20/10/2025
মোহাম্মদপুর :- ৪০০ বছরের পথচলার ইতিহাস ||
সাত মসজিদের ছায়া ও সময়ের স্রোত -------
ঢাকার ইতিহাস বলতে গেলে নদী আর মোগল যুগের গল্প না বললেই নয়। সেই ধারাবাহিকতায় মোহাম্মদপুর—আজকের ঘনবসতি, আবাসিক ব্লক আর ব্যস্ত সড়কের আড়ালে লুকিয়ে আছে চার শতকের স্মৃতি।
মোগল আমল থেকে সূচনা
১৭শ শতকে (শায়েস্তা খাঁর সময়) মোহাম্মদপুরের যে অঞ্চলটি ছিল ঢাকার পশ্চিম প্রান্তের বন্যাপ্লাবিত চরভূমি, সেখানেই ওঠে ঐতিহাসিক সাত গম্বুজ মসজিদ। স্থাপত্যের দিক থেকে একে অনন্য করে তুলেছে সাতটি গম্বুজের বিন্যাস, চার কোনায় মিনার ও সুবিন্যস্ত মুগল অলংকরণ। কাছেই ছিল এক অজ্ঞাত নারীর সমাধি—বিবির মাজার নামে লোকমুখে পরিচিত।
কথিত আছে, নবাব শায়েস্তা খাঁর কোনো এক মেয়ের কবর এটি। তবে বিষয়টি নিশ্চিত নয়।
সাইনবোর্ডে লেখা: অজানা সমাধি।
“সাত মসজিদের পাশেই ছিল বুড়িগঙ্গা”—আজ কোথায়?
পুরনো ঢাকার প্রাণ বুড়িগঙ্গা একসময় সাত মসজিদের একেবারে কাছ ঘেঁষে বইত। নদীর ধারা ক্রমে দক্ষিণে সরে যেতে থাকায় আজ মসজিদটি পড়েছে ভিতরের দিকে; এখন বরং তুরাগ ও বোসিলা-ঘাটের জলভূমিই নিকটবর্তী। নদীপথ বদলের সঙ্গে সঙ্গে পুরনো শাখাচ্যানেল (মোরাখারি/Old Channel) নানা জায়গায় ভরাট-দখলে সংকুচিত হয়েছে—বোসিলা থেকে লোহা-পুল পর্যন্ত সেই পুরনো ধারা আজও নথিতে টিকে আছে।
“মোহাম্মদপুর” নামের ইতিহাস:-
“মোহাম্মদপুর” নামটা নতুন DIT-এর বসতি গড়ার সময় (১৯৫০–৬০ দশক) বেছে নেওয়া হলেও নামটি নিজে অনেক পুরনো; এলাকাটা ব্রিটিশ আমল থেকেই “Muhammadpur/Mohammadpur” নামে মৌজা/গ্রাম হিসেবে নথিভুক্ত ছিল। নিচে নামকরণটা বোঝার তিনটি স্তর দিলাম—ভাষাগত, নথিগত, আর আধুনিক নগরায়ণ।
১) ভাষাগত উৎস (নামের অর্থ)
“মোহাম্মদ/মুহাম্মদ” + “পুর/পুরা” (সংস্কৃত pur = বসতি/নগর) → অর্থ দাঁড়ায় “মুহাম্মদের বসতি/নগর”।
এই গঠনটা মোগল-সুলতানি আমল থেকে পুরো বঙ্গদেশে খুব প্রচলিত (যেমন মিরপুর, যশোরের চন্দনপুর ইত্যাদি)।
২) পুরনো নথির ইঙ্গিত (নাম পুরোনো)
কলকাতা/ঢাকা সার্ভে মানচিত্র, ব্রিটিশ-আমলের রেভিনিউ/সার্ভে রেকর্ডে “Mohammadpur” নামে মৌজা দেখা যায়—লোকেশন বর্তমান রায়েরবাজার–বোসিলা–জাফরাবাদ–কাতাসুর ঘিরে।
