Quirky Quests

Quirky Quests জীবন থেকে নেয়া কিছু কথা কিংবা আপনাদের বলা কিছু কথা উপস্থাপন করা হবে এই পেইজে.... সাথে থাকবেন সবাই 💟

27/12/2023

বিয়ের প্রথম রাতে,আমার স্বামীর একটাই রিকোয়েস্ট
ছিল। আমার মা সহজ,সরল প্রকৃতির মানুষ,রেগে গেলে ভয়ঙ্কর হয়,মায়ের দিকে খেয়াল রেখো। কখনো মায়ের সাথে বেয়াদবি,মুখে মুখে তর্ক আর তোমার সাথে কম্পেয়ার করোনা প্লিজ!
অতঃপর,রাজনৈতিক প্রয়োজনে ডাকবাংলায়,তদান্তিন এমপি মহোদয়ের সাথে আড্ডা দিতে ফুরুৎ!!
সেই ফাঁকে আমিও শ্বাশুড়ীকে নিয়ে একটি দৃশ্যপট আঁকছিলাম,তিনি কেমন হতে পারেন!

অমনি দরজায় নক করে, চার ফুট আট ইঞ্চির হ্যাংলা
-পাতলা,দাঁতগেজা,ডাগর নয়নের ফর্সা এক মধ্যবয়সী-
সাথে শ্যামাবর্ণের আঠারো-ঊনিশের বিবাহিতা,কন্যা সন্তান কোলে নিয়ে ঘরে ঢুকলেন।

স্বামীর বর্ণনায় শ্বাশুড়ীকে চিনতে পেরে টাস্কি খেলাম।
বিনয়ী শাশুড়ী মা, আমাকে খাইয়ে- মেয়েকে দিয়ে ও ঘরে সরঞ্জাম পাঠিয়ে আমার গাঁ ঘেঁষে বসলেন।
বুঝিয়ে দিলেন,রাগী শ্বশুর,ননদ,দেবর ও বাড়ীর কর্তৃ দাদীমাকে কিভাবে সামলাতে হবে।

বিয়ের পর দেড় বছর পর্যন্ত একটানা শ্বশুর বাড়ীতে ছিলাম। তখন লক্ষ্য করেছি,এ বাড়ীতে দাদীমার আধিপত্য । তাঁর কথায় সবাই ওঠে-বসে।কোথাও যেতে আসতে আমার জামাইসহ সকলেই বুবু বুবু বলে মুখে ফেনা তুলে ফেলত। মায়ের কোনো খবর নেই।

কারণ উদ্ঘাটনে,ধীরে ধীরে উন্মোচিত হচ্ছিল,দেখছি
-লাম শাশুড়ীমা-আটা ছানা,তরকারি সাইজ করে কাটা, বীজ মাটিতে পোতা, চাল মেপে ভাত রান্নাসহ সাংসারিক কাজে খুব একটা সিদ্ধহস্ত নন! তিনি দাদীমার আদেশ পালনে,সবসময় অপেক্ষায় থাকতেন।

মাটির বাড়ি-ঘর ঝাড়ু,কাপড় কাঁচা,মশলা পিশাসহ গৃহস্তবাড়ীর নিত্যদিনের কাজ করা এ,সরল মানুষটির কাছে ছিল আনন্দের বিষয়।

আমি তখন সবে নতুন বৌ,দুদিন হল ও বাড়ীতে। দাদীমা আমাকে ঢেকিতে ধান দিয়ে বললেন-যা তোর
শ্বাশুরী একলা ঢেহিত, তুই গিয়ে সাহায্য কর দেখি!!
আদেশ পালনে,মায়ের সঙ্গে গিয়ে বেশ দক্ষতার সাথেই সেদিন ধান গাপকারা করে নাস্তা খেয়েছি। আবার ফুল কারা করে দুপুরের ভাত খেয়েছি। দাদীমা তো নেতৃত্বের আনন্দে আত্মহারা!

সেদিন রাতে আমার খুব জ্বর এলো,সে জ্বরে একেবারে টাইফয়েড,সে নিয়ে কত গঞ্জনা,সে কথা নাইবা বললুম! তারপর ঢেকিতে আর উঠতে হয়নি,আমার শ্বাশুড়ি মা ঢেকিতে আর উঠতে দেননি।

আরেকদিন দাদীমার কথায়,মায়ের মরিচ বাটায় হেল্প করতে যেয়ে হাত জ্বলছে তো জ্বলছেই! আমার কান্নায় সেদিন আকাশ-বাতাস কাঁপছিল। আমার মাননীয় বর ডক্টরের কাছে নিলে,ডক্টর সবুজ টুথপেস্ট লাগানোর পরামর্শ দিলে, শ্বাশুড়ির হস্তক্ষেপে মুক্তি পেয়েছিলাম এ যন্ত্রণা থেকেও।

