15/05/2025
https://www.facebook.com/share/p/12JArqCCMCq/?mibextid=wwXIfr
আজকের লেখাটা ওপার বাঙলার সুনীল গঙ্গােপাধ্যায়কে নিয়ে এপার বাঙলার ইমদাদুল হক মিলনকে দিয়ে শুরু করি:
"কলকাতায় সুনীলদাকে নিয়ে অনুষ্ঠান হচ্ছে। মৈত্রী ট্রেন উদ্বোধন উপলক্ষে 'আনন্দ বাজার'পত্রিকার অতিথি হয়ে কলকাতায় গেছি।সেই অনুষ্ঠানে আমাকে আমন্ত্রণ জানালো আমার বন্ধু কবি সুবোধ সরকার। আমি সুনীলদার সম্পর্কে প্রথমেই বললাম,--সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় নামে একজন লেখক লেখেন,একথা আমার বিশ্বাস হয় না।আমার মনে হয়,--সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় নামে কয়েকজন লেখক লেখেন।কারন একজন লেখক যে হাতে 'সন্তু ও কাকাবাবু' লেখেন,সেই লেখক কেমন করে লেখেন 'অর্জুন'।যে লেখক 'আমি কি রকম বেঁচে আছি 'লেখেন,তিনি কি করে লেখেন, 'ছবির দেশে কবিতার দেশে'।আর তার সেই সব কালজয়ী উপন্যাস 'সেই সময়,'পূর্ব -পশ্চিম','প্রথম আলো'।"
'হুমায়ুন বুলবুলের রাফ খাতা'র- সূচনাপত্রে ছোটবেলা থেকে আমার পড়ার নেশার কথাটা লিখেছিলাম।পাড়ার দোকানের ঠোঙা পর্যন্ত পড়তাম,বই হলে তো কথাই ছিল না,যে অভ্যাসটা এখনো বহমান।যান্ত্রিক জীবনের মাত্রাতিরিক্ত ব্যস্ততায় অনেক বই সংগ্রহ করে রেখেছিলাম,পরে পড়বো বলে।আচমকা পেয়ে যাওয়া অফুরন্ত অবসরে একে একে ওগুলো পড়া শুরু করেছি।যতই পড়ছি ততই অবিমিশ্র একটি অনুভব পাচ্ছি, যার অনুসিদ্ধান্ত হচ্ছে এরকম,কিছু বই চোখে দেখলেই চলে ,কিছু বই গিলতে হয় আর গুটিকয় বই চিবিয়ে চিবিয়ে খেয়ে হজম করতে হয়।অর্থাৎ কিছু বইয়ের কিছু কিছু অংশ পড়তে হয়।অন্য কিছু বই পড়তে হয় তবে খুব আগ্রহের সঙ্গে নয় এবং গুটিকয় বই একাগ্রতা ও গভীর মনোযোগের সঙ্গে পরিপুর্নভাবে পড়তে হয়। সুতরাং সবপড়া সমান মনোযোগ দাবী করে এমন না।তবে মানুষের বেলায় যেমন বই এর বেলায়ও তেমনি,অল্পসংখ্যকই মানুষ যেমন মহান ভুমিকা পালন করে বাকী সব হারিয়ে যায় আগমনের মধ্যে,কিছু বইও পড়ার সাথে সাথেই হারিয়ে যায় বিস্মৃতির অতল গর্ভে।
তবে বই পড়ার এবং ন্যুনতম কিছু লেখার এরকম একটা সুযোগ আমার জীবনে আর একবার এসেছিল।ছাত্র রাজনীতির সাথে গভীর সংশ্রবের কারনে আমাকে কয়েকবার কারাগারে থাকতে হয়েছিল। একটি ছিল সুদীর্ঘ,প্রায় দুই বছরের মতো,ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে।এখন যেটি পুরনো জেলখানা। একটি সেলে ছিলাম। সেল হলো জেলের ভিতর আরেকটা জেল।এই সেলে প্রধানত রাজবন্দীদের রাখা হতো অথবা সেই সব আসামীদের যারা ডিভিশন পাওয়ার অধিকারী, কিন্তু অনিবার্য কারনে দেয়া সম্ভব হতো না, তাদের কে সাধারন আসামী বা কয়েদীদের কাছ থেকে পৃথক রাখার জন্য এই সেল ব্যবহৃত হতো। আমার বিল্ডিংটি এক তলা, ৩০টি সেল ছিল,এজন্য এটিকে ৩০ সেল নামে ঢাকা হতো।আবার প্রতি তলায় ৩০টি করে তিনটি ফ্লোরে সর্বমোট ৯০ টি সেল হওয়ার কথা ছিলো বলে বলে এটি ৯০ সেল নামেও পরিচিত ছিলো।