মোগল আমলে পাশেই দাঁড়ানো সাত গম্বুজ মসজিদ (১৭শ শতক, শায়েস্তা খাঁ-পর্ব)–এর ওয়াক্ফ/খাস জমির চারপাশে যে মুসলিম বসতি বেড়েছিল, স্থানীয়রা সেটাকেই “মুহাম্মদ-পুর” বলত—এটাই নামটাকে টিকিয়ে রেখেছে বলে গবেষকেরা ধারণা করেন।
> সারমর্ম: “মোহাম্মদপুর” নাম DIT-এর আগেই ছিল; মানচিত্র/রেকর্ডে প্রমাণ মেলে।
৩) আধুনিক নগরায়ণ—নামটা স্থায়ী হয়
১৯৫০–৬০ দশকে DIT (Dhaka Improvement Trust) এখানে Mohammadpur Housing Estate/Model Town গড়ে তোলে।
তখনকার ব্লক/রোডের নামগুলো (বাবর, হুমায়ুন, নূরজাহান, তাজমহল রোড ইত্যাদি) মোগল-ঐতিহ্যের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে আগের “Mohammadpur” নামটাকেই আনুষ্ঠানিক ও শহুরে ব্র্যান্ডিং দেয়।
পরের দশকগুলোতে থানা/ওয়ার্ড গঠনের সময়ও সেই প্রচলিত নামই প্রশাসনিক নাম হয়ে যায়।
বিকল্প/লোকজ ব্যাখ্যা যা শোনা যায়
কোনো স্থানীয় জমিদার/ফৌজদার “মুহাম্মদ খান/শাহ”-এর নামে নামকরণ—এমন লোককথা আছে, কিন্তু নির্ভরযোগ্য নথি কম।
মোগল শাহজাদা মুহাম্মদ আজম শাহ–এর স্বল্পকালীন ঢাকাবাসের সঙ্গে নাম জোড়ার চেষ্টা হলেও প্রমাণ দুর্বল—গবেষকেরা একে কম সম্ভাব্য বলে দেখেন।
> অর্থাৎ, শক্ত নথির দিক থেকে মৌজা-নাম + DIT-এর নগরায়ণ—এই দুইয়ে “মোহাম্মদপুর” স্থির হয়, কোনো একক ব্যক্তির নামে নয়।
মোহাম্মদপুর নামটা নতুন নয়—ব্রিটিশ আমল থেকেই এ এলাকা “Muhammadpur” নামে মৌজা ছিল। নামের গঠন “মুহাম্মদ + পুর” = মুহাম্মদের বসতি; মোগল আমলে সাত গম্বুজ মসজিদের চারপাশে মুসলিম বসতি গড়ে ওঠায় নামটি প্রচলিত হয়। ১৯৫০–৬০ দশকে DIT এখানে Mohammadpur Model Town গড়লে পুরনো নামটাই আধুনিক শহুরে পরিচয় পায়। লোককথায় কখনো কোনো “মুহাম্মদ খান/শাহ”-এর নাম জুড়ে ব্যাখ্যা করা হলেও শক্ত নথি বলছে—পুরনো মৌজা-নাম + পরিকল্পিত নগরায়ণ = আজকের “মোহাম্মদপুর”।
সাত মসজিদের গল্প—আরও কিছু
নির্মাণকাল: মোগল শাসনামল, ১৭শ শতক (শায়েস্তা খাঁ পিরিয়ডে)।
বৈশিষ্ট্য: সাত গম্বুজের ক্লাসিক বিন্যাস, চার কোণে অষ্টভুজ মিনার, অলংকরণের সূক্ষ্ম কাজ।
প্রেক্ষাপট: একসময় নদীর বন্যাপ্লাবিত পাড়ে দাঁড়ানো “সীমানা-মসজিদ”, আজ নগরায়ণে ঘেরা।
মুক্তিযুদ্ধ, গণঅভ্যুত্থান ও স্মৃতিচিহ্ন
আসাদ গেট: ১৯৬৯ সালের ছাত্রনেতা শহীদ আসাদের স্মৃতিতে ‘আয়ুব গেট’ নাম বদলে ‘আসাদ গেট’—মোহাম্মদপুরের গণঅভ্যুত্থানের সাক্ষী এক তোরণ।
শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ (রায়েরবাজার): ১৯৭১-এর ১৪ ডিসেম্বরের নৃশংস বুদ্ধিজীবী হত্যার স্মৃতিবাহী স্মৃতিসৌধ—রায়েরবাজারের ইটভাটার স্থানে নির্মিত, মোহাম্মদপুর থানার ভেতরেই অবস্থান।
মোহাম্মদপুরের বিহারি ক্যাম্প—জেনেভা ক্যাম্পের কাহিনি
১৯৭১-এর পর আন্তর্জাতিক রেডক্রস (ICRC)-এর তত্ত্বাবধানে মোহাম্মদপুরে স্থাপিত জেনেভা ক্যাম্প—দেশের বৃহত্তম উর্দুভাষী (বিহারি) কমিউনিটির বসতি। “জেনেভা” নামটি এসেছে ICRC-এর সদর দপ্তরের শহরের নাম থেকে। সময়ের সঙ্গে নাগরিকত্ব ও অধিকার নিয়ে নানা অধ্যায় পেরিয়ে আজও এখানে হাজারো মানুষের ঘনবসতি, নিজস্ব অর্থনৈতিক-সাংস্কৃতিক জীবনচক্র।
মোহাম্মদপুরের উল্লেখযোগ্য ঐতিহাসিক/ঐতিহ্যচিহ্ন
সাত গম্বুজ মসজিদ ও বিবির মাজার (সাত মসজিদ রোড) – মোগল স্থাপত্য।
আল্লাকুড়ি মসজিদ (মোহাম্মদপুর কলোনি/জেনেভা ক্যাম্পের কাছে) – ১৭শ-১৮শ শতকের প্রাচীন মসজিদ।
আসাদ গেট ও আসাদ এভিনিউ – ১৯৬৯ গণঅভ্যুত্থানের স্মারক।
শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ, রায়েরবাজার – ১৯৯৯ সালে সম্পন্ন জাতীয় স্মৃতিচিহ্ন।
বোসিলা/বেরিবাঁধ নদীপাড় – বুড়িগঙ্গা-তুরাগের সঙ্গম-অঞ্চল ও পুরনো বুড়িগঙ্গার চ্যানেল এলাকার ধারাবৃত্ত ইতিহাস।
রামচন্দ্রপুর খাল ও চাঁদ উদ্যান-সংলগ্ন জলাধার – পশ্চিম ঢাকার বৃষ্টির জল নিষ্কাশনের ঐতিহ্যবাহী নালা-ব্যবস্থা।
আজকের মোহাম্মদপুর
DIT-পরিকল্পিত হাউজিং, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বাজার, দারুশ সালাম-আদাবর-লালমাটিয়া-রায়েরবাজারের মতো উপ-পাড়া মিলিয়ে আজ মোহাম্মদপুর এক বৈচিত্র্যময় নাগরিক আবাস। অথচ একটু হাঁটলেই ধরা পড়ে মোগল যুগের ইট-পাথর, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচিহ্ন, আর জেনেভা ক্যাম্পের দীর্ঘ সামাজিক ইতিহাস—সব মিলেই মোহাম্মদপুর একটি ‘লেয়ার্ড সিটি’।
__________________________
লেখা-মো:নাঈম ভুইয়া ||
এডমিন-ঢাকার গণপরিবহন ||
_________________________
#মোহাম্মদপুর #পুরানঢাকা #ঢাকারইতিহাস #ঐতিহাসিকঢাকা #ঢাকারপ্রাচীনঐতিহ্য #ঢাকারঐতিহ্য #ঢাকারপ্রাচীনস্থাপনা #পুরানঢাকারগল্প #ঢাকারপুরানচিত্র #ঢাকারঅতীত
#সাতমসজিদ #মোগলস্থাপত্য
#বুড়িগঙ্গা #ঢাকারনদী
#মোহাম্মদপুরনামকরণ
#জেনেভাক্যাম্প #উর্দুভাষীসম্প্রদায় #শহীদআসাদ
#১৯৭১