Israt Jahan Fariya - ইসরাত জাহান ফারিয়া

  • Home
  • Bangladesh
  • Dhaka
  • Israt Jahan Fariya - ইসরাত জাহান ফারিয়া

Israt Jahan Fariya - ইসরাত জাহান ফারিয়া শব্দ বুননের সূক্ষ্ম জাল; অমীমাংসিত, অসম্পূর্ণ তবুও পূর্ণ!

— ইসরাত জাহান ফারিয়া

 #অশ্রুবন্দী #লেখনীতে - ইসরাত জাহান ফারিয়া #পর্ব-৮৮ইহসানের ধারণা জান তার আশেপাশেই আছে কিন্তু সে-ই কোনো হদিস পাচ্ছে না। চ...
24/10/2025

#অশ্রুবন্দী
#লেখনীতে - ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-৮৮

ইহসানের ধারণা জান তার আশেপাশেই আছে
কিন্তু সে-ই কোনো হদিস পাচ্ছে না। চাওয়া জিনিস না পাওয়ার ক্ষোভে নিশ্চয় ওর মাথা বিগড়ে আছে, যেকোনো সময় একটা অঘটন ঘটিয়ে বসবে। জীবনে দ্বিতীয়বার কখনো প্রস্তাব দিয়ে সে রিজেক্ট হয়েছে, এখন নিশ্চয় চুপ করে বসে থাকবে না। যদিও আজিজ শেখ হাজতে আছেন, চাইলেও সাহায্য করতে পারবেন না ছেলেকে, তারপরেও ইহসানের শঙ্কা কমে না এই চিন্তা করে যে, এলিজটার না কোনো ক্ষতি হয়ে যায় এসবের চক্করে পড়ে। সংসার গোছানোর জন্য নতুন বাসাতেও তাই শেষ পর্যন্ত যাওয়া হলো না তাদের। ইজহান যখন শুনল নতুন বাসার ব্যাপারটা, ফোন করে একদিন বলল, “নতুন বাড়িতে উঠবি না, তো পার্মানেন্টলি ঘরজামাই থেকে যাবি আর মানুষকে যন্ত্রণা দিবি?”

কথাটা বেশ গায়ে লাগল ইহসানের। আগে নীলুফুপি ধরেবেঁধেও একরাত রাখতে পারত না তাকে। পারলেও বেশ কসরত করতে হতো। এখনো সে চায় না এখানে থাকতে। কিন্তু সাধে তো পড়ে আছে না এখানে, কারণবশত আছে! এটাকে কি ঘরজামাই থাকা বলে? দাঁতে দাঁত চেপে তীক্ষ্ণ স্বরে বলল, “তাতে তোর কোনো সমস্যা?”

”আমার কেন কোনো সমস্যা থাকবে? সমস্যা তো এলিজের।”

“ওর সমস্যা তোকে বলেছে?”

গা জ্বালানো হাসি হেসে ইজহান বলল, “সব কথা মুখে বলতে হবে কেন? তুই ওর স্বাধীনতা হরণ করেছিস, আর এটাও বুঝতে পারিসনি? এই সারাদিন আমার বোন, আমার বোন বলে ফেনা তুলিস? আমি তো ওর মুখ দেখেই বুঝে গেছি! তুই নিজে থেকে খাটছিস, অন্যদিকে বেচারি নিজেকে বোঝা ভাবছে!”

ইহসান বিরক্ত হয়ে শক্ত গলায় বলল, “এসব বলতে যদি ফোন করে থাকিস তাহলে ফোন রাখছি, বাই।”

ইজহান ক্যাটক্যাটে স্বরে বলল, “আমি তো কথা
বলছি তোর সঙ্গে, বেয়াদব! বড়ো ভাইয়ের মুখের উপর ফোন কেটে দেওয়ার হুমকি দিতে লজ্জা করে না? টনা-মনার সঙ্গে কথা না বলিয়ে ফোন কেটে দেখ তোর আর টনার কী হাল করি, টুনটুনি কেটে এরপরে তিন টাকায় হাটে বেচব! অবশ্য কেউ কিনবে কিনা কে জানে...”

ইহসান ওর আজেবাজে কথা শুনে ভয়ংকর রেগে গেল। ভীষণ ত্যক্ত হয়ে ধমকানো কণ্ঠে বলল, “তুই আমার চুল করবি, বা* করবি কারণ তুই নিজেই একটা বা*!”

বাচ্চারা নীলু ফুপির কাছে ছিল। ইহসান ভিডিয়ো কলে সংযুক্ত করে ফোনটা ধরিয়ে দিয়ে মেজাজ খারাপ করে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো সৃজাকে খুঁজতে। পেল ওকে রান্নাঘরে। বাচ্চাদের জন্য খিচুড়ি বানানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে, সবজি কাটাকুটি করে সবে হাতটা ধুয়েছে তখনি ইহসান দরজায় থাবা বসিয়ে ওর দৃষ্টি আকর্ষণ করে চাপা স্বরে ক্ষোভ নিয়ে বলল, “আমি তোদের বাড়ির ঘরজামাই? তোর বোন আমার উপর বিরক্ত? আজ তাহলে একটা হেস্তনেস্ত হয়ে যাক! নয়তো এক্ষুনি বেরিয়ে যাব আমি।”

বলে ফুঁসতে লাগল সে। সৃজা আহাম্মকের মতো তাকিয়ে রইল ওর দিকে। কী হয়েছে কিছুই বুঝতে পারল না। বিভ্রান্ত হয়ে বলল, “এসব আজেবাজে
কথা কে বলেছে তোমাকে? খেয়েদেয়ে আর কোনো কাজ নেই? ঘরজামাই হতে যাবে কেন তুমি? তুমি তো আমার আম্মুর মেয়েজামাই, আমার বর!”

বলেই জিভ কাটল। এই লোকটার সামনে এমন কথা স্বীকার করা মানে এই মুহূর্তের হাতের কাজে দেরি করা। কিন্তু ইহসানের কি হয়েছে? এসব উদ্ভট প্রশ্ন করছে কেন? মনের প্রশ্ন মুখে আনতে যাবে তার আগেই খেয়াল করল ইহসান ওর খুব নিকটে এসে দাঁড়িয়েছে, বড়ো বড়ো চোখ করে ওকে দেখছে! সৃজা থতমত খেয়ে বলল, “কী সমস্যা! দূরে দাঁড়াও! রান্নাঘর এটা, ছোঁকছোঁকানি করার জায়গা না।”

বলে আলতো করে ওকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো।আর তাতেই যেন ইহসানের রাগটা বৃদ্ধি পেল। ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলল, “আমি ছোঁকছোঁকানি করি?”

”পুরুষমানুষ মাত্রই ছোঁকছোঁকানি খোর! সুযোগ পেলেই মেয়েমানুষের উপর হামলে পড়ে। তুমিও তার ব্যতিক্রম নও।”

ইহসানের কুঁচকানো ভ্রু জোড়া আরো কুঁচকে গেল, “এইতো দেখিয়ে দিলি আসল রুপ! তোর বাড়ি আছি বলেই তো গলার এত জোর, ধমকে কথা বলছিস! বোঝা হয়ে গেছি আমি তোর কাছে, তাই না? তা সোজাসুজি বলে দিলেই তো পারিস, মনে এক রেখে মুখে আরেক বলে সান্ত্বনা দেওয়ার দরকার কী?
এতো হিপোক্রেসি জানিস তুই, ভাবতেই পারিনি।”

লোকে বলে, মেয়েরা নাকি কথা প্যাঁচায়! তারা এসে দেখে যাক, পুরুষমানুষ কথা প্যাঁচিয়ে কথার লতা বানিয়ে দিতে পারে! সৃজা নির্লিপ্ত গলায় বলল,
“ঘরে যাও, এসে শুনছি কী হয়েছে তোমার!”

অদৃশ্য চপেটাঘাত যেন ইহসানের গালে পড়ল। গম্ভীর কণ্ঠে বলল, “এখন শুনলে কী সমস্যা?”

“আরে বাবা, কাজ করছি তো! বাচ্চাদের মতো জ্বালাচ্ছ কেন তুমি?”

