19/04/2025
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় তৈরি নিজের কার্টুন : ইসলাম কী বলে?
মুফতি আব্দুল্লাহ মাসুম হাফি.
বর্তমান যুগে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) আমাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রকে ছুঁয়ে যাচ্ছে। এর অন্যতম আলোচিত দিক হলো AI দিয়ে নিজের কার্টুন বা ডিজিটাল অবতার তৈরি করা। এখন প্রায়ই দেখা যায়, সোশ্যাল মিডিয়ায় অনেকেই AI-এর বিভিন্ন টুলস (Studio Ghibli, ChatGPT) ব্যবহার করে নিজেদের ছবিকে কার্টুনে রূপান্তর করছেন। এর পর তা শেয়ার করছেন।
এতে সন্দেহ নেই যে, বর্তমান সময়ে উদ্ভাবিত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মানবজীবনের বহুমুখী কাজকে সহজ করে দিয়েছে। তবে একই সাথে এটি নানা দিক থেকে মানবতার জন্য হুমকিও হয়ে উঠছে। যেমন- যুদ্ধের জন্য নির্মিত AI-চালিত ড্রোন বা রোবট ভবিষ্যতে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে মানবজাতির ওপর হুমকি হয়ে উঠতে পারে। এর মাধ্যমে মানুষের পারস্পরিক যোগাযোগের অবনতি হচ্ছে। মানুষ দিন দিন সামাজিকতা হারাচ্ছে এবং ধীরে ধীরে ভার্চুয়াল জগতে ডুবে যাচ্ছে। Bias বা পক্ষপাতিত্ব তৈরি হচ্ছে।
AI মডেল যে তথ্য থেকে শেখে, যদি তা পক্ষপাতদুষ্ট হয়, তা হলে এর ফলাফল সঠিক নাও হতে পারে। চ্যাট জিপিটি, ডিপ সিক প্রভৃতি এআইয়ের ক্ষেত্রে এটি হরহামেশাই ঘটছে। কিছু কিছু AI মডেল এমন জটিল হয়ে উঠেছে যে, এর নির্মাতারাও তাদের আচরণ বুঝতে অক্ষম হয়ে পড়ছেন। বিগত ২০১৮ সালে বিশ্বখ্যাত প্রযুক্তিবিদ ও উদ্যোক্তা (Tesla, SpaceX, X.AI) ইলন মাস্ক (Elon Musk) মন্তব্য করেছেন- ‘AI is far more dangerous than nukes. AI পারমাণবিক অস্ত্রের চেয়েও ভয়ংকর।’ (CNBC Article (March 13, 2018) এ জন্য তিনি এসব নিয়ন্ত্রণের জন্য একটি সুদৃঢ় regulatory body গঠনের প্রস্তাব করেছেন। তা হলে মূলগতভাবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহারে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। এর অকল্যাণ থেকে বেঁচে থাকার চেষ্টা করতে হবে।
দুঃখজনক হলেও সত্য যে, বর্তমানে বিভিন্ন অপ্রয়োজনীয় কাজেও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করা হয়। এ রকম একটি অপ্রয়োজনীয় কাজ হলো- নিজের ছবিকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে কার্টুনে রূপান্তর করা। এ ব্যাপারে প্রথম কথা হলো, ইসলামে মূলগতভাবে অপ্রয়োজনীয় কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখা অছন্দনীয়। এক হাদিসে এসেছে- ইসলামের সৌন্দর্য হলো, নিজেকে অহেতুক কাজ থেকে বিরত রাখা। (জামে তিরমিজি, ২৩১৭)।
দ্বিতীয়, সমকালীন আলেমগণের উল্লেখযোগ্য অংশ প্রাণীর ডিজিটাল ছবি নির্মাণকেও নাজায়েজ মনে করেন। একে হাদিসে নিষিদ্ধ প্রাণীর ছবি তৈরির অন্তর্ভুক্ত মনে করেন। হাঁ, বরেণ্য কিছু আলেম প্রিন্টেড হওয়ার আগ পর্যন্ত একে নিষিদ্ধ ছবি অঙ্কনের মাঝে অন্তর্ভুক্ত করেন না। তবে অপ্রয়োজনে ডিজিটাল ছবি তোলা, অঙ্কন করা যে নিষিদ্ধ এ ব্যাপারে কারও কোনো দ্বিমত নেই। ইবনে মাসঊদ (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি যে, কিয়ামতের দিনে ছবি বা মূর্তি নির্মাতাদের সর্বাধিক কঠিন শাস্তি হবে। (সহিহ বুখারি, ৫৯৫০)।
তৃতীয়, আল্লাহর সৃষ্টি বিকৃত করা নিষিদ্ধ। (সুরা নিসা: ১১৯)। কার্টুনের মাধ্যমে নিজের ছবি কিছুটা হলেও বিকৃত হয়ে যায়।
চতুর্থ, কার্টুনের মাধ্যমে সমাজে বিভ্রান্তি তৈরি হতে পারে। এর মাধ্যমে ‘Real vs Fake’-এর পার্থক্য হ্রাস হয়ে যায়। যা ভবিষ্যতে সাইবার প্রতারণা, মিথ্যা সাক্ষ্য তৈরি করার আশঙ্কা বাড়িয়ে দেয়। AI দিয়ে নিজের কার্টুন বা ডিজিটাল অবতার তৈরি বৈধ নয়। এর থেকে বিরত থাকা উচিত।
এ বিষয়ে কাতারভিত্তিক ওয়েবসাইট ‘ইসলাম ওয়েব’-এর এক ফতোয়ায় বলা হয়েছে, ‘সফটওয়্যার ইত্যাদি ব্যবহার করে ছবিতে কোনো বিকৃতি সাধন করা জায়েজ নয়।’ (www.islamweb.net/ar/fatwa/192513)
AI‘ শিল্প প্রযুক্তির অগ্রগতির প্রতিফলন হলেও এর ব্যবহার নিয়ে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। AI যেন আমাদের সময় নষ্টের কারণ না হয়, নৈতিক, মানসিক ও ধর্মীয় প্রভাব ক্ষুণ্ন না করে। আমাদের উচিত— প্রযুক্তির এমন ব্যবহার করা যা সত্য, ন্যায্যতা এবং ‘ফিতরাহ্’ ও সুস্থ স্বভাবের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। অন্যথায়, এই প্রযুক্তি এক সময় মানবসমাজ ও ইসলামি মূল্যবোধের ওপর হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে।
লেখক: সহকারী মুফতি, জামিয়া শারইয়্যাহ মালিবাগ মাদ্রাসা ও পরিচালক, আইএফএ কনসালট্যান্সি লিমিটেড।