কেইস টেবিল,গেটে দর্শনার্থী সাক্ষাত,নাওয়া-খাওয়া,নামাজ,পেপার পড়া,ক্ষেত্রবিশেষে মেডিকেল,সেলুন, সাপ্তাহিক মেলা-বাজার,চৌকি ইত্যাদিতে যাওয়া,অথবা কোর্ট ডেটে আদালতে শুনানীতে হাজিরা এভাবে প্রাত্যহিক রুটিন কাজের দিনশেষে বিকাল পাঁচটায় সেলের লকআপে ডুকিয়ে ফেললে সকাল পর্যন্ত সময়টা আর কাটতে চাইতো না।তখন মাথায় ঢুকলো বই পড়েতো সময়টার সঠিক সদ্ব্যবহার করতে পারি।যোগাযোগ করলাম জেল লাইব্রেরীয়ানের সাথে।নামটা মনে করতে পারছি না,সবাই মাস্টার সাহেব বলে ডাকেন,যতটুকু স্মরন করতে পারি, তোয়াহা সাহেবের বাংলাদেশ সাম্যবাদী দলের এ মাস্টার সাহেব একটি হত্যা মামলায় যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত একজন কয়েদী। শিক্ষিত বলে সশ্রম কারাদণ্ডে তিনি লাইব্রেরীয়ানের দায়িত্বটি পেয়েছিলেন।আমি সে পর্যন্ত (১৯৯০সাল) বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের উপর রচিত সম্ভবত একান্নটি বই এর একটা তালিকা উনাকে প্রদান করি এবং অনুরোধ করি একটি বই পড়া শেষ হলে ফেরত দেয়ার পর যেন ক্রমিক অনুযায়ী পরবর্তী বইটি আমাকে সরবরাহ করেন।অবশ্য তিনি মহান মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক লাইব্রেরিতে থাকা বইগুলোর তালিকাটি আমাকে পুর্বেই সরবরাহ করেছিলেন,যা থেকে আমি ক্রমবিন্যাসটি করে দিয়েছিলাম। এর পাশাপাশি টুকটাক লেখার জন্য কারা কতৃপক্ষের মাধ্যমে একটা খাতাও অনুমোদন করিয়ে নিয়েছিলাম।কারন জেলকোড অনুযায়ী অনুমোদন ব্যতিরেক এ ধরনের লেখালেখি অবৈধ।যতদূর জানি এখনও এই নিয়মটি সংশোধন হয়নি।আবার আসি মাস্টার সাহের কথায়। তাঁর কাছে আমার অনেক ঋন।তিনি আমাকে অভুতপূর্ব সহযোগীতা করেছিলেন।তাঁর পাঠানো বইগুলো আমাকে সুযোগ করে দিয়েছে মুক্তি আকাঙ্ক্ষী বাঙালী জাতির ধারাবাহিক আন্দোলন সংগ্রামের ইতিহাস জানার মাধ্যমে অতীত-বর্তমানও ভবিষ্যতের মধ্যে আত্মোপলব্দির সেতুবন্ধন রচনার ।জামিনছাড়া একেবারে মামলাশেষে একদিন মুক্তি পেলাম প্রায় দু'বছরের মাথায়।জ্ঞানতৃষ্ণা এতটা প্রবল হয়েছিল যে মনে করছিলাম আস্তে অাস্তে লাইব্রেরির সকল বই পড়ে ফেলবো।কিন্তু ডাক যে চলে এসেছে বেরুবার।এ প্রসঙ্গে আবারও সুনীল গঙোপাধ্যায়:
একবার এক আড্ডায় বিখ্যাত ইতিহাসবিদ নীহার রন্জন রায়ের সঙ্গে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের দেখা।তাঁকে সুনীল প্রশ্ন করলেন," আপনি বাঙালীর ইতিহাস: আদিপর্ব " লিখে আর লিখেননি কেন?"