আমার গৃহস্থ শ্বশুর বাড়ীতে অনেক গরু ছিল।গোয়াল ঘর ছিল বাড়ির পুবের ভিটায়।গরুর গোবর ফেলার আদেশ দিলেন দাদীমা। তালের খোল দিয়ে উঠাতে যেয়ে দেখি বাবারে বাবা! বড় বড় সাদা শোয়াপোকা, কিলবিল করছে। তাই দেখে আমার চিৎকারে আশে-পাশের বাড়ীর বৌ-জিয়েরা চলে এসেছিল,সে ছিল এক এলাহীকান্ড!! সেইদিন থেকে আমার মায়ের মতো শাশুড়ি মায়ের হস্তক্ষেপে সকল গৃহস্থালি কাজ হতে চিরতরে মুক্ত হয়েছিলাম।
মা ঘোষণা করলেন,বৌমা কখনোই তুমি আর এসব কাজ করবেনা,তোমার দাদী বললেও না,
ব্যাস! কুটনৈতিক দাদীর নেতৃত্ব খতম!!
সেদিনই,প্রথম আমার সরল শ্বাশুড়ীমার মুখে যে প্রতি-
বাদের ছবি দেখেছিলাম তা কখনো ভুলবনা।

ছোটোমুটো,মধ্যবয়সী মাকে বিয়ের পর থেকেই দেখেছি,ব্লাউজ-পেটিকোট বিহীন,এক পেঁচা সুতী শাড়ী পড়ে সারাদিন দাদীমার ফরমায়েশ করতে ব্যস্ত! সে মায়ের আমার প্রতি টানে,প্রত্যেক কাজে প্রতিবাদ দেখে আমি তো মূক,বধির হয়ে গেলাম। আমার প্রতি তাঁর ভালবাসা দেখে, শ্রদ্ধায় আমার মাথা নুইয়ে এসেছিল। সেদিন প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, মাকে আমি সবসময় সুখের আলোয় মুড়িয়ে রাখবো।তখন থেকেই মায়ের সাথে আমার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরী হয়।

মা,আমাকে খুব স্নেহ করতেন! দাদিমার অধীনস্ত-
আমরা বৌ-শাশুড়ী সকালের নাস্তা বারোটায়, দুপুরের খাবার খেতাম বিকেল চারটায়। তবে মা লুকিয়ে আমাকে অল্প খাবার দিতেন,পরে দাদীমা এলে একসঙ্গে আবার খেতাম।
আমার বিয়ের উনিশ বছর পর,দাদীমার মৃত্যু হয়। অতঃপর মায়ের হাতে চামচা,মানে মায়ের উপর পরিবারের দায়িত্ব এসে পড়ে।
তার অনেক আগেই আমি শহরে চলে আসি। তবে মায়ের সাথে ফোনে সবসময় আমার কথা হতো।
শ্বশুরের রাগ-রাগী,দাদীমার কাজের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে মা মাঝে মাঝে মাঝে আমার বাসায় চলে আসতেন।

আমার হাজবেন্ড যখন দক্ষিণ কোরিয়াতে, আমার চাকুরীর সুবাদে মা আমার এখানে নাতির টেককেয়ারে বছর-দুয়েক ছিলেন। তখন আমাদের বৌ-শ্বাশুড়ির বন্ডিনটা বেশ মজবুত হয়েছিল।
ধানমন্ডি ১ নম্বরে- আমি তখন বেক্সিকো বেল টাওয়ার ফ্রনডেস্কে বসতাম। আমার অফিস সকাল ৯-২ টা। সকালে আমি রান্না করে অফিসে যেতাম।অফিস থেকে ফিরে এসে দেখতাম মা অপেক্ষা করছেন একসাথে খাবার জন্য। আমার বাসা ছিল তখন জিগাতলা ট্রেনারী মোড়। প্রায়ই বিকেলে আমরা ঘুরতে যেতাম শিশুপার্ক, বুড়ীগঙ্গা তীড়,বুদ্ধীজিবী শহীদমিনার,
ধানমন্ডি লেকের পাড়ে।
মা ছোট মাছ খেতে পারতেন না। মাছের কাটা
কাটা গলায় ফোঁটার ভয়ে এড়িয়ে যেতেন। আমি বুঝতে পেরে,সবসময় কাটা বেছে দিতাম। উনি খেতেন আর প্রাণভরে উচ্চস্বরে দোয়া করতেন। মাকে বাদামের শক্ত বিচি খুলে না দিলে খেতে চাইতনা। বাদাম কিনে দিলে মা আমার দিকে তাকিয়ে থাকত,আমি মৃদু ধমক দিলে বলতো, মায়ের ধমকই আমার ভালবাসা।।

