15/05/2025
"সন্তান বন্ধ্যা করতে কুফরি!" - কথাটা আজও আমার বুকের ভেতরটা হিম করে দেয়। ভাবলে শরীরটা যেন বরফ হয়ে যায়। আমার জীবনে যা ঘটেছে, তা সিনেমার গল্পকেও হার মানায়। বিশ্বাস করুন, প্রতিটা অক্ষর সত্যি।
আমার বিয়ে হয়েছিল প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে। আর আজ থেকে বছর পাঁচেক আগে, যখন আমার বয়স প্রায় ষাটের কাছাকাছি, তখন আমি একসঙ্গে তিন-তিনটি পুত্র সন্তানের জন্ম দিলাম! ভাবুন একবার, যে নারী জীবনে একটি সন্তানের মুখ দেখেনি, সে কিনা একসঙ্গে তিন সন্তানের জননী! এটা কোনো সাধারণ ঘটনা ছিল না। এর পেছনে লুকিয়ে ছিল এক ভয়ঙ্কর কালো জাদু, এক গভীর ষড়যন্ত্র।
আমার স্বামী, হাফিজুর রহমান, খুব ভালো মানুষ ছিলেন। তিনি চাকরি করতেন, আমাদের সংসার ভালোভাবেই চলছিলো। আমরা দুজনেই সন্তান চাইতাম, আর বহু বছর চেষ্টা করেছি। কিন্তু কোনো ফল আসেনি।
গ্রামে এক সময় কিছু মানুষ বলল, হয়তো কারো কাছ থেকে কালো জাদু হয়েছে, তাই সন্তান হচ্ছে না। আমি প্রথমে হাসতাম এসব কথা শুনে, কিন্তু সময় যত গড়ালো, আমার মনে ভয় বসতে লাগলো।
এক রাতে, ঘুম থেকে উঠে দেখি ঘরটা অন্ধকার আর ঠান্ডা। একটা অদ্ভুত বাতাস বইছিলো, যেন কেউ আমার বুক চেপে ধরেছে। সেই রাত থেকে স্বপ্নে ভুতুড়ে কিছু ছবি দেখতে শুরু করলাম — এক ব্যক্তি, মুখ ঢাকা, এক গাছতলায় দাঁড়িয়ে আছে। আমার স্বামী ছিলেন একজন অমায়িক মানুষ। বিয়ের পর থেকে তিনি আমাকে চোখে হারাতেন। আমাদের একটাই স্বপ্ন ছিল - একটি ফুটফুটে সন্তান। কিন্তু বছর পেরোতে লাগল, আর আমাদের কোল খালিই রয়ে গেল। সমাজের নানা কটু কথা, আত্মীয়-স্বজনের বাঁকা চাহনি - সব যেন আমার হৃদয়ে বিষের মতো বিঁধত।
রাতের পর রাত আমি জায়নামাজে চোখের জলে বুক ভাসিয়েছি। কত ডাক্তার, কত কবিরাজ দেখিয়েছি তার কোনো ইয়ত্তা নেই। আল্লাহর দরবারে কত মিনতি করেছি, তারও কোনো হিসাব নেই। দশবারেরও বেশি ওমরাহ ও হজ পালন করেছি শুধু একটি সন্তানের আশায়। আজমীর শরীফের খাজার দরবারেও গিয়েছি, যেখানে নাকি কেউ খালি হাতে ফেরে না। সেখানেও সাতবার গিয়েছি, কিন্তু আমার প্রার্থনা যেন আকাশেই মিলিয়ে যেত।
আমার স্বামীর আর্থিক অবস্থা ভালো ছিল। চাকরি পাশাপাশি ব্যবসা করতেন। সন্তানের জন্য আমি কত টাকা উড়িয়েছি, তা ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন। কিন্তু আমার স্বামী কখনোই তাবিজ-কবজ বা এই জাতীয় কুসংস্কারে বিশ্বাস করতেন না। আমিও তাই ওসবের ধার ধারিনি। আমাদের প্রচুর সম্পত্তি ছিল, টাকা-পয়সার অভাব ছিল না।
আমার স্বামী ছিলেন দুই ভাই। তিনি ছিলেন ছোট। তার বড় ভাইয়ের স্ত্রী, আমার জা ছিলেন খুবই ভালো মানুষ। বোনের মতোই সম্পর্ক ছিল আমাদের। কখনো কোনো কারণে আমাদের মধ্যে ঝগড়া হয়নি। হয়তো তাদের আর্থিক অবস্থা আমাদের মতো এতটা সচ্ছল ছিল না, কিন্তু আমরা কখনোই তাদের ছোট করে দেখিনি।
আমার বিয়ের আগেই আমার শাশুড়ি মারা যান। শ্বশুরও বিয়ের পাঁচ বছর পর ইহলোক ত্যাগ করেন। আমার জায়ের তিনটি ছেলেমেয়ে ছিল। সত্যি বলতে, তাদের সংসারের প্রায় পুরো খরচটাই আমরা বহন করতাম। আমার বড় ভাসুর ছিলেন একজন জুয়াড়ি। দিনরাত জুয়া খেলে উড়িয়ে দিতেন সব। তার ছেলেমেয়েদের মানুষ করার দায়িত্বও একরকম আমাদের কাঁধেই পড়েছিল।
