23/09/2025
“আমি চাই তুই তোর বউ নিয়ে আলাদা হয়ে যা শাওন।”
মায়ের কথা শুনে শাওন হতভম্ব হয়ে যায়। সে বিষ্ময় নিয়েই বলে,“মা কী হয়েছে? রূপা তোমার সাথে খারাপ আচরণ করেছে? তোমাকে কষ্ট দিয়েছে? তুমি রূপার উপর রাগ করে আমাদের আলাদা হয়ে যেতে বলছো?”
“রূপা তোর বউ। তোর দায়িত্ব। তোর ভালোবাসা। বউরে সম্মান, ভালোবাসা না দিলে সংসার জীবন সুখের হবে না তোর। তাই কিছু না জেনে সব কথায় বউয়ের দোষ খোঁজার চেষ্টা করিস না শাওন। এটা খুবই খারাপ গুন।”
কথাগুলো বলে মা শাওনের দিকে শান্ত চোখে তাকায়। শাওন কিছুটা লজ্জা পায়। তার মা তাকে শান্ত কন্ঠে বলে,“রূপা খুব ভালো মেয়ে। ও কিছু করেনি।”
“তাহলে আমাদের আলাদা হয়ে যেতে বলছো কেন?”
শাওন কথাটি জিজ্ঞেস করে উত্তরের আশায় মায়ের দিকে তাকিয়ে আছে। তার মা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,“তেমন কিছু না। আমি আসলে তোর বাবার সাথে একা থাকতে চাই। জয়েন ফ্যামিলি হওয়ায় তোর বাবার সাথে একা কখনো সংসার করা সম্ভব হয়নি। কিন্তু আমার খুব শখ ছিলো তার সাথে একা সংসার করবো, একটু এই আনন্দের অনুভূতি কেমন সেটা অনুভব করবো। কিন্তু তা কখনো হয়নি। আগে শ্বশুড়, শাশুড়ী, ননদ, দেবর এদের জন্য হয়নি। এখন এই বয়সে এসে তোর এবং তোর বউয়ের জন্য হচ্ছে না। তাই আমি চাচ্ছি তোরা আলাদা হয়ে যা।”
”এই ব্যাপার। তুমি আগে বলবে না মা। তোমার স্বপ্ন যদি এটাই হয় তাহলে আমি আলাদা হতে রাজি আছি মা। তুমি এবং বাবা এখন যদি সময়টাকে নিজেদের মতো করে উপভোগ করতে চাও তখন আমার সন্তান হিসাবে দায়িত্ব তোমাদের এমন সুন্দর জীবন দেওয়া।”
শাওনের কথায় মা মাথা নাড়ায়। দু’জনে কথা বলে সিদ্ধান্ত নেয়, শাওন এই মাসের বেতন পেলে বাসা ভাড়া খুঁজবে অফিসের আশেপাশে। পরের মাসে সেখানে চলে যাবে। শাওনের মা এতে সম্মতি জানায়। শাওন মজা করে মাকে বলে,“মা তোমার আর বাবার আলাদা সুন্দর সংসারে আমরা অতিথি হিসাবে আসতে পারবো তো? এখানে না বলো না মা। আমি কিন্তু তোমাদের না দেখে থাকতে পারবো না। তাই তোমাদের সুন্দর স্বপ্নের মাঝে হুট করে চলে আসতে পারি।”
“পাগল ছেলে। এটা তোর বাড়ি। তুই আসবি না তো কে আসবে? তোরা এখানে আসবি, আমরা তোদের ওখানে যাবো।”
মায়ের কথা শুনে শাওন মুচকি হাসে। তারপর সিরিয়াস ভঙ্গিতে বলে,“মা সত্যি এটাই তো তুমি তোমার এবং বাবার একার সংসারের স্বপ্ন পূরণ করার জন্য আমাদের আলাদা করে দিচ্ছো।”
মা কিছুটা হচচকিয়ে যায়। পরক্ষণে নিজেকে সামলে বলে,“হ্যাঁ। এটাই সত্যি রে। তোর বাবার সাথে একা সংসার করার বড় স্বাদ ছিলো রে। সেটার জন্যই তোদের আলাদা করছি।”