মায়ের সে সরল মুখটা দেখে,কি যে, ভাল লাগত তখন,8বলে বুঝাতে পারবনা!!
মায়ের সকল আবদার ছিল আমার কাছে, ঠিক যেন আমি ওনার মা,আর ওনি আমার মেয়ে।
বলত, কাঞ্চি আমায় সবসময় হলুদ ও লাল শাড়ী কিনে দিবা,আমিও তাই দিতাম। মাকে ব্লাউজ-পেটিকোট পড়ানো আমি শিখিয়েছিলাম।তারপর থেকে আর
কখনো ব্লাউজ-পেটিকোট ছাড়া মাকে কাপড় পড়তে দেখিনি।
মা আবদার করে করে,বাড়ীতে ফ্রিজ,রঙিন টেলিভিশন ও বাড়ীর সকল ফার্ণিচার আমাকে দিয়ে তৈরী করে নিয়েছিল।
মজার ব্যাপার হচ্ছে,এসব আমি করতে পেরেছিলাম, শ্বাশুড়ীকে আমার মায়ের আসনে বসিয়েছিলাম বলে। তাই মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত,কোনদিন আমাদের মধ্যে মন কষাকষি হয়নি। মায়ের সবচেয়ে বড় গুন ছিল- আমার প্রতি মায়ের অন্ধ ভালবাসা।
সত্যি বলতে,আমার শ্বাশুড়ি মায়ের দোয়ায়,মনে হয় আমার আজকের এ সফলতা। মা বলতেন, দেখো কাঞ্চি,একদিন তুমি অনেক বড় হবে, সফলতার শীর্ষে উঠে যেন আমাকে ভুলে যেওনা!!

মা শহর পছন্দ করতেন না, তাই আমার এখানে বেশিদিন থাকতেন না, কারণ আমি সার্ভিস করি, মাকে একা বাসায় থাকতে হয়, বোরিং ফিল করে। তবে আমার এখানে সবসময় রমজান মাস থাকতেন। রমজান মাসে মা আমার বাসায় এলে যত্ন সহকারে গোসল, করিয়ে তেল মালিশ করে চকচকে করে রাখতাম।

সবশেষ, মা আমার কাছে গত রমজান মাস-2023 ইং ছিলেন এবং সবগুলো রোজা রেখেছিলেন। বৃদ্ধ মা মুভ করতে পারতোনা,তাই কাজের লোকের অভাবে মাকে রোজার পর ছোট ছেলের বৌয়ের কাছে থাকতে হয়েছিল।

মৃত্যুর দুদিন আগে মাকে দেখতে গিয়েছিলাম, সুস্থ মানুষ। বলল,কাঞ্চি আমি মরে গেলে আমাকে তুমি গোসল করিয়ে,সুরমা দিয়ে সাজিয়ে দিও।
আমি বলেছিলাম, বালাইসাড! মরবেন কেন?
আরো আনেকদিন বেঁচে থাকবেন।

04/09/23 ইং সকালে আমার বাপের বাড়ী,গাজীপুর শহরে বেড়াতে গিয়েছিলাম। ইচ্ছে ছিল বিকালে চলে আসবো,তাই সাহেব যায়নি।
দুপুরে সাহেব কল দিয়ে বলল-তাড়াতাড়ি চলে আসো। মায়ের শরীর খুব খারাপ। হন্তদন্ত হয়ে এসে দেখি,
মায়ের ঘর ভর্তি মানুষ।সকাল থেকে নাকি মায়ের কথা বলা বন্ধ হয়ে গেছে,নড়াচড়াও বন্ধ! শুধু শ্বাস চলছে।

আমি বিকেল 4:30 মিনিটে মায়ের শিয়রে বসে মাকে ডাক দিয়েছিলাম। বিশ্বাস করুন!! দু ডাকের মধ্যেই, মা সবাইকে অবাক করে দিয়ে,শব্দ করে আমার দিকে তাকিয়েছিলেন। আমি ডালিমের রস হা করে মায়ের মুখে দিতেই মা রসটা গিলে,মুখটা কেবলার দিকে অটো কাত করে ডান চোখের জল ছেড়ে দিয়ে,চোখ খোলা রেখেই চলে গেলেন ঐপারে!!

আমার ননদসহ সবাই বসা,আমি ছাড়া কেউ বুঝতেই পারেনি,মা আর নেই!
আমার বাবা ও অনেকের মৃত্যু আমি কাছ থেকে দেখেছি।কিন্তু,মৃত্যু যে এত সহজ ও সুন্দর,তা আমার শ্বাশুড়ির মৃত্যু না দেখলে বুঝতে পারতাম না।
প্রিয় পাঠক সবাই দোয়া করবেন,আমার অতি প্রিয়জন
শ্বাশুড়ি মা যেন জান্নাতবাসী হন,আমিন!

"শাশুড়ি মা"
মীর_ছালেহা

Address

Dhaka

Alerts

Be the first to know and let us send you an email when Quirky Quests posts news and promotions. Your email address will not be used for any other purpose, and you can unsubscribe at any time.

Share