18/06/2025
এম ভি কালাম খান-১। ফারুক শিপিং লাইন্সের ঢাকা-বরিশাল রুটের তথা বাংলাদেশের লঞ্চ ইতিহাসের সর্বপ্রথম ৪ তলা লঞ্চ এটি। বর্তমানের লঞ্চগুলোতে চতুর্থ তলায় মাস্টার ব্রিজ ও কিছু কেবিন স্থাপন করে ৪ তলা বললেও কালাম খান-১ ছিল পুরোপুরি ৪ তলা বিশিষ্ট নৌযান। ওটার চতুর্থ তলায় মাস্টার ব্রিজ, কেবিন ছাড়াও ডেক যাত্রীদের জন্যও বসার বিস্তর জায়গা ছিল এবং তাদের জন্য অন্যান্য তলার মতই টয়লেটের ব্যবস্থা ছিল। এককথায়, কালাম খান-১ ছিল পরিপূর্ণ চারতলা নৌযান। প্রতি তলায় কতজন ডেকযাত্রী বসবে, তা ঐ তলার গায়ে লেখা থাকতো। যদিও আইনি জটিলতার কারণে ২০১৫ সালে চারতলার বর্ধিত অংশ কেটে ফেলতে হয়েছিল। কেটে ফেললেও বর্তমানের অন্যান্য লঞ্চগুলোর চারতলার চেয়েও (সুন্দরবন-১৬ ব্যতীত) বড় ছিল কালাম খানের চারতলা। খুব সম্ভবত ২০০০ সালের শেষের দিকে সার্ভিসে যুক্ত হয় কালাম খান-১। যেহেতু এটা ছিল প্রথম চারতলা নৌযান, স্বভাবতই কৌতূহলবশত অনেকেই লঞ্চটিকে একনজর দেখতে বা পুরো নৌযানটিকে ঘুরে দেখতে ঘাটে ভিড় করতো। ঘাটের কুলি, টিকেট ব্ল্যাকার ও হকাররা বলতো, ‘বরিশালের বড়োডা/ঢাকার বড়োডা’।
কালাম খান-১ অন্যান্য নৌযানের চাকচিক্যের ভিড়ে কিছুটা সেকেলেরই ছিল বটে। তবুও সাইজে বড় ও চারতলা হওয়ায় অনেকের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু ছিল নৌযানটি। কালাম খান অনেকেরই পছন্দের তালিকায় থাকতো না ঠিক; তবে সবার শেষ ভরসা ছিল এই কালাম খানই। কারণ, সুরভী-সুন্দরবন-পারাবতে যাত্রী পরিপূর্ণ হওয়ার পরে জায়গা বা কেবিন না পাওয়া যাত্রীরা কালাম খানে উঠতো। এজন্য সারা মাস জুড়েই ভ্রমণের জন্য নৌযানটিতে বিস্তর জায়গা পাওয়া যেত। ১ জন যাত্রী ৩ জনের জায়গা দখল করে বিছানার চাদর বিছাতো। সারারাত নিজ বাড়ির মত আরাম আয়েশে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে ভ্রমণ করতো। এজন্য লঞ্চে অনেকেই কেবিন বা জায়গা পাওয়ার ক্ষেত্রে বলতে শুনেছি, ‘আরে কালাম খান আছে না’। আমিও পরিবার নিয়ে যখন ভ্রমণ করতাম, তখন অন্য লঞ্চে জায়গা না পেলে সোজা চলে যেতাম কালাম খানে। ৩ জন মানুষ কিন্তু জায়গা দখল করতাম ৫ জনের। বেশি জায়গা পাওয়ার লোভে একটা সময় নিজের অজান্তেই কালাম খান আমার প্রিয় হয়ে ওঠে। ঈদ, কোরবানি, চরমোনাই মাহফিলের মত ক্রাইসিস মুহূর্তে আমার মত অনেকের কাছে ভরসার প্রতীক হয়ে ওঠে কালাম খান-১।
খুব সকালে সাইরেন বাজিয়ে বরিশাল ঘাটে যখন লঞ্চগুলো ভিড়ত, তখন দূর থেকে আলাদা আলাদা সাইরেন শুনেই বোঝা যেত কোন লঞ্চ ঘাটে এলো। তেমনি কালাম খানের সাইরেনটাও একটু বেশি আলাদা হওয়ায় খুব সহজেই বোঝা যেতো ‘খান সাহেবের গর্জন’।