ইহসান আর একটা কথা বলে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলো। সে জ্বালায়? সে বাচ্চাদের মতো জ্বালায়? মেয়েটা মুখের উপর এতবড় কথা বলে দিতে পারল? শ্বশুরবাড়ি পড়ে থাকার এই পরিণাম, কথা তো শুনতেই হবে। সব ঐ কু* বাচ্চা জানের জন্য! সারাটা জীবন জ্বালিয়ে গেল। একে, তাকে জ্বালিয়ে নিজে পালিয়ে বেড়ায়। অবশ্য কতদিন আর পালিয়ে বেড়াবে? একদিন না একদিন তো গর্ত থেকে বেরুতেই হবে। আর সেই দিনটাই হবে ওর জীবনের শেষ দিন। ভাই বলে আর কোনো সহমর্মিতা দেখাবে না সে, একেবারে মেরে দরকার হলে আজীবন জেল খাটবে, ফাঁসির দড়িতে ঝুলবে। প্রয়োজন নেই তার এমন ভাইয়ের, যার জন্য সারাক্ষণ আতঙ্কে থাকতে হয়। এলিজের মতো একটা মেয়েকে নিয়ে, যে খুব ভালো একটা জীবন ডিজার্ভ করে। এলিজের কথা মনে হতেই ইহসান ওর ঘরের দিকে গেল, একবার নক করতেই এলিজের ব্যস্ত গলা শোনা গেল, “ভেতরে এসো ভাইয়া।”

দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে ইহসান প্রশ্ন করল ওকে, “কীভাবে বুঝলি আমিই এলাম?”

গাঁদার ডাল কেটে অন্য একটা টবের মাটিতে পুঁতে দিতে দিতে এলিজ জবাব দিলো, “আপু বা ফুপি দরজায় নক করে না।”

ভীষণ ব্যস্ত দেখাল ওকে। ফুলগাছের প্রতি মেয়েটার এতো টান, টবে ভর্তি বারান্দাটায় দাঁড়ানোর জায়গাটাও মনে হয় আর কিছুদিন পর থাকবে না। ইহসান ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে ওর সঙ্গে কাজে হাত লাগাল। বিমর্ষ গলায় বলতে লাগল, “আমি তোকে সেফটি দিচ্ছি, আর তুই নাকি নিজেকে বোঝা মনে করছিস? এসব ভাবা কি ঠিক লিজ?”

“এসব তোমাকে কে বলল?”

”আগে বল, আমি তোকে একা কোথাও যেতে এলাউ করি না, এতে তুই আমাকে নিয়ে খুব বিরক্ত?”

হাতের কাজ থামিয়ে এলিজ অবাক হয়ে ওর দিকে তাকাল। ইদানীং কোথাও ওকে একা যেতে দেয়া হয় না৷ ইউনিভার্সিটিতে পর্যন্ত ওকে আনা-নেওয়া করে ইহসান। ওর শত অনুরোধ, বারণ কিছুই সে কানে তোলেনি। সারাদিন কাজবাজ নিয়ে এত দৌড় ঝাপের পর ছোটোদের মতো ওকে ট্রিট করাতে, এলিজের অস্বস্তি লাগে, নিজেকে পরনির্ভরশীল মনে হয়। এই নিয়ে ক্লাসমেটরা হাসাহাসি করে, অনেকে করে কটুক্তি। এসবে যদিও এলিজের কিছু যায় আসে না, তবুও এসবের জন্য দায়ী হিসেবে আরসালান শেখের উপর প্রতি মুহূর্তে তার ঘৃণার পারদ বাড়তেই থাকে।
এই একটা লোকের জন্য তাদের জীবনের এমন অস্থিরতা, আর সে কি-না দিব্যি তাকে শায়েরি লিখে পাঠাচ্ছে? বদমাশের বাচ্চা একটা! ভীষণ কুৎসিত একটা গালি দিয়ে সহজ গলায় এলিজ ইহসানকে বলল, “আমি তোমার অসুবিধার কথা ভেবে কয়েকবার মানা করেছি, বিরক্ত বলে নয়। তেমনটা হলে আমি তোমাকেই বলব, অন্য কাউকে নালিশ করতে যাব কোন দুঃখে?”

ইহসান তাও মুখ কালো করে রইল, “আমাকে কী তোদের বাড়ির ঘরজামাই বলে মনে হয়?”

এলিজ কিছুক্ষণ ওর দিকে তাকিয়ে থেকে এরপর হেসে ফেলল, “নিশ্চয় ভাইয়ের থেকে খোঁচা খেয়ে এসব অবান্তর কথাবার্তা বলছ? কিন্তু আমার তো সত্যিকার অর্থে তোমাকে ঘরজামাই নয়, বড়ো ভাই টাইপ ফিল পাচ্ছি। যে পরিবারে সেফটি দিতে পারবে কিনা এসব ভেবে শুকিয়ে এতটুকু হয়ে গেছে।”

ইহসান চট করে ওর দিকে তাকাল৷ নিচু গলায় বলল, “অথচ তোর বোন আমাকে বোঝে না। বলে আমি নাকি বাচ্চা!”

এলিজ হাসিতে ফেটে পড়ল ওর মুখভঙ্গি দেখে, “এই তোমার কী হয়েছে! ইজহান ভাইয়ার ভূত ভর করল নাকি? আসলেই তুমি ইহসান শেখ তো?”

অস্বস্তিতে পড়ে গেল ইহসান। কী বলবে ভেবে না পেয়ে চট করে ওর ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। ঠিক তখনি ওর ফোন বেজে উঠল। তার আইনজীবীর ফোন। কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ল ওর। কলটা রিসিভ করার পর ওপাশ থেকে যা শুনল তাতে মাথাটা বিগড়ে গেল ওর।পুরোটা না শুনেই তাই কল কেটে দিলো। এত এত ব্যর্থতা তার, শুনতে ইচ্ছে করে না। ইহসান চোখের সামনে সবকিছু ঝাপসা দেখতে শুরু করল! ঘরে যাওয়ার তাড়াহুড়োয় সামনে এগুতেই ধাক্কা খেল বেসিনের সাথে। পায়ের আঙুল ফুলে মুহূর্তেই রক্ত জমে গেল। রান্নাঘর থেকে শব্দ শুনে ছুটে এলো সৃজা, ওর কাহিনী দেখে কতক্ষণ থমকে রইল। এরপর ধমকে বলল, “আজ তোমার হলোটা কী? লাফালাফি করছ ছোটোদের মতো, খেয়াল করবে না সামনে কী আছে? বিরক্তিকর একটা লোক!”

একশো একটা কথা শুনিয়ে ওকে এনে শোয়ার ঘরে বসিয়ে বরফ ঠান্ডা পানিতে পা ভিজিয়ে রাখার নির্দেশ দিয়ে আরো কিছুক্ষণ বকাবকি করল সৃজা। ইহসানের অসহ্য লাগছিল ভেতরটা, টেনে এনে ওকে পাশে বসিয়ে ঘাড়ে মুখ গুঁজে বলল, “এত কথা বলছিস কেন? বাচাল কোথাকার!”

সৃজা শান্ত হলো, হয়েই প্রশ্ন করল, “কী হয়েছে এবার বলো তো?”

অনেককিছুই হয়েছে, আরো হওয়া বাকি। তার জীবনে শুরু হওয়া ঝড়ের সবে শুরু, পুরোটাই বাকি। কিন্তু সেসব বলে তো ভড়কে দেয়া যাবে না সৃজাকে, তাই ওর প্রশ্ন নাকচ করে দিয়ে নিচু স্বরে বলল,“ভেতরটা খুব অস্থির লাগছে।”

সৃজা উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞেস করল, “কিছু কী হয়েছে?”

“ভালো লাগছে না। আমি আমার ঘরটাকে খুব মিস করছি।”

ওর উদাসীনতা খেয়াল করে সৃজা বোঝার চেষ্টা করছে ওকে। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে ইতস্তত করে বলল, “বাড়ি যেতে চাইছ?”

“উহু, চাইছি না। তবুও মিস করছি, ওই বাড়িটা, আমার ঘরটা, আর বাকি সবাইকে, আমার কপিক্যাটকেও। ওকে একটা লাথি দিতে পারলে শান্তি লাগতো। আচ্ছা, তোর কি মনে হয় ও আমার ভাই হওয়ার যোগ্য? আমাকে কী বলে জানিস, আমার টুনটুনি নাকি কেটে দেবে! ওর কী ধারণা, আমি ওরটা আস্ত রাখব?”

অবলীলায় কথাটা বলে দেওয়াতে সৃজার কাশি উঠে গেল। ইহসান ওর পিঠে হালকা চাপড় দিতে দিতে বলল, “আমার ছেলে নাকি ওর মেয়েজামাই। অথচ ওর টুনটুনিও কেটে দিতে চায়। মাথায় বুদ্ধিশুদ্ধি থাকলে এমন করার চিন্তাভাবনা করতে পারত না...”

