ধার ভোঁতা করে ফেলেছে সে, আলসেমি করে, স্লথের মতো চলাফেরা করে, সামাজিক মর্যাদা অবজ্ঞা করে, অহঙ্কার ও সংস্কার বশে, তা ভালো পথে হোক বা মন্দ পথে। এটা কি? পুরনো বইয়ের ক্যাটালগ? তার প্রতিভা আবার কি জিনিস? প্রতিভা আছে ঠিকই, কিন্তু কাজে না লাগিয়ে তা নিয়ে বাণিজ্য করেছে সে। সে যা করেছে তা বিষয় ছিল না, বিষয় ছিল সে কি করতে পারত। সে কলম-পেন্সিলের বদলে আর কিছু বেছে নিয়েছে নিজের জীবন ধারণের উপায় হিসেবে। যখনই সে কোনো নতুন নারীর প্রেমে পড়েছে, দেখা গেছে সে আগেরজনের চেয়ে বেশি টাকা-পয়সার মালিক, সব সময়। বেশ অদ্ভুত ব্যাপার, তাই না? কিন্তু যখন প্রেমের অস্তিত্ব থাকে না, যখন সে নারীর সাথে কেবলই শোয়, এই মহিলার মত, যার প্রচুর টাকা, যে দুনিয়ার সব টাকার মালিক, যার স্বামী-সন্তান ছিল, যার অনেক প্রেমিক ছিল কিন্তু কেউ সন্তুষ্ট করতে পারেনি, যে তাকে প্রাণ দিয়ে ভালোবেসেছে একজন লেখক, পুরুষ, সঙ্গী এবং দখল করা বস্তু হিসেবে।
কর্মফলের কারণে আমাদের সবাইকে বিচ্ছিন্ন হতেই হবে, ভাবল সে। তোমার প্রতিভা যা-ই হোক, তুমি যেভাবেই জীবিকা নির্বাহ করো না কেন। সে নিজের প্রাণশক্তি বিক্রি করে দিয়েছে, একভাবে না হোক আরেকভাবে, তার সারা জীবন এবং যখন তোমার ভালোবাসা বেশি জড়িত থাকবে না, তখন তুমি টাকার অনেক ভালো মূল্য দিতে পারবে। বিষয়টা সে বুঝতে পেরেছে, কিন্তু এ নিয়ে কখনও লিখবে না। না, সে লিখবে না, যদিও এর বিশেষ মূল্য ছিল।
এখন ওকে দেখা যাচ্ছে, খোলা প্রান্তর ধরে ক্যাম্পের দিকে হেঁটে আসছে। যোধপুর রাইডিং ব্রিচেস পরে আছে, কাঁধে রাইফেল। তার পিছন পিছন একটা টমি ঝুলিয়ে নিয়ে আসছে দুই কিশোর। মহিলা এখনও যথেষ্ট সুন্দরী আছে, ভাবল সে। অসাধারণ ফিগার। বিছানায় দারুণ এক প্রতিভা। খুব একটা সুন্দরী নয়, কিন্তু ওর চেহারার ধাঁচটা ভালো লাগে তার। প্রচুর পড়াশোনা করে মহিলা, ঘোড়ায় চড়তে এবং শিকার করতে ভালোবাসে। পানও করে প্রচুর। বেশ অল্প বয়সে স্বামীকে হারিয়ে নিজের দুই শিশু সন্তানের দেখাশোনার কাজে ব্যয় করছিল সে। কিন্তু মাকে তাদের দরকার ছিল না, বরং সে ধারেকাছে থাকলে তারা বিব্রত বোধ করত। ব্যাপারটা বুঝতে পেরে তার ঘোড়া, আস্তাবল, বই এবং বোতল নিয়ে সময় পার করতে থাকে মহিলা। সন্ধ্যায় পড়তে ভালো লাগত তার, তখন স্কচ আর সোডা চলত। তারপর ডিনারে এক বোতল ওয়াইন খেয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়ার জন্য যথেষ্ট মাতাল হয়ে যেত।
এই ধারা বজায় ছিল তার প্রেমিকদের আগমন ঘটার আগে। প্রেমিকরা থাকতে ঘুমানোর জন্য পানীয়ের প্রয়োজন হত না মহিলার। কিন্তু প্রেমিকদের একঘেয়ে প্রেম তাকে অল্পদিনে বিরক্ত করে তোলে। তার স্বামী কখনও তাকে বিরক্ত করেনি, কিন্তু এই লোকগুলো করেছে।