__
সময় বয়ে চলে তার নিজস্ব গতিতে। তাই তো দিন পেরিয়ে দিন আসে। দেখতে দেখতে শাওনদের নতুন বাসায় ওঠার দিন চলে আসলো। আগামীকাল তারা এই বাড়ি থেকে চলে যাবে। আজ শাওনের মা সব শাওন এবং রূপার পছন্দের খাবার রান্না করেছে। রাতে শাওন তৃপ্তি করে খেয়ে বলে,“এই সুস্বাদু খাবার খুব মিস করবো মা। যদি এটা তোমার স্বপ্ন না হতো তাহলে কখনোই আমি এই সিদ্ধান্ত নিতাম না।”
রূপাও শাওনের কথায় সম্মতি জানায়। শাওনের মা কিছু বলে না। তার বাবা তার মায়ের দিকে ম্লান চোখে তাকায়।
*
রাতের বেলা শাওনের মা না ঘুমিয়ে খাটের এক পাশে বসে নিরবে চোখের পানি বিসর্জন দেয়। এটা দেখে তার বাবা বিরক্ত হয়ে বলে,“বুড়ো বয়সে ভিমরতিতে ধরেছে তোমায়। যখন ছেলের চলে যাওয়ায় এতই কষ্ট পাবে তাহলে এসব ফাল তু স্বপ্নের কথা মনে করে তাদের আলাদা করলে কেন? বুড়ো বয়সে কত শখ। স্বামীর সাথে আলাদা সংসার করবে।”
শেষ কথাটি ব্যঙ্গ করে বলে। মা তার কথা শুনে বিদ্রুপেরসুরে হাসি দিয়ে বলে,“না গো। বুড়ো বয়সে আমার কোন শখ জাগেনি। যে মানুষটাকে শখের বয়সে পেলাম না তাকে এই বয়সে চেয়ে কী করবো?”
“মানে?”
বাবা বুঝতে না পেরে কথাটি বলে। মা তার দিকে তাকিয়ে অভিমানের গলায় বলে,“তোমার মধ্যে তেমন কোন গুন নেই যার জন্য তোমার সাথে আলাদা, একান্ত সময় কাটানোর স্বপ্ন দেখবো আমি। এত স্বপ্ন আমি দেখি না।”
“কী বলতে চাও তুমি? যদি এটাই না হয় তাহলে ছেলেকে আলাদা করছো কেন?”
বাবার এই কথার জবাবে মা সুন্দরভাবে বলে,“দূরে থাকলে সম্পর্ক ভালো থাকবে।”
বাবা কিছু বলতে নেয় কিন্তু তাকে বলার সুযোগ না দিয়ে মা পুনরায় বলে,“আমার ছেলে যখন তার বউকে নিয়ে ঘুরতে বের হয় তখন আমার বড্ড হিংসা হয়। আমিও তো নতুন বউ ছিলাম। কই আমাকে নিয়ে তো তুমি কখনো ঘুরতে যাওনি? আমি যখন বৌমাকে বলি, রান্নায় এত তেল খরচ করছো কেন? তখন আমার ছেলে তার হয়ে বলে, তেল শেষ হয়ে গেলে আমি কিনে দিবো। এই নিয়ে কিছু বলো না। তখনও আমার হিংসা হয়। কই আমার হয়ে তুমি তো কখনো এই কথা বললে না। উল্টো তেল বেশি কেন দিয়েছি এই কৈফিয়ত তোমার মাকে দিতে পারিনি বলে কু কুরের মতো মে রেছো। ভবিষ্যতে আমার ছেলে বউয়ের জন্য অনেককিছু করবে, যা আমার হিংসা আফসোস বাড়িয়ে দিবে। এক পর্যায়ে তাদের সুখ সহ্য করতে না পেরে যদি আমি তাদের সুখের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াই। তখন তো সব শেষ হয়ে যাবে। সংসারে অশান্তি হবে। সম্পর্ক খারাপ হবে। আমি সেসব চাই না গো।