বলে একচোট হেসে ফেলল ইহসান। সৃজা ওর মুখ চেপে ধরে নাক সিঁটকে বলল, “তোমার খুব বুদ্ধি,
তাই এসব জঘন্য কথাবার্তা আমাকে বলছ! সব
ক'টা ভাই পাগল!

অন্যদের সঙ্গে তুলনা করে তাকে পাগল আখ্যা করায় ইহসান ক্ষিপ্ত চোখে চেয়ে রইল ওর দিকে। তবে এক মুহূর্তের জন্য মনে হলো, সৃজা মোটেও ভুল কিছু বলেনি। সে পাগলের বংশধর!

°

আজিজ শেখ বরাবরই নিজেকে নিয়ে প্রচন্ড আত্মবিশ্বাসী ছিলেন৷ তার ধারণা ছিল, খুব সহজেই এ মামলা থেকে বেরিয়ে আসতে পারবেন তিনি। কিন্তু যখন দেখলন প্রমাণ, সাক্ষ্য, প্রত্যক্ষদর্শী সবই প্রতিপক্ষের পক্ষে, আর বিশ্বস্ত কর্মচারীরাই তার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করছে তখন তিনি ক্রোধে উন্মত্ত হলেও প্রচন্ড দিশেহারা বোধ করছিলেন। চারদিক থেকে চেপে আসা পরিস্থিতিতে যখন তিনি এবং তার ব্যক্তিগত আইনজীবি কেসের কূলকিনারা খুঁজে পাচ্ছিলেন না, তখনই ধূর্ত ও নামকরা এক আইনজীবী মোটা অঙ্কের বিনিময়ে কেসটি নিজের হাতে নেন। যিনি আজ পর্যন্ত কোনো কেস হারেননি। যাকে সবাই ডাকে দ্য গেম চেঞ্জার হিসেবে। যিনি আইন বোঝেন কেবল বইয়ের ধারায় নয়, বোঝেন মানুষের ভয়, দুর্বলতায়ও। জেরা করার সময় তার চোখের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি প্রতিপক্ষ সাক্ষীকে এমনভাবে ভড়কে দেয়, ফলে সাক্ষীর সত্যটাকেও মিথ্যা বলে প্রমাণ করতে পারেন তিনি নিপুণভাবে। আজিজ শেখের কেসটা তার জন্য চ্যালেঞ্জিং হলেও প্রথমেই তিনি প্রমাণের উৎসের উপর জোর দিয়ে সিসিটিভি ফুটেজ উপস্থাপন করে দেখান, হত্যার কাজে যেসব অস্ত্র উদ্ধার হয়েছে আজিজ শেখের কারখানার ভেতর থেকে, দেখা যায় তার আগের রাতেই সেসব অস্ত্র কেউ ভেতরে ঢুকিয়েছে আজিজ শেখকে ফাঁসাতে। এমনকি তার সাবেক হিসাবরক্ষকের বক্তব্যকে দুর্বল প্রমাণ করতে ক্রস-এক্সামিনেশনে তার অতীতের আর্থিক অনিয়ম তুলে এনে প্রমাণ করেন, ব্যক্তিগত প্রতিশোধ থেকে সে মিথ্যা সাক্ষ্য দিচ্ছে। জামিন মঞ্জুরের জন্য সর্বশেষ চালটা ছিল সবচেয়ে বেশি কার্যকরী, যেখানে এক অডিও রেকর্ডে প্রতিপক্ষের প্রভাবশালী এক ব্যক্তি কীভাবে আজিজ শেখকে ফাঁসাতে নিজের লোকেদের নির্দেশ দিচ্ছে! সত্যকে ছাপিয়ে মিথ্যা আড়াল গড়ায় পারদর্শী রাশেদ জামান ব্যাপারগুলো এমনভাবে উপস্থাপন করেন যেন পুরো ঘটনাটিই ব্যক্তিগত স্বার্থ ও ব্যবসায়িক ষড়যন্ত্রের ফল, যেখানে আজিজ শেখের নাম জড়ানো হয়েছে ক্ষমতার ভারসাম্য নষ্ট করার জন্য। প্রতিপক্ষের প্রতিটি নথিতে এমন সূক্ষ্ম অসঙ্গতি বের করেন, যার ফলে ধীরে ধীরে অভিযোগের ওজন নড়তে শুরু করে এবং তার তৈরি করা আইনি ব্যাখ্যার মধ্যে ঢুকে পড়ে এবং পুরো কাঠামোটাকেই দুর্বল করে দেয়। এক পর্যায়ে পুরো মামলাটাই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ায় আজিজ শেখকে হাজত থেকে বের করে আনা খুব একটা কঠিন হলো না।

বড় এক বিপদ থেকে বেঁচে এসে আজিজ শেখ যেন নিজের পুরোনো রূপ ফিরে পেলেন, যেন এক অভিজ্ঞ খেলোয়াড় অচেনা মাঠেও নিজের জায়গা খুঁজে নিয়েছে। অবশ্য তার পেছনে কারণও আছে। যারা তার বিরুদ্ধে মুখ খুলেছিল, তিনি ফিরে আসতেই তাদের অনেকেই দেশ ছেড়েছে, কেউ আত্মগোপনে, কেউ সর্বস্ব হারিয়ে ধ্বংস। কিন্তু একজন আছে, যে বিন্দুমাত্র মূল্য দেয়নি তাকে। বরংচ অবজ্ঞার চোখে দেখছে। সে তার নিজের ছেলে, ইহসান শেখ। বাবাকে আইনি জটিলতায় ফাঁসিয়ে নাকানিচুবানি খাওয়ানোর পরেও ইহসানের প্রতিটি আচরণ প্রকাশ্যে জানিয়ে দেয়,
সে আজিজ শেখকে কতটা তুচ্ছ করে দেখে– তাচ্ছিল্যে, করুণায়, ঘৃণায়। আর এটাই আজিজ শেখকে ভিতর থেকে পোড়ায়। যে ছেলেকে এত বড় করেছেন, সেই ছেলের চোখের এই ঘৃণা, অবজ্ঞা আগে কিছু না মনে হলেও এবার আজিজ শেখের অহংকারে কাঁটার মতো বিঁধে আছে।
বড় মুখ করে ছেলেকে বলেছিলেন, “আইনের মারপ্যাঁচ তুমি বোঝো না। আমাকে অপরাধীর কাঠগড়ায় দাঁড় করানো সহজ না আব্বাজান। অহেতুক পেছনে লাগছ!”

অহেতুক লাগেনি, হেতু ছিল বলেই লেগেছিল। কিন্তু এখন সেই কথাগুলো তার বুকের ভেতর প্রতিধ্বনি তুলে তাকে জ্বালিয়ে দিচ্ছে। তাই ছাড়া পাওয়ার উচ্ছ্বাসটাও তিনি ঠিকঠাক অনুভব করতে পারছেন না। বুকের ভেতরটা সূক্ষ্ম, চিনচিনে অনুভূতিতে দলা পাকাচ্ছে বারবার। ক্রোধে তার মস্তিষ্কটাতে কিলবিল করছে অসংখ্য পোকার দল। ছেলে হিসেবে জান, তার কাছে একটা জিনিস চেয়েছে, আর তা স্বাভাবিকভাবে এনে দিতে তিনি ব্যর্থ; এ ব্যাপারটাই তাকে ক্রোধিত করছে!

আজিজ শেখ এখন মনে প্রাণে বিশ্বাস করেন, তার
জীবনের প্রতিটি গোলযোগের কেন্দ্রে একজনই আছে,
সৃজা রেহমান। এই মেয়ের জন্যই ইহসান তার উপর এতোটা হিংস্রতা দেখিয়েছে। তার সংসার আবার উলটপালট, ছেলের চোখে বরাবরের চেয়েও আরো বেশি বিষাক্ত তিনি। তার নাতি-নাতনিকে দূরে ঠেলে রেখেছে এই মেয়ে। এলিজকে জানের করে আনতে গিয়ে যে বাধাটা তিনি প্রথমেই পেয়েছে, তার মূলেই আছে এই সৃজা। শুধুমাত্র ইহসানের সঙ্গিনী বলে এতদিন তিনি বরদাস্ত করেছেন মেয়েটাকে। তবে আর কোনো দয়া নয়। আজিজ শেখ কোনো দয়ার ধার ধারে না। তার নীতি সহজ, যে আঘাত করবে, তাকে ধ্বংস করতে হবে এমনভাবে, যেন সে আর কখনও উঠে দাঁড়াতে না পারে। ইহসান তার সবচেয়ে বড় প্রতিপক্ষ। কিন্তু সেই প্রতিপক্ষই তার প্রাণাধিক প্রিয়।
তাকে আঘাত করা অসম্ভব, কিন্তু শিক্ষা তো দেওয়াই যায়। এমন একটা শিক্ষা, যা ছেলেকে কষ্ট দিলেও তার জীবনের অর্ধেক ঝামেলা মিটিয়ে দেবে। কিন্তু অন্যের জন্য গর্ত খুঁড়তে গেলে যে নিজেরও সেই গর্তে পড়ার সমূহ সম্ভাবনা থাকে, সেই ব্যাপারটা কি তিনি জানেন? কোনো কালেই না!