এক সময় তার দুই সন্তানের মধ্যে একটির প্লেন দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়। তারপর থেকে আর প্রেমিক কামনা করেনি সে, এবং পানীয় অনুভূতিনাশক নয় বলে তাকে নতুন জীবন গড়ে তোলার দিকে মন দিতে হয়। হঠাৎ নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ার ভয়ে ভীত হয়ে ওঠে সে এক সময়। সঙ্গী হিসেবে এমন একজনকে কামনা করে যাকে সে শ্রদ্ধা করে।
ব্যাপারটার শুরু নিতান্তই সাধারণভাবে। তার লেখা সে পছন্দ করত, তার জীবন যাপনের পদ্ধতিকে ঈর্ষা করত। তার মনে হত লোকটা যা করতে চায় ঠিক তাই করে। যে সমস্ত পদক্ষেপের ফলে সে লোকটাকে দখল করতে সফল হয়, এবং যে পদ্ধতি অনুসরণ করে সে শেষ পর্যন্ত লোকটার প্রেমে পড়ে, সেটা ছিল নিয়মিত অগ্রগতির ফল যার মধ্যে সে নিজের নতুন জীবন গড়ে নিয়েছিল এবং লোকটা তার পুরনো জীবনের অবশিষ্টাংশ ফেলে দিয়ে তার টানে পায়ে পায়ে সরে আসে।
সে আসে নিরাপত্তার জন্য, আরাম-আয়েশের জন্যও বটে, তার মধ্যে অস্বীকার করার কিছু নেই, নইলে আর কিসের জন্য? সে জানে না। সে যা চাইত মহিলা তাকে তাই কিনে দিত। সে তা জানে। ও আসলে চমৎকার একটি মেয়ে। আর সবার মত তাড়াতাড়ি তাকে নিয়ে বিছানায় যেত লোকটা; আসলে তার সাথে যেত, তাকে নিয়ে কথাটা ঠিক নয়, কারণ ও অনেক ধনী, অত্যন্ত মোহনীয়, তাকে সে যথার্থ মূল্য দিতে জানে এবং কখনও মহিলা কোনো দৃশ্যের অবতারণা করেনি। এখন লোকটার এই নতুন জীবন আবার এক প্রান্তসীমায় এসে পৌঁছেছে, কারণ দুই সপ্তাহ আগে হাঁটুতে কাঁটার খোঁচা লাগার পর সে আয়োডিন লাগায়নি। ব্যাপারটা অগ্রাহ্য করে ছবি তোলায় ব্যস্ত ছিল। বিশাল এক পাল ওয়াটার বাকের ছবি তোলার জন্য প্রস্তুতি নিয়েছিল। হরিণগুলো দাঁড়িয়েছিল গ্রিবা উঁচু করে - তীক্ষ্ণ নজর চারদিকে, নাকের ফুটো স্ফীত করে বাতাসে বিপদের গন্ধ শুঁকছে, কান ছড়ানো, বিপদের কোনোরকম আভাস পেলেই এক ছুটে ঝোপের মধ্যে ঢুকে পড়বে। অবশ্য ছবি তুলতে পারার আগেই ওটা পালিয়ে যায়।
ওই যে আসছে মহিলা।
মাথা ঘুরিয়ে তার দিকে তাকাল সে। ‘হ্যালো।’
‘একটা টমি মেরে এনেছি,’ মহিলা বলল। ‘ওটা দিয়ে তোমার জন্য চমৎকার ঝোল রেঁধে দেব। এখন কেমন বোধ করছ?’
‘অনেক ভালো।’
‘চমৎকার। আমি এরকমই কিছু আশা করছিলাম। আমি যাওয়ার সময় তুমি ঘুমাচ্ছিলে।’
‘ভালোই ঘুমিয়েছি আজ। তুমি দূরে গিয়েছিলে?’
‘না। পাহাড়টার ওপাশে। এক গুলিতে খতম করেছি টমিটাকে।’
‘তোমার নিশানা দারুণ।’
‘আমি শিকার করতে ভালোবাসি। আফ্রিকাকে ভালোবেসে ফেলেছি আমি, সত্যি। তুমি সুস্থ থাকলে এটা হত আমার সবচেয়ে আনন্দের বিদেশ সফর। তোমার সাথে শিকার করতে কত মজা তুমি জানো না। আমি এ দেশটাকে ভালোবেসে ফেলেছি।’
‘আমিও।’
‘ডার্লিং, তোমাকে সুস্থ দেখে কত ভালো লাগছে জানো না। তোমার রূঢ় আচরণ আমি সহ্য করতে পারি না। আর কখনও অমন আচরণ করবে না আমার সাথে। করবে? কথা দাও?’
