29/08/2024
#যৌতুক কী?
যুগ যুগ ধরে আমাদের সমাজে যৌতুক দেওয়া ও নেওয়ার নিয়ম চলমান। বাংলাদেশে ‘যৌতুক নিরোধ আইন-২০১৮ তে যৌতুকের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, যৌতুক হচ্ছে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনের পূর্বশর্ত হিসেবে এক পক্ষ কর্তৃক অন্য পক্ষের কাছে দাবি করা অর্থসামগ্রী বা অন্য কোনো সম্পদ। এ দাবি বিয়ের আগে, বা পরে—যখনই হোক না কেন, তা যৌতুক হিসেবে গণ্য হবে। তবে মুসলমানদের ক্ষেত্রে দেনমোহর যৌতুক বলে গণ্য হবে না। আবার বিয়ের আসরে অতিথিরা নিজের ইচ্ছায় উপহার প্রদান করলেও তা যৌতুক নয়।
#যৌতুকের মামলায় বিবাহ বলবৎ থাকতে
হবে
অনেক সময় বিবাহবিচ্ছেদের পর দেনমোহর মামলা করার পাশাপাশি যৌতুকের মামলা করার প্রবণতা দেখা যায়। কিন্তু যৌতুকের মামলা করার ক্ষেত্রে অবশ্যই বিবাহ বলবৎ থাকতে হবে। বিচ্ছেদের পর অন্যান্য মামলা করার ক্ষেত্রে বাধা না থাকলেও যৌতুকের মামলা করার জন্য বিবাহ বলবৎ থাকা জরুরি।
#একটি মামলার রায় আলোচনা করা যাক:-
মামলাটি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ১১(খ) ধারার অধীনে করা হয়; অর্থাৎ যৌতুকের জন্য মারাত্মক জখম করা হয়েছে বলে মামলাটি করা হয়। আদালতের কাছে প্রতীয়মান হয়, মামলাটি করার আগে পক্ষগনের বিবাহবিচ্ছেদ হয় এবং বিচ্ছেদ-সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় কাজকর্ম সম্পন্ন হয়েছে।
মামলায় সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়, বিচ্ছেদের পর যৌতুকের অভিযোগ ভিত্তিহীন।
#যৌতুকের মামলা কি শুধু বরপক্ষের বিরুদ্ধে হয়?
যৌতুক নিরোধ আইন, ২০১৮-এর ২(খ) ধারায় যৌতুকের যে সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে তা থেকে প্রতীয়মান হয় যে যৌতুক সর্বদা বরপক্ষ দাবি করবে, তা নয়। কনেপক্ষ বিয়ের শর্ত হিসেবে দেনমোহর ব্যতীত অন্যান্য অর্থসম্পদ দাবি করলেও তা যৌতুক।
এবং এর জন্য প্রচলিত আইনের অধীন আদালতে মামলা করা যায়।
#যৌতুক দাবী প্রমাণিত হলে সাজা?
২০১৮ সালের যৌতুক নিরোধ আইনের ৩ ও ৪ ধারা পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায় যে যৌতুক দাবি, প্রদান ও গ্রহণ করার সাজা হচ্ছে অনধিক পাঁচ (৫) বছর; কিন্তু অন্যূন এক (১) বছর কারাদণ্ড বা অনধিক ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় সাজা হতে পারে। যে ব্যক্তি যৌতুক দেওয়া বা গ্রহণ করার ব্যাপারে সহায়তা করবেন, তিনিও একই সাজাপ্রাপ্ত হবেন।
#যৌতুকের কারণে নির্যাতন ও মৃত্যু ঘটানোর শাস্তি
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন-২০০০ (সংশোধিত-২০০৩)-এর ১১ ধারায় বলা হয়েছে যে যদি যৌতুকের কারণে কোনো নারীর মৃত্যু ঘটানো হয়, তাহলে তার জন্য সাজা হচ্ছে মৃত্যুদণ্ড। মৃত্যু ঘটানোর চেষ্টা করা হলে তার জন্য শাস্তি হবে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। একই ধারায় বলা হয়েছে, যৌতুকের জন্য মারাত্মক জখম হলে দোষী ব্যক্তি যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড অথবা অনধিক ১২ বছর; কিন্তু অন্যূন ৫ বছর সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন এবং উক্ত দণ্ডের অতিরিক্ত অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবে। ১১ ধারাতে আরও বলা হয়েছে যে যৌতুকের জন্য সাধারণ জখম হলে দোষী ব্যক্তি অনধিক তিন বছর, কিন্তু অন্যূন এক বছর সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন এবং উক্ত সাজার অতিরিক্ত অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ১১ ধারার অধীনে সাজার ক্ষেত্রে অবশ্যই প্রমাণিত হতে হবে যে মৃত্যু, সাধারণ জখম ও মারাত্মক জখম যৌতুক প্রদানে অস্বীকৃতির কারণে ঘটানো হয়েছে।