__________

[ আর দুটো পর্ব, এরপর গোঁজামিল গল্পটার প্রথম পরিচ্ছেদের ইতি। রিচেকবিহীন। ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন আশা করি।]

চলবে...

 #অশ্রুবন্দী #লেখনীতে - ইসরাত জাহান ফারিয়া #পর্ব-৮৭সেদিনের পর এলিজের সঙ্গে সহজভাবে কোনো কথা হয়নি সৃজার। কোথাও না কোথাও ন...
20/10/2025

#অশ্রুবন্দী
#লেখনীতে - ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-৮৭

সেদিনের পর এলিজের সঙ্গে সহজভাবে কোনো কথা হয়নি সৃজার। কোথাও না কোথাও নিজেকেই দোষী মনে হচ্ছিল। ওর কারণেই ওসব বিশ্রী ঘটনার সম্মুখীন হতে হয়েছে এলিজকে। নয়তো আজিজ শেখের সাহসই হতো না এমনতর প্রস্তাব আনার, আর না ইনজান শেখ তার বিশ্রী নজরে বন্দী করতে পারত এলিজকে। ওসব ভেবেই বারবার কুণ্ঠায় ভুগছিল সৃজা। ওর হাবভাব দেখে ইহসানই উপলব্ধি করল ব্যাপারটা। অহেতুক নিজেকে দোষী ভাবার কারণে খানিকটা চটেও গেল সে। বলল, “দিনদিন বোধবুদ্ধি হারাচ্ছিস নাকি? ওসবে তোর কোনো দোষ নেই। থাকলেও সেটা আমার। তুই তো আর জানতিস না কে, কী নজরে কাকে দেখছে, মাথায় কী কুবুদ্ধি নিয়ে ঘুরছে! যাহোক, কুনজরের কুবুদ্ধিদাতাকে যখন আটকানো গেছে, তারও কোনো একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে।”

ধরা পড়ে গিয়ে অপ্রস্তুত হয়ে তাকিয়েছিল ইহসানের দিকে। এলোমেলো স্বরে বলল, “তোমার বাবা হাজতে থাকলেই বা কী, তোমার ভাইয়ের তো হদিস নেই।”

ইহসানের ভ্রু কুঁচকে গেল। মুখাবয়ব শক্ত। মেয়ের কপালে চুমু খেয়ে ওর দিকে ফের তাকাল। বলল, “আজ হদিস নেই, কাল তো পেতেও পারি। ভরসা নেই তোর আমার উপর?”

ভরসা আছে, কিন্তু সেটা স্বীকার করবে না সৃজা। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “তোমার বাবার কী যাবজ্জীবন হবে?”

ইহসান স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল, “জানি না। সব প্রমাণিত হলে ফাঁসিও হতে পারে। কিন্তু আমার কী মনে হয় জানিস, ব্যাপারটা এতো সহজ হবে না। এতদিনেও একটা অপরাধের কথাও তার মুখ দিয়ে কেউ স্বীকার করাতে পারেনি।”

কোনো সন্তান তার বাবাকে নিয়ে অকপটে এমন ভয়ংকর কথা বলতে পারে সৃজা কখনো ভাবেনি। আজিজ শেখের জন্য ওর খুব আফসোস হলো। যে লোকটা ভাবে তার জীবন পরিপূর্ণ, সে সবকিছু পেয়ে গেছে। অথচ তার নিজের সন্তানেরা এই বিষয়ে একটুও চিন্তিত নয়। জীবনকালে কী নিদারুণ তার ব্যর্থতা আর অপচয়। সবটাই বৃথা! ও ইহসানের পাশ ঘেঁষে বসলো, কাঁধে মাথা রেখে বলল, “এইযে, তোমার বাবার সব প্রতিদ্বন্দ্বীরা একসাথে তোমার বাবার পেছনে পড়েছে, তাকে টেনে-হিঁচড়ে নিচে নামানোর চেষ্টা করছে, তার অফিসের কাছের লোকগুলো তোমার বাবার বিরুদ্ধে চলে গেছে; এসবকিছুর
পেছনে কলকাঠি তুমিই নাড়াচ্ছা, তাই না?”

ইহসান চুপ করে রইল। এসব স্বীকারোক্তি দিয়ে নিজেকে মহান কিছু প্রমাণ করতে চায় না সে। কেননা, সে মহান নয়। মহান হলে এসবকিছু করতো না, নিজ হাতে খুন করতো সে আজিজ শেখকে। পারেনি বলেই এসবের দারস্থ হওয়া৷ যদি আইনিভাবে সর্বোচ্চ সাজা দেওয়া যায়; একপ্রকার ডুবে যাওয়া নাবিকের খড়কুটো আঁকড়ে ধরে তীরে উঠার প্রচেষ্টামাত্র!
ব্যর্থতার দীর্ঘশ্বাসটা বুকে চেপে দূরদৃষ্টি মেলে তাকিয়ে রইল রাস্তায় ওপাশে, কী দেখে কে জানে!
সৃজা নিচু স্বরে জানতে চাইল, “তুমি এমন কেন, ইহসান শেখ?”

“কেমন আমি?”

“অদ্ভুত, আমি তোমায় বুঝতে পারি না।”

“কেমন হলে পারতি?”

“বোধহয় স্বার্থপর হলে।”

রোষপূর্ণ কণ্ঠে বলল ইহসান, “আজিজ শেখের চরিত্রটা ধারণ করলে বুঝতিস, তেমনটাই বোঝাতে চাইছিস?”

সৃজা মাথা নাড়াল। তেমন হলেই সে ইহসানকে পুরোপুরি বুঝত কি-না জানে না। তবে রক্তের টানের চেয়ে ভালোবাসার টান বেশি, এমনটা পৃথিবীতে খুব বেশি দেখা যায় না। ও ফিসফিস করে বলল, “আমি বোধহয় কখনোই তোমায় বুঝতে পারব না।”

“আমি চাইও না তুই আমাকে বুঝিস!”

সুন্দর করে হাসলো ইহসান, সৃজার মনে হলো এত চমৎকারভাবে এর আগে কখনো হাসেনি ইহসান। আশ্চর্য! আজওয়াও তার পাপার দিকে তাকিয়ে তাঁর মতোই হাসছে! এতো আদুরে কেন এরা, বাবা-মেয়ে? সৃজা বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারল না, তার যে খুব নজর লেগে যাওয়ার ভয়!

°

শীতের কাঁটা হাওয়া জানালা ঠেলে ঘরে ঢুকছে।জানান দিচ্ছে এবার জাঁকিয়ে ঠান্ডা নেমেছে। কুয়াশাজড়ানো বারান্দার টব ভর্তি টিউবারোজের ঘ্রাণ ভেসে বেড়াচ্ছে ঘরময়। কিন্তু এলিজকে তা মুগ্ধ করতে পারছে না। সে হাতে থাকা ফোনের স্ক্রিনে তীব্র চোখে তাকিয়ে আছে; যেখানে আরসালান শেখ তাকে আবার শায়েরি লিখে পাঠিয়েছে। সঙ্গে একটা বার্তাও। তার ভাষা এমন, ‘আমি চাই যে, তুমি ভালো থাকো, তবে সেটা আমাকে নিয়ে। আমাদের দু'জনের জীবনসূত্র এক, তাই ভদ্র ছেলের মতো, বাপের দ্বারা প্রস্তাব পাঠিয়েছি। অথচ তোমরা প্রস্তাব না মেনে বুড়োটাকে হাজতে ঢুকিয়ে আমার প্রস্তাব প্রত্যাখান করেছ, ব্যাপারটা আমার বিশেষ ভালো লাগেনি। আমাকে জ্বালিয়ে তুমি অন্যকে নিয়ে বাঁচতে চাইবে, সেটা আমায় খুব হেরো হেরো অনুভূতি দেবে। যেটা মোটেও ভালো হবে না, তোমার জন্য!’