‘না,’ বলল সে। ‘আমি কেমন আচরণ করেছি মনে করতে পারছি না।’
‘আমাকে বিধ্বস্ত করার দরকার নেই। আমি মাঝবয়সী নারী, তোমাকে ভালোবাসি। তুমি যাতে খুশি হও তাই করতে চাই। আমি এর মধ্যেই দু’ তিনবার বিধ্বস্ত হয়েছি। তুমি নিশ্চয়ই আবার তা চাও না?’
‘আমি তোমাকে বিছানায় বিধ্বস্ত করতে পারলে খুশি হব,’ লোকটা বলল।
‘হ্যাঁ। ওটা ভালো কাজ। আমাদের জন্মই হয় বিধ্বস্ত হওয়ার জন্য। কাল প্লেন আসবে।’
‘তুমি জানলে কিভাবে?’
‘আমি নিশ্চিত। ওটাকে আসতেই হবে। ধোঁয়া সৃষ্টির জন্য কাঠ আর ঘাস রেডি করে রেখেছে ছেলেরা। আজ ওদের কাজ দেখে এসেছি আমি। ল্যান্ড করার জন্য যথেষ্ট জায়গা আছে ওখানে। দুই মাথা থেকে ধোঁয়ার আয়োজন করা থাকবে।’
‘তোমার কি দেখে মনে হল কাল ওটা আসবে?’
‘আমি জানি আসবে। আরও আগেই আসার কথা ছিল। শহরে নিয়ে আগে তোমার পায়ের ব্যবস্থা করা হবে, তারপর বিছানায় ভালোরকম কিছু বরবাদির ব্যবস্থা হবে। শুধু কথা নয়।’
‘একটু পানীয় হলে কেমন হয়? সূর্য ডুবে গেছে।’
‘তুমি মনে করো তোমার পান করা ঠিক হবে?’
‘আমি পান করছি।’
‘তাহলে দু’ জনে একসাথে খাই। মোলো! লেট্টি ডুই হুইস্কি-সোডা!’’ গলা চড়িয়ে বলল সে।
‘তুমি বরং মসকুইটো বুট পরে নাও,’ লোকটা বলল।
‘গোসল করে...’
পান করে চলল তারা, ওদিকে সন্ধ্যার আঁধার ঘনিয়ে আসছে। পুরোপুরি আঁধার হওয়ার ঠিক আগে; যখন আলোর স্বল্পতার কারণে গুলি করার উপায় রইল না, ঠিক তখনই একটা হায়েনা দেখা দিল। সামনের খোলা প্রান্তর পেরিয়ে ধীর পায়ে, হেলেদুলে পাহাড়ের দিকে চলেছে।
‘ওই বাস্টার্ড রোজ রাতে এখান দিয়ে যায়,’ লোকটা বলল। ‘দুই সপ্তাহ ধরে লক্ষ করছি আমি।’
‘রাতে বেশ আওয়াজ করে ওটা, রোজ। আমি মাথা ঘামাই না। নোংরা জানোয়ার।’
একসাথে পান করছে তারা। লোকটা এখন আর কোনো ব্যথা অনুভব করছে না, কেবল এক কাতে শুয়ে থাকতে হয় বলে অস্বস্তি বোধ করছে। ছেলেরা আগুন প্রস্তুত করতে ব্যস্ত। তার ছায়া নাচছে তাঁবুর গায়ে। লোকটা এই মনোরম মুহূর্ত উপভোগ করছে। মহিলা তার প্রতি অনেক সদয় ছিল। আজ দুপুরে সে নিষ্ঠুর, অন্যায্য আচরণ করেছে ওর সাথে। চমৎকার মেয়ে ও, সত্যি।
ঠিক তখনই মনে হলো তার মৃত্যু হতে যাচ্ছে।
উপলব্ধিটা হুড়মুড় করে ধেয়ে এলো; তবে জলোচ্ছ্বাস বা দমকা বাতাসের মতো নয়, অনেকটা বদ গন্ধওয়ালা আকস্মিক অসীম শূন্যতার মতো, এবং একই সাথে আরেকটা অদ্ভুত কাণ্ডও ঘটল। সেই উপলব্ধির কিনারা ঘেঁষেই লঘু পায়ে হেঁটে গেল হায়েনাটা।
‘কি হয়েছে, হ্যারি?’