এই দুনিয়ায় কেউ কারো মনের দুঃখ বোঝে না গো। আমি যে কোন আফসোসে কোন দুঃখে এসব করছি তা বৌমা বুঝবে না। কারণ বৌমাদের তো জন্মের পর থেকেই মনে হয় বোঝানো হয় শাশুড়ী মানেই দজ্জাল। আর আমার হিংসায় বলা কথাগুলো তো তাকে কষ্ট দিবে। সে তো আজকালকার মেয়ে, আমাদের যুগের না। যে শত কষ্ট সয়ে এসে শাশুড়ীর পায়ে পড়বে। উল্টো শাশুড়ীর সাথে তর্ক করবে। করাই উচিত। কোন অন্যায় না করে কথা শোনালে তো মুখ খোলাই উচিত। সেই মুখ খুললেই তো আমি আর বৌমা হয়ে উঠবো দু’জনার চোখের বিষ। আমি চাই না এমন কিছু হোক। আমি যা পাইনি সেটা সে পাক আমি তাই চাই। আমি চাই না তার পূর্ণতা দেখে আমার কষ্ট হোক। আমি আমার ছেলের সুখে সুখী হতে চাই। সেজন্য তাদের আলাদা করে দিচ্ছি। তোমার সাথে সংসার সংসার আদিখ্যেতার জন্য নয়।”
মা কথাগুলো বলে বাবার দিকে তাকায়। বাবা অসহয় চোখে তাকিয়ে আছে। আজ তার বলার কিছুই নেই। বয়সের সময় কখনো নিজের স্ত্রীর শখ, আহ্লাদ সম্পর্কে জানতে চায়নি। কখনো তার জন্য কিছু করেনি। কোন দায়িত্বও পালণ করেনি। উল্টা অন্যদের কথায় গায়ে হাত তুলেছে। আজ যখন এসব বুঝতে পারছে তখন সবকিছু তার হাতের বাহিরে চলে গেছে। বাবাকে যে আর মা ভালোবাসে না। মা সারাজীবন ধরে শুধু দায়িত্ব পালণ হিসাবে সব করে গেছে। বাবার প্রতি থাকা ভালোবাসা তো সব ম রে গেছে বহুআগে। এখন বাবা এসব বুঝতে পারে।
মা বাবার অসহয় মুখ দেখে ম্লান হেসে বলে,“এভাবে তাকিও না গো।”
“আমাকে মাফ করে দিও শাওনের মা।”
বাবার অনুতাপে ভরা কথা শুনে মায়ের চোখ দিয়ে গড়িয়ে পানি পড়ে। সে শান্ত গলায় বলে,“না শাওনের বাবা। যে বয়সে ভালোবাসার দরকার ছিলো তখন আমি তোমার শুধু চাহিদা ছিলাম। আর আজ মাফ চেয়ে ভালোবাসা দেখাতে চাইছো। এমনটা করো না গো। এখন আর ভালোবাসার প্রয়োজন নেই আমার।”
বাবা মাথানত করে ফেলে। মা আবারও বলে,“সবাই বলে শাশুড়ীরা ছেলের বউয়ের সুখ সহ্য করতে পারে না। হ্যাঁ পারে না। কিভাবে পারবে? যেসব শখ তার পূরণ হয়নি সেসব শখ তার চোখের সামনে অন্যকারো পূরণ হচ্ছে এসব যে তাকে কতটা কষ্ট দেয় তা কেউ বোঝে? বোঝে না।
একদিন তুমি আমার জন্য একটি শাড়ী নিয়ে আসছিলে। সেটা আমার খুব পছন্দ হয়েছিলো। কিন্তু সেই শাড়ীটা যখন তোমার বোন বললো তার পছন্দ হয়েছে, তার চাই। তখন তুমি কী করলে? সঙ্গে সঙ্গে তাকে দিয়ে দিলে। আর আজ যখন আমার খুঁকির ভাবীর একটি শাড়ী পছন্দ হলো তখন আমার ছেলে বললো সে অন্য একটা কিনে দিবে, এটা তার ভাবীর। আজ আমি বৌমাকে কোন কথা বললে তার ঢাল হয়ে আমার ছেলে দাঁড়ায়। এসব দেখে আমিও তো অতীতে চলে যাই। আমারও তো মনে হয় আমার সাথে যখন এসব হচ্ছিলো তখন যদি তুমি প্রতিবাদ করতে তাহলে তো সব সমস্যা মিটে যেতো। কিন্তু করোনি।