প্রতুত্তরে এলিজ লিখল, ‘আপনি একটা হেরো লোকই। যা খারাপ করার করে দিয়েছেন, কী কোনো খারাপ হবে না আমার।’

‘সেল্ফ কনফিডেন্ট খুব বেশি তোমার।’

‘না তো, খুব কম। তাও আপনার মতো লোকের মাথায় কী চলছে সেটা আমি ধরতে পেরে গেছি।’

‘কী চলছে আমার মাথায়?’

‘বুদ্ধিমানেরা অত্যন্ত সেটা সরাসরি আপনাকে বলবে না।’

‘“হাহ… ইউ কন্টিনিউ টু মেজমারাইজ মি… ইন দ্য মোস্ট পিকুলিয়ার ওয়েই।”

ঘৃণায় ফোনটা ছুঁড়ে বিছানায় ফেলে রাখল এলিজ। এরপর আরো অনেক নোটিফিকেশন বাজল, কিন্তু ও সিন করল না একটা ম্যাসেজও৷ একটা সময় জবাব না পেয়ে ওপাশে থাকা ব্যক্তিও থেমে গেল, এলিজও নিজের একটা কাজ সারল। কাজটা সারামাত্রই ওর মনে হলো, মাথাটা একটু হালকা হয়ে এসেছে।
ঐ জঘন্য লোকটা বিগড়ে দিতে পারেনি সম্পূর্ণভাবে ওকে। সে নিজেকে শান্ত করে পুনরায় পড়াশোনায় ডুবে গেল, যে দিনের আলো রাতের আঁধারে ডুবে গেছে তাও টের পেল না।

°
সৃজা ঘরে ঢুকে দেখল এলিজ পড়ার টেবিলে মাথা রেখে অন্যমনস্কভাবে পেন্সিলের দাগ কাটছে ডায়েরিতে। কী নিয়ে এত চিন্তা তা আন্দাজ করে গলা খাকারি দিয়ে এলিজের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলল, “কে, কী চায়, কী বলেছে এসব মাথায় নিস না। ভাবিসও না এসব নিয়ে। সামনে তোর পরীক্ষা, মন দিয়ে পড়। অন্য কোথাও মনোযোগ ঘুরানোর প্রয়োজন নেই।”

এলিজ বোনের উদ্বিগ্ন কণ্ঠ টের পেয়ে মাথা তুলে তাকাল ওর দিকে। স্পষ্ট অবসাদ ফুটে থাকা মুখে দৃষ্টি স্থির রেখে বলল, “কে, কী চায়, না চায় সেটা নিয়ে হয়তো ভাবা যেতো, যদি ভাবনার কোনো জায়গা বা সুযোগ থাকতো। তাদের কুকীর্তি আমার জীবনের অর্ধেক আলো নিভিয়ে দিয়েছে, বাকি অর্ধেকটা জীবনে তাদের কথা গুরুত্ব দিয়ে ভাবা মানে তাদের কাছে নিজেকে ন্যস্ত করা, যেটা আত্মসমর্পণ করার শামিল। আমার দ্বারা এটা সম্ভব বলে মনে হয় তোমার?”

সৃজা গভীর আবেগে বোনকে জড়িয়ে ধরল। মাথায় হাত বুলাল। ছোট্ট এলিজকে আদর দেওয়ার মতো আগলে রাখল নিজের বাহুডোরে। বুকের ভেতর বয়ে চলা শব্দগুলো জানান দিচ্ছিল উদ্বিগ্নতার মাত্রা কতখানি। এলিজ মৃদু গলায় বলল, “যে অন্ধকারে বাস করে, সে কখনো আমাকে নিজের অন্ধকারে টেনে নিতে পারবে না। আমি একটুখানি বাঁচব, সেটাও নিজের মতো করে, নিজের নিয়মে। বিগড়ে যাওয়া কোনো কাপুরুষের বিকৃত চাওয়া, পাওয়ার দাসী হিসেবে নয়। খুব বেশি না, শুধু একটুখানি সাহসী হতে শিখতে হবে।”

“তুই আমার বোন কম, মেয়ে হোস বেশি। মা না হলেও মা হিসেবেই ভাবি, তোর সঙ্গে অন্যায় কিছু হলে নিজেকে কখনো ক্ষমা করতে পারব না আমি।”

ওসব এলিজ ভালোভাবে জানে। আর জানে বলেই কখনো প্রকাশ করতে চায় না, বোঝাতে চায় না আপুকে সে, কতটা দুর্বল! তবে বাস্তবের অন্ধকার বা দুর্বলতা পুরোপুরি দূর হয় না বলে, সেটাকে আঁকড়ে ধরে পড়ে থাকতে হবে সেটারও তো কোনো যৌক্তিকতা নেই। এলিজ শুকনো গলায় সৃজাকে বলল,“ভবিষ্যৎ কী হবে সেটা ভেবে এখনি কুঁকড়ে থাকলে হবে? এইযে তুমি আর ভাইয়া আমাকে সীমাবদ্ধ জীবনে অভ্যস্ত করতে চাইছ, একা ইউনিভার্সিটিতে যেতে দাও না, টিউশনেও না; কতদিন এমন চলবে? সবসময় তো তোমরা আমার পাশে থাকতে পারবে না। একদিন না একদিন তো আমাকে একা পথে চলতেই হবে। তাহলে কেন এতো ভয়?”

“পরেরটা পরে দেখা যাবে। কিন্তু ইনজান শেখ যে এখনি তোর কোনো ক্ষতি করবে না, তার গ্যারান্টি কে দেবে? বাপের মতো আস্ত একটা বদমাইশ সে। উহু! একটুখানি পার্থক্য আছে, গর্তে লুকিয়ে থাকার স্বভাবেই!”

এলিজের প্রতিক্রিয়া হলো অত্যন্ত অদ্ভুত, “বদমাইশ বলছ? অমানুষ না হলে নিশ্চিত তুমি তোমার শ্বশুরের প্রস্তাবটা নিদ্বির্ধায় গ্রহণ করে আমাকে তার গলায় ঝুলিয়ে দিতে। ভাগ্যিস, লোকটা অমানুষ!”

এমন খোলাখুলি কথা আগে কখনো বলেনি এলিজ। সৃজা একটু হকচকিয়ে গেল। পরক্ষণে বিষয়টি ধরতে পেয়ে কিছুটা রাগান্বিত হয়ে পুনরায় বলল,
“ভাগ্যিস অমানুষ!”

“এই যে, আমি তোমার পাশে আছি, তুমি আমার পাশে আছো। এরচেয়ে বড়ো সত্যি আর কী আছে এই মুহূর্তে?”

সৃজা রেহমানের ছোট্ট বোনটি খুব বড়ো হয়ে গেছে!
যে তার চোখ পড়তে পারে, মন বুঝতে পারে, তার ভেতরে চলমান দাপুটে ঝড় এক নিমিষেই থামিয়ে দিতে পারে।

______

এরপর, এরপর, এরপর এন্ডিং!

[রিচেকহীন। ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন আশা করি।]

চলবে...

20/10/2025

#অশ্রুবন্দী লিখলাম, ৫০০ শব্দ।
এখন নিজেকে নিজে ঝাড়া ঝুড়ি দিয়ে আপনাদের জিজ্ঞেস করতে এলাম, ১ হাজার শব্দের পর্ব পড়বেন কী?

#ইসরাত_ফারিয়া

 #অশ্রুবন্দী  #লেখনীতে - ইসরাত জাহান ফারিয়া  #পর্ব-৮৬ [শেষ]কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেল সৃজা। ঠিক কি শুনল ও?এলিজকে লাগবে? ইনজ...
16/10/2025

#অশ্রুবন্দী
#লেখনীতে - ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-৮৬ [শেষ]

কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেল সৃজা। ঠিক কি শুনল ও?
এলিজকে লাগবে? ইনজান শেখের এলিজকে লাগবে? ওর হাতদুটো ইহসানের কলার চেপে ধরল শক্ত করে, “তোমার বাপ-ভাই পেয়েছেটা কী? আমার পরিবারটাকে নিঃশেষ করে দিতে চাইছে কেন ওরা? কী ক্ষতি করেছি আমরা?”