‘কিছু না,’ বলল সে। ‘তুমি বরং এপাশে এসে বোসো। বাতাসের দিকে মুখ করে।’
‘মোলো তোমার ড্রেসিং বদলে দিয়েছে তো?’
‘হ্যাঁ। বোরিকের প্রভাব টের পাচ্ছি আমি।’
‘কেমন বোধ হচ্ছে?’
‘একটু বেসামাল।’
‘আমি গোসল করতে যাচ্ছি,’ মহিলা বলল। ‘বেশি সময় লাগবে না। ডিনারের পর তোমার কট ভেতরে নেয়ার ব্যবস্থা করব।’
ঝগড়া বন্ধ করার ক্ষেত্রে তাহলে ভালোই উতরে গেছি আমরা, লোকটা ভাবল। অবশ্য এর সাথে সে বেশি ঝগড়া করেনি। আগে যাদেরকে সে ভালোবাসত, তাদের সাথে করত। এত ঝগড়া করত যে শেষ পর্যন্ত সম্পর্ক নষ্টই হয়ে যেত। সে ভালোবাসত খুব বেশি, দাবি করত খুব বেশি, এভাবেই সবকিছু জীর্ণ করে ফেলত সে।
*****
একাকী হয়ে কনস্টান্টিনোপলের কথা ভাবল সে। ঝগড়া করে প্যারিস ছাড়ার পর কনস্টান্টিনোপলে গিয়ে কিছুদিন একা ছিল সে। পুরোটা সময় বেশ্যা নিয়ে কাটিয়েছে। সে অধ্যায় চুকে যেতে আবার একাকীত্ব চেপে ধরল। সেটা দূর করতে ব্যর্থ হল সে, পরিস্থিতি বরং আরও খারাপ হল। তখন মেয়েটাকে চিঠি লিখল। প্রথমটিকে, যাকে ছেড়ে এসেছে। লিখল তার স্মৃতি কিছুতেই মুছে ফেলতে পারেনি সে... রিজেন্সের সামনে তাকে যখন প্রথম দেখে, তখন কিভাবে সে জ্ঞান হারাতে যাচ্ছিল, অসুস্থ হয়ে পড়েছিল, তারপর বুলেভারে অন্য একটি মেয়েকে অনুসরণ করার কথা লিখল যে দেখতে অনেকটাই তার মতো ছিল, যদিও কাছে গিয়ে দেখতে সাহস হচ্ছিল না সে-ই কি না। কারণ ভয় ছিল যে অনুভূতি মেয়েটা দিয়েছে, তা হারিয়ে যেতে পারে। আরও লিখল সে, যত মেয়ের সাথেই ঘুমাক, তারপরও কিভাবে তাকে আরও বেশি মিস করে সে। মেয়েটি কিভাবে কি করেছে সেসব কোনো বিষয় হত না, কেননা সে জানত ওকে ভালো না বেসে সে কিছুতেই পারবে না। কোল্ড সোবার ক্লাবে বসে চিঠিটা লিখেছে সে, নিউ ইয়র্কের ঠিকানায় পাঠিয়ে দিয়েছে। ওকে অনুরোধ করেছে তার প্যারিস অফিসের ঠিকানায় চিঠি লিখতে। সেটাই নিরাপদ মনে হয়েছে। সেই রাতে ওর অভাব এত বেশি কষ্ট দিয়েছে যে এক ধরনের ফাঁপা অসুস্থতা পেয়ে বসে তাকে। পরে টাকসিম স্কয়ারে অনেকক্ষণ হাঁটাহাঁটি করে সে, একটা মেয়ে জুটিয়ে নিয়ে সাপার খেতে যায়। পরে তাকে নিয়ে নেচেছে সে, কিন্তু খুব বাজে নাচে মেয়েটা। তাই ওকে ছেড়ে এক আলুথালু আমেরিকান যুবতীকে দখল করে সে অধীনস্থ এক ব্রিটিশ গানারের কাছ থেকে। এই মেয়েটা নাচার সময় পেট দিয়ে এমন ঘষা মেরেছিল যে তার পেটের চামড়াই উঠে যাওয়ার জোগাড়। অবশ্য মেয়েটাকে দখল করার জন্য গানারের সাথে বোঝাপড়া করতে হয়েছে তাকে। গানার তাকে চ্যালেঞ্জ করায় অন্ধকার রাস্তায় হাতাহাতি লড়াই করতে হয়েছে। লোকটাকে সে দুটো কঠিন মার দিয়েছে, চোয়ালে। তারপরও গানার যখন দু’ পায়ে