16/06/2025
আমি যেখানে শুয়ে আছি এটা একটা আগ্নেয়গিরি।
প্রায় মিলিয়ন বছর পূর্বে এটা সমুদ্রের গভীরে লুকায়িত একটি সুপ্ত আগ্নেয়গিরি ছিলো, তারপর একদিন ব্লাস্ট হয়ে বিশাল এক ভুখন্ড সমুদ্রের বুক চিরে ভেসে ওঠে। মাঝে চলে গেছে মিলিয়ন বছর, সময়ের সাথে সাথে অগ্নিশিখা হারিয়েছে আর এটি পরিনত হয়েছে লোহার পাহাড়ে এবং এর পাদদেশে গড়ে উঠেছে জনবসতি। তবে মাঝেই মাঝেই এই পাহাড়ে দাবানলের তান্ডব চলে তাই এর বৃহদাংশই থাকে পোড়া।
যখন আমরা এই পাহাড়ে যাবার জন্য রেজিষ্ট্রেশন করি তখন আমাদেরকে দুইটা ক্লাসের এপয়েন্টমেন্ট দেয় (১টা থিওরি ক্লাস, আরেকটা ভিডিও ক্লাস)। প্রথমে একটু বিরক্তই হলাম কারন আমরা যাবো হাইকিং এ (হাইকিং আর ট্র্যাকিং এর মাঝে কিছু পার্থক্য রয়েছে, হাইকিং তুলনামূলক সহজ পথ) এতে এতো ফরমালিটির কি আছে এসব ভাবতে ভাবতেই গেলাম ক্লাসে। এবং প্রথম ক্লাসটা করেই বুঝে গেলাম এই ক্লাসগুলো কতটা ইম্পোর্টেন্ট ছিলো। তো প্রথম ক্লাসে আমাদের এই পাহাড়ের ইতিহাস, এর উপর গড়ে ওঠা গাছপালা এবং কি কি পশুপাখির মুখোমুখি আমরা হতে পারি আর কিভাবে সেসময় নিজেদেরকে সেইফ করবো এইসব বিষয়ে মোটামুটি একটা ধারণা দেয়া হলো। এরপর ভিডিও ক্লাসটাতে আমাদেরকে এই পাহাড়ে ওঠার পথটা কতটুকু দূর্গম বা কঠিন হতে পারে সে বিষয়ে একটা ধারণা দিলো এবং আবহাওয়া অনুযায়ী কি ধরনের পোশাক, জুতা ও খাবার পানিয় নিতে হবে সেটাও ক্লিয়ার করে দিলো। এরপর দুবারে আমরা দুটো পাহাড় হাইকিং করি প্রথমত ৪ ঘন্টার একটা হাইকিং পরেরবার ৮ ঘন্টার। এর আগে ১ঘন্টার একটা ছোট ট্র্যাক ঘুরে আসতে সাজেস্ট করে তারা, আমরা সেটাও ঘুরে এসেছিলাম। ৮ জনের গ্রুপে ১ জন গাইড, ১জন হোস্ট এবং ১জন জুওলজিস্ট ছিলেন আমাদের সাথে।
এতো কিছু কেনো লিখলাম?
আমি দেশে থাকতেও টুকটাক ঘুরে বেড়াতাম তো একে একে ডালভাত জায়গাগুলো যেমন হিমছড়ি, বারিক্কাটিলা, কংলাক, চন্দ্রনাথ, নাপিত্তাছড়ার পর নীলগিরি , নীলাচল দেখে একটু বান্দরবানের ভিতরে যাবার লোভ লাগলো। আমরা বান্দরবানের সবচেয়ে সহজ ট্রেইল রেমাক্রি, নাফাখুম হয়ে আমিয়াখুম যাবার সিদ্ধান্ত নেই। ওতো ডিটেইলস লিখতে গেলে লিখা অনেক বড় হয়ে যাবে তাই ছোট্ট করে আমার অভিজ্ঞতাটা লিখার চেষ্টা করছি- আমরা ছিলাম প্রায় ১০/১২ জনের একটা গ্রুপ সাথে ১জন অনভিজ্ঞ হোস্ট আর ১জন লোকাল গাইড। তবে আমাদের গ্রুপে একজন ছিলো যে রেগুলারট্র্যাকিং করতো এবং তার অভিজ্ঞতা সেই সময় ভিষণ কাজে লেগেছিলো। আমরা যখন যাচ্ছিলাম মাঝপথে কতজন সেন্সলেস হয়ে পড়েছিলো তাদের সাথে ২/১ জন রয়েছে বাকি টিমমেম্বাররা তাদের ফেলে রেখেই সামনে এগিয়েছে, কতোজন পাথরের উপর পরে গিয়ে মাথা ফাটিয়ে, হাত পা কেটে র* ক্তাত্ব হয়ে এগোচ্ছে কারন কারোই বসে থাকার উপায় নেই, রাত নেমে গেছে যত দ্রুত সম্ভব পাড়ায় যেয়ে উঠতে হবে। এর মাঝে জোঁকের আক্রমণ তো আছেই, প্রায় প্রত্যেককেই