নীহার রন্জন বললেন," আমি দীর্ঘদিন জেলে ছিলাম,তখন আমার হাতে খুব সময় ছিল,তাই বইটি লিখতে পেরেছিলাম।এখনতো ব্যস্ত।তাই আর লিখতে পারছি না।"এ সময় সুনীল যা বললেন তা শুনে হেসে উঠলো পুরো মজলিশ," আপনাকে তবে আবার জেলে ডোকানো উচিৎ, যাতে করে আপনি বাঙালীর ইতিহাস পুরোটা শেষ করতে পারেন।"
তালিকার শেষে ছিল সুনীলের 'পুর্ব-পশ্চিম' দুই খন্ড।তালিকা করার সময় ভেবেছিলাম মাস্টার সাহেব মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক তালিকায় এই উপন্যাসটি কেন রেখেছেন। সুনীলকে তো জানি কবি হিসাবে।তাঁর অনেক কবিতা ইতোমধ্যে আমার পড়া হয়েছিল।
ভারতের প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে নিয়ে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বিখ্যাত কবিতা আছে"ইন্দিরা গান্ধীর প্রতি"। তার কয়েকটি লাইন এরকম:"ইন্দিরা,তুমি বিমানের জানালায় বসে/গুজরাটের বন্যা দেখতে যেও না,/এ বড় ভয়ংকর খেলা/......ইন্দিরা তখন সেই বন্যার দৃশ্য দেখেও একদিন তোমার মুখ ফস্কে/বেরিয়ে যেতে পারে,বা: কী সুন্দর। '
কিন্তু তাঁর পূর্ব-পশ্চিম উপন্যাসটি পড়ার পর ভিমরি খেলাম।এ কি! অসাধারণ। পড়ছি আর পড়ছি।আরে, এটিতো পড়েছিলাম সেলিনা হোসেনের 'হাঙর নদী গ্রেনেড',আখতারুজ্জামানের 'চিলেকোঠার সেপাইতে', এতো পেয়েছিলাম আনোয়ার পাশার 'রাইফেল রুটি আওরাতে', বা মঈদুল হাসানের মূলধারা '৭১ -এ,অথবা জাহানারা ইমামের 'একাত্তরের দিনগুলি' কিংবা সৈয়দ শামসুল হকের 'নিষিদ্ধ লোবান'-এ।মনে হলো বললে ঠিক হবে না,অনেকটা নিশ্চিতভাবেই বলতে পারি 'পুর্ব-পশ্চিম' লিখতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের উপর লিখা প্রায় সকল বইই সুনীল গঙোপাধ্যায়ের পড়তে হয়েছে। লিখতে গেলে কতো যে পড়তে হয়,এটি তাঁর একটা উদাহরন মাত্র। কোন বিষয়ে লিখার আগে ভাবতে হয়,পড়াশোনা করতে হয়,তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করতে হয়।যাতে কেউ লিখার সঙ্গে দ্বিমত করলেও যুক্তি খণ্ডন করা যায়।
যারা লেখেন তাঁরাই রাইটার।তাঁরাই রাইটার্স ব্লকের সদস্য।এদের মধ্য যারা আমার মতো জাত রাইটার নয়,তাদের নিয়ে একটি রম্য লেখা কোথায় জানি পড়েছিলাম:
কোষ্ঠ কাঠিন্যের সঙ্গে রাইটার্স ব্লকের বড় মিল।এই দুই জিনিষ যার হয়,সে জানে--"মালটা ভেতরই আছে,কিন্তু বের হচ্ছে না।"
কোষ্ঠ ব্লক ছাড়ানোর জন্য "ইউসুফ গুল" সাহেবের ভুষি ভেজানো শরবত কিংবা ঐতিহাসিক শ্রীপুরের বড়ি থাকলেও রাইটার্স ব্লক ছাড়ানোর জন্য সে ধরনের সমাধান নেই।বিনা ডেলিভারিতে বদনা হাতে টয়লেটে বসে থাকা আর বিনা লেখায় কাগজ-কলম হাতে লেখার টেবিলে বসে থাকা সমান কথা।
আমার মতো সৌখিন অথচ আনকোরা লেখকের বেলায় ১০০ পৃষ্ঠা বই পড়লে এক পাতা লেখা যায়।তবুও পড়ছি আর লিখছি এ "হুমায়ুন বুলবুলের রাফ খাতা"-য়।