ঊর্মি প্রকাশনী

ঊর্মি প্রকাশনী Urmi Prokashoni is a publishing house based on translation (English to Bengali).

এক হাতে মাংস,আরেক  হাতে বই — ঈদের আনন্দ জমুক দুই-ই!ঈদ মুবারক ❤️
07/06/2025

এক হাতে মাংস,আরেক হাতে বই — ঈদের আনন্দ জমুক দুই-ই!

ঈদ মুবারক ❤️

প্রিয় লেখকের বই হাতে পেয়ে উচ্ছ্বসিত পাঠক 🔥😍
19/05/2025

প্রিয় লেখকের বই হাতে পেয়ে উচ্ছ্বসিত পাঠক 🔥😍

নতুন বই এর ঘ্রাণ আর শুক্রবার দুপুর! 💥 🔥কে কে চান?  ইনবক্সে টোকা দিন 😏
16/05/2025

নতুন বই এর ঘ্রাণ আর শুক্রবার দুপুর! 💥 🔥
কে কে চান? ইনবক্সে টোকা দিন 😏

আমি জানি একজন বাবা হারানো কতটুকু কষ্টেরএছাড়া, আমি এটাও বুঝি, একজন পাঠকের কাছে, একজন পছন্দনীয় লেখকের পরলক গমন কতটুকু শোকে...
15/05/2025

আমি জানি একজন বাবা হারানো কতটুকু কষ্টের

এছাড়া, আমি এটাও বুঝি, একজন পাঠকের কাছে, একজন পছন্দনীয় লেখকের পরলক গমন কতটুকু শোকের হতে পারে।

তবে, এভাবে যদি আমরা ব্যাকফুটে চলে যাই, তবে আমাদের সকলের প্রিয় মানুষটার সাজানো স্বপ্ন অধরাই থেকে যাবে।

তাই, আমি ফারহান সিদ্দিক, ইফতেখার আমিনের ছোটোছেলে, আজ সজ্ঞানে ঘোষণা করছি, ঊর্মি প্রকাশনীর যাবতীয় কার্যক্রম পরিচালনা করার এখন থেকে। আমি Farhan Siddique Saadi এবং আমার সাথে আমার বন্ধু ইমতিয়াজ আবীর সরাসরি এই কাজে যোগ হচ্ছে।

আমরা, হয়ত গুছিয়ে উঠতে একটু সময় নিবো, তবে খুব বেশি সময় নিবো না। আমার বাবার রেখে যাওয়া বই গুলো পুনরায় ছাপানো + ইতোমধ্যে ছাপানো বইসমূহ রিপ্রিন্ট + আমার বাবার পপুলার বই গুলো নিয়ে অনলাইন বইমেলা লঞ্চ + ওয়েবসাইট ফিচার আনা + নবীন লেখক, যারা একটু স্ট্যাবল ফ্ল্যাটফর্মের আশায় আছেন, তাদের হাতে হাত রেখে সামনে আগানো সহ ইত্যাদি আরও নানামুখী স্টেপ গ্রহণ করবো ইনশাআল্লাহ।

I promise, no matter what it takes or what it costs, I will make sure to keep alive the last dream of my father in sha allah. Just need your co-operation, soon we will be on track.

Can contact me here

https://wa.me/60143946714

30/04/2025

আপনাদের সকলের প্রিয় অনুবাদক, আমার বাবা, জনাব ইফতেখার আমিন, আজ বিকাল ৪ ঘটিকা নাগাদ, মৃত্যুবরণ করেছেন।

ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন

সবাই আমার বাবার বিদেহি আত্মার মাগফেরাত কামনা করবেন।

আমার বাবা যদি কারও সাথে কোনো খারাপ ব্যবহার করে থাকেন, তবে তাঁকে ক্ষমা করে দিবেন।

আর যদি কেউ ওনার কাছে ঋণী থাকেন, আমাকে পার্সোনালি জানাবেন, আমি আপনাদের ঋণ আমার সামর্থ্য অনুযায়ী পরিশোধ করে দিবো।

বি:দ্র: - উনি বিগত বেশ কিছু মাস যাবৎ লিভার সিরোসিস রোগে ভুগছিলেন, তাছাড়া ব্রেইন স্ট্রোকের কারণে ওনার মানসিক স্বাস্থের অবনতি হয়েছিলো, এছাড়াও আরও নানাবিধ রোগে তিনি আসক্ত ছিলেন।

03/04/2025

This page is a scam, be aware from this page, try to report

I paid them for a service, but they didn’t give me the desired product which they suppose to give me. And they blocked me from their account.

I want to file a complain to cyber crime depaerment, can anybody help regarding this?

Before help, make sure u report this page.

Thanks in advance

Digital creator

07/02/2025

আসসালামু আলাইকুম

সবাইকে অসংখ্য ধন্যবাদ আমার বাবার সুস্থতা কামনার জন্য

আল্লাহ'র রহমতে আমরা ওনাকে বাসায় আনতে পেরেছি।

ওনার ব্রেনের কন্ডিশন আগের চেয়ে ভাল আছে আলহামদুলিল্লাহ, নিয়মিত মেডিকেশন চলছে।

তবে কোমরের সমস্যার জন্য ওনার উঠে দাঁড়াতে আরও সময় লেগে যাবে হয়ত, তবে আশার বাণী হলো ফিজিওথেরাপি চলছে প্রতিদিন কোমরের সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে

তার সাথে ওনার লিভার সিরোসিসও আছে, যা আমাদের জন্য আরও একটি চিন্তার কারণ।

তবে আল্লাহ চাইলে উনি আমাদের মাঝে ওনার বই নিয়ে আবারও হয়ত ফিরে আসবেন, যদিও এবারের রাস্তাটা বোধহয় একটু বেশিই কঠিন পাড় করা 🙂

তাই সবাই দোয়া করবেন আমার বাবার পরিপূর্ণ সুস্থতার জন্য।

সবাইকে আবারও ধন্যবাদ।

02/02/2025

আসসালামু আলাইকুম

আমি ফারহান সিদ্দিক সাদি

ইফতেখার আমিন সাহেবের ছোটো ছেলে

আমার বাবা গত বৃহস্পতিবার ব্রেইন স্ট্রোক করেছেন, বর্তমানে তিনি মুগদা ইসলামি ব্যাংক হস্পিটালে চিকিৎসাধীন আছেন

স্ট্রোকের সময় আমার বাবা পড়ে যান, সেজন্য ওনার কোমড়ের হাড়ও ডিসলোকেট হয়ে যায়

যার দরূণ ওনাকে আগামী কিছুদিন সম্পূর্ণভাবে বেড রেস্টে থাকতে হবে এবং প্রোপার অবজারভেশনে রাখতে হবে আমাদের।

আমি খুবই দুঃখিত এমন নিউজ শেয়ার করার জন্য।

তবে আশার বাণী, আমার বাবা আগের চেয়ে কিছুটা স্টেবল হয়েছেন, আলহামদুলিল্লাহ।

আমি সবার দোয়া কামনা করছি আমার বাবার জন্য, আল্লাহ যেনো তাঁকে অতি দ্রুত সুস্থ করে আমাদের মাঝে ফিরিয়ে আনেন এবং তিনি যেনো আপনাদের আরও অনেক বই উপহার দিতে পারেন সেজন্য সবাই দোয়া করবেন।

Farhan Siddique Saadi এটা আমার আইডি, প্রয়োজন সাপেক্ষে আমাকে এই আইডিতে নক করতে পারবেন আপনারা।

ধন্যবাদ সবাইকে 🙏

দি স্নোজ অব কিলিমানজারোকিলিমানজারো ১৯,৭১০ ফুট উঁচু এক পর্বতের নাম। আফ্রিকার সর্বোচ্চ পর্বত বলে পরিচিত। সারা বছরই বরফে ম...
12/11/2024