ইহসান নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা না করে হাসলো, “কোনো ক্ষতি করিসনি, কিন্তু ওদের নজরে পড়ে গেছিস। যেমনভাবে পড়েছিল আমার মা! যাকে রক্ষা করার মতো এবিলিটি আমার ছিল না, যার কোনোকিছুই আমার হাতে ছিল না। আজও ছেলে হিসেবে অক্ষম মনে হয় নিজেকে। তাই আমি ওদের এই নোংরামোতে এলিজকে বলি হতে দেব না।”

আজিজ পুত্রের নজরে পড়েছে এলিজ! এ পর্যন্ত
যার দিকে তার নজর গেছে, তার জীবন কি এলোমেলো হয়ে যায়নি? কিন্তু এলিজের জীবন তো বহু আগেই সে এলোমেলো করে দিয়েছে, আর কি বাকি রয়ে গেছে? মেয়েটার সম্মান? সৃজার ভাবতে খুব কষ্ট হয়, আরসালান শেখ ইহসানের ভাই! ওর দু'চোখ ফেটে রক্ত বেরুনোর উপক্রম। ইহসান ওর গালে হাত রাখে। দৃঢ় কণ্ঠে বলে, “বোন হয় আমার, ভাইয়া বলে ডাকে আমাকে; এই সম্বোধনের, এই সম্পর্কের যথাযথ মূল্য দেবে ওর ভাইয়া।”

“না দিতে পারলে?”

“তোদের সবাইকে মুক্তি দিয়ে দেব। আর কখনো এই মুখ দেখাব না৷”

সৃজার উদ্বিগ্নতা বাড়ল, চোখ বুজে পড়ে রইল। ওর ভাবনায় এক পৃথিবী অস্থিরতা। শেষমেশ তার এলিজকে নিয়ে এতো এতো যুদ্ধ? অথচ মেয়েটা খুব সুন্দর একটা জীবন ডিজার্ভ করে। কীভাবে পরিত্রাণ পাবে শকুনিদের হাত থেকে তার বোনটি? পরদিন থেকে অন্য এক সৃজাকে দেখা গেল। যে সারাক্ষণ এলিজের সঙ্গে থাকে, ওর আশেপাশে থাকে। একটুখানি চোখের আড়াল হলেই ওর মনে হয়, এই বুঝি টুপ করে চুরি করে নিয়ে গেল কোনো এক দস্যু!

বোনের অদ্ভুত আচরণের মানে বুঝে না এলিজ। তবে ও অনুভব করতে পারে সৃজার উদ্বিগ্নতা আর ভালোবাসা। যেটা কপটতা বিহীন, নিঃস্বার্থ!

°

হাসপাতালে কাটানো কয়েকটা দিন আজিজ শেখের কেটেছে অপ্রসন্ন পীড়নে, অসহনীয় ক্রোধে। তবে তিনি নিজেকে ঠান্ডা মাথার মানুষ বলে মনে করেন, তাই অযথা হুল্লোড় করলেন না। এখান থেকে বেরিয়ে কী কী করবেন তা মনে মনে গুছিয়ে ফেললেন। ইমরানকে ডেকে কঠিন গলায় জানালেন, ‘কাল দিন পরশু বাদে হাসপাতাল থেকে রিলিজ নিয়ে তিনি নিজের একটা কাজে যাবেন। সে সময় তাকে যাতে অসুস্থতার দোহাই দিয়ে সেঁটে দেওয়া না হয়।’ বাবার কথা শুনে কিছুক্ষণ চুপচাপ তাকিয়ে থেকে মতিগতি বোঝার চেষ্টা করে ব্যর্থ হওয়া ইমরান লম্বা একটা শ্বাস ফেলে বলল, “আমাকে সঙ্গে নেবে না?”

“যে কাজে যাব, সেইটা পারিবারিক। খানিকটা জটিল। একাই সামলাইতে হইব আমার। তোমারে সঙ্গে নিলেও তেমন কিছু লাভ হইব না। সুতরাং, আমারে নিয়া ব্যস্ত হইতে হইব না আব্বা।”

ইমরান অতিষ্ঠ চিত্তে বলল, “তো যাকে সঙ্গে নিলে লাভ হবে, তাকেই নিয়ে যাও!”

আজিজ শেখ ওর দিকে তাকিয়ে কটুক্তিভরা চোখে হাসলেন, “সে-ই কেউ কি আছে? কোনো জীবনে ছিল?”

ইমরান ভাবনায় পড়ে গেল। মিনিটখানিক আঁতিপাঁতি করে ভাবনার দুয়ার ঘুরে আসার পর মনে হলো, তার বাবার পাশে বিশ্বস্ত লোকের বড়োই অভাব। এইযে, ব্যবসায় নিয়ে এতো বড়ো ঝামেলায় পড়েছে, মামলা চলছে, এতে করে অফিসের ম্যানেজার থেকে কর্মচারী; সবক'টাই নিজেদের রুপ দেখিয়ে দিচ্ছে। আজিজ শেখের সব অবৈধ কাজে তাকে সঙ্গ দিয়ে নিজেদের আখের গুছিয়ে নিয়ে তারা এখন আইনি ঝামেলায় আটকে পড়ার ভয়ে সটকে পড়ছে। একদিক থেকে ভালোই হয়েছে, এই দুর্দশায় লোক চেনা হয়েছে। মুখ দিয়ে মধু ঝরতে থাকা পল্টিবাজদের চিহ্নিত করা গেছে। তাকিয়ে দেখল ইমরান, জ্বলজ্বলে চোখে তার দিকে দৃষ্টিতাক করে আছে আজিজ শেখ। বাবার এই দৃষ্টিকে সে শিকারি দৃষ্টির সঙ্গে তুলনা করে। তার মানে আজিজ শেখের কাছে কিছুই অজানা নেই, কোন ফ্যাসাদে নিজের নাম লিখিয়েছেন, তা আন্দাজ করে ফেলেছেন। ইমরান খানিকটা অপ্রস্তুত হলো। আজিজ শেখ ওকে বললেন, “যেসব মামলা করা হইছে তাতে জামিন
তো অসম্ভব! কিন্তু আমি তো জেলহাজতে থাকার মতো মানুষ না, জামিনের ব্যবস্থা তো কইরা রাইতে হইব বাপ। যাও উকিলরে খবর দাও। আমি কথা বলব তার সাথে।”

ইমরান বিষণ্ণ চোখে বাবার দিকে তাকিয়ে রইল,
কিছু বলার মতো শব্দ তার ভান্ডারে খুঁজে পেল না।

°

হসপিটাল থেকে রিলিজ নেওয়ার পর আজিজ শেখ সরাসরি শেখ বাড়িতে ফেরার প্রয়োজনবোধ করলেন না। ইমরানের বারণ স্বত্তেও তিনি রওনা দিলেন শ্যাওড়াপাড়ায়। অগত্যা ইমরানও এলো তার সঙ্গে।দুপুর নাগাদ একনাগাড়ে বাজতে থাকা কলিংবেলের শব্দটাকে ক্ষান্ত দিতে এলিজ যখন দরজা খুলল, মেয়েটার চমকে উঠার কথা থাকলেও কেন যেন একটুও চমকাল না। যেন এটা খুব স্বাভাবিক। জানতোই যেন আজিজ শেখ এখানে আসবে।
তা আজ হোক, তো কাল!

ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করা দূর, সালামটুকু দেওয়ার প্রয়োজনবোধও করেনি। দরজা খুলে কেমন অভদ্র চিত্তের মতো দাঁড়িয়ে আছে। নূন্যতম সহবৎ শিক্ষা নেই। আজিজ শেখ সন্তপর্ণে নিজের রাগটা গিলে নিলেন। মেয়েটা যেমনই হোক না কেন, তাকে সংযত আচরণের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতে হবে। কেননা, এই মেয়েটা জানের। ক্রোধের বশে পড়ে তাকে কিছু বলা যাবে না। মধুর ভাষায় কথা বলতে হবে। সতর্ক করে দিয়েছে তার ছেলেটা তাকে। আর জানের আবার মাথাটা বেশ গরম থাকে সবসময়। অবশ্য থাকবেই বা না কেন? এমির পেট থেকে বেরিয়েছে না, হাজার ডিগ্রি তাপমাত্রা নিয়ে ঘুরতো মেয়েটা। স্পর্শ করলেই কাঁচা মাছ গরম তেলে ফেলানোর মতো ছ্যাঁত করে উঠতো। হুট করে এমিলির কথা মনে পড়ায় আজিজ শেখ একটু থমকালেন। হাসলেন। তার মনে হলো সামনে এলিজা নয়, এমিলি দাঁড়িয়ে আছেন। আর এমির সঙ্গে গলা চড়িয়ে কথা বলাটা মানায় না। তাই তিনি আলতো গলায় বললেন, “কী খবর, কেমন আছো?”