খাড়া থাকল, তখন বুঝতে অসুবিধা হয়নি ছুঁড়িটাকে কষ্ট করেই হাসিল করতে হবে। গানার প্রথমবার মেরেছিল পেটে, পরেরবার চোখের পাশে। পরেরবার তার বাঁ হাতের প্রচণ্ড এক ঘুসিতে পড়ে যায় গানার, টান খেয়ে সে-ও পড়ে যায় লোকটার ওপর। এই সময় টান মেরে তার কোটের একটা আস্তিন ছিঁড়ে নেয় গানার। ছড়ি দিয়ে তার কানের পিছনে দুটো আঘাত করে, তারপর একটা ঘুসি মেরে তাকে গায়ের ওপর থেকে ঠেলে সরিয়ে দেয়। সুযোগ পেয়ে মেয়েটাকে নিয়ে পালাতে শুরু করে সে, কারণ তার কানে এসেছে মিলিটারি পুলিশ তেড়ে আসছে। একটা ট্যাক্সি নিয়ে কেটে পড়ে তারা। বসফরাসের তীর ধরে রিমিলি হিসা হয়ে আবার ফিরে আসে ঠাÐা রাতে। বিছানায় মেয়েটিকে বেশি পাকা ফলের মতো লাগলেও মসৃণ, গোলাপি, রসালো, মসৃণ পেটের, বড় স্তনের ছিল সে। নিতম্বের নীচে বালিশ দিয়ে নেয়ার প্রয়োজন হয়নি। ভোরে ওর ঘুম ভাঙার আগেই হোটেল ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছিল সে। গায়ে চাষাভুষাদের মত ঢিলাঢালা শার্ট, চোখের কোনা কালো। কোট বয়ে নিয়ে চলেছে কারণ ওটার একটা আস্তিন ছিল না।
সেই রাতে প্যারিস থেকে আনাতোলিয়া যাত্রা করে সে। মনে আছে, সেদিন সে পপি’র মাঠের মধ্য দিয়ে হেঁটেছে। পপি দিয়ে আফিম তৈরি হয়। আফিম খেলে অদ্ভুত অনুভূতি হয়। সবশেষে এত পথ পেরিয়ে আসা মনে হলো ভুল হয়ে গেছে তার। কারণ নতুন আসা কনস্ট্যান্টাইন অফিসারদের নেতৃত্বে আক্রমণ চালানোর পর দেখা গেল তারা কিছুই জানে না। আর্টিলারি সৈন্যদের মধ্যে গোলা বর্ষণ করল তারা, ব্রিটিশ অবজারভাররা শিশুর মত কাঁদতে লাগল।
সেদিনই সে প্রথম দেখেছে সাদা ব্যালে স্কার্ট পরা এবং একগোছা রিবন পরানো, ওপরদিকে মোড়ানো জুতো পায়ে দেয়া মানুষের মৃতদেহ। তুর্কিরা তরঙ্গের মতো এগিয়ে আসছিল। সে দেখেছে স্কার্ট পরা মানুষগুলো দিগ্বিদিক পালাচ্ছে। অফিসাররা তাদের লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়ছে। তারপর তাদের লক্ষ্য করেও গুলি করা হতে লাগল, ফলে সে আর ব্রিটিশ অবজারভারও দৌড়াতে লাগল। ফুসফুস ফেটে যাওয়ার অবস্থা হতে বিরাট এক পাথরের আড়ালে থামল তারা, মুখের স্বাদ পেনির মতো হয়ে গেছে। তুর্কিরা তখনও সমানতালে এগিয়ে আসছে। সেখানে সে এমন সব ঘটনা দেখেছে যা কখনও দেখবে বলে কল্পনা করেনি। পরে তার চেয়ে আরও অনেক বেশি খারাপ জিনিসও দেখেছে সে। তাই পরে প্যারিসে ফিরে আসার পর সেসব নিয়ে কখনও কথা বলত না, বা কেউ বললে সহ্য করতে পারত না। সেখানে তার আসা-যাওয়ার পথে একটা কাফে পড়ত যেখানে সামনে পিরিচের স্তূপ নিয়ে বসে থাকত সেই আমেরিকান কবি। আলুর মতো গোল মুখ, নির্বোধের মতো চাউনি। ট্রিসটান জারা