শ্বশুরবাড়ির কোনো অনুষ্ঠানে আমি যেতাম না। কারণ একটাই - সবাই আমাকে বন্ধ্যা বলত। কুড়িটা বছর এভাবেই কেটে গেল। আমিও একসময় ধরে নিয়েছিলাম হয়তো আমার কপালে সন্তান নেই। অথচ ডাক্তারি রিপোর্টে আমাদের দুজনেরই কোনো সমস্যা ধরা পড়েনি। সময়ের স্রোতে আমার বয়স বাড়ছিল, আমার স্বামীরও। বিয়ের সময় আমার বয়স ছিল পনেরো আর তার একুশ। আমার শ্বশুর শখের বশে তার ছেলেকে তাড়াতাড়ি বিয়ে দিয়েছিলেন। সারা জীবনে একটি সন্তানের জন্য আমি কী পরিমাণ হাহাকার করেছি, তা শুধু আমি আর আমার আল্লাহই জানেন।
আমার ঋতু'স্রা'বও অনিয়মিত ছিল। বছরে হয়তো একবার বা দু'বার হতো, তাও এক-দু'মাস স্থায়ী থাকত। অথচ বিয়ের আগে এমনটা ছিল না। প্রায় সময়ই আমার জা আমাকে বিভিন্ন তাবিজ লেখা জল খেতে দিতেন। বলতেন এগুলো নাকি বাচ্চা হওয়ার জন্য। আমিও সরল বিশ্বাসে খেতাম। কিন্তু সমাজের মানুষ তো আমাকে বন্ধ্যা বলেই ডাকত। অনেকে বলত একটি সন্তান দত্তক নিতে। কিন্তু আমার স্বামী রাজি ছিলেন না। তার স্পষ্ট কথা ছিল, না হলে নেই, কিন্তু আমরা কোনো পালকপুত্র নেব না। আমার ভাইয়ের ছেলেমেয়েরাই আমাদের সব। ওরাই আমাদের মৃত্যুর পর মাটি দেবে।
সুখে-দুঃখে, মানুষের নানা কথায় আমাদের চুয়াল্লিশটি বছর কেটে গেল। আমার স্বামীও বৃদ্ধ হয়ে গেলেন, বয়স প্রায় পঁয়ষট্টির কাছাকাছি। আমারও ঊনষাট। সন্তানের আশা একরকম ছেড়ে দিয়েছিলাম। ইদানিং আমার স্বামীর শরীরটাও ভালো যাচ্ছিল না। মনে হচ্ছিল হয়তো আর বেশিদিন বাঁচবেন না। তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন আমাদের জায়গা-জমি, টাকা-পয়সা সব আমার ভাসুরের ছেলেদের নামে লিখে দেবেন। কিন্তু তার আগে আমরা বড় হজ পালন করতে যাব। হজ থেকে ফিরে এসে কিছু সম্পত্তি তাদের নামে লিখে দিয়ে বাকিটা আল্লাহর রাস্তায় দান করে আমরা দু'জন আল্লাহর পথে মুসাফির হব।
আমরা যথারীতি হজ্বের জন্য রওনা হলাম।
যেদিন শয়তানকে পাথর মারার পালা, সেদিন হঠাৎ ভয়ংকর ঝড় উঠল। আমরা পাথর নিক্ষেপ করে কাবার সামনে বসলাম। মুষলধারে বৃষ্টি পড়ছিল। আমি কান্নায় ভেঙে পড়লাম। আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ জানালাম, "হে আল্লাহ, এই জীবনে তো একটি সন্তানও দিলে না, কত চেয়েছি তোমার কাছে। কত মানুষের কটু কথা শুনেছি জীবনে। তবুও তুমি রহমত করলে না। অসুবিধা নেই, হয়তো আমরা জাহান্নামী, তাই আমাদের দোয়া কবুল করোনি। তোমার সামনে বলছি, বাচ্চা দাওনি, এই জীবনে আর কখনো কিছু চাইব না তোমার কাছে। শুধু মৃত্যু দিও। বাচ্চার দোয়া কবুল করোনি, কিন্তু আমার মৃত্যুর এই মিনতি তুমি কবুল করো। আর নিঃসন্তান থাকার কোনো ইচ্ছে নেই আমার, হে আল্লাহ, তোমার উপর বড় অভিমান আমার।"
কথাগুলো বলে আমরা হোটেলে ফিরে এলাম। পরে ফরজ তওয়াফের পর সাফা ও মারওয়া পাহাড়ের মাঝে দৌড়ানোর পর ক্লান্ত হয়ে আমরা একটি পাথরের উপর একপাশে বসলাম।
ঠিক তখনই এক ফি'লি'স্তি' নের ব্যক্তি আমাদের দিকে তাকিয়ে কী যেন বললেন। আরবি না উর্দু, কিছুই বুঝতে পারলাম না। আমাদের পাশেই একজন প্রবাসী ভাই দাঁড়িয়ে ছিলেন। তিনি এগিয়ে এসে বললেন, "আপনাদের উপর কালো জাদু করা হয়েছে। সন্তান না হওয়ার জন্য।" আমরা দু'জন ভয়ে আঁতকে উঠলাম। "হায় আল্লাহ, এ কী কথা!"
