16/05/2025
গল্পের নাম: আলো ফিরে এলো
পর্ব – ৫: **নতুন শহর, নতুন যুদ্ধ**
রায়হানের জীবনে প্রথমবারের মতো সে তার প্রিয় গ্রাম ছেড়ে শহরে পা রাখল। বাস থেকে নামার পর চারদিকের কোলাহল, উঁচু দালান, অপরিচিত মুখ আর ঠান্ডা বাতাস—সবকিছুই তার কাছে অচেনা আর অস্বস্তিকর লাগছিল। মনে হচ্ছিল, যেন কোনো স্বপ্নে এসেছে সে।
তাকে অভ্যর্থনা জানাতে এসেছিলেন শহরের দারুল উলুম মাদ্রাসার এক শিক্ষক, হুজুর মাওলানা সালেহ সাহেব। উনি হালকা হেসে বললেন, “তুমিই রায়হান? গ্রামের সেই ছোট বক্তা? তোমার কথা শুনেছি। ইনশাআল্লাহ এখানে থেকো, শিখো, আর বড় আলেম হওয়া চেষ্টা করো।”
রায়হান মাথা নিচু করে সালাম দিল। তারপর তাকে নিয়ে যাওয়া হলো ছাত্রাবাসে। এক কক্ষে ৮ জন ছাত্র, সবাই রায়হানের থেকে বড় এবং অচেনা। তাদের কেউ কেউ বিরক্ত মুখে তাকালো, কেউ আবার বলল, “নতুন এসেছে?” একজন তো খেঁকিয়ে বলেই দিল, “এতো ছোট ছেলেকে কে পাঠায় মাদ্রাসায়?”
রায়হান চুপচাপ বিছানায় ব্যাগ রাখল। মায়ের কথা মনে পড়ল। গ্রামের নিরিবিলি ঘর, পরিচিত চেহারা, ছোট মসজিদ—সব চোখে ভেসে উঠল। একটা অদ্ভুত কষ্ট বুকের মধ্যে জমে উঠল।
**প্রথম রাত**
রাতের খাবার খুব সাধারণ—একটু ভাত, ডাল আর ঝোল। রায়হান মুখ না খুলেই খেয়ে নিল। কারো সঙ্গে কথা বলার সাহস পেল না। রাতে ঘুমানোর সময় কোরআন তিলাওয়াত করল ধীরে ধীরে। তারপর মাকে মনে করে চোখ বুজল। কিন্তু ঘুম এল না।
হঠাৎ পাশে থাকা এক ছাত্র বলল, “এই শুন! এখানে রাতের বেলা কাঁদা যায় না, বুঝলি? বাড়ি মিস করিস, তাও মুখে আনিস না!”
রায়হান মাথা নাড়ল—না বলেই বোঝালো সে কাঁদেনি। কিন্তু ভেতরের কান্না বুকের মধ্যে জমে রইল।
**সকালের শুরু**
পরদিন ফজরের আজানের আগেই সবাই জেগে উঠল। মাদ্রাসার কঠোর নিয়ম—পাঁচ ওয়াক্ত নামায জামাতসহ, প্রতিদিন হিফজ, আরবি, ফিকহ ও হাদীসের ক্লাস।
রায়হান সকালে অযু করে নামাযে দাঁড়াল। ইমামের কণ্ঠস্বর গভীর ও আবেগপূর্ণ। তাতে কিছুটা প্রশান্তি পেল রায়হান। নামায শেষে সে এক কোনায় বসে কুরআন পড়ল।
মাওলানা সালেহ সাহেব এসে তার পাশে বসলেন। বললেন, “রায়হান, মন খারাপ করিস না। শুরুতে কষ্ট হয়। ধৈর্য ধর। এখানেই তোর ভবিষ্যৎ তৈরি হবে।”
তার কথাগুলো যেন ওষুধের মতো কাজ করল। রায়হান একটু সাহস পেল।
**মাদ্রাসার ক্লাস ও কঠোরতা**
প্রথম ক্লাস হিফজ। হুজুর কড়া গলায় প্রশ্ন করেন, “কালকে যা মুখস্থ করেছিলি, বল!”
অনেকেই আটকে যায়। কাউকে কান ধরে দাঁড় করানো হয়, কাউকে বসতে দেওয়া হয় না।
রায়হান বুঝে যায়—এখানে ভালো করতে হলে শুধু আল্লাহর উপর ভরসা নয়, অনেক পরিশ্রমও করতে হবে।
রাতের বেলা রায়হান খাতা-কলম নিয়ে কুরআনের আয়াত মুখস্থ করে। তবুও কিছু ভুল হয়। পরদিন সেই ভুলের জন্য হুজুরের কাছে বকুনি খায়।
কিছু ছাত্র ঠাট্টা করে, “গ্রামের বক্তা ভুল করে ফেলেছে?”