#একটি মামলার উদাহরণ
মামলাটি ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে করা হয়। পরবর্তী সময়ে তা নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে পাঠানো হয়। ঘটনাটি এমন যে, মামলার প্রধান আসামি ও হত্যাকাণ্ডের শিকার ভুক্তভোগী নারী বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ ছিলেন। বিয়ের পর থেকেই আসামি যৌতুক হিসেবে ৫০ হাজার টাকা দাবি করে আসছিলেন, যা ভুক্তভোগীর পক্ষে জোগাড় করা সম্ভব হচ্ছিল না। এ জন্য ভুক্তভোগী প্রতিনিয়ত আসামির দ্বারা অত্যাচারের শিকার হতেন। একদিন প্রচণ্ড রকম বিবাদের একপর্যায়ে মামলার প্রধান আসামি ও তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী মিলে ভুক্তভোগীকে মারাত্মক জখম করেন। ঘটনার পরদিন ভুক্তভোগীকে হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসকেরা তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন। উল্লেখ্য যে, প্রধান আসামি ও ভুক্তভোগীর সংসারে চার সন্তান ছিল এবং ঘটনার সময় ভুক্তভোগী সন্তানসম্ভবা ছিলেন। সেই অবস্থায়ই তাঁকে নির্যাতন করে মৃত্যু ঘটানো হয়। ঘটনার পর মৃত ভুক্তভোগীর আত্মীয়রা জিডি করেন এবং তাঁর ছোট ভাই আদালতে অভিযোগ করেন।
মামলার উভয় পক্ষের সাক্ষ্য গ্রহণ শেষে ট্রাইব্যুনাল আসামিদের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ১১(ক) ও ৩০ ধারার অধীনে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করেন। পরবর্তী সময়ে ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক তা উচ্চ আদালতে পাঠানো হলে, উচ্চ ওই আইনের ধারা থেকে পরিবর্তন করে দণ্ডবিধির ৩০২/৩৪ ধারার অধীনে সাজা ঘোষণা করেন। ফলে আসামিরা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে এবং সেই সঙ্গে ১০ হাজার টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হন। পরবর্তী সময়ে মামলাকারী কর্তৃক আপিল করা হলে আপিল বিভাগ মত দেন যে বিশেষ আইনে দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিকে সাধারণ আইনের অধীনে নিয়ে এসে সাজা পরিবর্তন করার জন্য উচ্চ আদালত অধিকারভুক্ত নন।
#যৌতুক নিয়ে মিথ্যা মামলার সাজা
অনেক ক্ষেত্রে যৌতুক নিরোধ আইনটিকে প্রতিশোধের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়। ফলে কিছু ব্যক্তি মিথ্যা মামলায় ফেঁসে যাচ্ছেন, যা ব্যাপক হয়রানির কারণ। ২০১৮ সালের যৌতুক নিরোধ আইনের ৬ ধারায়, বলা হয় কোনো আইনানুগ কারণ নেই জেনেও যদি কোনো ব্যক্তি অপর কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে যৌতুকের মামলা বা অভিযোগ করেন, তাহলে সেই ব্যক্তি অনধিক পাঁচ বছর কারাদণ্ড বা অনধিক ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। আবার ১৮৬০ সালের দণ্ডবিধির অধীনেও মিথ্যা মামলার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যায়। দণ্ডবিধি আইনের ২১১ ধারা অনুযায়ী, মিথ্যা মামলা করা একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ এবং ক্ষতিসাধনের উদ্দেশ্যে এ ধরনের মামলা করলে তার জন্য শাস্তি হবে দুই বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড বা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড। তবে মামলার ধরন যদি এমন হয়, যার জন্য মৃত্যুদণ্ড, যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা সাত বছরের অধিক কারাদণ্ড হওয়ার আশঙ্কা ছিল, তাহলে মিথ্যা মামলাকারীর সাত বছর পর্যন্ত কারাদণ্ডসহ অর্থদণ্ড হবে। যে ব্যক্তির বিরুদ্ধে যৌতুকের অভিযোগ আনা হয়েছে, তিনি নির্দোষ প্রমাণিত হলে এ ধারার অধীনে মামলা করা ব্যক্তির বিরুদ্ধে পাল্টা মামলা করতে পারবেন।