07/09/2025
কথার নেশা
~ ড. নজরুল ইসলাম খান
কথা বলা আসলে একধরনের আসক্তি। প্রথমে আমরা টের পাই না। মনে হয়, কারো সাথে দু’চারটা বাক্য বিনিময় করলেই কী-বা এমন হবে! কিন্তু সেই সামান্য আলাপনই ধীরে ধীরে নীরবতার ভিত ভাঙতে শুরু করে। আমরা অভ্যস্ত হয়ে যাই একটি নির্দিষ্ট কণ্ঠস্বরের অপেক্ষায়, একটি নির্দিষ্ট নাম্বার থেকে আসা মেসেজের শব্দে, কিংবা রাত গভীর হলে কারো সাথে বুক ভরে গল্প করার অভ্যাসে।
পৃথিবীতে আসলে এর চেয়ে বড় কোনো আসক্তি নেই। খাবার খাওয়ার অভ্যাস ভাঙা যায়, ঘুমের অভ্যাসও কমানো যায়। কিন্তু একবার কারো সাথে নিয়মিত কথা বলার অভ্যাস তৈরি হয়ে গেলে, সেটাকে ভাঙা মানে নিজের ভিতরের অর্ধেক ভেঙে ফেলা।
কথার নেশা
কথা বলা আসলে একধরনের আসক্তি। প্রথমে আমরা টের পাই না। মনে হয়, কারো সাথে দু’চারটা বাক্য বিনিময় করলেই বা কী এমন হবে! কিন্তু সেই সামান্য আলাপনই ধীরে ধীরে নীরবতার ভিত ভাঙতে শুরু করে। আমরা অভ্যস্ত হয়ে যাই একটি নির্দিষ্ট কণ্ঠস্বরের অপেক্ষায়, একটি নির্দিষ্ট নাম্বার থেকে আসা মেসেজের শব্দে, কিংবা রাত গভীর হলে কারো সাথে বুক ভরে গল্প করার অভ্যাসে।
এটাই সবচেয়ে ভয়ঙ্কর। কারণ অভ্যাস মানেই আসক্তি, আর আসক্তি মানেই নির্ভরশীলতা।
কথার ভয়ঙ্করতা
কথা হলো একরকম অদৃশ্য সুতো। যে সুতোর বাঁধন চোখে দেখা যায় না, কিন্তু ভেতরের সবকিছু জড়িয়ে ধরে রাখে। কথার ভেতর লুকিয়ে থাকে একধরনের নেশা—এতটাই তীব্র, যে সেটা নীরবতার চেয়েও গভীরভাবে মানুষকে শাসন করে।
প্রথমে হয়তো তুমি ভেবেছিলে, একদিন কথা না বললেও চলবে। কিন্তু হঠাৎ দেখবে, একদিন কথা না হলে তোমার ভেতরে অস্থিরতা বাড়ছে। মনে হবে, কিছু একটা নেই। ঘড়ির কাঁটা চলতে থাকে, কিন্তু সময় যেন আটকে আছে। একটা ফাঁকা জায়গা, যেটা পূর্ণ হওয়ার জন্য শুধু সেই মানুষটার কয়েকটা শব্দ দরকার।
কথা তাই শুধু আলাপন নয়, এটা একধরনের বেঁচে থাকার কৌশল হয়ে দাঁড়ায়।
যখন অভ্যাস ভাঙে
সবচেয়ে ভয়ঙ্কর হলো, এই অভ্যাস ভাঙা। হঠাৎ করেই যদি সেই মানুষটা আর না আসে, যদি তার কণ্ঠস্বর আর শোনা না যায়, যদি ফোনটা সারাদিন নিঃশব্দ পড়ে থাকে—তখন বুঝতে পারবে, পৃথিবীর সবচেয়ে মারাত্মক অভ্যাস এটাই।
কারণ কথা যখন থেমে যায়, তখন ভেতরের নিস্তব্ধতা আর আগের মতো থাকে না। সেটা আর শান্ত নীরবতা নয়, সেটা কেবলই যন্ত্রণার নিস্তব্ধতা। মাথার ভেতর ঘুরতে থাকে সেই সব পুরোনো শব্দ, পুরোনো হাসি, পুরোনো উচ্ছ্বাস। তুমি বারবার চেষ্টা করো ভুলতে, কিন্তু যত বেশি ভুলতে চাও, তত বেশি মনে পড়ে যায়।
কথার অভ্যাস তখন হয়ে ওঠে অভিশাপ।
কেন এটা মারাত্মক
মানুষকে হারিয়ে ফেললে আমরা তাকে ভুলতে পারি, সময়ের সাথে স্মৃতি ঝাপসা হয়ে যায়। কিন্তু যাকে নিয়ে আমাদের প্রতিদিনকার কথা বলার অভ্যাস তৈরি হয়ে গেছে, তাকে হারানো মানে প্রতিদিন এক নতুন শূন্যতায় ডুবে যাওয়া।
