04/02/2025
বিভ্রম ও বাস্তবতা
আমরা যা দেখি, তা সবসময় সত্য নাও হতে পারে। যেমন, আমরা আকাশকে মাথার ওপর দেখি বলেই মনে করি আকাশ ওপরে আর পৃথিবী নিচে। কিন্তু বাস্তবে, "উপরে" বা "নিচে" বলে কিছু নেই—আকাশ চারদিক থেকে পৃথিবীকে ঘিরে রেখেছে।
আমরা অ্যান্টার্কটিকার তীব্র শীতলতাকে অনুভব করতে পারি, অথচ মহাকাশের শূন্যতার তুলনায় সেটি উষ্ণ। আমাদের চোখে সূর্য প্রতিদিন পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করছে বলেই মনে হয়, অথচ বাস্তবে পৃথিবীই সূর্যের চারপাশে ঘুরছে।
আমরা চাঁদকে রাতের আকাশের বৃহত্তম বস্তু হিসেবে দেখি, কিন্তু সৌরজগতে এটি তুলনামূলকভাবে ক্ষুদ্রতম উপগ্রহগুলোর একটি। আমরা লোহাকে কঠিন মনে করি, অথচ বিজ্ঞান বলে, এটি কেবল অসংখ্য ক্ষুদ্র কণার সমষ্টি। এসব কণার মধ্যে শূন্যস্থান এতটাই বিশাল যে, তা একেকটি নক্ষত্রের দূরত্বের মতোই বিস্তৃত। আমরা কঠিন পদার্থ স্পর্শ করি না, বরং বৈদ্যুতিক চুম্বকীয় আকর্ষণ অনুভব করি।
রঙের ক্ষেত্রেও একই বিভ্রম—আলো ছাড়া রঙের অস্তিত্ব নেই। অন্ধ চোখের জন্য রঙের কোনো অর্থ নেই, কারণ রঙ কেবল আলো প্রতিফলনের ফল। আমরা যাকে ভালোবাসার চুম্বন ভাবি, সেটিও মূলত শরীরের হরমোনের খেলা।
ইতিহাসের বিভ্রম
ইতিহাসও ঠিক তেমনই জটিল এবং বিভ্রমে ভরা। ইতিহাস মূলত সেইসব মানুষের গল্প, যারা ক্ষমতার কেন্দ্রে ছিলেন। আফ্রিকান একটি প্রবাদ আছে—"যতদিন হরিণ নিজে ইতিহাস লিখতে না পারবে, ততদিন শিকারীই বিজয়ী হিসেবে বিবেচিত হবে।"
ব্রিটিশ ইতিহাসে লর্ড ক্লাইভ একজন মহানায়ক, উমাইয়া যুগে ইয়াজিদ ছিল বীর, মহারাণী ভিক্টোরিয়া শত জাতির সম্পদ লুট করে গড়ে তুলেছিলেন এক সাম্রাজ্য। কলম্বাসকে আমেরিকার আদিবাসীরা প্রথমে পানিতে ভাসমান একজন মানুষ হিসেবে আবিষ্কার করেছিল, কিন্তু ইতিহাস তাকে "আবিষ্কারক" বানিয়েছে—যদিও বাস্তবে তিনি লুটপাট ও দাসত্বের ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন।
সংবাদপত্রে কেউ বীর হতে পারে, অথচ বাস্তবে সে কাপুরুষ। কেউ প্রেমিকের খ্যাতি পেতে পারে, অথচ সে প্রতারক। সবচেয়ে দানবীর মানুষটিও হতে পারে আত্মীয়-স্বজনের সম্পদ লুটে নেওয়া এক স্বার্থপর। কেউ হয়তো সমাজের চোখে অপরাধী, অথচ প্রকৃত দোষী অন্য কেউ।
সত্য কত কঠিন?
সত্য জানা কঠিন, এবং সঠিক সত্যে পৌঁছানো আরও কঠিন। বাহ্যিকভাবে দেখে সিদ্ধান্তে পৌঁছানো শিশুসুলভ কাজ। চিন্তার ভাষা আর মুখের ভাষা এক নয়—কেউ হয়তো গভীর অনুভূতি লুকিয়ে রেখেছে, যা অনুধাবন করা মহাকাশের কোনো দূরবর্তী তারায় পৌঁছানোর চেয়েও কঠিন।
আমরা কজন নিশ্চিতভাবে বলতে পারি যে, আমরা সত্য জানি? বা আমরা নিজেদেরই পুরোপুরি চিনি?
এই একমাত্র সত্য যে, আমরা সবকিছু জানি না। এমনকি যা শুনি, যা দেখি, সেটাও পুরোপুরি সত্য নাও হতে পারে।
আমাদের এই সীমাবদ্ধতা উপলব্ধি করাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। যদি আমরা বুঝতে পারতাম যে, যা জানি, তা আসলে কিছুই না—তাহলে আমাদের হৃদয়ে আরও দয়া ও ভালোবাসা জাগ্রত হতো। পৃথিবী হয়ে উঠত সহমর্মিতা, ভালোবাসা আর সৌহার্দ্যের এক অনন্য সংগীত।