দি স্নোজ অব কিলিমানজারো

কিলিমানজারো ১৯,৭১০ ফুট উঁচু এক পর্বতের নাম। আফ্রিকার সর্বোচ্চ পর্বত বলে পরিচিত। সারা বছরই বরফে মোড়া থাকে সেটার চূড়া। মাসাইরা তার পশ্চিম শৃঙ্গকে বলে “নগেজ গাই (Nagaje Ngai )”। শৃঙ্গের সামান্য দূরে মাদী চিতাবাঘের ঠাণ্ডায় জমাট বাঁধা পুরনো, শুষ্ক একটা কঙ্কাল পড়ে আছে। ওটা অত উঁচুতে কিসের খোঁজে উঠেছিল তা কেউ জানে না যদিও।
*****
‘অবাক কাণ্ড এটায় কোন ব্যথা-ট্যাথা হয় না,’ লোকটা বলল। ‘এরকম হলে বোঝা যায় ব্যাপারটা কখন শুরু হয়েছে।’
‘সত্যি নাকি?’
‘অবশ্যই। গন্ধটার জন্য আমি দুঃখিত যদিও। নিশ্চই তোমার অসুবিধা হচ্ছে।’
‘না! প্লিজ, দুঃখিত হয়ো না!’
‘ওগুলোকে দেখো,’ বলল সে। ‘দৃশ্য দেখে এসেছে, নাকি এই গন্ধ ওদের এভাবে ডেকে এনেছে?’
লোকটা যে কটে শুয়ে আছে, সেটা মিমোজা গাছের প্রশস্ত ছায়ায় ঢাকা। ছায়ার ওপাশের রোদ ঝলসানো সমতলভূমির দিকে তাকাল সে। বিশাল তিনটা পাখি উবু হয়ে, অমার্জিত ভঙ্গিতে বসে আছে। আকাশে আরও ডজনখানেক ভেসে বেড়াচ্ছে মাটিতে নিজেদের বিশাল, দ্রæত চলমান ছায়া ফেলে।
‘আমাদের ট্রাক নষ্ট হওয়ার দিন থেকেই ওগুলো আকাশে ছিল,’ বলল সে। ‘আজই প্রথমবারের মতো মাটিতে পা রাখল। ওগুলোর ওড়াউড়ির দিকে প্রথম থেকেই সতর্ক নজর রেখেছিলাম যদি পরে কখনো কোনো গল্পে লিখতে হয় ভেবে। এখন তা অদ্ভুত লাগে।’
‘ভাবছি না করলেই ভলো হত,’ মহিলা বলল।
‘বলছি আরকি,’ সে বলল। ‘কথা বললে ভালো লাগে আমার। কিন্তু তোমাকে বিরক্ত করতে চাই না।’
‘তুমি জানো এসবে আমি বিরক্ত হই না,’ বলল মহিলা। ‘আসলে আমি কিছু করতে পারছি না বলে ভীষণ নার্ভাস হয়ে পড়েছি। মনে হয় আমাদের সবকিছু যতটা পারা যায় স্বভাবিকভাবে নেয়া উচিত প্লেন পৌঁছানো পর্যন্ত।’
‘অথবা প্লেন যদি না-ই পৌঁছায়, সেই পর্যন্ত।’
‘প্লিজ, আমি কি করতে পারি বলো! নিশ্চয়ই কিছু না কিছু আছে যা করতে পারি আমি।’
‘তুমি আমার পা-টা খুলে নিতে পারো, তাতে হয়ত ওটার ছড়িয়ে পড়া বন্ধ হবে, যদিও আমার সন্দেহ আছে সে ব্যাপারে। অথবা আমাকে গুলি করতে পারো। তুমি তো এখন ভালোই গুলি করা শিখেছ। আমি শিখিয়েছি তোমাকে, তাই না?’
‘প্লিজ, ওভাবে বোলো না। আমি কিছু পড়ে শোনাতে পারি না তোমাকে?’
‘কি পড়বে?’
‘পড়া হয়নি এমন যা আছে বইতে।’
‘আমার শুনতে মন চায় না। কথা বলাই সহজ। আমরা ঝগড়া করব, তাতে সময় কেটে যাবে।’
‘না। আমি ঝগড়া করব না। আমি কখনও ঝগড়া করতে চাই না। আর ঝগড়া করব না যত নার্ভাসই হই না কেন। ওরা হয়তো আজ অন্য ট্রাক নিয়ে ফিরে আসবে। হয়ত প্লেন আসবে।’
‘আমি নড়াচড়া করতে চাই না,’ লোকটা বলল। ‘এখন নড়ার কোনো মানে হয় না, তোমার কাজ সহজ করে দেয়া ছাড়া।’
‘এ তো কাপুরুষোচিত।’
‘যা-তা না বলে একজন মানুষকে শান্তিতে মরতে দিতে পার না? আমাকে বিব্রত করে কি লাভ?’
‘তুমি মরতে যাচ্ছ না।’
‘বোকার মত কথা বোলো না। আমি মরব। ওই বাস্টার্ডগুলোকে জিজ্ঞেস করো,’ যেদিকে কুৎসিত পাখিগুলো পালকবিহীন লাল মাথা দুই পাখার মাঝখানে গুঁজে দাঁড়িয়ে আছে, সেদিকে তাকাল লোকটা। চতুর্থ পাখিটা মাটিতে নেমেই দ্রুত সামনের দিকে ছুটে গেল কয়েক পা, তারপর হেলেদুলে প্রথম তিনটার সাথে যোগ দিল।
‘ওরা প্রত্যেক ক্যাম্পেরই আশেপাশে থাকে। তুমি কখনও বিশেষ লক্ষ করোনি। তুমি আশা ছেড়ে না দিলে মরবে না।’
‘কোথায় পড়েছ এ কথা? তুমি একটা আস্ত বোকা।’
‘তুমি আর কারও কথা ভাবতে পার।’
‘যিশুর কসম,’ বলল সে। ‘ওটা ছিল আমার বৈশিষ্ট্য।’
কিছু সময় চুপ করে শুয়ে থাকল লোকটা, সমতলভূমির মাটি থেকে উঠে আসা উত্তাপের অদৃশ্য ধোঁয়ার কাঁপন দেখল। দূরে কিছু টমি চরে বেড়াচ্ছে। দূরত্বের কারণে অনেক ছোটো আর হলুদের পটভূমিতে সাদা লাগছে ওগুলোকে। আরও দূরে এক পাল জেব্রা দেখতে পেল সে, সবুজ ঝোপঝাড়ের পটভূমিতে সাদা। পাহাড়ের গা ঘেঁষা বড় বড় গাছের নিচের এই ক্যাম্পটা বেশ মনোরম। আশপাশে পরিষ্কার পানি আছে প্রচুর। কাছেই প্রায় শুকনো একটা পানির গর্ত আছে যেখানে সকালে বালীহাঁস এসে পড়ে।
‘তুমি চাও না আমি কিছু পড়ে শোনাই?’ মহিলা জানতে চাইল। কটের পাশে একটা ক্যানভাস চেয়ারে বসে আছে সে। ‘বাতাস শুরু হতে যাচ্ছে।’
‘না, ধন্যবাদ।’
‘হয়ত ট্রাক আসবে।’
‘আমি ট্রাক নিয়ে মোটেও মাথা ঘামাই না।’
‘আমি ঘামাই।’
‘তুমি অনেক কিছু নিয়ে ঘামাও যা নিয়ে আমি পরোয়া করি না।’
‘বেশি কিছু নিয়ে নয়, হ্যারি।’
‘একটা ড্রিঙ্ক হলে কেমন হয়?’
‘তোমার জন্য ভালো হয় না। কালোরা বলে সব ধরনের অ্যালকোহল বর্জন করে চলতে। তোমারও পান করা উচিত না।’
‘মোলো!’ চেঁচিয়ে ডাকল সে।
‘জি, বওয়ানা!’
‘হুইস্কি আর সোডা নিয়ে এসো।’
‘জি, বওয়ানা!’
‘উচিত হবে না,’ আবার বলল মহিলা। ‘হাল ছেড়ে না দেয়া বলতে আমি এটাই বোঝাতে চেয়েছিলাম। ওসব তোমার জন্য খারাপ। আমি জানি তোমার জন্য খারাপ।’
‘না, আমার জন্য ভালো।’
তাহলে সব শেষ হয়ে গেল, ভাবল সে। কাজটা শেষ করার সময় আর হবে না। পান করা নিয়ে ঝগড়া, তারপরই সব শেষ। ডান পায়ের আঘাতটা গ্যাংগ্রিনে রূপান্তরিত হওয়ার পর থেকে আর কোনো ব্যথা অনুভব করছে না সে। আতঙ্কবোধটাও বিদায় নিয়েছে ব্যথার সাথে। এখন নিজেকে তার অসম্ভব ক্লান্ত লাগছে। আর খুব রাগ হচ্ছে সবকিছু এভাবে ফুরিয়ে গেল বলে। এ জন্য, যেটা এখন আসছে, খুব সামান্যই কৌতূহল ছিল তার।
বহু বছর থেকে বিষয়টা তাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল, কিন্তু এখন ওসব অর্থহীন হয়ে গেছে। ভাবতে অদ্ভুত লাগে কত সহজে একজন ক্লান্ত হয়ে উঠতে পারে।
সে যেসব বিষয় সম্পর্কে ভবিষ্যতে আরও ভালো করে জেনে-বুঝে লিখবে বলে তুলে রেখেছিল, সেসব আর কখনও লেখা হবে না। অবশ্য লেখার চেষ্টা করার ক্ষেত্রে ব্যর্থ হওয়াও উচিত হয়নি তার।
হয়ত তুমি কখনও সেসব লিখতে পারতে না, তাই একটা যেন-তেন বাহানা বানিয়ে লেখা শুরু করতে দেরি করেছ। এখন আর তা জানার কোন উপায় রইল না তার।
‘যদি আমরা এখানে না আসতাম,’ মহিলা বলল। সঙ্গীর দিকে চেয়ে ঠোঁট কামড়াচ্ছে। হাতে গ্লাস। ‘প্যারিসে থাকলে আজ এই অবস্থা হত না। তুমি সব সময় বলতে তুমি প্যারিসকে ভালবাসো। আমরা প্যারিসেই থেকে যেতে পারতাম অথবা আর কোথাও যেতে পারতাম। আমি আর কোথাও যেতে পারতাম। আমি বলেছি তুমি যেখানে চাও সেখানে যেতে রাজি আছ আমি। তুমি শিকার করতে চাইলে আমরা হাঙ্গেরিতে গিয়ে শিকার করতে পারতাম। আরামে থাকতে পারতাম।’
‘তোমার টাকায়,’ সে বলল।
‘ঠিক বললে না। ও টাকা যেমন আমার, তেমনি তোমারও। আমি সব ছেড়ে এসেছি, তুমি যেখানে চেয়েছ সেখানে গিয়েছি। তুমি যা যা করতে বলেছ তাই করেছি। কিন্তু এখানে যদি না আসতাম।’
‘তুমি বলেছ এ জায়গা তোমার ভালো লেগেছে।’
‘তুমি যখন সুস্থ ছিলে তখন বলেছি। কিন্তু এখন ঘৃণা হচ্ছে। আমি বুঝি না এটা কেন তোমার পায়েই হলো। এটা হওয়ার মত কি এমন করেছি আমরা?’
‘মনে হয় প্রথমবার ক্ষতটা চুলকানোর পর ওখানে আয়োডিন লাগাইনি বলে না এটা ঘটেছে,’ লোকটা বলল। ‘আগে কখনও ইনফেকশন হয়নি বলে ব্যাপারটাকে পাত্তা দেইনি। পরে অন্যসব অ্যান্টি সেপটিক ফুরিয়ে যেতে কার্বলিক সলিউশন ব্যবহার করেছিলাম। মনে হয় তাতেই অবস্থা খারাপের দিকে মোড় নিয়েছে, কারণ এর ফলে ছোটো ছোটো রক্তনালীগুলো প্যারালাইজড্ হয়ে যেতে রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। তারপর গ্যাংগ্রিন তার কাজ শুরু করেছে,’ সঙ্গিনীর দিকে তাকাল সে। ‘আর কি?’
‘আমি তা বোঝাতে চাইনি।’
‘আমরা যদি অল্প বিদ্যার কিকুউ ড্রাইভারের বদলে একজন ভালো মেকানিককে ভাড়া করতাম, তাহলে সে তেল চেক করত এবং ট্রাকের বিয়ারিং কখনও জ্বলে যেত না।’
‘আমি তা বোঝাতে চাইনি।’
‘যদি তুমি আমার জন্য আপনজনদের ছেড়ে না আসতে, তোমার বাজপড়া ওল্ড ওয়েস্টবিউরি, সারাটোগা, পাম বিচের লোকদের।’
‘আমি তোমাকে ভালবেসেছি বলে এসেছি। এভাবে বলা উচিত না। আমি তোমাকে ভালবাসি। সব সময়ই ভালবেসেছি। তুমি আমাকে ভালবাসো না?’
‘না,’ লোকটা বলল। ‘মনে হয় না। কখনও বাসিনি।’
‘হ্যারি, এসব কি বলছ? তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে।’
‘না। খারাপ হওয়ার মতো মাথাই আমার নেই।’
‘আর খেয়ো না,’ মহিলা বলল। ‘ডার্লিং, আর খেয়ো না। আমাদেরকে যতদূর সম্ভব করতে হবে।’
‘তুমি করো গিয়ে,’ লোকটা বলল। ‘আমি ক্লান্ত।’
*****

মনের পর্দায় কারাগাচ রেলওয়ে স্টেশন দেখতে পেল লোকটা। কাঁধে প্যাক নিয়ে অপেক্ষায় আছে সে, সামনে সিম্পলন-ওরিয়েন্টের হেডলাইটের তীব্র আলো গাঢ় আঁধারের দেয়াল ফুঁড়ে এগিয়ে গেছে। রিট্রিটের পর থ্রেস ছেড়ে চলে যাচ্ছে সে। এটা ছিল সেইসব ঘটনার একটা, যা নিয়ে সে পরে; সকালবেলা জানালা দিয়ে দূরে, বালগেরিয়ার পর্বতমালার চূড়ায় জমাট বাধা তুষারের ওপর দৃষ্টি রেখে নাস্তা খাওয়ার সময় লিখবে বলে জমিয়ে রেখেছিল। নানসেনের সেক্রেটারি বৃদ্ধের কাছে জানতে চাইবে ওগুলো তুষার কি না, বৃদ্ধ সেদিকে চোখ বুলিয়ে জবাব দেবে, না, তুষার না। তুষার পড়ার সময় এখনও আসেনি। সেক্রেটারি তখন অন্য মেয়েদের উদ্দেশে পুনরাবৃত্তি করবে, না। ওগুলো তুষার না। তখন মেয়েরাও একযোগে বলবে, ওগুলো তুষার না। আমাদের ভুল হয়েছে। কিন্তু ওগুলো আসলেই তুষার ছিল এবং সে তাদেরকে ওর মধ্যে পাঠিয়ে দিয়েছিল। সেবারের শীতে মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত তুষারের মধ্যেই ছিল তারা।
সেবার গয়েরটালেও গোটা ক্রিসমাস সপ্তাহ জুড়ে তুষারপাত হয়, যে বছর এক কাঠুরিয়ার বাড়িতে ছিল তারা যেখানে রুমের অর্ধেকটাই দখল করে ছিল চারকোনা বিশাল এক পোরসেলিন স্টোভ। তারা ঘুমাত বিচ পাতা বোঝাই ম্যাট্রেসের ওপরে। যখন ডেজার্টার (সেনাবাহিনী থেকে পলাতক) এসে জানায় যে তার পিছনে পুলিশ লেগে আছে, তখন তুষারের আঘাতে তার পা রক্তাক্ত। লোকটাকে তারা উলের মোজা পরতে দেয় এবং নতুন তুষারের তলায় তার পায়ের ছাপ চাপা না পড়া পর্যন্ত এ-কথা সে-কথায় আটকে রাখে তাড়া করে আসা পুলিশদের।
সেই ক্রিসমাসের দিন সকালে শ্রানজ-এ এত উজ্জ্বল, ধপধপে তুষার পড়েছিল যে ভাইনস্টুবার জানালা দিয়ে গির্জা থেকে প্রার্থনা সেরে বাড়ি ফেরা লোকজনের দিকে তাকাতেও কষ্ট হচ্ছিল। হেঁটে সেখানে পৌঁছায় তারা, কাঁধে স্কি-র ভারী বোঝা নিয়ে। ¯স্লেজ চলাচলের কারণে সেখানকার রাস্তা ছিল সমতল, প্রস্রাবের মত হলুদাভ বরফে মোড়া। নদীর তীর ধরে চলে গেছে। পথের পাশে পাইন গাছে ঢাকা খাড়া পাহাড়। সেই পাহাড়ে উঠেছিল তারা লম্বা ম্যাডলেনার-হস গেøসিয়ারে স্কি করতে। সেখানকার তুষার এত মসৃণ ছিল যেন কেক ফ্রস্ট করা হচ্ছে, এত হালকা ছিল যেন ওগুলো পাউডার। মনে আছে তাদের সেই দীর্ঘ, নিম্নমুখী স্কি-যাত্রা ছিল নিঃশব্দ, ডানা মেলা পাখির দ্রুত অবতরণের মতো।
ম্যাডলেনার-হসে প্রবল তুষারঝড়ের মধ্যে লণ্ঠনের আলোয় তাস খেলে কাটত তাদের। চড়া দানে খেলত তারা এবং হের লেন্ট বেশি হারতেন। এক সময় সবকিছু খোয়ান তিনি। সবকিছু। স্কিশুলের টাকা, গোটা মওসুমের লাভের টাকা এবং তারপর পুঁজি, সব। তখনকার দিনে সব সময়ই জুয়া খেলা চলত। যখন তুষার পড়ে না তখনও চলত, যখন খুব বেশি তুষার পড়ে তখনও চলত। সারা জীবন সে জুয়া খেলেই কাটিয়েছে।
কিন্তু কখনও তা নিয়ে একটা লাইনও লেখেনি। লেখেনি প্রচÐ ঠাÐা সেই বড়দিন নিয়েও, যেদিন সমভূমির অপর প্রান্ত থেকে পর্বতমালা দেখা যাচ্ছিল; যেদিন বারকার প্লেন নিয়ে লাইন অতিক্রম করে অস্ট্রিয়ান অফিসারদের ট্রেনে বোমা ফেলতে গিয়ে পালাতে থাকা অফিসারদের অনেককে মেশিন গানের গুলিতে ঝাঁঝরা করে দিয়েছিল। বারকার পরে মেসে এসে তাদেরকে সেই গল্প শোনাতে চুপ হয়ে গিয়েছিল সবাই। তারপর কে যেন বলে উঠল: ‘ইউ ব্লাডি মার্ডারাস বাস্টার্ড!’
ওরা ছিল সেই অস্ট্রিয়ান অফিসার যাদের সাথে পরে স্কি করেছে সে। অস্ট্রিয়ান না, তারা ছিল হানস (জার্মান)। সেবার সারা বছরই তাদের সাথে স্কি করেছে সে। কাইজার-জ্যাগার্সে একসাথে খরগোশ শিকার করতে গেছে। তখন তারা পাসুবিওর যুদ্ধ এবং পের্টিকা ও আসালোনে হামলার প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা করেছে অথচ তা নিয়ে কখনও একটা শব্দও সে লেখেনি। মন্টি কর্নো নিয়ে লেখেনি, সিয়েট কমান নিয়ে লেখেনি, আরসিয়েডো নিয়েও লেখেনি।
ভরার্লবার্গ আর আর্লবার্গে কয়টা শীতকাল কাটিয়েছে সে? চারটা। তারা হেঁটে বøান্ডেজে যাওয়ার পর যে লোকটা শিয়াল বিক্রি করতে এসেছিল, তার কথা মনে আছে। উপহার কিনতে গিয়েছিল তারা, চেরির রসে তৈরি অ্যালকোহল খেতে, পাউডারের মতো তুষারের ওপর স্কি করতে। ইনের উষ্ণ পরিবেশে অ্যাকর্ডিয়ান বাজিয়েছে তারা।

