24/05/2025
ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাস থেকে ১৩ই ফেব্রুয়ারি, ২০০৭ এ পাঠানো গোপন টেলিগ্রামটিতে ড. ইউনূসের তৎকালীন রাজনৈতিক ভাবনা বুঝতে খুবই সহায়ক। আর ইতিহাস থেকে যদি শিক্ষা নেওয়ার কিছু থাকে তবে বর্তমানেও প্রাসঙ্গিক.
টেলিগ্রামটি হুবহু বাংলায় অনুবাদ করা হল:
বাংলাদেশের রাজনীতি
১. (SBU) সারসংক্ষেপ: ১২ ফেব্রুয়ারি, কনজেন (মার্কিন কনসাল জেনারেল) নোবেল পুরস্কার বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে তাঁর রাজনীতিতে আসার পরিকল্পনা নিয়ে কথা বলেন। কলকাতায় দুই দিনের সফরের সময় ইউনূস রাজনীতিতে প্রবেশের গভীর আগ্রহ প্রকাশ করেন এবং জানান তিনি বিভিন্ন বিকল্প বিবেচনা করছেন। তিনি তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের "জরুরি অবস্থা" ঘোষণার পক্ষে মত দেন এবং বলেন, এটি একটি সম্ভাব্য গৃহযুদ্ধ এড়াতে সহায়তা করেছে। ইউনূস মনে করেন, মুসলিম মৌলবাদীরা এক ধরনের প্রান্তিক গোষ্ঠী এবং মূল রাজনৈতিক দলগুলো কেবল ভোটের স্বার্থে মৌলবাদীদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলেছে; অধিকাংশ বাংলাদেশি চরমপন্থাকে সমর্থন করে না। তিনি ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক উন্নয়নের পক্ষে মত দেন। ইউনূস স্বীকার করেন যে, রাজনীতিতে প্রবেশ করলে তাঁর গৌরবময় ব্যক্তিত্ব কলুষিত হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। যদিও তিনি বলছিলেন যে, এখনো বিকল্পগুলো বিবেচনা করছেন, কিন্তু তাঁর কথায় স্পষ্ট ছিল যে, তিনি বাংলাদেশের রাজনীতির ঘূর্ণাবর্তে ঝাঁপ দেওয়ার জন্য প্রস্তুত।
২. (SBU) একজন বাঙালি হিসেবে অধ্যাপক ইউনূস ১১-১২ ফেব্রুয়ারি কলকাতায় বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের সময় নায়কের মতো সংবর্ধনা পান। কলকাতা চেম্বার অব কমার্সের ১৭৫তম বার্ষিকীতে আয়োজিত এক মধ্যাহ্নভোজে কনজেন তাঁর সঙ্গে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করেন। ১১ ফেব্রুয়ারি ইউনূস একটি খোলা চিঠিতে জানান যে, তিনি বাংলাদেশের সহিংসতা ও দুর্নীতির সংস্কার সাধনে একটি রাজনৈতিক দল গঠনের জন্য দেশবাসীর সমর্থন কামনা করছেন। কনজেন জানতে চান, সম্প্রতি সংবাদে প্রকাশিত তাঁর রাজনীতিতে আসার সিদ্ধান্ত সম্পর্কে তাঁর অভিমত কী। ইউনূস জানান, তিনি এতে আগ্রহী এবং অনেক মানুষই তাঁকে অনুরোধ করেছেন যাতে তিনি শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার মধ্যকার অচলাবস্থার অবসানে নেতৃত্ব দেন। তবে তিনি জানান, এখনো এ সিদ্ধান্তের উপযোগিতা নিয়ে আলোচনা করছেন। চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি মনোজ মোহাঙ্কা রাজনীতিতে যোগ দেওয়া ইউনূসের জন্য কতটা যুক্তিযুক্ত হবে তা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন এবং সম্ভাব্য বদনামের কথা বলেন। জবাবে ইউনূস বলেন, তিনি ঝুঁকি সম্পর্কে অবগত, তবে মনে করেন দায়িত্বশীল মানুষদেরই এগিয়ে এসে পরিবর্তন ঘটাতে হবে।
