12/06/2025
#সিরাজগঞ্জ ও নজরুল।
দুইজন মহান ব্যাক্তির ছায়া আমাদের এই সিরাজগঞ্জের, ভুমিকে করেছে গৌরবময়, একজন হলেন, যিনি তাহার নামেই আমাদের এই জেলার নাম করণ "মৌলানা সৈয়দ ইসমাইল হোসেন শিরাজী সাহেব"।
অন্যজন হলেন মানুষের কবি, বিদ্রোহী "কাজী নজরুল ইসলাম"। তাহাদের দুজনের আত্মার যে, মিল বা সঙ্গম তাহার লিখা পড়ে আমি বিমহিত, মুগ্ধ, আপ্লুত।
আজ সিরাজগঞ্জে আসিয়া সর্বপ্রথম অভাব অনুভব করিতেছি আমাদের মহানুভব নেতা—বাংলার তরুণ মুসলিমের সর্বপ্রথম অগ্রদূত, তারুণ্যের নিশান-বর্দার মৌলানা সৈয়দ ইসমাইল হোসেন শিরাজী সাহেবের। সিরাজগঞ্জের শিরাজীর সাথে বাংলার শিরাজ বাঙলার প্রদীপ নিভিয়া গিয়াছে ৷ যাঁহার অনল-প্রবাহ-সম বাণীর গৈরিক নিঃস্রাব জ্বালাময়ী ধারা-মেঘ-নীরন্ধ্র গগনে অপরিমাণ জ্যোতি সঞ্চার করিয়াছিল, নিদ্রাতুরা বঙ্গদেশ উন্মাদ আবেগ লইয়া মাতিয়া উঠিয়াছিল, “অনল-প্রবাহের” সেই অমর কবির কণ্ঠস্বর বাণীকুঞ্জে আর শুনিতে পাইব না। বেহেশতের বুলবুলি বেহেশতে উড়িয়া গিয়াছে। জাতির কওমের, দেশের যে মহাক্ষতি হইয়াছে, আমি শুধু তাহার কথাই বলিতেছি না, আমি বলিতেছি, আমার একার বেদনার ক্ষতির কাহিনী। আমি তখন প্রথম কাব্য-কাননে ভয়ে ভয়ে পা টিপিয়া টিপিয়া প্রবেশ করিয়াছি—ফিঙে-বায়স, বাজপাখির ভয়ে ভীরু পাখির মত কণ্ঠ ছাড়িয়া গাহিবারও দুঃসাহস সঞ্চয় করিতে পারি নাই, নখচঞ্চুর আঘাতও যে না খাইয়াছি এমন নয়—এমনি ভীতির দুর্দিনে মনি-অর্ডারে আমার নামে দশটি টাকা আসিয়া হাজির। কুপনে শিরাজী সাহেবের হাতে লেখা : “তোমার লেখা পড়িয়া খুশি হইয়া দশটি টাকা পাঠাইলাম। ফিরাইয়া দিও না ব্যথা পাইব। আমার থাকিলে দশ হাজার টাকা পাঠাইতাম।” চোখের জলে স্নেহসুধা-সিক্ত ঐ কয় পঙক্তি লেখা বারে বারে পড়িলাম। টাকা দশটি লইয়া মাথায় ঠেকাইলাম। তখনো আমি তাঁহাকে দেখি নাই। কাঙাল ভক্তের মত দূর হইতেই তাঁহার লেখা পড়িয়াছি, মুখস্থ করিয়াছি, শ্রদ্ধা নিবেদন করিয়াছি। সেইদিন প্রথম মানস-নেত্রে কবির স্নেহ-উজ্জ্বল মূর্তি মনে মনে রচনা করিলাম, গলায় পায়ে ফুলের মালা পরাইলাম। তাহার পর ফরিদপুর বঙ্গীয় প্রাদেশিক কনফারেন্সে তাঁহার জ্যোতিঃ বিমণ্ডিত মূর্তি দেখিলাম। দুই হাতে তাঁহার পায়ের তলায় ধূলি কুড়াইয়া মাথায় মুখে মাখিলাম। তিনি আমায় একেবারে বুকের ভিতর টানিয়া লইলেন, নিজে হাতে করিয়া মিষ্টি খাওয়াইয়া দিতে লাগিলেন। যেন বহুকাল পরে পিতা তাহার হারানো পুত্রকে ফিরাইয়া পাইয়াছেন। আজ সিরাজগঞ্জে আসিয়া বাঙলার সেই অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি মনস্বী দেশ-প্রেমিকের কথাই বারে বারে মনে হইতেছে। এ যেন হজ্জ করিতে আসিয়া কাবা-শরিফ না দেখিয়া ফিরিয়া যাওয়া। তাঁহার রুহ মোবারক হয়ত আজ এই সভায় আমাদের ঘিরিয়া রহিয়াছে। তাঁহারই প্রেরণায় হয়ত আজ আমরা তরুণেরা এই যৌবনের আরাফাত ময়দানে আসিয়া মিলিত হইয়াছি। আজ তাঁহার উদ্দেশ্যে আমার অন্তরের অন্তরতম প্রদেশ হইতে শ্রদ্ধা তসলিম নিবেদন করিতেছি, তাঁহার দোওয়া ভিক্ষা করিতেছি।
আপনারা যে অপূর্ব অভিনন্দন আমায় দিয়াছেন, তাহার ভারে আমার শির নত হইয়া গিয়াছে, আমার অন্তরের ঘট আপনাদের প্রীতির সলিলে কানায় কানায় পুরিয়া উঠিয়াছে। সেই পূর্ণ ঘটে আর শ্রদ্ধা প্রতি-নিবেদনের ভাষা ফুটিতেছে না। আমার পরিপূর্ণ অন্তরের বাকহীন শ্রদ্ধা-প্রীতি-সালাম আপনারা গ্রহণ করুন। আমি উপদেশের শিলাবৃষ্টি করিতে আসি নাই। প্রয়োজনের অনুরোধে যাহা না বলিলে নয়, শুধু সেইটুকু বলিয়াই আমি ক্ষান্ত হইব।
তরুণের সাধনা (১৯২০)– কাজী নজরুল ইসলাম।