‘আমরা প্যারিসে কোথায় থাকতাম?’ আফ্রিকায়, পাশের ক্যানভাস চেয়ারে বসা মহিলাকে জিজ্ঞেস করল সে।
‘ক্রিলনে। তুমি জানো।’
‘আমি জানব কেন?’
‘কারণ ওখানেই আমরা সব সময় থেকেছি।”
‘না। সব সময় না।’
‘ওখানে থেকেছি। সেইন্ট জার্মেইনের প্যাভিলন হেনরি-কোয়ার্ট্রেিত থেকেছি। তুমি বলেছ ওখানে ভালো লাগে তোমার।’
‘গোবরের গাদায় প্রেম,’ বলল হ্যারি। ‘আর আমি হলাম মোরগ যে সেই গাদায় উঠে ডাক ছাড়ে।’
‘যদি তোমাকে যেতেই হয়,’ মহিলা বলল, ‘তাহলে কি পিছনের সবকিছু গলা টিপে মেরে রেখেই যেতে হবে? বলতে চাইছি, সবকিছু তোমাকে নিয়ে যেতে হবে। তোমার ঘোড়া, তোমার স্ত্রীকে মেরে রেখে যেতে হবে? স্যাডল, বর্ম পুড়িয়ে ছাই করে রেখে যেতে হবে?’
‘হ্যাঁ,’ বলল সে। ‘তোমার টাকা আমার বর্ম। আমার সুইফট এবং আমার বর্ম।’
‘আর বোলো না।’
‘ঠিক আছে। এই চুপ করলাম। আমি তোমাকে কষ্ট দিতে চাই না।’
‘একটু দেরি হয়ে গেছে।’
‘ঠিক আছে। তাহলে কষ্ট দিতে থাকব তোমাকে। কাজটা মজার। তোমার সাথে যে কাজটা করে আমি মজা পাই তা এখন করতে পারছি না।’
‘না, কথাটা ঠিক না। তুমি অনেক কিছুতেই মজা পাও। তুমি যা যা চেয়েছ তার সবই আমি করেছি।’
‘ওহ্, যিশুর দোহাই, বড়াই করা বন্ধ করো!’
তাকিয়ে দেখল মহিলা কাঁদছে।
‘শোনো,’ সে বলল। ‘তোমার কি মনে হয় এসব করে আমি আনন্দ পাই? আমি জানি না এসব আমি কেন করছি। হয়ত করছি তোমার বেঁচে থাকার চেষ্টাকে খতম করতে। যখন আমরা আলোচনা শুরু করি তখন ঠিকই ছিল। আমি এসব শুরু করতে চাইনি। এখন কুট পাখির মত ঝগড়া করছি, তোমার সাথে যারপরনাই নিষ্ঠুর আচরণ করছি। আমি কি বলি না বলি সেদিকে বেশি আমল দিয়ো না, ডার্লিং। আমি তোমাকে ভালোবাসি। তুমি জানো আমি তোমাকে ভালোবাসি। তোমাকে যেমন ভালোবাসি, তেমন ভালো আর কাউকে বাসিনি।’
নিজের রুটি-রুজির উপায়, চিরাচরিত মিথ্যার আশ্রয় নিল লোকটা।
‘আমার প্রতি তুমি খুবই নরম।’
‘তুমি যৌনাবেদনময়ী নারী। ধনী যৌনাবেদনময়ী। এটা কবিতা। আমি এখন কবিতায় পূর্ণ। পচন ও কবিতা। পচা কবিতা।’
‘থামো, হ্যারি। আবার কেন নিষ্ঠুর হয়ে উঠলে?’
‘আমি পিছনে কিছু রেখে যেতে চাই না,’ লোকটা বলল। ‘পছন্দ করি না।’
*****
সন্ধ্যা হয়েছে। লোকটা ঘুমিয়ে আছে। সূর্য পাহাড়ের পিছনে চলে গেছে বলে সমতলভূমির পুরোটা ছায়ায় ঢেকে গেছে। ছোটো প্রাণীগুলো ক্যাম্পের আশপাশে খাচ্ছে; দ্রæত মাথা নামিয়ে খাবার তুলছে, লেজ উঠছে-নামছে। ঝোপ থেকে বেশ কিছুটা দূরে চরছে ওগুলো, লক্ষ করল সে। পাখিরা মাটি ছেড়ে উঠে পড়েছে। একটা বড় গাছের ডালে গিয়ে বসেছে সবগুলো। প্রচুর পাখি। তার ব্যক্তিগত বালক পরিচারক কটের পাশে বসা।
‘মেমসাহেব শিকার করতে গেছে,’ ছেলেটা বলল। ‘বওয়ানার কি লাগবে?’
‘কিছু না।’
মাংসের জন্য শিকারে গেছে মহিলা। তার সঙ্গী পাখি দেখতে ভালোবাসে বলে দূরে কোথাও গেছে যাতে বন্দুকের আওয়াজে গাছে বসা পাখিগুলো পালিয়ে গিয়ে তার দেখার মজা নষ্ট করে না দেয়। মহিলা বেশ চিন্তাশীল, ভাবল লোকটা। সবদিক বিবেচনা করে কাজ করে। যা ও জানে, বা পড়েছে, বা কারও মুখে শুনেছে, সব।
হ্যারি যখন তার কাছে যায়, তখন যে সে ভেতরে ভেতরে শেষ হয়ে গেয়েছিল, সে দোষ তো মেয়েটার নয়। একটা মেয়ে কি করে বুঝবে তুমি যা বলছ তার সবই ভুয়া? অভ্যাস থেকে মিথ্যা বলছ আরাম-আয়েশে থাকার জন্য? তার কথাবার্তা অর্থহীন প্রমাণিত হলেও মেয়েদের কাছে বরং সেসবই বেশি সাফল্য পেয়েছে সত্যের চেয়ে।
তবে এটাও ঠিক নয় যে লোকটা যা কিছু বলেছে মিথ্যাই বলেছে, তার মধ্যে কোনো সত্যি ছিল না। সে তার জীবন কাটিয়েছে এবং যখন সবকিছু শেষ হয়ে গেছে, তখন সে অন্যদের সাথে বাস করেছে আরও বেশি টাকার জন্য। বেশিরভাগ সময় প্রায় একই জায়গায়, তবে নতুনদের সাথে।
তুমি চিন্তা-ভাবনা করা থেকে বিরত থাকলে সব ঠিক থাকবে। তোমার অন্তরটা ভালো দিয়ে ঠাসা ছিল যাতে তুমি ভেঙে খান্ খান্ হয়ে না যাও, বেশিরভাগ মানুষের ক্ষেত্রে যা ঘটেছে, আর তুমি এমন ভাব দেখিয়েছ, তুমি যা কিছু করে অভ্যস্ত, যেসবের ক্ষেত্রে কিছু পরোয়া করতে না, এখন আর সেসব করতে পারছ না। কিন্তু তুমি মনে মনে বলেছিলে, এইসব মানুষকে নিয়ে তুমি লিখবে। খুব ধনীদের ব্যাপারে; যে তুমি তাদের দলের নও, তাদের দেশে একজন স্পাই। তুমি সে দেশ ছেড়ে গিয়ে তাদের নিয়ে লিখবে এবং একবারের মত সেটা এমন একজনের লেখা হবে, যে জানে সে কি লিখেছে। কিন্তু সে আর কখনও তা করতে পারবে না। কেননা নিয়মিত না লেখার কারণে, বেশি আরাম-আয়েশে থেকে, যা সে ঘৃণা করে তাই হয়ে নিজের ক্ষমতাকে ভোঁতা করে ফেলেছে সে। কাজ করার মনোবল এতটাই হারিয়ে ফেলেছে যে, শেষ পর্যন্ত সে আর কোনো কাজই করেনি। কাজ না করায় যাদেরকে সে একদিন চিনত, তারা এখন অনেক মৌজে আছে। আফ্রিকা ছিল সেই জায়গা যেখানে সে তার জীবনের বেশিরভাগ সময় সবচেয়ে সুখে কাটিয়েছে। তাই সে আবার এখানে এসেছে নতুন জীবন শুরু করতে। যে কারণে এই সাফারিতে বেশি আরাম-আয়েশের আয়োজন করা হয়নি। বেশি কষ্টের কিছু নেই, বেশি বিলাসিতাও নেই। সে ভেবেছিল এভাবেই ফিরে যেতে পারবে ট্রেনিংয়ে। ফাইটার যেভাবে পাহাড়ে চড়ে কাজ করতে এবং গতরে জমে ওঠা চর্বি গলাতে, সে-ও নিজের আত্মায় জমে ওঠা চর্বি একই কায়দায় ঝরাবে।
ব্যাপারটা সঙ্গিনীর ভালো লেগেছে। বলছিল, ও নিজেও এসব পছন্দ করে। উত্তেজনাকর সবকিছুই পছন্দ করে মেয়েটা, বিশেষ করে যেখানে দেখার মত নতুন নতুন জিনিস আছে, নতুন মানুষ আছে এবং যেখানকার সবকিছু সুখকর, মনোরম। তার সঙ্গীরও বিভ্রম ঘটেছিল যে এভাবে নিজের কর্মদক্ষতা ফিরিয়ে আনতে পারবে। এখন যদি এভাবেই সে সম্ভাবনার ইতি ঘটে; সে জানে যা ঘটার ঘটে গেছে, তাহলে অবশ্যই বিশেষ প্রজাতির সাপের মত নিজেকে কামড় দেবে না সে কারণ তার মেরুদÐ আগেই ভেঙে গেছে। সেটা তার সঙ্গিনীর দোষে নয়। এখানে এই মেয়ে না হয়ে আর কেউ হতে পারত। একটা মিথ্যার ওপর ভর করে যদি সে বাঁচতে পারে, তাহলে তার ওপর নির্ভর করেই তার মরার চেষ্টা করা উচিত। পাহাড়ের ওপাশে একটা গুলির শব্দ হল।
ও খুব ভালো একজন লক্ষ্যভেদী, এই ধনী যৌনাবেদনময়ী, দয়ালু কেয়ারটেকার এবং তার প্রতিভা ধ্বংসকারিনী। নির্বোধ কোথাকার। তার প্রতিভা সে নিজহাতে নষ্ট করেছে। মেয়েটাকে দোষ দেয়া কেন, সে তাকে সুখে রেখেছে বলে? সে নিজের প্রতিভা নষ্ট করেছে ব্যবহার না করে, নিজের সাথে এবং যা সে বিশ্বাস করে তার সাথে প্রতারণা করে। অতিরিক্ত মদ পান করে নিজের উপলব্ধির ধার ভোঁতা করে ফেলেছে সে, আলসেমি করে, স্লথের মতো চলাফেরা করে, সামাজিক মর্যাদা অবজ্ঞা করে, অহঙ্কার ও সংস্কার বশে, তা ভালো পথে হোক বা মন্দ পথে। এটা কি? পুরনো বইয়ের ক্যাটালগ? তার প্রতিভা আবার কি জিনিস? প্রতিভা আছে ঠিকই, কিন্তু কাজে না লাগিয়ে তা নিয়ে বাণিজ্য করেছে সে। সে যা করেছে তা বিষয় ছিল না, বিষয় ছিল সে কি করতে পারত। সে কলম-পেন্সিলের বদলে আর কিছু বেছে নিয়েছে নিজের জীবন ধারণের উপায় হিসেবে। যখনই সে কোনো নতুন নারীর প্রেমে পড়েছে, দেখা গেছে সে আগেরজনের চেয়ে বেশি টাকা-পয়সার মালিক, সব সময়। বেশ অদ্ভুত ব্যাপার, তাই না? কিন্তু যখন প্রেমের অস্তিত্ব থাকে না, যখন সে নারীর সাথে কেবলই শোয়, এই মহিলার মত, যার প্রচুর টাকা, যে দুনিয়ার সব টাকার মালিক, যার স্বামী-সন্তান ছিল, যার অনেক প্রেমিক ছিল কিন্তু কেউ সন্তুষ্ট করতে পারেনি, যে তাকে প্রাণ দিয়ে ভালোবেসেছে একজন লেখক, পুরুষ, সঙ্গী এবং দখল করা বস্তু হিসেবে।
কর্মফলের কারণে আমাদের সবাইকে বিচ্ছিন্ন হতেই হবে, ভাবল সে। তোমার প্রতিভা যা-ই হোক, তুমি যেভাবেই জীবিকা নির্বাহ করো না কেন। সে নিজের প্রাণশক্তি বিক্রি করে দিয়েছে, একভাবে না হোক আরেকভাবে, তার সারা জীবন এবং যখন তোমার ভালোবাসা বেশি জড়িত থাকবে না, তখন তুমি টাকার অনেক ভালো মূল্য দিতে পারবে। বিষয়টা সে বুঝতে পেরেছে, কিন্তু এ নিয়ে কখনও লিখবে না। না, সে লিখবে না, যদিও এর বিশেষ মূল্য ছিল।
এখন ওকে দেখা যাচ্ছে, খোলা প্রান্তর ধরে ক্যাম্পের দিকে হেঁটে আসছে। যোধপুর রাইডিং ব্রিচেস পরে আছে, কাঁধে রাইফেল। তার পিছন পিছন একটা টমি ঝুলিয়ে নিয়ে আসছে দুই কিশোর। মহিলা এখনও যথেষ্ট সুন্দরী আছে, ভাবল সে। অসাধারণ ফিগার। বিছানায় দারুণ এক প্রতিভা। খুব একটা সুন্দরী নয়, কিন্তু ওর চেহারার ধাঁচটা ভালো লাগে তার। প্রচুর পড়াশোনা করে মহিলা, ঘোড়ায় চড়তে এবং শিকার করতে ভালোবাসে। পানও করে প্রচুর। বেশ অল্প বয়সে স্বামীকে হারিয়ে নিজের দুই শিশু সন্তানের দেখাশোনার কাজে ব্যয় করছিল সে। কিন্তু মাকে তাদের দরকার ছিল না, বরং সে ধারেকাছে থাকলে তারা বিব্রত বোধ করত। ব্যাপারটা বুঝতে পেরে তার ঘোড়া, আস্তাবল, বই এবং বোতল নিয়ে সময় পার করতে থাকে মহিলা। সন্ধ্যায় পড়তে ভালো লাগত তার, তখন স্কচ আর সোডা চলত। তারপর ডিনারে এক বোতল ওয়াইন খেয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়ার জন্য যথেষ্ট মাতাল হয়ে যেত।
এই ধারা বজায় ছিল তার প্রেমিকদের আগমন ঘটার আগে। প্রেমিকরা থাকতে ঘুমানোর জন্য পানীয়ের প্রয়োজন হত না মহিলার। কিন্তু প্রেমিকদের একঘেয়ে প্রেম তাকে অল্পদিনে বিরক্ত করে তোলে। তার স্বামী কখনও তাকে বিরক্ত করেনি, কিন্তু এই লোকগুলো করেছে।
এক সময় তার দুই সন্তানের মধ্যে একটির প্লেন দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়। তারপর থেকে আর প্রেমিক কামনা করেনি সে, এবং পানীয় অনুভূতিনাশক নয় বলে তাকে নতুন জীবন গড়ে তোলার দিকে মন দিতে হয়। হঠাৎ নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ার ভয়ে ভীত হয়ে ওঠে সে এক সময়। সঙ্গী হিসেবে এমন একজনকে কামনা করে যাকে সে শ্রদ্ধা করে।
ব্যাপারটার শুরু নিতান্তই সাধারণভাবে। তার লেখা সে পছন্দ করত, তার জীবন যাপনের পদ্ধতিকে ঈর্ষা করত। তার মনে হত লোকটা যা করতে চায় ঠিক তাই করে। যে সমস্ত পদক্ষেপের ফলে সে লোকটাকে দখল করতে সফল হয়, এবং যে পদ্ধতি অনুসরণ করে সে শেষ পর্যন্ত লোকটার প্রেমে পড়ে, সেটা ছিল নিয়মিত অগ্রগতির ফল যার মধ্যে সে নিজের নতুন জীবন গড়ে নিয়েছিল এবং লোকটা তার পুরনো জীবনের অবশিষ্টাংশ ফেলে দিয়ে তার টানে পায়ে পায়ে সরে আসে।