একমাত্র এই কালাম খানই শীতের সময়ে ডেকযাত্রীদের কষ্টের কথা বিবেচনা করে প্রতি তলার ডেকে আরামদায়ক ফোমের ব্যবস্থা করেছিল। বলা যায়, অন্যান্য সব লঞ্চের চেয়ে এই লঞ্চ মালিকই ডেকযাত্রীদের সুবিধা দিয়েছিলেন বেশি। এছাড়াও এই লঞ্চের ইনসাইড ও রিভার সাইডের প্রতিটি কেবিন শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ছিল। যা এখনো কোন লঞ্চ করেনি।
দীর্ঘ দেড় যুগেরও বেশি সময় নিরবচ্ছিন্ন সার্ভিস দিয়েছে কালাম খান-১। এরপরে বিভিন্ন কোম্পানির অন্যান্য আধুনিক লঞ্চের চোখ ধাঁধানো ডেকোরেশন ও উন্নত যাত্রীসেবার বিপরীতে আস্তে আস্তে পিছিয়ে পড়তে থাকে ‘বরিশালের বড়োডা’ তথা কালাম খান-১, বার্ধক্যের ছাপ পড়ে তার গায়ে। ক্রমেই হারাতে থাকে তার জৌলুস। ধীরে ধীরে রুটে আসতে থাকে দানবাকৃতির নয়নাভিরাম চারতলা বিশিষ্ট নতুন নতুন লঞ্চ। কে কার চেয়ে বেশি সৌন্দর্য করতে পারে, সাইজে বড় করতে পারে, আধুনিক যাত্রীসেবা দিতে পারে- এমন মৌন প্রতিযোগিতা শুরু হয় লঞ্চমালিকদের মধ্যে। তারই ধারাবাহিকতায় রুটে আবির্ভাব হয়; মানামী, সুরভী-৯, কুয়াকাটা-২, এ্যাডভেঞ্চার-৯, কীর্তনখোলা-১০, সুন্দরবন-১০, পারাবত-১২ এর মতো বিলাসবহুল নৌযানের।
এই প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে পুরোপুরি ছিটকে যায় কালাম খান-১। সর্বশেষ ২০১৯ সালের কোরবানির ঈদে সার্ভিস দিতে দেখা গিয়েছিল লঞ্চটিকে। এরই মধ্যে কালাম খানের মালিক মারা যাওয়ায় আর কেউ নজর দেয়নি লঞ্চটির প্রতি। সম্পূর্ণ অবহেলিতভাবে দীর্ঘদিন পড়ে ছিল ফরাশগঞ্জ ঘাটে। বুড়িগঙ্গার কালো, পচা পানিতে থেকে থেকে আস্তে আস্তে জং ধরে দুর্বল হতে থাকে বুড়িগঙ্গা-কীর্তনখোলা দাপিয়ে বেড়ানো একসময়ের কিংবদন্তি কালাম খান-১। এরপরে একদিন শুনলাম, নৌযানটির ইঞ্জিন খুলে বিক্রি করে দিয়েছে। এরপরে মালিকপক্ষ ওটা আর না চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়ে ২ কোটি টাকায় বিক্রি করে দেয়। পরের ঘটনা সবারই জানা। কেটে ফেলা হয়েছে হাজারো মানুষের ভালোবাসার কিংবদন্তিকে।
লঞ্চপ্রেমী ও কালাম খানের ভালোবাসায় আবদ্ধ যাত্রীরা আর শুনবে না ‘খান সাহেবের গর্জন’ খ্যাত সাইরেন। কেউ আর বলবেনা, ঢাকা-বরিশালের বড়োডা। আর কখনও দাপিয়ে বেড়াবেনা বুড়িগঙ্গা-কীর্তনখোলায়। কেউ কোনোদিন বলবেনা ‘আরে, চিন্তা কীসের; আমাগো কালাম খান আছে না’। হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হচ্ছে কালাম খানের জন্য। এভাবে কিংবদন্তির বিদায় মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে হাজারো কালাম খান প্রেমীদের। কালাম খান’রা কখনও মরে না। লঞ্চ ইতিহাসের প্রথম চারতলা কালাম খান; তাই তার মৃত্যু নেই। ইতিহাস সৃষ্টিকারীরা কখনও মরে না। কালাম খান-১ বেঁচে থাকবে লাখো লঞ্চপ্রেমীদের হৃদয়ের গহিনে।
ছবিটি ২০০৯ সালের ১৯ জুলাই ঢাকা সদরঘাট থেকে তোলা হয়েছিল।