15/07/2025
ইউভাল নোয়া হারারি’র স্যাপিয়েন্স পাঠ আর শরতচন্দ্র চট্টপাধ্যায়ের উপন্যাস পাঠ দুটোই খুব জরুরী। হারারির স্যাপিয়েন্স পড়লে আমরা মানবজাতির ক্রম-ইতিহাস জানতে পারবো যা আমাদের মধ্যে ধর্মীয় রেষারেষি, জাতীয়তাবাদের ঠুনকো অস্তিত্ব সম্পর্কে সজাগ করে। বিজ্ঞান এই পর্যন্তই আমাদের সাহায্য করতে পারে। বাকীটা করে সাহিত্য। সাহিত্য কখনোই বর্বরতাকে ধারণা করে রচিত হয় না। হলেও তাকে সাহিত্য বলে না। শরতচন্দ্রের নায়িকারা পতিতা বাঈজি হলেও তারা দেবীর মতই একেকজন চরিত্র, তাদের মন আছে, প্রেম আছে, আছে জগতের সকলের প্রতি মমতা। শরতের এই চরিত্র নির্মাণ পাঠককে একটা পতিতার প্রতিও সংবেদনশীলতা এনে দেয়। বিজ্ঞান তো আপনাকে পতিতার প্রতিও সহানুভূতিশীল হতে বলবে না। বিজ্ঞানের কাজ এটা নয়। এমনকি হারারি বা ডকিন্সের বইতে যতখানি মানবিকতার প্রতি পাঠককে জাগ্রত করে তার সবটাই লেখকের নিজস্ব মতামত যা তিনি সমাজ থেকে পেয়েছেন। সেটা কোথা থেকে পেয়েছেন? খুঁজে দেখুন এইসব বিজ্ঞান লেখকরা একেকজন সর্বভূক পাঠক। বিশ্ব সাহিত্য তারা গুলে খেয়েছেন।
এইসব মানবিকতার প্রতি দৃঢ়ভাবে দাঁড়ানোর শিক্ষা সাহিত্য কাব্য থেকে আমরা পেয়েছি। মহাভারতে দ্রৌপদী তার অপমানের জন্য যেভাবে পঞ্চ পান্ডব আর দ্রোণ বিদুরের সমালোচনা করে, তাদের নিরবতাকে কটাক্ষ করে, তখন আমাদের মনে সাহিত্যের এক নিরব নারীবাদ কুসুম আলোর ছটার মত বিরাজ করে দেয়। সর্বপরি মহাকাব্য তার সাহিত্য রস মানুষের শৈল্পিক ক্ষমতা যা অন্য প্রাণী থেকে তাকে আলাদা করে দিয়েছে। এই চর্চার বিশেষ মহাত্ব আছে। শাহ আবদুল করিম বলেছেন, এই পৃথিবীটা একদিন বাউলের হবে। এই আশাবাদ আসলে পৃথিবীতে যুদ্ধ হানাহানি ঘৃণা বিদ্বেষের অবসানের। কারণ বাউল যুদ্ধ করে না। ঘৃণা করে না। জাত মানে না। তাই আমাদের স্টেফিন হকিং যেমন লাগবে, তেমন বাউলও লাগবে। যেসব বিজ্ঞানীদের চিকিত্সা বিজ্ঞানের আবিস্কার আমাদের বাঁচিয়ে রাখছে তারা আমাদের নমস্য। কিন্তু আমরা কেবল চিকিত্সা বিজ্ঞানের বই পড়ে ডাক্তার হলে রোগীর প্রতি সংবেদনশীল হতে পারবো না। ডাক্তার সাহিত্য পাঠক, সংগীত, শিল্পের অনুরাগী হলে অনেক মানবিকতা আশা করা যায়...। ডাক্তার ইঞ্জিনিয়াররা মাদ্রাসার মতই এক বইয়ের পাঠক। এটি খুবই চিন্তার বিষয়...।