৩. (SBU) কনজেন ইউনূসকে জিজ্ঞেস করেন, The Economist ম্যাগাজিনের একটি প্রবন্ধ নিয়ে তাঁর মত কী, যেখানে বাংলাদেশের জরুরি অবস্থাকে "The Coup That Dare Not Say Its Name" বলে উল্লেখ করা হয়েছে। ইউনূস বলেন, জরুরি অবস্থা ঘোষণার ফলে গৃহযুদ্ধ এড়ানো গেছে। তিনি মনে করেন না যে সেনাবাহিনীর ভূমিকা খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল, বরং এটি সংবিধান অনুযায়ী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দায়িত্ব ছিল।
৪. (SBU) ভারতের দৃষ্টিতে বাংলাদেশে মৌলবাদের উত্থান নিয়ে জানতে চাইলে ইউনূস বলেন, মৌলবাদীরা এক প্রান্তিক গোষ্ঠী এবং বাংলাদেশের মূলধারায় তারা গ্রহণযোগ্য নয়। তবে কনজেন উল্লেখ করেন, এমনকি আওয়ামী লীগও ২০০৬ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশ খেলাফত মজলিশের (বিকেএম) সঙ্গে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল, যেখানে ইমামের জারি করা ফতোয়া স্বীকৃতি পাবে এবং শরিয়া-বিরোধী আইন পাস করা যাবে না বলে বলা হয়। ইউনূস বলেন, এটি আওয়ামী লীগের নৈতিক দেউলিয়াপনার পরিচয় এবং শুধুমাত্র রাজনৈতিক স্বার্থে করা হয়েছিল। এটি একটি নতুন রাজনৈতিক দলের প্রয়োজনীয়তাকেই প্রতিফলিত করে।
৫. (SBU) ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্ক উন্নয়নের সম্ভাবনা নিয়ে জানতে চাইলে ইউনূস ইতিবাচক মত দেন এবং দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা (SAARC) এর মধ্যে অর্থনৈতিক সম্পর্ক জোরদারের কথা বলেন। তিনি স্বীকার করেন যে, ভারতীয় বাজারে বাংলাদেশের পণ্যের প্রবেশে উল্লেখযোগ্য অ-শুল্ক বাধা রয়েছে। তিনি চট্টগ্রাম বন্দর ভারত, মিয়ানমার, ভুটান ও চীনের জন্য আঞ্চলিক বাণিজ্যে উন্মুক্ত করার পক্ষেও মত দেন, তবে বলেন, বন্দরটি বর্তমানে ছোট এবং সম্পূর্ণ সক্ষমতায় পরিচালিত হচ্ছে। তিনি জানান, গ্রামীণ ব্যাংক একটি "মেগা-পোর্ট" প্রকল্পে অর্থায়নের সম্ভাবনা বিবেচনা করছে।
৬. (SBU) মন্তব্য: যদিও ড. ইউনূস প্রকাশ্যে বলছিলেন যে, তিনি এখনো বিকল্প বিবেচনা করছেন, তবে তাঁর মন্তব্যে বাংলাদেশের রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে যোগ দেওয়ার প্রবল ইচ্ছার ইঙ্গিত পাওয়া যায়। তিনি বুঝতে পারছেন যে, তিনি “দুই নেত্রী” এবং অন্যান্য প্রভাবশালী রাজনীতিবিদদের কড়া প্রতিক্রিয়ার মুখে পড়বেন, কিন্তু তিনি মনে করেন দেশ এক সংকটময় সময় পার করছে এবং গৃহযুদ্ধ মাত্র এড়ানো হয়েছে। একজন নৈতিক ব্যক্তিত্ব এবং সংগঠক হিসেবে তাঁর অংশগ্রহণ হাসিনা-জিয়া দ্বন্দ্ব থেকে উত্তরণের একটি সম্ভাব্য পথ হতে পারে।
৭. (U) এই বার্তাটি ঢাকায় মার্কিন দূতাবাসের সঙ্গে সমন্বিতভাবে প্রস্তুত করা হয়েছে।
জারডিন
দ্রষ্টব্য:
SBU = Sensitive But Unclassified (সংবেদনশীল কিন্তু শ্রেণিবদ্ধ নয়)।
ConGen = Consul General (মার্কিন কনসাল জেনারেল)।
GOI = Government of India।