17/09/2025
বাংলাদেশে সম্প্রতি ঘটে যাওয়া এক হৃদয়বিদারক ঘটনা আমাদের সমাজের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে উদাসীনতাকে আবারও সামনে নিয়ে এসেছে। এক মা তার ছয় মাস বয়সী শিশুকে গলা কেটে হত্যা করেছেন। পুলিশের সামনে তিনি অবলীলায় স্বীকার করেছেন যে, সন্তান জন্মের পর থেকে তিনি ভালোভাবে রান্না করতে পারেননি, বড় সন্তানের যত্ন নিতে পারেননি, আর সেই কারণেই তিনি নিজেই শিশুটিকে হত্যা করেছেন। এমন স্বীকারোক্তি শুধু ভয়ঙ্করই নয়, বরং আমাদের সমাজের অদৃশ্য এক ব্যর্থতার প্রতিচ্ছবি।
শিশুর জন্ম একটি পরিবারের জন্য আনন্দের মুহূর্ত হলেও, একজন মায়ের জন্য এটি এক কঠিন পরীক্ষার সময়। এই সময়ে তিনি শারীরিক ও মানসিক নানা পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে যান। চিকিৎসাবিজ্ঞানে এর নাম পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশন—প্রসব-পরবর্তী বিষণ্নতা। এটি এমন একটি অবস্থা যেখানে মা অসহায়তা, ক্লান্তি, আত্মগ্লানি এমনকি শিশুর প্রতি বিরূপ চিন্তার মতো ভয়ংকর অনুভূতির শিকার হতে পারেন। কিন্তু দুঃখজনকভাবে আমাদের সমাজে এই বিষয়টি এখনো স্বীকৃতি পায় না, বরং “নাটক” বা “অজুহাত” বলে এড়িয়ে যাওয়া হয়।
প্রতিটি মায়ের পাশে তার পরিবার—বিশেষ করে স্বামী—সবচেয়ে বড় ভরসা হওয়ার কথা। কারণ সন্তান জন্মের পর একজন মা শারীরিক দুর্বলতার পাশাপাশি মানসিক অস্থিরতায়ও ভুগতে থাকেন। এ সময় স্বামী যদি ঘরের কাজে সহায়তা করেন, সন্তানের দায়িত্ব ভাগ করে নেন, স্ত্রীকে আশ্বস্ত করেন এবং সমালোচনার বদলে বোঝাপড়া দেখান, তবে মা নিজেকে একা মনে করেন না। দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদের সমাজে খুব কম স্বামী এই দায়িত্ব স্বতঃস্ফূর্তভাবে গ্রহণ করেন। বরং অনেক সময় পরিবার থেকে চাপ সৃষ্টি করা হয়, যা মায়ের অবস্থা আরও জটিল করে তোলে।
এমন পরিস্থিতিতে সমাজের দায়িত্বও কম নয়। প্রসব-পরবর্তী মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে সচেতনতা তৈরি করা অত্যন্ত জরুরি। হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রে শারীরিক চিকিৎসার পাশাপাশি মানসিক পরামর্শ সেবা যুক্ত হওয়া উচিত। মিডিয়া ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকেও এ বিষয়ে খোলামেলা আলোচনা শুরু করতে হবে, যাতে মায়েরা নিজেদের সমস্যাকে লুকিয়ে না রেখে সাহসের সঙ্গে প্রকাশ করতে পারেন।
ছয় মাস বয়সী একটি শিশুর মৃত্যু কেবল একজন মায়ের অপরাধ নয়, এটি পুরো সমাজের ব্যর্থতা। আমরা যদি সময়মতো মায়েদের মানসিক অবস্থার প্রতি মনোযোগী হতাম, যদি পরিবার দায়িত্বশীল আচরণ করত, তবে হয়তো এই শিশুটি আজও বেঁচে থাকত। এই করুণ ঘটনার শিক্ষা আমাদের একটি কথাই মনে করিয়ে দেয়—একজন মায়ের যত্ন মানে শুধু সন্তান জন্ম দেওয়ার পর তাকে বিশ্রাম দেওয়া নয়, বরং তার মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতিও সমান যত্নবান হওয়া। সন্তানের জন্মের আনন্দ তখনই পূর্ণতা পাবে, যখন মা নিজেকে নিরাপদ, ভালোবাসায় ঘেরা এবং বোঝাপড়ার পরিবেশে খুঁজে পাবেন।