24/10/2025
গ্রাহামের শেষ সকাল
বৃদ্ধাশ্রমের করিডোরটা সকালবেলায় সবসময়ই নির্জন থাকে। কফির গন্ধ, ওষুধের গন্ধ, আর জীবনের মৃদু শব্দ — যেন একটা আলাদা জগৎ। এই জগতে আমি কাজ করি। প্রতিদিন সকালে নির্দিষ্ট কক্ষে ঢুকে একেকজনকে দেখি, কেউ হাসে, কেউ চুপ করে থাকে, কেউবা শুধু জানালার বাইরে তাকিয়ে থাকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা।
গ্রাহাম হার্ভি — সেই কক্ষের একজন।
১৬০ কেজি ওজনের বিশাল শরীরটা যেন জীবনের এক বোঝা হয়ে উঠেছিল, কিন্তু তার চোখদুটো সবসময় শান্ত। যতবারই তার কাছে গিয়েছি, কখনো রূঢ়ভাবে কথা বলেনি, বরং বলত, ' তুমি নিশ্চয়ই আবার আমাকে হালকা করার চেষ্টা করছো?”
আমি হেসে বলতাম, “আজ কিন্তু তোমাকেই একটু সাহায্য করতে হবে, গ্রাহাম।”
সে হাসত, ভারি গলায় সেই হাসি ছড়িয়ে পড়ত ঘরে।
গ্রাহাম নিজে কিছুই করতে পারত না — উঠতে, বসতে, এমনকি শোয়া থেকে চেয়ারে যাওয়াও অসম্ভব ছিল তার পক্ষে। দু’জন কেয়ারগিভার মিলে মেশিনের সাহায্যে তাকে স্থানান্তর করতে হতো। তবুও সে কখনো বিরক্ত করত না।
আমার সহকর্মীরা অনেকে তার দায়িত্ব নিতে চায় না। কারণ ওজন মানেই পরিশ্রম, ঝুঁকি, ক্লান্তি।
কিন্তু আমার কাছে গ্রাহাম ছিল অন্যরকম।
তার সাথে কাজ করলে মনে হতো, আমি কারও সেবা করছি না — আমি একজন মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছি।
গত সোমবার সকালে আমি ওর সাথে কাটিয়েছিলাম প্রায় পুরো আধা দিন। আমরা কিছুক্ষণ গল্প করেছিলাম, পুরনো সিনেমার কথা, তার তরুণ বয়সের কাজের গল্প। দুপুরে আমি তাকে খাবার খাইয়েছিলাম, তারপর বলেছিলাম,
কাল দেখা হবে, গ্রাহাম।
সে হেসে বলেছিল, ভালো থেকো আবার দেখা হবে।। না তার সাথে আমার আর দেখা হয়নি। আর কোন দিন দেখা হবে না এ পৃথিবীর বুকে।
পরদিন আমার ছুটি ছিল।
বুধবার সকালে কাজে এসে শুনি— সে আর নেই
শব্দটা শুনে মনে হয়েছিল, কেউ বুকের ভেতর থেকে কিছু টেনে নিয়ে গেছে। না, সে আমার আত্মীয় ছিল না, তবুও চোখ ভিজে উঠেছিল। কাজের জায়গায় কান্না দেখানো চলে না, পেশাদার হতে হয়। তাই চুপ করে কাজ চালিয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু অন্তরের ভেতরে কেমন একটা শূন্যতা, এক অদ্ভুত কষ্ট ঘুরপাক খাচ্ছিল সারাদিন। বাথরুমে লুকিয়ে কেঁদেছি। কি এক অদ্ভুত জায়গা যেখানে কাঁদার জন্য আড়ালে যেতে হয়।
সেই কক্ষটায় এখন আর কেউ নেই। বিছানাটা খালি। যন্ত্রগুলো নিস্তব্ধ। মাঝে মাঝে গিয়ে দাঁড়াই ওখানে, যেন আবার শুনতে পাই,
Good morning sam. How are you today?
বাহির থেকে জীবনকে যত শক্ত মনে হোক, আসলে কত ভঙ্গুর!
মানুষ একদিন হঠাৎ থেমে যায়, কিন্তু তার উপস্থিতি থেকে যায় আমাদের স্মৃতিতে, হৃদয়ে।
হয়তো এটাই জীবনের আসল মায়া —
আমরা হারাই, তবুও ভুলতে পারি না।
আর জীবনের এই অম্লান স্বপ্নই আমাদের মানুষ করে রাখে।
ওপার ভালো থেকো আমার বন্ধু।😭😭😭