11/04/2025
“পাত্রী দেখা ও একটি না-বলা কথা”
--------------------------------------------------
মুনতাসিরের বয়স আটাশ। কোনো চাকরি করে না, বড় কোনো স্বপ্নও নেই। সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে চায়ের কাপ হাতে বারান্দায় বসে থাকে। মা কখনো বলেন, “চা খা”, কখনো বলেন, “বিয়েটা কর।”
মুনতাসির চুপ করে থাকে। তার চুপ করে থাকার অভ্যাসটা বাবা মোটেও পছন্দ করেন না।
রফিক সাহেব অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংক কর্মকর্তা। নিয়মের মানুষ। সাতটায় নাস্তা, বারোটায় দুপুরের খাবার, বিকেলে খবরের কাগজে চোখ বুলিয়ে একটা
দীর্ঘশ্বাস—“এই ছেলের কী হবে!”
---
“কাল পাত্রী দেখতে যাব,” রফিক সাহেব ঘোষণা দিলেন। মুনতাসির মাথা তুলল না। জানালার বাইরে তাকিয়ে বলল, “যাব না।”
“তোর সবকিছুতেই না। একদিন গিয়ে চুপ করে বসে থাকবি, চা খাবি, চলে আসবি। এতে কী জাত যাবে?”
মা বললেন, “যাবি বাবা। মেয়ে নাকি খুব ভালো। মেডিকেলে পড়ে, খুব শান্ত। তোর মতো।”
“শান্ত মানুষ কি সবসময় সুখী হয়?”—মুনতাসির জিজ্ঞেস করল। কেউ উত্তর দিল না।
-----
মেয়ের বাসায় এলাহি কান্ড! চারপাশে সাজানো পিঠা, থরে থরে সাজানো ফল, পানির বোতল, ক্রিস্টালের গ্লাস। মায়ের গলায় সেই চিরন্তন গর্ব—“আমার মেয়েটা একটু চুপচাপ, বই পড়ে। রাঁধতেও পারে।”
মেয়েটার নাম শায়লা।
সে এল কিছুক্ষণ পর। মাথায় সাদা ওড়না, চোখে এলোমেলো ক্লান্তি। খুব অল্প কথায় বলল, “সালাম”।
রফিক সাহেব মুগ্ধ হলেন। বললেন, “মেয়েটা খুব শান্ত। একেবারে ঘরোয়া।”
---
শায়লা আর মুনতাসির ছাদে দাঁড়িয়ে আছে। চারপাশে সন্ধ্যার আলো, হালকা বাতাস। কারো মুখে কোনো কথা নেই।
“আপনি বই পড়েন?”—শায়লা জিজ্ঞেস করল।
“হ্যাঁ। পড়ি।”
“কী পড়েন?”
“হুমায়ুন আহমেদ। বেশি কিছু না।”
“হুমায়ুন আহমেদ আমার খুব প্রিয়,” — বলেই শায়লা চুপ করে গেল।
তারপর হঠাৎ বলল, “আমি একবার প্রেমে পড়েছিলাম।”
মুনতাসির তাকাল। শায়লা নিচে তাকিয়ে বলল, “ছেলেটা এখন অন্য কারো সাথে। বিয়েটা এক রকম জোর করেই মেনে নিচ্ছি।”
মুনতাসির একটু হাসল। বলল, “আমারটা ভিন্ন। আমি কখনো কাউকে ভালোবাসিনি। হয়তো পারিনি। হয়তো ভয় পেয়েছি।”
দুজনে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল।
---
মেয়ে দেখে রফিক সাহেব খুব উচ্ছ্বসিত। বললেন, “মেয়েটা তো একেবারে তোর জন্য! রাজি হয়ে গেলেই কাজি ডাকা যাবে।”
মুনতাসির শুধু বলল, “মেয়েটা এখনো কাউকে ভালোবাসে।”
“সবাই কারো না কারো ছিল একসময়। নতুন সম্পর্ক পুরানটাকে ঢেকে দেয়।”
“সব সম্পর্ক কি ঢেকে দেওয়া যায়?”
রফিক সাহেব বিরক্ত হলেন। বললেন, “তুই এমন কথা বলিস কেন রে?”
---
সপ্তাহ খানেক পর সালেহা খালার ফোন আসলো।
“আপনার ছেলে দারুণ। আমাদের মেয়ে সেদিন বলেছিল—ওর চোখে অনেক কিছু আছে, কিন্তু মুখে কিছুই বলে না। তার এই নীরবতাটাই আমার মেয়েকে কষ্ট দিয়েছে। ও রাজি না।”
রফিক সাহেব ফোন রেখে কিছুক্ষণ বসে থাকলেন।
পেছন থেকে মুনতাসির আস্তে বলল, “আমি তো বলেছিলাম, আমি যাব না।”
---
ঘুমাতে যাবার আগে মুনতাসির নিজের ঘরে “নন্দিত নরকে”র একটি পাতায় চোখ রাখল।
সেখানে লেখা—
“আমরা যাদের ভালোবাসি, তাদের কাছ থেকে চাইলেই পাওয়া যায় না। কখনো কখনো ভালোবাসাটাই যথেষ্ট না।”
তার মনে হলো, এই লাইনটা সম্ভবত তার জন্যই লেখা!
[আলমগীর কবির]