সে আসে নিরাপত্তার জন্য, আরাম-আয়েশের জন্যও বটে, তার মধ্যে অস্বীকার করার কিছু নেই, নইলে আর কিসের জন্য? সে জানে না। সে যা চাইত মহিলা তাকে তাই কিনে দিত। সে তা জানে। ও আসলে চমৎকার একটি মেয়ে। আর সবার মত তাড়াতাড়ি তাকে নিয়ে বিছানায় যেত লোকটা; আসলে তার সাথে যেত, তাকে নিয়ে কথাটা ঠিক নয়, কারণ ও অনেক ধনী, অত্যন্ত মোহনীয়, তাকে সে যথার্থ মূল্য দিতে জানে এবং কখনও মহিলা কোনো দৃশ্যের অবতারণা করেনি। এখন লোকটার এই নতুন জীবন আবার এক প্রান্তসীমায় এসে পৌঁছেছে, কারণ দুই সপ্তাহ আগে হাঁটুতে কাঁটার খোঁচা লাগার পর সে আয়োডিন লাগায়নি। ব্যাপারটা অগ্রাহ্য করে ছবি তোলায় ব্যস্ত ছিল। বিশাল এক পাল ওয়াটার বাকের ছবি তোলার জন্য প্রস্তুতি নিয়েছিল। হরিণগুলো দাঁড়িয়েছিল গ্রিবা উঁচু করে - তীক্ষ্ণ নজর চারদিকে, নাকের ফুটো স্ফীত করে বাতাসে বিপদের গন্ধ শুঁকছে, কান ছড়ানো, বিপদের কোনোরকম আভাস পেলেই এক ছুটে ঝোপের মধ্যে ঢুকে পড়বে। অবশ্য ছবি তুলতে পারার আগেই ওটা পালিয়ে যায়।
ওই যে আসছে মহিলা।
মাথা ঘুরিয়ে তার দিকে তাকাল সে। ‘হ্যালো।’
‘একটা টমি মেরে এনেছি,’ মহিলা বলল। ‘ওটা দিয়ে তোমার জন্য চমৎকার ঝোল রেঁধে দেব। এখন কেমন বোধ করছ?’
‘অনেক ভালো।’
‘চমৎকার। আমি এরকমই কিছু আশা করছিলাম। আমি যাওয়ার সময় তুমি ঘুমাচ্ছিলে।’
‘ভালোই ঘুমিয়েছি আজ। তুমি দূরে গিয়েছিলে?’
‘না। পাহাড়টার ওপাশে। এক গুলিতে খতম করেছি টমিটাকে।’
‘তোমার নিশানা দারুণ।’
‘আমি শিকার করতে ভালোবাসি। আফ্রিকাকে ভালোবেসে ফেলেছি আমি, সত্যি। তুমি সুস্থ থাকলে এটা হত আমার সবচেয়ে আনন্দের বিদেশ সফর। তোমার সাথে শিকার করতে কত মজা তুমি জানো না। আমি এ দেশটাকে ভালোবেসে ফেলেছি।’
‘আমিও।’
‘ডার্লিং, তোমাকে সুস্থ দেখে কত ভালো লাগছে জানো না। তোমার রূঢ় আচরণ আমি সহ্য করতে পারি না। আর কখনও অমন আচরণ করবে না আমার সাথে। করবে? কথা দাও?’
‘না,’ বলল সে। ‘আমি কেমন আচরণ করেছি মনে করতে পারছি না।’
‘আমাকে বিধ্বস্ত করার দরকার নেই। আমি মাঝবয়সী নারী, তোমাকে ভালোবাসি। তুমি যাতে খুশি হও তাই করতে চাই। আমি এর মধ্যেই দু’ তিনবার বিধ্বস্ত হয়েছি। তুমি নিশ্চয়ই আবার তা চাও না?’
‘আমি তোমাকে বিছানায় বিধ্বস্ত করতে পারলে খুশি হব,’ লোকটা বলল।
‘হ্যাঁ। ওটা ভালো কাজ। আমাদের জন্মই হয় বিধ্বস্ত হওয়ার জন্য। কাল প্লেন আসবে।’
‘তুমি জানলে কিভাবে?’
‘আমি নিশ্চিত। ওটাকে আসতেই হবে। ধোঁয়া সৃষ্টির জন্য কাঠ আর ঘাস রেডি করে রেখেছে ছেলেরা। আজ ওদের কাজ দেখে এসেছি আমি। ল্যান্ড করার জন্য যথেষ্ট জায়গা আছে ওখানে। দুই মাথা থেকে ধোঁয়ার আয়োজন করা থাকবে।’
‘তোমার কি দেখে মনে হল কাল ওটা আসবে?’
‘আমি জানি আসবে। আরও আগেই আসার কথা ছিল। শহরে নিয়ে আগে তোমার পায়ের ব্যবস্থা করা হবে, তারপর বিছানায় ভালোরকম কিছু বরবাদির ব্যবস্থা হবে। শুধু কথা নয়।’
‘একটু পানীয় হলে কেমন হয়? সূর্য ডুবে গেছে।’
‘তুমি মনে করো তোমার পান করা ঠিক হবে?’
‘আমি পান করছি।’
‘তাহলে দু’ জনে একসাথে খাই। মোলো! লেট্টি ডুই হুইস্কি-সোডা!’’ গলা চড়িয়ে বলল সে।
‘তুমি বরং মসকুইটো বুট পরে নাও,’ লোকটা বলল।
‘গোসল করে...’
পান করে চলল তারা, ওদিকে সন্ধ্যার আঁধার ঘনিয়ে আসছে। পুরোপুরি আঁধার হওয়ার ঠিক আগে; যখন আলোর স্বল্পতার কারণে গুলি করার উপায় রইল না, ঠিক তখনই একটা হায়েনা দেখা দিল। সামনের খোলা প্রান্তর পেরিয়ে ধীর পায়ে, হেলেদুলে পাহাড়ের দিকে চলেছে।
‘ওই বাস্টার্ড রোজ রাতে এখান দিয়ে যায়,’ লোকটা বলল। ‘দুই সপ্তাহ ধরে লক্ষ করছি আমি।’
‘রাতে বেশ আওয়াজ করে ওটা, রোজ। আমি মাথা ঘামাই না। নোংরা জানোয়ার।’
একসাথে পান করছে তারা। লোকটা এখন আর কোনো ব্যথা অনুভব করছে না, কেবল এক কাতে শুয়ে থাকতে হয় বলে অস্বস্তি বোধ করছে। ছেলেরা আগুন প্রস্তুত করতে ব্যস্ত। তার ছায়া নাচছে তাঁবুর গায়ে। লোকটা এই মনোরম মুহূর্ত উপভোগ করছে। মহিলা তার প্রতি অনেক সদয় ছিল। আজ দুপুরে সে নিষ্ঠুর, অন্যায্য আচরণ করেছে ওর সাথে। চমৎকার মেয়ে ও, সত্যি।
ঠিক তখনই মনে হলো তার মৃত্যু হতে যাচ্ছে।
উপলব্ধিটা হুড়মুড় করে ধেয়ে এলো; তবে জলোচ্ছ্বাস বা দমকা বাতাসের মতো নয়, অনেকটা বদ গন্ধওয়ালা আকস্মিক অসীম শূন্যতার মতো, এবং একই সাথে আরেকটা অদ্ভুত কাণ্ডও ঘটল। সেই উপলব্ধির কিনারা ঘেঁষেই লঘু পায়ে হেঁটে গেল হায়েনাটা।
‘কি হয়েছে, হ্যারি?’
‘কিছু না,’ বলল সে। ‘তুমি বরং এপাশে এসে বোসো। বাতাসের দিকে মুখ করে।’
‘মোলো তোমার ড্রেসিং বদলে দিয়েছে তো?’
‘হ্যাঁ। বোরিকের প্রভাব টের পাচ্ছি আমি।’
‘কেমন বোধ হচ্ছে?’
‘একটু বেসামাল।’
‘আমি গোসল করতে যাচ্ছি,’ মহিলা বলল। ‘বেশি সময় লাগবে না। ডিনারের পর তোমার কট ভেতরে নেয়ার ব্যবস্থা করব।’
ঝগড়া বন্ধ করার ক্ষেত্রে তাহলে ভালোই উতরে গেছি আমরা, লোকটা ভাবল। অবশ্য এর সাথে সে বেশি ঝগড়া করেনি। আগে যাদেরকে সে ভালোবাসত, তাদের সাথে করত। এত ঝগড়া করত যে শেষ পর্যন্ত সম্পর্ক নষ্টই হয়ে যেত। সে ভালোবাসত খুব বেশি, দাবি করত খুব বেশি, এভাবেই সবকিছু জীর্ণ করে ফেলত সে।
*****
একাকী হয়ে কনস্টান্টিনোপলের কথা ভাবল সে। ঝগড়া করে প্যারিস ছাড়ার পর কনস্টান্টিনোপলে গিয়ে কিছুদিন একা ছিল সে। পুরোটা সময় বেশ্যা নিয়ে কাটিয়েছে। সে অধ্যায় চুকে যেতে আবার একাকীত্ব চেপে ধরল। সেটা দূর করতে ব্যর্থ হল সে, পরিস্থিতি বরং আরও খারাপ হল। তখন মেয়েটাকে চিঠি লিখল। প্রথমটিকে, যাকে ছেড়ে এসেছে। লিখল তার স্মৃতি কিছুতেই মুছে ফেলতে পারেনি সে... রিজেন্সের সামনে তাকে যখন প্রথম দেখে, তখন কিভাবে সে জ্ঞান হারাতে যাচ্ছিল, অসুস্থ হয়ে পড়েছিল, তারপর বুলেভারে অন্য একটি মেয়েকে অনুসরণ করার কথা লিখল যে দেখতে অনেকটাই তার মতো ছিল, যদিও কাছে গিয়ে দেখতে সাহস হচ্ছিল না সে-ই কি না। কারণ ভয় ছিল যে অনুভূতি মেয়েটা দিয়েছে, তা হারিয়ে যেতে পারে। আরও লিখল সে, যত মেয়ের সাথেই ঘুমাক, তারপরও কিভাবে তাকে আরও বেশি মিস করে সে। মেয়েটি কিভাবে কি করেছে সেসব কোনো বিষয় হত না, কেননা সে জানত ওকে ভালো না বেসে সে কিছুতেই পারবে না। কোল্ড সোবার ক্লাবে বসে চিঠিটা লিখেছে সে, নিউ ইয়র্কের ঠিকানায় পাঠিয়ে দিয়েছে। ওকে অনুরোধ করেছে তার প্যারিস অফিসের ঠিকানায় চিঠি লিখতে। সেটাই নিরাপদ মনে হয়েছে। সেই রাতে ওর অভাব এত বেশি কষ্ট দিয়েছে যে এক ধরনের ফাঁপা অসুস্থতা পেয়ে বসে তাকে। পরে টাকসিম স্কয়ারে অনেকক্ষণ হাঁটাহাঁটি করে সে, একটা মেয়ে জুটিয়ে নিয়ে সাপার খেতে যায়। পরে তাকে নিয়ে নেচেছে সে, কিন্তু খুব বাজে নাচে মেয়েটা। তাই ওকে ছেড়ে এক আলুথালু আমেরিকান যুবতীকে দখল করে সে অধীনস্থ এক ব্রিটিশ গানারের কাছ থেকে। এই মেয়েটা নাচার সময় পেট দিয়ে এমন ঘষা মেরেছিল যে তার পেটের চামড়াই উঠে যাওয়ার জোগাড়। অবশ্য মেয়েটাকে দখল করার জন্য গানারের সাথে বোঝাপড়া করতে হয়েছে তাকে। গানার তাকে চ্যালেঞ্জ করায় অন্ধকার রাস্তায় হাতাহাতি লড়াই করতে হয়েছে। লোকটাকে সে দুটো কঠিন মার দিয়েছে, চোয়ালে। তারপরও গানার যখন দু’ পায়ে খাড়া থাকল, তখন বুঝতে অসুবিধা হয়নি ছুঁড়িটাকে কষ্ট করেই হাসিল করতে হবে। গানার প্রথমবার মেরেছিল পেটে, পরেরবার চোখের পাশে। পরেরবার তার বাঁ হাতের প্রচণ্ড এক ঘুসিতে পড়ে যায় গানার, টান খেয়ে সে-ও পড়ে যায় লোকটার ওপর। এই সময় টান মেরে তার কোটের একটা আস্তিন ছিঁড়ে নেয় গানার। ছড়ি দিয়ে তার কানের পিছনে দুটো আঘাত করে, তারপর একটা ঘুসি মেরে তাকে গায়ের ওপর থেকে ঠেলে সরিয়ে দেয়। সুযোগ পেয়ে মেয়েটাকে নিয়ে পালাতে শুরু করে সে, কারণ তার কানে এসেছে মিলিটারি পুলিশ তেড়ে আসছে। একটা ট্যাক্সি নিয়ে কেটে পড়ে তারা। বসফরাসের তীর ধরে রিমিলি হিসা হয়ে আবার ফিরে আসে ঠাÐা রাতে। বিছানায় মেয়েটিকে বেশি পাকা ফলের মতো লাগলেও মসৃণ, গোলাপি, রসালো, মসৃণ পেটের, বড় স্তনের ছিল সে। নিতম্বের নীচে বালিশ দিয়ে নেয়ার প্রয়োজন হয়নি। ভোরে ওর ঘুম ভাঙার আগেই হোটেল ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছিল সে। গায়ে চাষাভুষাদের মত ঢিলাঢালা শার্ট, চোখের কোনা কালো। কোট বয়ে নিয়ে চলেছে কারণ ওটার একটা আস্তিন ছিল না।
সেই রাতে প্যারিস থেকে আনাতোলিয়া যাত্রা করে সে। মনে আছে, সেদিন সে পপি’র মাঠের মধ্য দিয়ে হেঁটেছে। পপি দিয়ে আফিম তৈরি হয়। আফিম খেলে অদ্ভুত অনুভূতি হয়। সবশেষে এত পথ পেরিয়ে আসা মনে হলো ভুল হয়ে গেছে তার। কারণ নতুন আসা কনস্ট্যান্টাইন অফিসারদের নেতৃত্বে আক্রমণ চালানোর পর দেখা গেল তারা কিছুই জানে না। আর্টিলারি সৈন্যদের মধ্যে গোলা বর্ষণ করল তারা, ব্রিটিশ অবজারভাররা শিশুর মত কাঁদতে লাগল।
সেদিনই সে প্রথম দেখেছে সাদা ব্যালে স্কার্ট পরা এবং একগোছা রিবন পরানো, ওপরদিকে মোড়ানো জুতো পায়ে দেয়া মানুষের মৃতদেহ। তুর্কিরা তরঙ্গের মতো এগিয়ে আসছিল। সে দেখেছে স্কার্ট পরা মানুষগুলো দিগ্বিদিক পালাচ্ছে। অফিসাররা তাদের লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়ছে। তারপর তাদের লক্ষ্য করেও গুলি করা হতে লাগল, ফলে সে আর ব্রিটিশ অবজারভারও দৌড়াতে লাগল। ফুসফুস ফেটে যাওয়ার অবস্থা হতে বিরাট এক পাথরের আড়ালে থামল তারা, মুখের স্বাদ পেনির মতো হয়ে গেছে। তুর্কিরা তখনও সমানতালে এগিয়ে আসছে। সেখানে সে এমন সব ঘটনা দেখেছে যা কখনও দেখবে বলে কল্পনা করেনি। পরে তার চেয়ে আরও অনেক বেশি খারাপ জিনিসও দেখেছে সে। তাই পরে প্যারিসে ফিরে আসার পর সেসব নিয়ে কখনও কথা বলত না, বা কেউ বললে সহ্য করতে পারত না। সেখানে তার আসা-যাওয়ার পথে একটা কাফে পড়ত যেখানে সামনে পিরিচের স্তূপ নিয়ে বসে থাকত সেই আমেরিকান কবি। আলুর মতো গোল মুখ, নির্বোধের মতো চাউনি। ট্রিসটান জারা