রায়হানের চোখে জল আসে। কিন্তু সে চুপ থাকে।
**এক বন্ধুর আগমন**
এই কঠিন সময়েই একদিন তার পাশে বসে হাসিমুখে একটি ছেলে বলে, “আমি মারুফ। তুমি নতুন, তাই বুঝি একটু কষ্ট হচ্ছে। আমি তো প্রথমে এক সপ্তাহ কাঁদতেই কাঁদতাম।”
রায়হান অবাক হয়। কেউ এমনভাবে কথা বলল, সহানুভূতির সাথে!
তারপর থেকে মারুফই হয়ে ওঠে রায়হানের সহচর। রাতে একসাথে পড়া, একসাথে নামায, এমনকি খাওয়াও একসাথে। মারুফ তাকে সাহায্য করে আয়াত মুখস্থ করতেও।
মারুফ একদিন বলে, “রায়হান ভাই, আল্লাহ আমাদের কষ্ট দেখেন। আমরা যদি তাঁর জন্য কষ্ট করি, তিনিও আমাদের অনেক কিছু দেন।”
রায়হান মুচকি হাসে। এই কথাগুলো যেন তার হৃদয়ে সাহস যোগায়।
**একটি বিশেষ দিন**
মাদ্রাসায় একদিন ঘোষণা দেওয়া হয়—“পরবর্তী জুমার দিনে ছাত্রদের কুরআন তিলাওয়াত প্রতিযোগিতা হবে। যার কণ্ঠ সুন্দর, সে অংশগ্রহণ করুক।”
মারুফ বলে, “তুমি অংশগ্রহণ করো রায়হান ভাই! তোমার কণ্ঠ অনেক সুন্দর।”
রায়হান দ্বিধায় পড়ে, কিন্তু তারপর মনে পড়ে গ্রামের সেই প্রতিযোগিতার দিন। সে ভাবে, “আল্লাহ আমাকে আগে সাহায্য করেছেন, এবারও করবেন।”
তিন দিন টানা প্রস্তুতি চলে। মারুফ প্রতিদিন তাকে সাহায্য করে উচ্চারণ ঠিক করতে, রাগ ঠিক রাখতে।
শেষ পর্যন্ত প্রতিযোগিতার দিন এলো। বড় মসজিদের মিম্বরে দাঁড়িয়ে, শত শত ছাত্রের সামনে রায়হান তিলাওয়াত শুরু করল:
"وَالضُّحَىٰ * وَاللَّيْلِ إِذَا سَجَىٰ..."
তার কণ্ঠ যেন পুরো মসজিদে এক প্রশান্তির সুর ছড়িয়ে দেয়। সবার মন শান্ত হয়ে আসে।
তিলাওয়াত শেষে মুহূর্তের নীরবতা। তারপর শিক্ষক বললেন, “মাশাআল্লাহ! এ তো কোরআনের সুরের মতো মধুর!”
অনেকেই প্রশংসা করে। কেউ কেউ বলে, “এই ছেলে একদিন অনেক বড় হবে!”
**আত্মবিশ্বাস ও অগ্রগতি**
এই ঘটনাই রায়হানের মনে নতুন আত্মবিশ্বাস এনে দেয়। সে এখন নিয়মিত পড়াশোনা করে, কুরআন তিলাওয়াত করে, কখনো ছাত্রদের হাদীস বোঝায়।
একদিন মাওলানা সালেহ সাহেব এসে বলেন, “তুই প্রথমে কাঁদতিস, আর এখন সবাই তোর কথা শোনে!”
রায়হান মাথা নিচু করে বলে, “সব আল্লাহর রহমত। আমি শুধু চেষ্টা করেছি।”
**মায়ের সাথে চিঠি**
রায়হান এখন মাঝে মাঝে মাকে চিঠি লিখে। এক চিঠিতে সে লেখে:
“মা, আমি প্রথমে কাঁদতাম। কিন্তু এখন বুঝি—আল্লাহ যার সাথে থাকেন, সে একা থাকে না। তুমি আমার জন্য দোয়া করো, আমি যেন শুধু কুরআন মুখস্থ না করি—বরং মানুষের জন্য পথ দেখানোর আলো হতে পারি।”
মা সেই চিঠি পড়ার সময় চোখের পানি ধরে রাখতে পারেন না। গ্রামের ছোট ঘরে বসে শুধু বলেন,
“আল্লাহ, তুই আমার ছেলেকে হিফাজত করো। ও যেন তোমার পথে ঠিক থাকে।”
*উপসংহার*
রায়হানের জীবনের এই অধ্যায় অনেক কঠিন, কিন্তু আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা, মা’র দোয়া আর বন্ধুত্বের হাত ধরে সে এগিয়ে চলেছে। শহরের কোলাহলে থেকেও সে মনে মনে বলছে:
“আমার পথ কষ্টের, কিন্তু লক্ষ্য জান্নাতের। আমি লড়ব, কারণ আল্লাহ আমার সঙ্গে আছেন।”
,,,,,