16/10/2025
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে এবার কালীপূজা হতে দেওয়া হবে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন দুটো কারণ তুলে ধরেন এই সিদ্ধান্তের। প্রথমতঃ তারা পূজাকালীন নিরাপত্তার দায়িত্ব নিতে পারবেন না। আচ্ছা! তবে কাদের দ্বারা পূজা মণ্ডপ আক্রা-ন্ত হবে বলে তারা মনে করছেন সেটা যদিও স্পষ্ট করেন নি। দ্বিতীয় কারণ হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সম্মানিত প্রক্টর নাকি দাবী করেছেন যে কালীপূজা উত্তরভারতীয় সংস্কৃতি তাই বিশ্ববিদ্যালয়ে কালীপূজা হতে দেওয়া হবে না। সনাতনী শিক্ষার্থীরা উনাকে এর পালটা জবাব দিতে পারতো, তখন অবশ্য ধর্মীয় অনুভূতির প্রশ্ন আসতো। আমাদের জন্য কিন্তু অনুভূতিতে আঘাতের বিষয়টা থাকতে নেই, থাকলে এতোক্ষণে উনার বিরুদ্ধে অবশ্যই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ব্যবস্থা নিতো।
যাইহোক উনি শিক্ষক মানুষ। উনি যেহেতু পড়াশোনা জানা মানুষ তাই উনার উদ্দেশ্য কিছু ফ্যাক্ট তুলে ধরছি। আশাকরি এরপর উনি লজ্জিত হয়ে উনার অজ্ঞতার জন্য উনার শিক্ষার্থীদের কাছে নি:শর্ত ক্ষমা চাইবেন।
কালীপূজা উত্তরভারতীয় সংস্কৃতি?
প্রথমত সনাতন সংস্কৃতিতে উত্তর ভারতীয় বা দক্ষিণ ভারতীয় কোন সংস্কৃতি নেই। সম্পূর্ণ আর্যাবর্তের প্রতিটি কোনায় কোনায় সনাতন সংস্কৃতি বিরাজ করছে, এমনকি বিশ্বের বহু প্রাচীন সভ্যতায়ও সনাতন সংস্কৃতির প্রভাব প্রমাণ করা হয়েছে। তবুও উনার জন্য বঙ্গের সাথে কালীপূজার সম্পর্ক নিয়ে কিছু বিষয় উপস্থাপন করছি।
কুমিল্লার লালমাইয়ে সহস্রাধিক বছরের প্রাচীন একটি কালীমন্দির রয়েছে যা "লালমাই চণ্ডী মন্দির" নামে পরিচিত। উনি কি জানেন মন্দিরটি কবে প্রতিষ্ঠিত? ৭ম শতকে অর্থাৎ আজ থেকে ১৪০০ বছর পূর্বে রানী প্রভাবতী মা কালীর উদ্দেশ্যে এই মন্দিরটি প্রতিষ্ঠিত করেন। তাই মা কালীর আরাধনা এই বঙ্গে কতোটা প্রাচীন তা উনার পড়াশোনার অনেক বাইরে।
পাল রাজবংশের সময় অর্থাৎ নবম, দশম ও একদশ শতকের দিকে বঙ্গে কালী সাধনা ব্যাপক আকার ধারণ করেছিলো। সে সময়ের বহু মূর্তি এখনও ব্রিটিশ বা আমেরিকার অনেক মিউজিয়ামে সংরক্ষিত আছে। মাননীয় প্রক্টর মহোদয় চাইলে ঘুরে আসতে পারেন।
অষ্টাদশ (১৭১৮ খ্রিস্টাব্দ) শতকে বঙ্গের মহান কবি ও সাধক রামপ্রসাদ মা কালীকে উদ্দেশ্য করে অসংখ্য গান রচনা করেছিলেন। তাঁর রচিত "একবার কালী বল রে মন" এখনও কালীপূজার অন্যতম অনুসঙ্গ। ১৯১৪ সালের দিকে চট্টগ্রামের সন্তান রামকৃষ্ণ পরমহংস দেবের অনুপ্রেরণায় বিভিন্ন শাস্ত্রের সারস্বরূপ মাতৃশক্তিকে নিয়ে আদ্যাস্তোস্ত্র রচনা করেন। কি লিখেছেন?
"কালিকা বঙ্গদেশে চ-অযোধ্যায়াং মহেশ্বরী।
বারাণস্যামন্নপূর্ণা গয়াক্ষেত্রে গয়েশ্বরী।।"
অর্থাৎ, বঙ্গদেশে তিনি দেবী কালিকা রূপে বিরাজমান।
বঙ্গে কালী সাধনা এতো ব্যাপক ছিলো যে আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম কালীতত্ত্বে প্রভাবিত হয়ে "অগ্নিবীণা", "চন্দ্রবিন্দু" ও "দোলনচাঁপা" এর মতো গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। তাঁর রচিত বিখ্যাত শ্যামাসংগীতের মধ্যে রয়েছে "জাগো মা কালী, জাগো রে শঙ্করী", " আমার কালো মায়ের পায়ের তলায়" ইত্যাদি। এমনকি তিনি মা কালীকে শুধু বঙ্গে নয়, বিশ্বমাতা হিসেবে প্রচার করেছিলেন। তিনি লিখেছিলেন,
"মা, তোর কৃপা আগুন হয়ে
জ্বালুক মোরে, জ্বালুক বিশ্বে।"
আমি নিশ্চিত মাননীয় প্রক্টর মহোদয় তার অজ্ঞতার জন্যই এমন আপত্তিকর মন্তব্য করেছেন। তিনি এই বিষয়ে যথেষ্ট পড়াশোনা করে তার অনাকাঙ্ক্ষিত মন্তব্যের জন্য ক্ষমা চাইবেন এটাই প্রত্যাশা। তাছাড়া উনি যে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর হয়েছেন সেটাও কালীসাধকদের দানকৃত জমিতে প্রতিষ্ঠিত৷ এই বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ২০১৯ সালের পূর্বে প্রতিবছরই কালীপূজা হতো, তারপর করোনা মহামারির সময় বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর এই বছর শিক্ষার্থীরা এবার পুনরায় তা শুরু করার প্রয়াস করেছিলো। তাতেই বাদ সাধে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন!
:@অনিক কুমার সাহা