আসছে... বিয়ের আগে কাউন্ট ড্রাকুলার সাথে সবার  অলক্ষে ঘটে যাওয়া মিনা হারকারের প্রণয় কাহিনী নিয়ে রচিত: ড্রাকুলা, মাই লাভ: ...
05/11/2024

আসছে...

বিয়ের আগে কাউন্ট ড্রাকুলার সাথে সবার অলক্ষে ঘটে যাওয়া মিনা হারকারের প্রণয় কাহিনী নিয়ে রচিত: ড্রাকুলা, মাই লাভ: দ্য সিক্রেট জার্নাল অব মিনা হারকার। দুর্দান্ত এক প্রেমকাহিনী। সাথে আছে আরও অনেক কিছু।

পাঠক, আপনি প্রকৃত রোমান্সপ্রিয় হয়ে থাকলে এ বই পড়তেই হবে আপনাকে কারণ এটা ক্ষণে ক্ষণে ভয়ের শিহরণ জাগানোর, প্রেমের, মোহের, লালসার, টিকে থাকার ও অবিশ্বাস্য ত্যাগের গল্প। যার অনলে কেবল মিনা হারকারই অবিরত পুড়ে চলেছে।

অপেক্ষায় থাকুন। আমরা আসছি।

পাথরের নাইটমূল : এডিথ ই. নেসবিটসেবার অক্টোবরের ৩১ তারিখ রাতে আমি আর লরা “একটা বিভ্রমের মধ্যে ছিলাম” - এ কথা প্রায় সবাই ব...
31/10/2024

পাথরের নাইট

মূল : এডিথ ই. নেসবিট

সেবার অক্টোবরের ৩১ তারিখ রাতে আমি আর লরা “একটা বিভ্রমের মধ্যে ছিলাম” - এ কথা প্রায় সবাই বলেছে। কিন্তু আমি হাড়ে হাড়ে জানি কোন বিভ্রম ছিল না বিষয়টা। আমরা তিনজন ছিলাম এই গল্পের পাত্র-পাত্রী। লরা, আমি এবং আরেকজন। এক আইরিশ ডাক্তার। এই লোক আজও বেঁচে আছে। আমার গল্পের পরিণতি তার মুখ থেকে শুনে যাচাই করা যাবে। এবার আসল কথায় আসি।

জীবনের মামুলী চাহিদা মেটানো, যেমন চিত্র আঁকার ভালো রং, ক্যানভাস, ব্রাশ, বই ইত্যাদি কেনা এবং ক্যাব ভাড়া দেয়ার মতো পর্যাপ্ত টাকা পকেটে থাকার মজা কেমন হতে পারে সে বিষয়ে আমার কোনো ধারণা ছিল না। যখন বিয়ে করি, তখন খুব ভালো করেই জানতাম বেঁচে থাকতে হলে কড়া নিয়মানুবর্তিতা আর পেশার প্রতি একনিষ্ঠ থাকতে হবে আমাদেরকে। আমি ছবি আঁকতাম, লরা লেখালেখি করত। যে রোজগার, তাতে লন্ডনের মতো ব্যয়বহুল শহরে বাস করা সম্ভব না, তাই গ্রামাঞ্চলে পছন্দমতো একটা কটেজের খোঁজে উঠেপড়ে লাগি। একইসঙ্গে স্বাস্থ্যকর এবং দেখতে ছবির মতো সুন্দর জায়গা খুঁজলাম অনেক। কিন্তু দুটো চাহিদা একযোগে পূরণ করার মতো বাড়ি পাওয়া কঠিন, তাই বেশ কিছুদিন পর্যন্ত আমাদের অনুসন্ধান কোনো ফল প্রসব করল না। বিজ্ঞাপন দিলাম, কিন্তু পছন্দের জায়গাগুলোর কোথাও দুই সুযোগওয়ালা কটেজ পাওয়া গেল না।

যদি বা কোনোটায় একটা সুবিধা জোটে, অন্যটা প্রায় অবধারিতভাবেই জোটে না। যদি দ্রাক্ষালতা বা গোলাপ শোভিত পোর্চ পাই, তার মধ্যে দূষণের উপস্থিতি অবধারিত। সব মিলিয়ে আমাদের মাথা এতটাই কুয়াশাচ্ছন্ন হয়ে ছিল যে বিয়ের রাতে একটা বাড়ি আর খড়ের গাদার পার্থক্য বোঝার মতো বোধশক্তি আমাদের কারও অবশিষ্ট থাকবে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ ছিল। কিন্তু যখন বন্ধু-বান্ধব আর হাউস এজেন্টদের খপ্পর থেকে বেরিয়ে হানিমুনে গেলাম, তখন মাথা পরিষ্কার হলো। আক্কেল-জ্ঞান ফিরে এলো এবং অতপর একটা পছন্দসই কটেজ নিজেরাই খুঁজে বের করলাম ব্রেনযেত-এ। পাহাড়ের ওপরের এক ছোট গ্রামে, সাউদার্ন জলাভূমির কাছে।

তখন একটা জেলে পল্লীতে থাকতাম। সেখান থেকে গিয়েছিলাম কাছের একটা গির্জা দেখতে। গির্জার দু’ মাইল দূরে সেই কটেজ। নিঃসঙ্গ দাঁড়িয়ে আছে। বাড়িটা একে নিচু, তার ওপর ছিরিছাদ যেন কেমন। বেশিরভাগ রুম জায়গা-বেজায়গা থেকে মাথা বের করে আছে। দেখলে বোঝা যায় অতীতে বিশাল বাড়ি ছিল।বেশিরভাগ রুম সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে বিলীন হয়ে গেছে। ফলে বর্তমানে বাসযোগ্য রুম আছে মাত্র দু’টো - কিছু স্টোনওয়ার্কের আভাস আছে যা আইভি লতা আর শ্যাওলায় ঢাকা।ভাগ্যিস গোলাপ আর জেসমিন চারদিক থেকে বাড়িটাকে ঘিরে আড়াল করে রেখেছিল। নইলে দেখতে নিশ্চয়ই ভয়ঙ্কর লাগত। কিন্তু আমাদের ভালো লেগে গেল প্রথম দর্শনেই। নিরিবিলি জায়গায় এমন একটা বাড়িই আসলে মনে মনে খুঁজছিলাম। নিয়ে নিলাম সেটা। অবিশ্বাস্যরকম অল্প ভাড়ায়। হানিমুনের বাকি দিনগুলো অ্যাশফোর্ডের সেকেন্ড হ্যান্ড জিনিসপত্রের দোকানে চক্কর মেরে কাটালাম। ওক কাঠের হালকা চেয়ার কিনলাম কয়েকটা। লিবার্টি থেকে কিনলাম রেডিমেড ঘর নির্মাণের জিনিসপত্র। এরপর ওক কাঠের বিম আর ঝাঁজরিওয়ালা জানালা বসিয়ে সেটাকে নিচু টাইপের মোটামুটি একটা বাড়িতে রূপান্তরিত করলাম।

পুরনো আমল স্টাইলের বাগান ছিল বাড়িটাকে ঘিরে। প্রচুর উজ্জ্বল বর্ণের পাতাওয়ালা বড় গাছ, সূর্যমুখী, বড় বড় পদ্মফুল, গোলাপসহ হাজারো মিষ্টি গন্ধওয়ালা ফুলে ভর্তি বাগান। জানালা দিয়ে তৃণক্ষেত্র, জলাভূমি চোখে পড়ে। তার ওপাশে হালকা নীল ফিতের মতো সমুদ্র। সেবারের গ্রীষ্মকালটা পত্রে-পুষ্পে ঐশ্বর্যময় ছিল। যত তাড়াতাড়ি কাজ শুরু করতে পারব ভেবেছিলাম, তার আগেই শুরু করে দিলাম। ভালোই কাটতে লাগল সময়। আমি খোলা জানালার পাশে বসে নিরলসভাবে প্রকৃতির স্কেচ আঁকি, লরা সেসবের জন্য উপযুক্ত পংক্তি লেখে।