“খবর যদিও ভালো না, তবে আমি ভালো আছি।”

কাষ্ঠ হেসে বললেন আজিজ শেখ, “ভদ্রতা বইলাও একটা কথা আছে, একজনে কুশল জিজ্ঞাসা করলে পাল্টা তারেও ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করতে হয়। অবশ্য পারিবারিক শিক্ষার বড়ো অভাব, বুঝলা! তোমার মা-বাপ বা আমি, কেউই সন্তানদের এইসব সহবৎ শিক্ষা দিতে পারি নাই। কেউ সুযোগ পায় নাই, আবার কেউ তার সদ্ব্যবহার করে নাই। যেমন, আমি।”

অমায়িক হাসলেন আজিজ শেখ, এলিজ নিজেও হাসলো। ভন্ডদের মুখে মধুর রস একটু বেশিই থাকে কি-না, স্বাভাবিক গলায় বলল ও, “ভালো থাকার কথা না আপনার, শুনলাম হাসপাতালে কাটিয়ে এসেছেন বেশ অনেকগুলো দিন। বোধহয় সুস্থ হয়ে গেছেন।”

“হ্যাঁ, ওইখান থেইকাই সোজাসুজি এইখানে আসলাম। শরীর যখন সুস্থ, মন যখন চাঙ্গা তখন আর রোগী সাইজা পইড়া থাকবার দরকার কী? অবশ্য আমার ইমিউনিটি সিস্টেম বেশ ভালো কাজ করে।”

বিড়বিড় করে কী যেন বলে এলিজ, আজিজ শেখ স্পষ্ট বুঝতে পারেন না ওর কথা। তবে আন্দাজ করেন, ভালো কিছু বলেনি মেয়েটি। তবে তিনি খারাপই, ভালো কী বলবে লোকে? আশাও করেন না তিনি। সহাস্যে বলেন, “দরজার বাইরেই দাঁড় করায়া রাখবা নাকি? ভেতরে যাই? বইসা কথাটথা বলি? চা-নাস্তা কিছু বানাইতে পারো তো? কড়া করে এক কাপ লিকার দেওয়া চা নিয়া আসো তো, মা!”

এলিজ মুখে স্বাভাবিক হাসি ধরে রেখে বলল, “আমাকে এসব সম্বোধনে ডাকবেন না, নাম ধরে ডাকুন।”

মুখে স্বাভাবিক হাসি রাখলেও ওর চোখে অন্যরকম রেষ। আজিজ শেখের চক্ষু এড়াতে পারল না। তিনি কয়েকটা মুহূর্ত রুক্ষ চোখে ওর দিকে তাকিয়ে এরপর হেসে ফেললেন। মাথা দুলিয়ে বললেন, “বেশ, বেশ তা-ই সই! তা বাড়িতে মানুষজন আছে তো, আছে না? ডাকো তোমার ফুফু আর বোনরে! কিছু কথা বলার আছে, আমার হাতে বেশি সময় নাই। ঝামেলাটামেলা পিছনে নিয়া ঘুরতাছি। যাও, ডাকো তাদের।”

এলিজ আজিজ শেখের দিকে এবার সরাসরি তাকাল, ওর চোখে সন্দেহ, অল্প বিরক্তি। সেইসঙ্গে অবশ্য কৌতূহলও ভেসে উঠল। নিচু স্বরে বলল,
“কিন্তু ওরা কেউ-ই যে আপনার কথা শুনতে আগ্রহী না, ইনফেক্ট আপনার মুখদর্শনও করতে চায় না!”

ইমরান বাবার পেছনে দাঁড়িয়েছিল, সে হাসফাস করছে। ভাবেনি তার বাবা এখানে চলে আসবে। আবার কোন ঝামেলা কর‍্তে এসেছে, কে জানে! একবার যখন চলে এসেছেই, একরোখা স্বভাবের বাবাকে আটকানোর সাধ্যি নেই ওর। নিজেকে অসহায় লাগছিল কেন জানি। এদিকে মুখের উপর এলিজের বলে দেওয়া তিক্ত সত্য কথাগুলো শুনে শরীরের হাড়-মাংস কিলবিল করতে লাগল, চোয়াল কাঁপতে লাগল আজিজ শেখের। তবুও যে কাজে এসেছেন, সেটা সম্পন্ন করতে হবে ভেবেই নিজেকে সংযত করলেন, যা তার স্বভাবের বিপরীত বৈশিষ্ট্য। কপট বিরক্তি দেখিয়ে বললেন, “বাড়ি বয়ে আলাপ পাড়তে আসছি, আগ্রহী না হইলেও শুনতে হইব আমার কথাগুলা। অবশ্য না শুনলেও আমার কিছু যায়-আসবে না। এইটা একটা ফর্মালিটি মাত্র! তবে পরবর্তীতে এই ফর্মালিটি পালন করি নাই বইলা কেউ যদি আমার দিকে আঙ্গুল তুলে, সেটা কিন্তু মেনে নিব না। দোষ না কইরা দোষী হিসেবে সাব্যস্ত হইলে আমার আবার মাথা ঠিক থাকে না।”

গলা নামিয়ে শেষোক্ত কথাটা বললেন তিনি। এলিজ সূক্ষ্ম চোখে এই লোকটার উদ্দেশ্যে বোঝার চেষ্টা করল। এই অহংকারী, আত্মকেন্দ্রিক, উন্মাদ লোকটা কেন এসেছে এখানে? কী এমন আলাপ থাকতে পারে এর পেছনে? অযাচিত লোকটাকে মূল্যবান সময় দেওয়া কী উচিৎ হবে, যেটা সে ডিজার্ভ করে না? সেকেন্ড খানিক সময় নিলো এলিজ, এরপর দরজা থেকে সরে দাঁড়িয়ে নাছোড়বান্দা আজিজ শেখ আর ইমরানকে ভেতরে ঢুকতে দিলো। আজিজ শেখকে দেখে মনে হলো, তিনি বেশ খুশি হয়েছেন ওর আচরণে। তর্কে জিতে গেলে অবশ্য মানুষ খুশিই হয়।

°

নীলু ফুপি যোহরের নামাজ শেষ করে মাত্র বালিশে মাথা লাগিয়েছেন, একটু শুয়ে নেবেন বলে। কিন্তু তা আর হলো না। এলিজের ডাক পড়ায় ধরফড়িয়ে উঠলেন তিনি। ফুপিকে এমন অস্থির হতে দেখে এলিজা বলল, “প্যানিক করো না। ধীরেসুস্থে উঠো। বসার ঘরে একজন অপেক্ষা করছে তোমাদের জন্য। তুমি এসো, আপুকে ডাকছি আমি।”

এই ভরদুপুরে, খাওয়ার সময়ে কে এলো আবার?
নীলু ফুপি ঠিক বুঝলেন না। ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলেন, “কে এসেছে রে?”

এলিজ রহস্যময় হেসে বলল, “তোমাদের এক অনাকাঙ্খিত মেহমান।”

বলে পর্দা উড়িয়ে চলে গেল মেয়েটা। নীলু ফুপি থমকে বসে রইলেন। মেয়েটার কথার আগামাথা কিছুই বুঝলেন না। দীর্ঘশ্বাস ফেলে তিনি নিজেকে গুছাতে লাগলেন। কে এসেছে দেখতে হবে, তেমন কেউ হলে আবার রান্নাবান্নার ব্যপারও আছে। না খাইয়ে তো আর মেহমান বিদায় করা যায় না এই অসময়ে। চট করে চায়ের ব্যবস্থা করে ফেললে কেমন হয়?

সোফাসেটে ইমরানের পাশে আজিজ শেখকে বসে থাকতে দেখে সৃজা অবিশ্বাস্য রকমের চমকে গেল। মানে কী?এই লোকটা এখানে কেন এসেছে? ওকে মারতে, বাচ্চাদের নিয়ে যেতে? নাকি অন্য কোনো মতলবে? ও বিক্ষুব্ধ রাগ নিয়ে এলিজের দিকে তাকাল। চোখে প্রশ্ন, এই লোকটাকে ফ্ল্যাটে প্রবেশ করতে দিয়েছে কেন সে? এলিজা ওর দিকে চেয়ে,
ওর প্রশ্ন বুঝে অপ্রসন্ন হাসলো। হাত মুঠোয় নিয়ে বলল, “কতদিন পালিয়ে থাকবে লোকটার থেকে, একবার মুখোমুখি হয়েই দেখো; কাপুরুষ লোকেদের কোনো ক্ষমতা নেই তোমার ক্ষতি করার, তোমার থেকে কিছু ছিনিয়ে নেওয়ার!”

