10/10/2025
কেউ এটাকে বলবেন ট্রেন্ড, কেউ বলছেন ভাইরালের ভাইরাস, আবার কেউ হয়তো বলবেন প্রজন্মগত অধঃপতন৷ কিন্তু আমার কাছে মনে হয়, এতোসব আলাপের ভিড়ে আরেকটা সম্ভাবনা চাপা পড়ে যায়৷ সেটা হলো—নীরব বেকারত্ব।
একটা সময় ছিল যখন সন্তানেরা বাবার কাঁধের উপর চড়েই যৌবনের একটা অংশ পার করে দিতে পারত অনায়াসে। বাবাদের যে আহামরি উপার্জন বা সহায় সম্পদ থাকত তা-ও নয়৷ তথাপি, সেই স্বল্প আয়ের সংসারেও বাবার উপার্জনের উপর ভর করে অনেক সন্তানাদি বড় হয়ে উঠত। কেউ কলেজে পড়ছে কিন্তু সম্পূর্ণ খরচা বাবা বহন করছে। কেউ ইউনিভার্সিটিতে পড়ছে, সম্পূর্ণ খরচটাও বাবা বহন করতেন নিজের পকেট থেকে বাড়তি কোনো টানাপোড়েন বা চাপ ব্যতীতই।
কিন্তু, সেই সহজিয়া সময়টা এখন আর নেই। জীবন সংসারে এখন নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি আর খরচাপাতির পরিমাণ এতো বেশি বেড়েছে যে, একটা স্মার্ট স্যালারির চাকরি করেও, দুটো সন্তানকে ভালো স্কুলে পড়াতেই এখনকার বাবারা হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে।
ঢাকা শহরে থাকছি আজকে প্রায় দশ বছর হতে চলল। এই জাদুর শহরে ৩০ হাজার টাকা বেতনের চাকরি দিয়ে চার থেকে পাঁচজন মানুষের একটা সংসার টেনে নিয়ে যাওয়া কী পরিমাণ যে টানাপোড়েনের ঘটনা—এই অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে যারা যায়নি বা যাচ্ছে না তারা ব্যতীত আর কেউ বুঝবে না।
একটা সময় ছিল যখন মানুষের চাহিদার পরিমাণও সীমিত ছিল৷ তিনবেলা আহারের সংস্থান হলেই মানুষগুলোর দিব্যি চলে যেতো। ফলে, আহার সংস্থানকেন্দ্রিক জীবনব্যবস্থাই ছিল এখানে মূল ঘটনা৷
কিন্তু এখন?
এখনকার সময়ে ক্লাস এইটে পড়ুয়া একটা ছেলের মাসিক হাত খরচও কম করে হলে হাজার পাঁচেক টাকা৷ তার ইন্টারনেট বিল দেওয়া লাগে। নিয়ম করে বন্ধুদের সাথে তাকে ঘুরতে যেতে হয়, আড্ডা দিতে হয়। দুই মাসে অন্তত একবার শপিং। নেটফ্লিক্সের সাবস্ক্রিপশান, প্রেমজনিত ব্যাপারাদি থাকলে সেইসব খরচা (আজকালকার দিনে তো অসম্ভব না)—সব মিলিয়ে তার যে এই বাড়তি খরচা, এটা বাবাদের উপার্জন থেকে বের আনতে কয়জন সন্তান পারে? দিনকাল যে হারে কঠিন হয়েছে, জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে, সেই হারে তো তার বাবার বেতন বাড়েনি।
এইসব বাড়তি খরচের সংস্থান কল্পে অনেকসময় তাকে উপার্জনের রাস্তা খুঁজতে হয়। কিন্তু, এই স্কিল আর প্রযুক্তির উৎকর্ষতার যুগে সে দেখতে পায়, এইখানে উপার্জন ব্যাপারটা পাহাড় ঠেলার মতোই কঠিন। তার না আছে যোগ্যতা, না আছে স্কিল, না আছে অভিজ্ঞতা।
তাহলে সে কী করবে?
সে বেছে নেয় এই ধরণের ক্রিঞ্জ উপায়। সে জানে, দুনিয়াটা এখন একইসাথে কঠিন এবং একইসাথে সহজও৷ সে যদি নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে হাঁটতে চায়, জীবন তার সামনে হিমালয়ে উঠার মতোই কঠিন হয়ে ধরা দেবে। তবে, যদি সে নিয়মের বাইরে গিয়ে কাজ করে যা আপাত দেখতে অস্বস্তিকর আর বেঢপ, তার জন্য অনেকখানি রাস্তা সহজ হয়ে যায়।
এই চিন্তা থেকেই কাউকে কেক বেচতে এসে নাচতে হচ্ছে, কাউকে কেক বেচতে এসে গান গাইতে হচ্ছে, কাউকে করতে হচ্ছে সিনক্রিয়েট।
শুধু কেক বেচার বেলাতেই নয়, এইসব সিম্পটম এখন অনেক পেশাতেই ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ছে।
হতে পারে অনেকে ক্রিঞ্জ টাইপ মনোভাব থেকে, ভাইরালের নেশায় কিংবা প্রজন্মগত অধঃপতন থেকে এসব করে। তবে এটাও সমানভাবে সত্য—ভয়াবহ বেকারত্বও এইসব ঘটনার পেছনে এক বড় অনুঘটক হিশেবে কাজ করছে।
দেশে এক নীরব বিপ্লব চলছে৷ বেকার বিপ্লব।
আরিফ আজাদ