এক লম্বা, বয়স্ক মহিলা নিয়োগ দিয়েছি রান্নাসহ গেরস্থালীর বাকি সব কাজ সামল দেয়ার জন্য। মিসেস ডরম্যান। চেহারা, শারীরিক গঠন ভলোই, কিন্তু রান্না সাদামাটা। তবে বাগান পরিচর্যায় ওস্তাদ।গল্পে গল্পে স্থানীয় পুরনো ঝোপঝাড়, শস্যক্ষেত প্রভৃতির নাম বলেছে সে আমাদেরকে । চোরাচালানী আর হাইওয়েম্যানদের গল্প বলেছে, “যেসব জিনিস হেঁটে বেড়ায়,” সে সম্পর্কেও বলেছে, যা তারাভরা রাতে নির্জন পথে চোখে পড়ে।

মহিলা অনেকদিক থেকেই আশীর্বাদ হয়ে এসেছে আমাদের জন্য। প্রথমত, লরা রাঁধতে জানে না। দ্বিতীয়ত, আমি লোককাহিনী শুনতে ভালোবাসি।তৃতীয়ত, মহিলা বাগানের মালি হিসেবে এ ক্লাস। তো, সংসারের যাবতীয় দায়ভার তার কাঁধে তুলে দিয়ে আমরা ঝাড়া হাত-পা হয়ে নিজেদের কাজে মন দিলাম। মিসেস ডরম্যানের মুখে শোনা গল্প মাঝেমধ্যে লিখে পত্রিকায় পাঠাই, তারা ছাপে, লোকে টাকা দিয়ে কেনে সেসব।বিয়ের পর তিনটা মাস সুখেই কাটল আমাদের। একবারও মনোমালিন্য হয়নি আমাদের, ঝগড়া হয়নি। তারপর হঠাৎ করেই ঘটল এই বিপত্তি।সেই অপয়া অক্টোবরের এক সন্ধ্যারাতে আমাদের একমাত্র প্রতিবেশী সঙ্গে বাড়ির সামনে বসে গল্প করছি, ধূমপান করছি। লরা ভেতরে মান্থলি মারপ্লট পত্রিকার জন্য কিছু কমিক স্কেচ আঁকছে। বের হওয়ার সময় দেখে গেলাম উজ্জ্বল হাসিমুখের মেয়েটাকে, ফিরে এসে দেখি জানালার পাশে বসে কাঁদছে। ভাঙাচোরা ভঙ্গিতে বসে আছে একদলা মসলিনের মতো। আমি আঁতকে উঠলাম।

“কী হয়েছে, ডার্লিং?” লরার দিকে ছুটে গেলাম । ও আমার কাঁধে মাথা রেখে নীরবে কাঁদতে থাকল। আমি বিচলিত হয়ে পড়লাম, কারণ লরাকে কখনও কাঁদতে দেখিনি। ভাবলাম নিশ্চয়ই ভয়ঙ্কর কিছু ঘটে গেছে। “কী হয়েছে, বলো আমাকে!”

“মিসেস ডরম্যান...” ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল ও।

খুব খারাপ কিছু নয় তাহলে, স্বস্তির দম ছেড়ে ভাবলাম। “কী করেছে সে, ডার্লিং?”

“বলেছে, এ মাসের শেষদিকে ছুটিতে যাবে। তার ভাগ্নি অসুস্থ। তাকে দেখতে গেছে সে। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি না। মহিলা সত্যি কথা বলছে না। তার ভাগ্নি অনেকদিন থেকেই অসুস্থ। আমার মনে হয় কেউ তাকে আমাদের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তুলেছে। ছুটির কথা বলার সময় মহিলা এমন অদ্ভুত আচরণ করেছে যে, কী বলব!”

‘বাদ দাও,’ আমি বললাম। ‘আর যা-ই করো, কেঁদো না। নইলে কিন্তু আমিও কেঁদে ফেলব।’

আমার রুমাল দিয়ে চোখ মুছল লরা, এক টুকরো ফ্যাকাসে হাসি হেসে বলল, ‘কিন্তু বিষয়টা খুবই জটিল, ডার্লিং। এইসব গ্রামের মানুষদের আচরণ সুবিধের হয় না। একজন যেটা করতে চাইবে না, অন্যরাও তা করতে রাজি হবে না। তার মানে মিসেস ডরম্যান ছুটিতে গেলে রান্নাবান্না আমাকেই করতে হবে, তেল-ঝোল মাখানো বাসন-কোসন ধুতে হবে,’ বলতে বলতে ঘৃণায় মুখ বিকৃত করে শিউরে ওঠার ভঙ্গি করল ও। “তোমাকেও ক্যান ভরে পানি নিয়ে এটা-সেটা করতে হবে। আমরা নিজেদের কাজ করার সময় পাবো না, রোজগার বন্ধ হয়ে যাবে। সারাদিন কাজ, বিশ্রাম জুটবে কেবল কেটলির পানি ফোটার আগের সময়টুকু।”

আমি ওকে নানাভাবে বোঝানোর চেষ্টা করলাম, কিন্তু কে শোনে! তার এক কথা। এক সময় বিরক্ত হয়ে বললাম, অযৌক্তিক আচরণ করছে সে। বলেই ভাবলাম, মেয়েরা যৌক্তিক আচরণ কখনও করে?

“সে ফিরলে আমি কথা বলে দেখব কিছু করা যায় কি না,” আমি বললাম। “মনে হয় কায়দা করে বেতন বাড়ানোর চেষ্টা করছে। সব ঠিক হয়ে যাবে। চলো, গির্জা থেকে ঘুরে আসি।”

গির্জাটা যেমন বিশাল, ভেতরে তেমনি শুনশান নীরবতা। মাঝেমধ্যে এখানে এলে মনটা ভালো হয়ে যায়, বিশেষ করে ভরা জোছনার রাতগুলোতে। সেখানে পৌঁছানোর রাস্তা একটা বনের পাশ দিয়ে গেছে, এক জায়গায় বনের মধ্যে দিয়েও গেছে খানিকটা। তারপর দুটো জলাশয়ের মধ্যে দিয়ে পাহাড়ের চূড়ার দিকে উঠে গির্জার দেয়াল ঘুরে সামনেরদিকে গেছে। কালো কালো, ঝাঁকড়া মাথার ইউ গাছ দেয়ালের বাইরেরদিকে ঝুঁকে আছে। এই পথকে বলা হয় সৎকারের রাস্তা। এই পথে গির্জার আঙিনায় কবর দেয়ার জন্য মৃতদেহ আনা হয় দীর্ঘদিন থেকে। গির্জার প্রাঙ্গনে প্রচুর বড়ো বড়ো দেবদারু গাছ। লম্বা লম্বা বাহু মেলে দিয়ে কবরগুলোকে ছায়া দেয়।

বড়ো, নিচু পোর্চ হয়ে ভেতরে যেতে হয়। ভারী ওক কাঠের নরম্যান দরজা, লোহার পিঠানো কাজ করা। ভেতরে অন্ধকারের মধ্যে উঁচু উঁচু খিলান মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। সেগুলোর মাঝখানে আছে জালের মতো জানালা, চাঁদের আলোয় সাদা দেখায়। বেদির পুব অংশের জানালার কাচ অত্যন্ত উন্নতমানের, কারণ ভেতরের প্রায় অন্ধকারের মধ্যেও সেগুলোর রং ফুটে থাকে। বেদির দু’ পাশে দু’টো ধূসর মার্বল পাথরের মানুষের মূর্তি আছে, সশস্ত্র এবং নাইটের সম্পূর্ণ বর্ম পরিহিত। নিচু পাথরের স্ল্যাবের ওপর শুয়ে আছে, দু’ হাত বুকের ওপর প্রার্থনার ভঙ্গিতে স্থির। অদ্ভুত বিষয় হলো, ভেতরে যদি সামান্যতম আলোও থাকে, তাহলেও ও দু’টো যে কারও চোখে পড়বে। তাদের নাম হারিয়ে গেছে। তবে স্থানীয়দের কাছে তাদের কাজকর্ম সম্পর্কে শুনেছি। প্রচণ্ডরকমের হিংস্র আর অনিষ্টকর ছিল তারা। সাগরে, মাটিতে লুটপাট আর রাহাজানি করে বেড়াত। এত অপরাধ করেছে তারা, এত জঘন্য সব পাপ করেছে যে, যে বিশাল বাড়িতে তারা থাকত - আমাদের কটেজের কাছের পরিত্যক্ত বাড়িটায়, ঈশ্বরের অভিশাপে একদিন বজ্রপাত হয়ে ধ্বংস হয়ে গেছে। পরে তাদের লুটপাট করে জমানো সোনাদানা দিয়ে উত্তরসুরীরা গির্জার ভেতরে জায়গা কিনে তাদের শেষ বিশ্রামের জন্য এই আয়োজন করেছে। পাথরে তাদের যে বদ, কঠোর চেহারা ফুটে আছে, তাতে কথাগুলো বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়।

সে রাতে প্রাচীন গির্জাটাকে সবচেয়ে সুন্দর লাগছিল সম্ভবত। আমরা দীর্ঘসময় নীলবে বসে ছিলাম। মুগ্ধ চোখে লক্ষ করলাম চারদিকের পবিত্র সৌন্দর্য। কাছে গিয়ে চিরঘুমে আচ্ছন্ন দুই যোদ্ধাকে দেখলাম কিছু সময়, তারপর বেরিয়ে এসে পোর্চের পাথরের সিটে বসে চাঁদের আলোয় ঝলমল করতে থাকা জলাভূমির দিকে চেয়ে থাকলাম। নিঝুম রাতের নীরবতা আর প্রশান্তি অনুভব করলাম মনপ্রাণ দিয়ে।

মিসেস ডরম্যান গ্রাম থেকে ফিরতেই তাকে ডাকলাম বিষয়টা নিয়ে কথা বলার জন্য। “মিসেস ডরম্যান। শুনলাম আপনি নাকি আমাদের কাজ আর করবেন না?”

“মাস শেষ হওয়ার ক’দিন আগে যেতে পারলে খুশি হবো,” স্বভাবসুলভ শান্ত কণ্ঠে বলল মহিলা।

‘আমাদের আচরণে কোনো দোষ পেয়েছেন, মিসেস ডরম্যান?’

“মোটেই না, স্যার! আপনি আর আপনার মিসেস, দু’জনই অনেক দয়ালু। আমি শিওর...”

“তাহলে কেন? আপনার বেতন কী কম দিচ্ছি আমরা?”

“না, স্যার। বেতন যথেষ্টই পাই।”

“তাহলে কেন থাকবেন না?”

“আমার ভাগ্নি অসুস্থ, স্যার। ওকে দেখতে যেতে হবে “

“কিন্তু সে তো আমরা আসার পর থেকেই শুনছি অসুস্থ।”

জবাব নেই। লম্বা, অস্বস্তিকর নীরবতা। আমিই ভাঙলাম। “আরেকটা মাস থেকে যেতে পারেন না?”

“না, স্যার। আমাকে বৃহস্পতিবার যেতেই হবে।”

সেদিন ছিল সোমবার।

“ওয়েল, না বলে পারছি না, স্যার। কথাটা আপনার আগে জানানো উচিত ছিল। এখন নতুন একজন কাজের লোক নিয়োগ করার সময় নেই। ওদিকে আমার স্ত্রীও সংসারের ভারী কাজ করে অভ্যস্ত নন। আগামী সপ্তাহটা থেকে যেতে পারেন না আপনি?”

“আমি তো আগামী সপ্তায় ফিরেই আসব,” মিসেস ডরম্যান বলল।

এইবার বুঝলাম মহিলার দু’-একদিনের ছুটি দরকার। আমরা তাতে খুশিমনেই মত দিতে পারতাম, যদি তার বদলে আর কাউকে পেতাম। “কিন্তু আপনি এই সপ্তাহেই এত ব্যস্ত হয়ে কেন যেতে চাইছেন, সত্যি করে বলুন তো?”

মিসেস ডরম্যান শালটা ভালো করে গায়ে জড়িয়ে নিল, যেন শীত করছে। ওটা সব সময়ই গায়ে দিয়ে থাকে সে। তারপর ইতস্তত কণ্ঠে বলল, “স্যার, সবাই বলে এটা ক্যাথলিকদের সময়কার বাড়ি। বিগ হাউস। এখানে অনেক ঘটনাই ঘটানো হয়েছে।”

মহিলা গলার স্বরেই “ঘটনা”-র খানিকটা হলেও যে আভাস পাওয়া গেল, তা যে কোনো মানুষের রক্ত ঠাণ্ডা করে দিতে যথেষ্ট। ভাগ্য ভালো লরা তখন সেখানে ছিল না। ও খুব ভীতু আর নার্ভাস টাইপের মেয়ে। আমি বুঝলাম মহিলা যে বাড়ির কথা বলছে সেটা আমাদের বর্তমান বাড়িটাই। আর যেভাবে কথাগুলো বলল, তাতে এ বাড়ির ওপর থেকে লরার আগ্রহ মুহূর্তে উবে যেতো।

“আমাকে সব খুলে বলুন, মিসেস ডরম্যান,” আমি বললাম। “আমি জানতে চাই।”

“ওয়েল, স্যার,” গলা কেঁপে গেল মিসেস ডরম্যানের। “আপনি বোধহয় গির্জার বেদির দু’পাশে দেখেছেন, দুটো মানুষের শেপ...”