জোঁকে ধরেছিলো এরমাঝে আমাদের এক টিম মেম্বার ভাইয়ের পায়ুপথে জোঁক ঢুকে যায়, কখন ঢুকেছে সে নিজেও জানে না, জুমঘরে তার ব্লাড দিয়ে সব মাখামাখি তারপর গাইড সেটা টেনে বের করতে পেরেছে কারন ওটা ব্লাড খেয়ে খেয়ে ফুলে ব্লাস্ট হবার উপক্রম হওয়ায় খুব বেশি ভেতরে যেতে পারেনি। আমরা প্রায় মাঝরাতে যেয়ে দেবতা পাহাড়ের আগে একটা পাড়ায় পৌছাই (পাড়ার নামটা মনে নেই, সেই ২০১৮/১৯ এর ঘটনা, এখন অনেক কিছুই মনে পরছে না)। যাইহোক পরেরদিন আমাদের গন্তব্য আমিয়াখুম, সাতভাইখুম। এই পথের দেবতা পাহাড় যেনো আরেক মরনফাঁদ। আমি আর আমার বন্ধুরা শুধু দোয়া পরেছি আর কানে ধরেছি যে আল্লাহ এই যাত্রায় শুধু প্রাণটা নিয়ে মায়ের বুকে ফিরতে দাও, আর কখনও এই মুখী হবোনা আমরা। জোঁকের আক্রমণ তার উপর হাত পা কেটে ছিলে একনাশ, আর পুরো শরীর যেনো একটা বিষফোঁড়ায় পরিনত হয়েছিলো এত্ত যন্ত্রণাদায়ক ব্যথা যে প্রতিদিন দুইটা করে নাপা খেয়েও কাজ হচ্ছিলো না। ফিরতি পথে দেখেছি কতো জনের পা ভেঙেছে তাদেরকে লোকাল গাইডদের কাঁধে চড়ে ফিরতে হচ্ছে কারন এছাড়া আর কোনো উপায় নেই, আমাদের মতো টাল্টুবাল্টুদের উদ্ধারের জন্য কখনো হেলিকপ্টার যাবেনা। যার কাঁধে চড়ে ফিরছে সে যদি কোনভাবে স্লিপ করে তাহলে দুইটাই ডেড, ভাবতে পারেন কি অবস্থা। যেখানে জীবিত মানুষের চলাটাই এতো কঠিন সেখানে লাশ নিয়ে আসাটা কতো কঠিন হতে পারে ভাবতে পারেন?পুরোটা সময় দোয়া পড়তে পড়তে মচকানো পা নিয়ে বাড়ি ফিরেছিলাম (আলহামদুলিল্লাহ) এরপর আর ওই মুখি হইনি আমি, অনেক পরে অবশ্য আরেক হোস্টের ধোকায় পরে সহজ ভেবে হামহাম ট্র্যাকিং এর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম।
যাই হোক এতো কিছু লিখার উদ্দেশ্য একটাই, আমার প্রিয় ছোট ভাই বোনেরা অল্প বয়সে আমাদের রক্ত গরম থাকে, হুজুগে পরে অনেক কিছুতেই কোনোকিছু না বুঝে, না ভেবেই লাফিয়ে চলতে শুরু করি। তোমাদের কাছে অনুরোধ তোমরা যেকোনো সিদ্ধান্তের আগে মা বাবা কিংবা বড় ভাইবোন বা সেই বিষয়ে অভিজ্ঞতা রয়েছে এমন কারো সাথে আলোচনা করে নিও এতে তোমার সাময়িক মন খারাপ হলেও হয়তো বিশাল কোনো দূর্ঘটনা থেকে বেঁচে যাবে জীবনটা।
ট্রাভেল করো, এডভেঞ্চার করো তবে সবকিছুর আগে নিজেকে ভালোবাসো। লোক দেখানো কিংবা লোক দেখে কোনো কিছু করা থেকে বিরত থেকো।
বান্দরবানে এডভেঞ্চার করতে যেয়ে যারা লাশ হয়ে ফিরলো এখানে অবিবেচক হোস্টের দ্বায় যতটুকু রয়েছে তার চেয়ে বরং দায়টা বেশি তাদের যারা কোনোরকম রিসার্চ, স্টাডি ছাড়াই লাইফরিস্ক রয়েছে এমন জায়গায় হুজুগে পরে চলে গেলো। আর হোস্টদেরকেও অনুরোধ আপনারা বিজনেস করেন তবে মানুষকে পন্য ভাইবেন না, একেকটা মানুষের জীবনের মূল্য আপনার ব্যবসায়ের চাইতে অনেক বেশি।
শেষ কথা বাস্তবতা রিলস, ভিডিও কিংবা ফটোর মতো সহজ নয়, প্রকৃতি সুন্দর বটে তবে সেটা অনেক বেশি ভয়ংকর।
Modhu pie