কথা হলো সেই সেতু, যা দুইজন মানুষকে অদৃশ্যভাবে বেঁধে রাখে। এই সেতু একবার তৈরি হলে সেটা ভাঙা যায়, কিন্তু ভাঙলে বিপর্যয় নেমে আসে। যে মানুষটা প্রতিদিনের নিয়মের মতো অভ্যাসে ঢুকে গিয়েছিল, সে অনুপস্থিত হলে জীবন অচল হয়ে যায়।
কথার সামাজিক দিক
একজন বন্ধুর সাথে প্রতিদিনের আলাপ আমাদের ভেতরের চাপ কমায়। একটা সাধারণ "কেমন আছ?" শুনলেই মনে হয় কেউ আমাদের খেয়াল রাখছে। পরিবারেও কথার আসর আছে—ডাইনিং টেবিলে সবার একসাথে বসা, গল্প করা, হাসি-ঠাট্টা। এগুলো আমাদের টিকিয়ে রাখে।
কিন্তু এখানেই ফাঁদ। এই অভ্যাস একবার গাঢ় হয়ে গেলে, সেটা ছাড়তে পারা অসম্ভব হয়ে ওঠে। হঠাৎ যদি সেই বন্ধু না থাকে, যদি পরিবারের হাসির আসর ভেঙে যায়, তখন প্রতিটি নীরবতা হয়ে ওঠে ভয়ের মতো।
নীরব বিকল্প
কথা না থাকলেও যোগাযোগ হয়। চোখের দৃষ্টিতে, নিঃশ্বাসের ভেতরে, কিংবা হাতে লেখা চিঠিতে। তবুও এগুলো কথা বলার আসক্তির বিকল্প নয়। কারণ আমরা মানুষ, আমরা শব্দে অভ্যস্ত।
কথা থেমে গেলে চোখও থেমে যায়, চিঠি লেখা হয় না। তখন বুঝি, নীরবতারও একটা সীমা আছে। কিন্তু কথার অনুপস্থিতি সীমাহীন কষ্ট তৈরি করে।
কথার স্মৃতিচিহ্ন
একসময়কার বলা কথা শুধু মুহূর্তেই শেষ হয় না। সেটা রয়ে যায় প্রতিধ্বনির মতো। হয়তো পুরোনো ফোনে রেকর্ড করা আছে কোনো কল, হয়তো ডায়েরির পাতায় রয়ে গেছে কারো শব্দে লেখা কিছু বার্তা। সেগুলো খুললেই আবার মনে পড়ে যায়, অভ্যাসটা কত গভীর ছিল।
সবচেয়ে কষ্টের ব্যাপার হলো, যেসব কথা একসময় বেঁচে থাকার মতো লেগেছিল, সময়ের সাথে সাথে সেগুলো হয়ে ওঠে বেদনার ছায়া। তবুও আমরা স্মৃতি আঁকড়ে ধরি।
কথার দ্বৈত রূপ
আসলে কথা একদিকে যেমন নির্মল আলো, অন্যদিকে তেমন গভীর অন্ধকার।
আলো তখন, যখন দুজন মানুষকে কাছে আনে, মন খুলে দেওয়ার সাহস জোগায়।
অন্ধকার তখন, যখন সে আলো নিভে যায় আর তুমি একা থেকে যাও।
তুমি বুঝতে পারো, পৃথিবীতে আসলে এর চেয়ে বড় কোনো আসক্তি নেই। খাবার খাওয়ার অভ্যাস ভাঙা যায়, ঘুমের অভ্যাসও কমানো যায়। কিন্তু একবার কারো সাথে নিয়মিত কথা বলার অভ্যাস তৈরি হয়ে গেলে, সেটাকে ভাঙা মানে নিজের ভিতরের অর্ধেক ভেঙে ফেলা।
কথার অনিবার্যতা
তবুও আমরা কথা বলি।
তবুও আমরা প্রতিদিন নতুন কারো দিকে হাত বাড়াই, কণ্ঠস্বরের সেতু গড়ি।
কেন?
কারণ মানুষ একা থাকতে পারে না। মানুষ একা থেকে বাঁচতে জানে না। তাই বারবার একই ভুল করে। একই মারাত্মক অভ্যাসে আবার জড়িয়ে পড়ে।
যেন আমরা নিজেরাই নিজের ক্ষতির দিকে এগিয়ে যাই। তবুও থামি না।
শেষ সত্য
সব শেষে দাঁড়িয়ে যে সত্যটা ধরা দেয়, সেটা হলো—কথা হলো সবচেয়ে শক্তিশালী নেশা। আর এই নেশাই একদিন সবচেয়ে বড় যন্ত্রণার কারণ হয়।
তুমি চাইলে পালাতে পারো না। কারো সাথে কথা বলা শুরু করলে, একদিন না একদিন তার অভ্যাস তোমাকে গিলে ফেলবেই।
তাই বলা যায়, পৃথিবীতে সবচেয়ে মারাত্মক অভ্যাস আসলেই একটাই—কারো সাথে কথা বলার অভ্যাস।
© ডক্টর নজরুল ইসলাম খান, সেপ্টেম্বর ৭, ২০২৫