“আর্মার পরা দুই নাইটের কথা বলছেন?” আমি হেসে জানতে চাইলাম।

“আমি বলতে চাইছি মার্বল পাথরের দুটো মানুষ আকৃতির কথা।”

“দেখেছি।”

“ওরা বলে, স্যার, অল সেইন্টস’ ডে-র আগের রাতে ওরা উঠে বসে। বেদি থেকে নেমে মার্বল পাথরের পা দিয়ে আইলের মধ্যে হাঁটাহাঁটি করে। গির্জার ঘড়িতে এগারোটার ঘণ্টা পড়লে দরজা খুলে বেরিয়ে পড়ে। কবরস্থান হয়ে, সৎকারের রাম্তা ধরে হেঁটে যায়। রাতে বৃষ্টি হলে সকালে মাটিতে ওদের পায়ের ছাপ স্পষ্ট দেখা যায়।”

“হেঁটে কোথায় যায়?”

“নিজেদের পুরনো বাড়িতে, স্যার। সে সময় যদি কেউ সামনে পড়ে ...”

“সামনে পড়লে?”

কিন্তু না। ভাগ্নি অসুস্থ, বৃহস্পতিবার যেতেই হবে, এ ছাড়া ওই বিষয়ে আর একটা শব্দও বের করা গেল না তার মুখ থেকে। বুঝলাম, হ্যালোইনের রাত এড়াতেই পুরনো গল্পের ওপর ভর করে আছে সে।

“আপনি আর যা-ই করুন, স্যার,” মহিলার গলা ঝপ করে খাদে নেমে গেল। “ওই রাতে আগেভাগে দরজা লক করে দেবেন। ঘরেই থাকবেন। আর জানালা-দরজায় ক্রুশ এঁকে রাখবেন।”

“‘ওগুলোকে’ কেউ কখনো দেখেছে?”

“তা বলতে পারব না, স্যার। আমি যা জানি তাই বললাম।”

“গত বছর এই সময় কে থাকত এই বাড়িতে?”

“কেউ না, স্যার। যে মহিলা এটার মালিক, সে কেবল সামার ভ্যাকেশন এখানে কাটাতে আসে। তারপর সময় আসার ঠিক এক মাস আগে লন্ডনে ফিরে যায়। আপনার এবং লেডিকে সমস্যায় ফেলে যেতে হচ্ছে বলে দুঃখিত, স্যার। আমার ভাগ্নি অসুস্থ। বৃহস্পতিবার না গেলেই নয়।”

আমি হয়ত বুঝিয়ে-সুঝিয়ে তার অমূলক ভুলটা ভাঙিয়ে দিতে পারতাম, কিন্তু সে স্থির প্রতিজ্ঞ যাবেই। অনুনয়-বিনয়ে কোনো কাজ হবে না।তাই কিছু বললাম না।লরাকে দু’টো কারণে এ নিয়ে কিছু বলিনি। প্রথমত, আমাদের এত সাধের বাড়ি নিয়ে এসব গাল্প-গল্প চালু আছে জানতে পারলে বেচারী দুশ্চিন্তায় পড়ে যেতে পারে, আর দ্বিতীয়ত, কিছুটা অতিপ্রাকৃত ভাবনা। এটাকে আমার অন্য দশটা কাহিনীর মতো মনে হয়নি, তাই আসল দিনটা পার না হওয়া পর্যন্ত তা নিয়ে মুখ খুলতে চাইনি। খুব দ্রুত মিসেস ডরম্যানের সতর্কবাণী ভুলে জানালার পাশে বসে থাকা লরার স্কেচ আঁকতে বসলাম।

বৃহস্পতিবার সকালে মহিলা চলে গেল। যাওয়ার সময় লরাকে বলে গেল: “খুব বেশি খাটুনি করতে যাবেন না, ম্যা’ম। তাতে কাজ যদি কিছু জমেও যায়, আমি ফিরে এসে করে দেবো।”

বৃহস্পতিবার দিনটা ভালোই কাটল। স্টিক তৈরি আর আলু কাটার ব্যাপারে আশাতীত নৈপুণ্য দেখাল লরা। আর আমি স্বীকার না করে পারছি না যে, ছুরি-কাঁটা চামচ আর প্লেট ধোয়ার বেলায় আমিও কম পারঙ্গমতা দেখাইনি। কখনও স্বপ্নেও ভাবিনি আমি এত ভালো কাজ করতে পারি।

শুক্রবার এলো। এ গল্পের কাহিনী যা নিয়ে, তা সেদিনেই ঘটেছে। আজও মাঝেমধ্যে ভাবি, এসব যদি কেউ আমাকে বলত, আমি বিশ্বাস করতাম কি না। সেদিনের প্রতিটা ঘটনা আমার মগজে গেঁথে আছে, জীবনে কখনও ভুলব না।

সকাল সকাল ঘুম ভাঙল। কিচেনে গিয়ে সবে চুলোয় ধোঁয়া সৃষ্টি করার মতো সাফল্য অর্জন করেছি, এই সময় বউ দৌড়ে এলো। সূর্যের মতো ঝলমলে, অক্টোবরের সকালের মতো মিষ্টি বউ আমার। দু’জনে একসঙ্গে ব্রেকফাস্ট তৈরি করলাম, বেশ মজাই লাগল। বাসন ধোয়া শেষ হতে ঘর ঝাট দেয়া হলো। দিনের বাকিটা কাটালাম নিজেদের বই ঝাড়ামোছা আর শেলফে সাজিয়ে রাখার পিছনে। ডিনার করলাম ঠাণ্ডা স্টিক আর কফি দিয়ে। লরাকে অন্যান্য দিনের তুলনায় বেশি ঝলমলে, হাসিখুশি আর মিষ্টি লাগছিল। বিয়ের পরে সেদিনের মতো এত ভালো ওকে আর কখনও লাগেনি। বিকেলের হাঁটাও খুব উপভোগ করলাম আমরা। আমার মতে সেদিন ছিল আমাদের জীবনের সবচেয়ে সুখের দিন। পরে যখন দেখলাম গাঢ় লালচে মেঘ সিসার মতো ধূসর আকাশের গায়ে ফ্যাকাশে চেহারা পেতে শুরু করেছে, দূরের জলাভূমি থেকে ধোঁয়া পাক খেয়ে ওপরে উঠতে শুরু হয়েছে, তখন হাতে হাত ধরে নীরবে বাসায় ফিরে এলাম।

“তোমাকে বিষণ্ন দেখাচ্ছে, পুসি,” নিজেদের পার্লারে বসে মন্তব্য করলাম আমি।

“ঠিক,” অবাক করে দিয়ে স্বীকার করল লরা। “মন ভালো নেই। অস্বস্তি লাগছে। জ্বর-টর না এলে বাঁচি। বাসায় ফেরার পর থেকে বার তিনেক শীত লেগে উঠেছিল। অথচ সেরকম ঠাণ্ডাও পড়েনি, তাই না?”

“তাইতো!” বলে ভাবলাম, অস্তমিত আলোয় জলাভূমি থেকে ওঠা কুয়াশার কারণে কিছু ঘটেনি নিশ্চয়ই?

লরাও সেরকম ধারণার কথা বলে হঠাৎ প্রশ্ন করে বসল, “তুমি নিজের আশেপাশে অশুভ কিছুর উপস্থিতি টের পেয়েছ কখনো?”

“না,” হেসে বললাম। “আর পেলেও বিশ্বাস করতাম না।”

“আমি কিন্তু করি। যে রাতে আমার বাবা মারা যান, সে রাতে আমি টের পেয়েছি ব্যাপারটা। অথচ তিনি মারা গেছেন স্কটল্যান্ডে।”

আমি কিছু বললাম না।

কিছু সময় আমার হাত ধরে নীরবে আগুনের দিকে চেয়ে থাকল লরা, তারপর স্প্রিংয়ের মতো লাফিয়ে উঠে আমার পিছনে এসে দাঁড়াল। মাথা পিছনদিকে টেনে নিয়ে ঝুঁকে চুমু খেলো আমাকে।

“ব্যস, ভাবটা চলে গেছে,” বলল ও। “এসো, মোমবাতি জ্বালি। পিয়ানো বাজাই কিছু সময়।”

এক-দুই ঘণ্টা মনের আনন্দে পিয়ানো বাজালাম। রাত সাড়ে দশটার দিকে শেষবারের মতো পাইপ টানার তাগিদ অনুভব করলাম ভেতর থেকে। কিন্তু লরা এমন অসহায়ের দৃষ্টিতে তাকাল যাতে বসার রুম তামাকের কড়া গন্ধ আর ধোঁয়ায় ভরিয়ে তুলতে ইচ্ছ হলো না।

“আমি বাইরে গিয়ে পাইপ টেনে আসি,” বললাম আমি।

“আমাকেও নিয়ে চলো।”

“না, সুইটহার্ট, আজ রাতে না। আজ তুমি বেশি টায়ার্ড। আমার বেশি সময় লাগবে না। তুমি বিছানায় যাও।”

আমি ওর কপালে হালকা করে চুমু খেয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিলাম, কিন্তু লরা গলা ধরে ঝুলে থাকল। মিশে যেতে চাইল আমার সঙ্গে। আমি ওর চুলে আঙুল বুলিয়ে দিলাম। “যাও, পুসি। বেশি ক্লান্ত লাগছে তোমাকে।”

হাতের বাঁধন শিথিল করে চাপা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল ও। “বাইরে বেশি সময় থেকো না, জ্যাক।”

“থাকবো না।”

দরজা খুলে বেরিয়ে এলাম, ল্যাচ খোলাই রইল। কী একটা রাত! ভারী মেঘের পাহাড় থেকে থেকে এক দিগন্ত থেকে অন্য দিগন্তে ছুটে যাচ্ছে। সাদা মেঘে তারা ঢাকা পড়ে গেছে। এত মেঘের মধ্যেও চাঁদটা থেকে থেকে ঝিক করে হেসে উঠছে। তার আলো বনের মাথায় পৌঁছালে মনে হচ্ছে যেন নিঃশব্দে, ধীরগতিতে মেঘের সঙ্গে দুলছে। মাটি ছুঁয়ে ভেসে বেড়াচ্ছে এক ধরনের অদ্ভুত, ধূসর আলোর ছটা। ফসলের মাঠেও একটা ছায়া ছায়া ভাব। চাঁদের আলো আর শিশিরের, অথবা হিম আর তারার আলোর মিলনের ফলে ঘটে এরকম।

আমি বাসার সামনে হাঁটাহাঁটি করছি আর প্রকৃতির সুধা পান করছি। চারিদিকে শুনশান নীরবতা। কোথাও কিছু নেই। খরগোশের ছোটাছুটি বা ঘুম ভাঙা পাখির ডাক নেই। বাতাসের তোড়ে আকাশে মেঘের জোর আনাগোনা চললেও তা নিচে নামছে না, ফলে বনের রাস্তায় বিছিয়ে থাকা ঝরা পাতা উড়ছে না। তৃণক্ষেত্রের ওপাশে, অন্ধকার আকাশের বুকে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে থাকা গির্জার কালো চূড়া দেখতে পাচ্ছি পরিষ্কার। আমি পা বাড়ালাম সেদিকে। গত তিন মাসের সুখী জীবনের কথা, আমার বউয়ের কথা, তার সুন্দর দুই চোখের কথা ভাবছি।

গির্জার ঘণ্টাধ্বনি কানে এলো। এগারোটা! বাসায় ফিরব বলে ঘুরলাম, কিন্তু রাত ঠেকিয়ে দিল। এখনই নয়। মনে হলো ঈশ্বরকে আমার ভালোবাসা আর ধন্যবাদ পৌঁছে দিতে আগে গির্জায় যাওয়া প্রয়োজন। সেদিকে পা বাড়ানোর সময় দেখি লরা আগুনের সামনে আধা শোয়া হয়ে চেয়ারে বসা। মুখ দেখতে পাইনি, শুধু মাথা দেখেছি। নিথর। ঘুমিয়ে পড়েছে। যেতে যেতে ভাবলাম, ঈশ্বর বলে কেউ নিশ্চয়ই আছে। ভালো ঈশ্বর। নইলে জীবনে যা পাওয়ার কথা কখনও কল্পনাও করিনি; এত মিষ্টি একটা মেয়ে বউ হিসেবে আমার ভাগ্যে জুটল কী করে?