সৃজা আহত চোখে বোনের দিকে তাকিয়ে রইল। এই মেয়েটা কী জানে, আজিজ শেখ ঠিক কতটা ভয়ংকর হতে পারে স্বার্থসিদ্ধির জন্য? না, জানে না। ও নিজেকে স্বাভাবিক রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করে শুধু বলল, “তোর ভাইয়াকে একটা ফোন দে।”

আজিজ শেখ কোনো ভনিতা করলেন না। গলা ঝেড়ে প্রথমেই সৃজাকে বললেন, “সোনামণিরা কই? ওদের আনো তো, দেখি! বইলো ওদের দাদু আসছে।”

সৃজা শক্ত গলায় বলল, “আপনার কাছে ওরা যাবে না। ওরা আপনাকে ভয় পায়। আর আপনি ওদের
দাদু নন।”

আজিজ শেখের কপালে ভাঁজ পড়ল সৃজার ধৃষ্টতা দেখে। তিনি দাদু নন, বাচ্চাদুটো তার নাতি-নাতনি নয়, তারা তার কাছেই যাবে না, এসব মূলত এই মেয়েটার বানোয়াট কথা। যা তিনি আমলে নেওয়ার প্রয়োজন বোধ করলেন না। তাই এ ব্যাপারে কথা না বাড়িয়ে ইতিওতি না করে প্রসঙ্গে চলে এলেন, “সেইদিন যেটা হইছিল, যেসব ঘটনার জন্য বাড়ি ছাইড়া চইলা আসছ, ওইটা আমার রাগের মাথায় করা একটা কাজ। যেইটা করতে চাই নাই, কিন্তু হইয়া গেছে। মূলত আমি সেদিন গেছিলাম, তোমার সঙ্গে একটা জরুরি আলাপ করতে, কিন্তু কথার পিঠে জবাব দেওয়ার বাহানায় তুমি যা আচরণ করছ, নিজের রাগ কন্ট্রোলে আনতে পারি নাই। যাইহোক,
যা হইসে হইসে। তুমিও ঔদ্ধত্য দেখাইছ, আমিও রাগ কইরা হাত তুলছি। সমানে সমান।”

ভুল করেছেন, অপরাধ করেছেন এরপরেও অনুশোচনার লেশমাত্র নেই লোকটার মধ্যে। জানেই না বোধহয় ওসব কী! ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নিয়ে সৃজা কঠিন গলায় বলল, “আপনি এসব বলতে এসেছেন?”

“না। এসব বলতে আসি নাই। অন্য একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা বলতে আসছি! তোমার ফুফু কই? তারেও ডাক দাও। ওসব আলোচনা বাচ্চাদের সাথে করা ঠিক না, মুরুব্বিদের লাগে।”

কাউকে বলে দিতে হলো না, এক লহমায় সৃজা বুঝে গেল কোন বিষয়ে আলোচনা করার কথা বলছেন তিনি। ওর রন্ধ্রে রন্ধ্রে রাগ ছড়িয়ে পড়ল। একবার এলিজের দিকে তাকাল, নিজেকে দুর্দশাগ্রস্ত মনে হতেই চোখ ফিরিয়ে নিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলল ও, “আলোচনাটা কি আপনার ছোটো ছেলে বিষয়ক?”

আজিজ শেখ সুন্দর করে হাসলেন। মেয়েটার বোধশক্তি ভালো। অল্পতেই বুঝে গেছে। তিনি ঘাড় দুলিয়ে হাসলেন, “ছোটো ছেলে আবদার করল, তোমার পাশে দাঁড়ানো তোমার এই বোনটিকে ওর লাগবে। লাগবে মানে বুঝছ তো? নাকি খুইলা বলতে হইব?”

ওমন একটা বিস্ফোরক মন্তব্যে সৃজা, এলিজকে বিস্ময়ের পাহাড় ছুঁতে না পারলেও নীলু ফুপিকে পারল। তার হাত থেকে চায়ের ট্রে'টা মেঝেতে পড়ে ঝনঝন শব্দে ভর দুপুরের নীরবতাকে চাঞ্চল্যময় করে তুলল। তিনি আজিজ শেখকে দেখে যতটা না চমকালেন, তারচেয়ে বেশি চমক পেলেন মাত্র বলা লোকটার কথা শুনে, “ক কী বললেন এটা? আপনার খু নী ছেলের আমার এলিজকে লাগবে?”

“সঠিক বলছেন। ব্যপারটা বিয়েশাদী বিষয়ক।”

নীলু ফুপি রাগে কাঁপতে লাগলেন রীতিমতো, “এতবড়ো দুঃসাহস দেখানোর স্পর্ধা কোথায় পেলেন আপনারা বাপ-ব্যাটা? আমাদের মেয়ে কি এতই ফেলনা যে, তার মায়ের মৃত্যুর জন্য যে দায়ী, তার হাতেই মেয়ের জীবনটা তুলে দেব? জঘন্য চিন্তাভাবনা আপনাদের!”

“আমি মানুষটারে যেমন জঘন্য জানেন, তেমনি আমার চিন্তাভাবনাও সেরকমই জঘন্য। ওটা তো আপনাদের বরং ভালো জানার কথা, বেয়াইন।”

ইমরানের ইচ্ছে করল একছুটে কোথাও পালিয়ে যেতে। সে ভেবেছিল, আযরান-আজওয়াকে দেখতে এসেছে বোধহয় এখানে। কিন্তু ব্যপার তো দেখছে অন্য! ওর মাথা এলোমেলো হয়ে গেল। এতকিছুর পরেও নতুন জটিলতা বাড়ানোর জন্য মুখিয়ে আছে তার বাবা? কীভাবে, কোন মুখে এই প্রস্তাব নিয়ে এ বাড়িতে এলেন তিনি? আরসালান তার এতই প্রিয় সন্তান হয়ে গেল যে, নূন্যতম বিবেকবোধ রেখেও কথা বলছেন না! মায়ের খুনীর সঙ্গে মেয়ের বিয়ে? তাও এলিজার মতো একটা মিষ্টি মেয়ের? তাকে ভীষণ ক্ষুদ্ধ দেখাল। এ পর্যায়ে গলা ঝেড়ে কঠিন কণ্ঠে সে আজিজ শেখকে বলল, “এসব কথা বন্ধ করো, আর এখান থেকে চলো। তামাশার দিকে যাচ্ছে ব্যাপারটা।”

আজিজ শেখ ওর থেকে দ্বিগুণ কঠিন স্বরে ঘর কাঁপিয়ে ধমক দিলেন ওকে, “চুপ করো, তোমার মতামত কেউ জানতে চায় নাই।”

ইগোতে লাগল কী-না কে জানে, নাকি অন্য কোনো বিবেকবোধ থেকে! ইমরান আর কোনো কথা বলল না, চুপ করে গেল। ফোনটা বের করে ভাইকে ম্যাসেজ করল সে। এর কিছুক্ষণ পরেই সাদা পোশাকধারী কয়েকজন লোকের সঙ্গে অফিসার ইনচার্জকেও দেখা গেল ফ্ল্যাটে। যাদের দেখে আজিজ শেখ মিনিট খানিক ভ্রু কুঁচকে চেয়ে থেকে এরপর ছেলের উদ্দেশ্যে হুঙ্কার ছাড়লেন, “এইসব তোমার কাজ? একটা কাজও ঠিকমতো করতে পারো না। একটা জামিনের ব্যবস্থা করতে বলছিলাম, করছ মীরজাফরগিরি!”

ইমরান স্তব্ধ মুখে বসে রইল। শারীরিক অসুস্থতার দোহাই শর্তসাপেক্ষে আগাম জামিনের ব্যবস্থা করে রেখছিল সে, অথচ অফিসার আজই এলেন গ্রেফতার কর‍তে। মানে কী? তাহলে কী তার ভাই? ইহসানের কাজ এটা? ইমরান ফোঁস করে শ্বাস ছাড়ল! জামিনের ব্যবস্থা করতে গিয়ে তার কালঘাম ছুটে গেছিল, এখন সবেতে গুঁড়ে বালি!

______

[রিচেকহীন। ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন আশা করি।]

চলবে...

Address

Dhaka

Website

Alerts

Be the first to know and let us send you an email when Israt Jahan Fariya - ইসরাত জাহান ফারিয়া posts news and promotions. Your email address will not be used for any other purpose, and you can unsubscribe at any time.

Share