আমার আজও মনে পড়ে, যখন আমার গর্ভে শাওন ছিলো তখন আমি নয়টা মাস ভাত ছাড়া কিছু পাইনি। ফল খেতে ইচ্ছে করলেও পাইনি। সকাল ছয়টা থেকে সন্ধ্যায় সাতটা অব্দি গাধার মতো খেটেছি। তারপর সন্তান জন্ম দিয়েছি। কিন্তু আজকাল তো তা হয় না। আজকাল বউরা পোয়াতি হলেই বিছানায় পড়ে যায়, তাদের এটা সেটা ইচ্ছে হয়। ঘরের মধ্যে একটি জগ জাগানোর শক্তি হয় না। কিন্তু আমাদের সময় নয় মাসের ভরা পেট নিয়ে কলস ভর্তি পানি টানা লাগছে, ধান সিদ্ধ করা লাগছে। যখন আমার শাওনের বউ পোয়াতি হবে তখন তো সে কিছু করতে চাইবে না। ঘরের সামান্য কাজ করতেও অসুবিধা হবে। আর চোখের সামনে এসব তো আমার সহ্য হবে না। কিছু বললেই আবার আমার ছেলের সাথে তর্ক বেধে যাবে। তখন সারা দুনিয়া বলবে শাশুড়ী ভালো না। সে এত এত খারাপ। আমি এসব চাই না। সারাজীবন সংসারিক কলহের মাঝে কাটিয়েছি। কিন্তু আজ চাই না। তাই সময় থাকতে শাওন এবং রূপাকে আলাদা করে দিলাম। ওরা দূরে ভালো থাকুক। সুখে থাকুক।”
কথাগুলো বলে মা নিজের চোখের পানি মুছে নেয়। তারপর আবারও বলে,“তাই আমার যতই কষ্ট হোক না কেন, ওরা চলে যাক এটাই আমি চাই।”
বাবা কোন জবাব দেয় না। তার চোখেও অশ্রু এসে জমে। মা এটা বুঝতে পেরে বলে,“অনেক রাত হয়েছে ঘুমিয়ে পড়ো।”
কথাটি বলে মা বিছানার একপাশে শুয়ে পড়ে। বাবা মায়ের দিকে অসহয় চোখে তাকিয়ে থাকে। যে বয়সে এসব বোঝা উচিত ছিলো সেই বয়সে বুঝেনি। তাই এই বয়সে বুঝে এখন আফসোস করা ছাড়া কিছুই করার নেই তার।
–
সকাল সকাল শাওন এবং রূপা তৈরি হয়ে নেয়। তাদের সকল ব্যাগপত্র গুছিয়ে নেয়। আজ তারা নতুন বাড়িতে উঠবে। মা এসে হাতে হাতে তাদের ব্যাগ গুছিয়ে দিচ্ছে। অতঃপর নিচে গাড়ি আসতে শাওন ঘরে এসে বলে,“গাড়ি চলে এসেছে। চলো রূপা।”
“হ্যাঁ চলো।”
রূপা খুশিমনে কথাটি বলে। রূপা এবং শাওন বাবা-মায়ের থেকে বিদায় নেয়। তাদের বিদায় দেওয়ার সময় মা শাওনকে বলে,“স্ত্রী স্বামীর দূর্বলতা নয় শক্তি। তার যথাযথ মর্যাদা করিস। আমি জানো কখনো শুনি না, তুই বৌমাকে কোন কারণে কষ্ট দিয়েছিস। তাহলে খুব খারাপ হবে।”
”মা তুমি শুধু আমাদের জন্য দোয়া করো। আমরা যাতে সবসময় একসাথে এভাবে থাকতে পারি। আমি আমার সকল দায়িত্ব কর্তৃব্য পালণ করতে পারি। তোমার দোয়া সঙ্গে থাকলে আমি সব পারবো মা। আমার দ্বারা রূপা কখনো কষ্ট পাবে না।”
শাওনের এই কথায় মা ম্লান হাসে। বাবা এসে শাওনের মাথায় হাত রেখে বলে,“দোয়া করি তোরা সবসময় ভালো থাক। একজন ভালো স্বামী হও। সেই সাথে ভালো সন্তানও হও শাওন। তোমার মায়ের জন্য হলেও অন্তত হও ভালো সন্তান।”
শাওন মাথা নাড়ায়। অবশেষে রূপা এবং শাওন বেরিয়ে যায়। তারা তাদের নতুন বাড়ির উদ্দেশ্য চলে যায়। যেখানে তাদের দু'জনার সুন্দর একটি সংসার তাদের জন্য অপেক্ষা করছে। শাওনরা চলে যেতে শাওনের মা মনেমনে বলে,“প্রত্যেক মেয়েই বোধহয় একটি আলাদা সংসার ডিজার্ব করে। মা হিসাবে দোয়া করি, ওদের সংসার সুখের হোক।”
(সমাপ্ত)
সংসার