এরপর সেই ফি*লি'স্তি নের লোকটি বলতে লাগলেন, "আপনারা সম্ভবত বহু বছর ধরে কালো জাদুতে আক্রান্ত। আপনাদের জরা'য়ু এবং আপনার স্বামীর শুক্রা'শয় কালো জাদু দিয়ে বন্ধ করে রাখা হয়েছে, যাতে আপনারা কখনোই সন্তানের বাবা-মা হতে না পারেন। যদি এই জাদু না কাটানো হয়..."
কথাটা শেষ না হতেই আমি কান্নায় ভেঙে পড়লাম। মনে হচ্ছিল আল্লাহর ঘরের পাশে দাঁড়িয়ে কেউ মিথ্যা কথা বলবে না। আমরা দু'জন তাদের ভাষা বুঝতে পারছিলাম না। সেই প্রবাসী ভাই তাদের কথাগুলো বাংলায় অনুবাদ করে বলছিলেন। আমরা জিজ্ঞেস করলাম, "কে করেছে এটা?" তিনি তখন কারো নাম বললেন না। আমরা জানতে চাইলাম, "এ থেকে মুক্তির উপায় কী?" তখন তিনি আমাকে কিছু রুকইয়ার পানি পড়া দিলেন এবং বললেন, "এই পানি পান করবেন এবং ২১ দিন ধরে গোসলের পানিতে মিশিয়ে গোসল করবেন। তাহলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।"
তিনি আরও বললেন, "আর যখনই মনে হবে কেউ আবার কিছু করার চেষ্টা করছে, তখন আপনারা এবং আপনাদের পরিবারের সবাই এই পানি পান করবেন ও গোসল করবেন। এই পানি সারা জীবন রাখবেন। তবে আপনারা ছাড়া অন্য কেউ যেন এটা ব্যবহার না করে।"
তখন ছিল ২০০৪ সাল।
হজ্ব শেষ করে দেশে ফিরলাম।
২১ দিন সেই পানি দিয়ে গোসল করলাম। আল্লাহর অশেষ রহমতে আমি গর্ভবতী হলাম। সবাই অবাক! এই বুড়ো বয়সে সন্তানের মা!
ঠিক তখন থেকেই আমার জায়ের আসল রূপ প্রকাশ পেতে শুরু করল।
কারণ হজ্ব থেকে ফেরার পর আমাদের কথা ছিল আমার ভাসুরের ছেলেদের নামে সম্পত্তি লিখে দেওয়ার। তারা কাগজপত্রও তৈরি করে রেখেছিল। কিন্তু আমার স্বামী আর তা করেননি।
ডাক্তাররাও অবাক হয়ে গিয়েছিলেন এই বয়সে গর্ভ'ধা'রণ দেখে। তারা আমাকে নিবিড় পর্যবেক্ষণে রেখেছিলেন। আমার মনে আছে, গর্ভ'কা'লীন সময়ে আমি প্রায় বিছানা ছেড়ে নামিনি। আল্লাহর অসীম দয়ায়, দীর্ঘ পঁয়তাল্লিশ বছর পর, ২০০৫ সালে আমি একসঙ্গে তিনটি পুত্র সন্তানের জন্ম দিলাম! সারা এলাকায় এই খবর ছড়িয়ে পড়ল
গল্প: সন্তান বন্ধ্যা করতে কুফরি!
লেখক: ভূতের গল্প লেখক সান
Cp
#ভূতেরগল্প #ভৌতিক #কালোযাদু