বনের পাশ দিয়ে ধীরপায়ে হেঁটে যাচ্ছি। খানিক পর একটা শব্দ শুনে থেমে এদিক-সেদিক তাকালাম। শব্দটাও থেমে গেছে। আবার পা বাড়ালাম, এবার আরেক জোড়া পায়ের শব্দ স্পষ্ট কানে এলো। আমার পদক্ষেপের প্রতিধ্বনির মতো। সম্ভবত কোনো চোরা শিকারী, নয়তো কাঠ চোর। এখানে এসব অপরিচিত কিছু নয়। কিন্তু লোকটা যে-ই হোক, শব্দ আরও কম করা উচিত তার। চুরি করতে এসে শব্দ করে অন্যদের জানান দেয়া... আমি বনের ভেতরের পথে পা রাখলাম। টের পেলাম আমার ফেলে আসা পথ ধরে কেউ হেঁটে যাচ্ছে। ভাবলাম, এটা নিশ্চয়ই প্রতিধ্বনি। চাঁদের আলোয় বনটাকে মোহময় লাগছে। বড়ো, মৃত্যু পথযাত্রী ফার্ন গাছের মরা পাতার ফাঁক দিয়ে আলো মাটিতে এসে পড়ছে। আমার চারদিকে গাছের গুঁড়িগুলো গথিক কলামের মতো দাঁড়িয়ে আছে।

দৃশ্যটা গির্জার কথা মনে করিয়ে দিল। সৎকারের রাস্তায় পা রাখলাম, একটু পর কর্পস গেট বা মরদেহ ভেতরে নেয়ার গেট আর কবরস্থানের মধ্যে দিয়ে ঢুকলাম গির্জা প্রাঙ্গনে। আগের রাতে আমি আর লরা যে নিচু পাথরের বেঞ্চে বসে সময় পার করেছি, সেটার সামনে মুহূর্তের জন্য দাঁড়ালাম। খেয়াল করলাম গির্জার দরজা খোলা। কাল আমরাই খোলা রেখে গিয়েছি ভেবে বিরক্তি লাগল। কারণ রোববার ছাড়া অন্য দিন আশপাশের কেউ এদিকে আসে না, আমরা ছাড়া। আমার ভুলেই এক রাত একদিন দরজা খোলা ছিল ওটার। শরতের ভেজা বাতাস ভেতরে ঢুকে প্রাচীন ভবনের ক্ষতি করার অনেক সুযোগ পেয়েছে। ভেতরে ঢুকলাম আমি। অদ্ভুত ব্যাপার যে আইলের অর্ধেকটা পথ অতিক্রম করার পর আচমকা শীত লেগে উঠল - মনে পড়ল আজ সেই দিন! সেই সময়! যখন “... ওই দুটো উঠে বসে। বেদি থেকে নামে... গির্জার ঘড়িতে এগারোটার ঘণ্টা পড়লে দরজা খুলে বেরিয়ে পড়ে...।”

সারা দেহে ভয়ের একটা শিহরণ বয়ে গেল। কী লজ্জার কথা! আমিও ওসব বিশ্বাস করতে শুরু করেছি নাকি? সোজা হেঁটে গেলাম বেদির দিকে। নিজেকে বোঝালাম , প্রথমত আমি এইসব কথিত কিংবদন্তীতে বিশ্বাস করি না, এবং দ্বিতীয়ত, বিষয়টা সত্যি হতে পারে না প্রমাণ করতেই আজ এখানে আসা। এসে ভালোই করেছি। মিসেস ডরম্যান ফিরলে তাকে বলতে পারব কী সব আবোল-তাবোল বিষয় নিয়ে তারা মাথা ঘামায়।

দু’ হাত পকেটে ভরে পায়ে পায়ে বেদির দিকে চললাম। ধূসর, মৃদু আলোয় গির্জার পুবদিকের খালি জায়গাটা অন্যদিনের তুলনায় প্রশস্ত লাগল, খিলানগুলোও বেশি উঁচু মনে হলো। মেঘ ফুঁড়ে চাঁদ বেরিয়ে এসে আমাকে সাহায্য করল তার কারণটা বুঝতে। আঁতকে উঠে থমকে দাঁড়ালাম, বুকটা এমনভাবে ধড়াশ করে উঠল যে আরেকটু হলে হৃৎপিণ্ড লাফ দিয়ে বেরিয়ে পড়তো খাঁচা ছেড়ে। দম আটকে গেছে।

পশ্চিমদিকের জানালা দিয়ে ভেতরে ঢোকা তীর্যক চাঁদের আলোয় স্পষ্ট দেখতে পেলাম বেদি খালি। ও দু’টো নেই।

সত্যিই নেই? নাকি আমি পাগল হয়ে গেলাম? ঝুঁকে পাথরের স্ল্যাবে হাত বোলালাম - মসৃণ আর ঠাণ্ডা মার্বল পাথর! কেউ নিয়ে যায়নি তো ওগুলো? কোন নির্মম রসিকতা নয় তো এসব? পকেটে একটা খবরের কাগজ ছিল কয়েক ভাঁজ করা। সেটাকে দলা পাকিয়ে এক মাথায় আগুন ধরিয়ে দিতে মশালের মতো জ্বলে উঠল। মাথার ওপরে তুলে ধরলাম মশাল। নেই ও দুটো। গির্জায় আমি একা!

প্রবল ত্রাস হৃৎপিণ্ড খাবলে ধরল আমার - ব্যাখ্যার অতীত ত্রাস, বর্ণনার অতীত। হুঁশ ফিরতে খবরের কাগজের মাশাল ফেলে উর্ধ্বশ্বাসে ছুটে বেরিয়ে এলাম গির্জা থেকে। ভেতর থেকে উঠে আসা চিৎকার চাপা দিতে ঠোঁট শক্ত করে কামড়ে ধরে রেখেছি। এক লাফে গির্জার দেয়াল টপকে ফসলের মাঠর মধ্যে দিয়ে কোনাকুনি ছুটলাম বাসার দিকে। কিছু দূর যেতে একটা গাঢ় আকৃতি যেন মাটি ফুঁড়ে উঠে দাঁড়াল আমার সামনে।চেঁচিয়ে বললাম, “সরে যান! সরে যান সামনে থেকে!”

কিন্তু লোকটা নড়ল না। পথ আটকে আমার দুই বাহু চেপে ধরে মুখের কাছে মুখ এনে তাকাল। আমার একমাত্র প্রতিবেশী। আইরিশ ডাক্তার। “আরে, আপনি? এখানে কী?”

“ছাড়ুন আমাকে!” অসহায় রাগে চিৎকার করে উঠলাম। “মার্বল পাথরের সেই দুই মূর্তি... ওরা বেরিয়ে পড়েছে গির্জা থেকে!”

লোকটা শব্দ করে হেসে উঠল। “আই সি! কাল এক ডোজ ওষুধ দেবো, খেলে দেখবেন সব ঠিক হয়ে যাবে। আপনি ইদানীং বেশি বেশি ধূমপান করছেন আর আবোল-তাবোল কেচ্ছা শুনছেন।”

“এইমাত্র নিজচোখে দেখে এলাম স্ল্যাব খালি পড়ে আছে। ও দু’টো নেই!”

“ওয়েল, আমার সাথে বুড়ো পালমারের বাসায় চলুন। তার মেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। হিস্টিরিয়া। ওকে দেখে গির্জায় যাবো খালি স্ল্যাব দেখতে।”

“আপনি যেখানে যেতে চান যান। আমি বাসায় যাবো।”

“রাবিশ, ম্যান!” বললেন ডাক্তার। “আপনি ভেবেছেন আমি যেতে দেবো? আর সারাজীবন মানুষকে বলে বেড়াবেন পাথরকে মানুষে আসল মানুষে রূপান্তরিত হতে দেখেছেন? আর আমি বাকি জীবন আপনাকে কাপুরুষ ভেবে যাবো? নো, স্যার! আমি তা হতে দিতে পারি না।”

নিশিরাত, মানুষের কণ্ঠ এবং ছয় ফুট লম্বা নিরেট এক আইরিশের সংস্পর্শে মনে হলো নিজেকে খুঁজে পেলাম আমি। তার সাথে কাপুরুষ শব্দটা ঠাণ্ডা শাওয়ারের কাজ করল।

“চলুন তাহলে,” হালছাড়া কণ্ঠে বললাম। “মনে হয় ঠিকই বলেছেন আপনি।”

ফিরে এলাম গির্জায়। চারদিকে কবরের নিস্তব্ধতা। ভেতরের পরিবেশে মেটে আর ভেজা ভেজা গন্ধ। ডাক্তার কেলিকে দেশলাইয়ের কাঠি ধরাতে শুনলাম।

“নেই বললেন না তখন? এই তো আছে! নেই মানে? দেখুন, দেখুন! ভালো করে দেখুন!” ডাক্তার বলল হাসি মুখে। “ বলিনি, আপনি হয় বেশি পান করেছেন, নয়তো স্বপ্ন দেখছিলেন “

আমি মহাবেকুবের মতো সামনে তাকিয়ে থাকলাম। সত্যিই যার যার জায়গায় শুয়ে আছে দুই নাইট। লম্বা করে দম নিয়ে ডাক্তারের হাত চেপে ধরলাম। “আপনার প্রতি আজীবন কৃতজ্ঞ থাকব আমি। নিশ্চই আলোর কোনো ট্রিকের জন্য ভুল দেখেছি। অথবা খুব বেশি কাজের চাপ নিয়ে ফেলেছি। পরেরটাই হবে। আমি স্পষ্ট দেখেছি ও দু’টো ছিল না।”

“বুঝতে পারছি,” মাথা দোলাল ডাক্তার। “ব্রেনের ওপর এত চাপ দেয়া ঠিক হচ্ছে না। ওটার দিকেও খেয়াল রাখা উচিত আপনার।’ ডানদিকের বেদিতে শোয়া নাইটের ওপর ঝুঁকে ছিল ডাক্তার। কী মনে হতে আরেকটা কাঠি ধরিয়ে বলে উঠল, “বাই জোভ! এটার কিছু একটা ঘটেছে মনে হয়। হাত ভাঙা দেখছি!”

ঠিকই তো! যদিও আমি নিশ্চিত, আমি আর লরা গতকাল ঘুরে যাওয়ার সময় ওটার হাত অক্ষত ছিল দেখেছি।

“চলুন,” আমি বললাম। “দেরি হলে আমার স্ত্রী উদ্বিগ্ন হয়ে পড়বে।”

“আমার পালমারের বাসায় যাওয়া উচিত ছিল ওর মেয়েকে দেখতে,” ডাক্তার বলল। “যাকগে, রাত বেশি হয়ে গেছে। কাল যাবো। চলুন এবার।”

বাগানের পথ দিয়ে বাসার সামনে আসতেই দেখি সামনের খোলা দরজা দিয়ে প্রচুর আলো আসছে বাইরে। লরা বাইরে কোথাও গেছে নাকি?

পার্লারে পা রাখলাম আমরা। মোমবাতির আলোয় প্রায় সূর্যের মতো হলদেটে উজ্জ্বল আলোয় হাসছে রুমটা। শুধু লম্বা মোমবাতিই নয়, অন্তত ডজনখানেক কাপ মোমবাতিও জ্বলছে রুমের সর্বত্র। আমি জানি লরা নার্ভাস হলে এ কাজ করে। ভয় তাড়ায়। বেচারী! কেন ওকে একা রেখে গেলাম?

চারদিকে নজর বোলালাম। প্রথমে ওকে দেখতে পাইনি। জানালার পাল্লা খোলা। একমুখী বাতাসের চাপে প্রতিটা মোমবাতির শিখা ভেতরদিকে বেঁকে আছে। লরার চেয়ার খালি, কিন্তু রুমাল আর বই মেঝেতে পড়ে আছে। আমি জানালার ওপর চোখ বোলালাম।

ওখানে, জানালার কুলুঙ্গিতে দেখতে পেলাম ওকে। খোলা জানালা দিয়ে ভীত, আতঙ্কিত দৃষ্টিতে বাইরে কাউকে দেখছে। অথচ আমি যাওয়ার সময় বন্ধ ছিল জানালাটা! লরা কী আমাকে দেখার চেষ্টা করছিল? ওর পিছন দিয়ে কেউ ঢুকেছিল রুমে? কার দিকে তাকিয়ে ছিলো লরা?

ওর অর্ধেক দেহ জানালার বাইরে ঝুলে আছে, বাকি অর্ধেক ভেতরে। মাথাটা টেবিলের ওপাশে শূন্যে ঝুলছে, ধূসর চুল ছড়িয়ে আছে কার্পেটে। মুখ খোলা, চোখও খোলা। বড়ো বড়ো চোখে কিছু একটা দেখছে।

এ মুহূর্তে কিছু দেখছে না যদিও।

ডাক্তার ওর দিকে এগোতে যাচ্ছে দেখে আমি ধাক্কা মেরে তাকে সরিয়ে দিয়ে লরাকে কোলে তুলে নিলাম। অনিয়ন্ত্রিত কণ্ঠে চেঁচিয়ে বললাম, ‘আর ভয় নেই, লরা! আমি এসে পড়েছি! এই যে... দেখো...!’

আমার কোলে রক্তমাংসের স্তূপের মতো পড়ে থাকল ও। আমি ওর মাথা ধরে ঝাঁকালাম, চুমুর পর চুমু খেলাম, আদরের যত নাম ছিল সবগুলো ধরে ডাকলাম, যদিও আমার মন প্রথম দর্শন থেকেই বলছিল লরা বেঁচে নেই। ওর দু’ হাত শক্ত মুঠোয় পরিণত হয়ে আছে। এক হাতের মুঠোর মধ্যে কী যেন আছে।

যখন নিশ্চিত হলাম লরা বেঁচে, কোনকিছুতেই এখন আর কিছু আসবে-যাবে না, তখন ওর মুঠো খোলার অনুমতি দিলাম ডাক্তারকে। সে জোর করে মুঠো খুলল।

দেখি একটা ধূসর মার্বল পাথরের তৈরি ভাঙা আঙুল ধরে আছে লরা।

©ইফতেখার আমিন

Address

132/1-A, Ahmedbag 2nd Lane, Sabujbag
Dhaka
1214

Telephone

+8801747673378

Website

Alerts

Be the first to know and let us send you an email when ঊর্মি প্রকাশনী posts news and promotions. Your email address will not be used for any other purpose, and you can unsubscribe at any time.

Share

Category