জার্মান দার্শনিক ফ্রেডরিখ নিতশে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর বলেছিলেন, ঈশ্বর মৃত। যুদ্ধের ভয়াবহতায় নির্বিকার ঈশ্বর যে মানুষের কাজে লাগে না এটা তারই স্বীকারোক্তি। কিন্তু নিতশের এই কথা মানবজাতি মেনে নিলেও যুদ্ধ যে ক্ষত তাদের হৃদয়ে রেখেছে তার উপশম হয় না। তখন তাদের হাত পাততে হয় এক বাঙালি কবির কাছে। গীতাঞ্জলির অনুবাদ ব্রিটেন, ইতালি, জার্মানি, জাপান, রাশিয়া, আমেরিকা... সমগ্র ইউরোপের ভগ্ন হৃদয়ের মানুষের সান্ত্বনা বয়ে আনে। আজ কেউ কল্পনা করতে পারবে না গীতাঞ্চলি পাশ্চত্যে কী গভীর প্রভাব রেখেছিল। এ জন্যই সাহিত্য দরকার।
না, আমি মনে করি না সাহিত্য জ্ঞান দান বা শিক্ষা দেয়ার উদ্দেশ্যে রচিত হয়। বা কোন নৈতিক শিক্ষার জন্য আমাদের সাহিত্য পড়তে হবে। সাহিত্যিকের কোন কমিটমেন্টও থাকতে নেই। রবীন্দ্রনাথ তো গীতাঞ্জলি যুদ্ধবিধ্বস্থ মানুষদের সান্ত্বনা দেয়ার জন্য লিখেননি। তিনি শিলাইদহের চিলেকোঠায় দিগন্ত বিস্তৃত হলুদ সর্ষে ক্ষেতের সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে, ভগ্ন হৃদয়ের কবি, ব্যক্তি জীবনে একের পর এক মৃত্যু তাঁকে আঘাত করেছিল, সেখান থেকে যে সংগীত সান্ত্বনার মত করে বেজে উঠেছিল সেকথাই লিখেছিলেন। আমাদের পাঠক হৃদয় সেখান থেকেই সান্ত্বনা নিয়েছে...।
এই পৃথিবীটা আরো একটু জটিল হয়ে পড়ে যখন এক বইয়ের পাঠক বেশি হয়ে যায়। একজন পূর্ণাঙ্গ মানুষকে সব পড়তে হয়। বিজ্ঞান, ইতিহাস, দর্শন, সাহিত্য, ধর্ম, পুরাতত্ত্ব, মিথলজি...। নাস্তিকতার সঙ্গে মানবতাবাদ খুবই জরুরী। ম্যাকবেথের নাটকে তিনজন ডাইনি যে ভবিষ্যতবাণী করে সেটাই ফলেছিল ম্যাকবেথের জীবনে। এই অলৌকিকতা, ভূত প্রেত যুক্তিবাদী পাঠককে শেক্সপিয়র সাহিত্য বর্জন করতে বলে না। কারণ ম্যাকবেথ এক মহানুভব রাজাকে হত্যার পর তার হাতের রক্ত মুছতে পৃথিবীর সমস্ত সমুদ্রের জল খরচ করলেও সে রক্ত মুছছিল না। এটিই আমাদের নজর কাড়ে এটি আমাদের বুঝায় নরহত্যা কোন কিছুতে তামাদি হয়ে যায় না। কিংবা হ্যামলেটকে যখন তার বাবা ভূত হয়ে জানিয়ে দিয়ে যায় তাকে কানে বিষ ঢেলে হত্যা করেছে হ্যামরেটের বিমাতা, তখন পাঠক এটাকে কুসংস্কার হিসেবে দেখে না। বরং হ্যামলেট অনুতপ্ত রানীকে যখন বলেন, তোমার হৃদয়ের অন্ধকার অংশটুকু ফেলে দাও আর ভালো অংশটুকু নিয়ে বাঁচো- তখন আমরা জীবনে অনুপ্রেরণা পাই। এটাই সাহিত্য। নিউটনের যেমন আমাদের দরকার, তেমনি মার্কেজ দস্তয়ভস্তি মুরাকামিও দরকার।
আমার তরুণ যুক্তিবাদী বন্ধুদের উদ্দেশ্যে লিখিত।
লেখা -সুষুপ্ত পাঠক
সেপিয়েন্স বাংলা অনুবাদ পেতে নাম+ ঠিকানা + ফোন নাম্বার দিন...