19/03/2025
ফিজিওথেরাপিস্টরা কি ডাক্তার?
----------------------------------------------
ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা যারা প্রদান করেন, তারা ফিজিওথেরাপি চিকিৎসক। উনারা বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসা অনুষদ থেকে ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা বিষয়ে পাঁচ বছর ( তত্ত্বীয় চার বছর ও ইন্টার্নশিপ এক বছর) পড়াশোনা করেন। এছাড়াও ফিজিওথেরাপি চিকিৎসকদের সহকারী হিসাবে সহায়তা করার জন্য ৩-৪ বছর মেয়াদি "ডিপ্লোমা ইন মেডিকেল টেকনোলজি" কোর্স রয়েছে।
এই যে আমি এখানে ফিজিওথেরাপি চিকিৎসক বললাম, এটাতে কিছু মানুষের আপত্তি থাকলেও ৫ বছর মেয়াদী "ব্যাচেলর অব সাইন্স ইন ফিজিওথেরাপি (বি.পি.টি)" ডিগ্রিধারীরা যে ফিজিওথেরাপিস্ট, সে বিষয়ে তাদের কোনও আপত্তি নাই।
আসুন এবার "ফিজিওথেরাপিস্ট" শব্দটি বিশ্লেষণ করি। "ফিজিওথেরাপিস্ট" শব্দটি "ফিজিক্যাল" ও "থেরাপিস্ট" দুটি শব্দের সমন্বয়ে গঠিত। তো "ফিজিক্যাল" শব্দের অর্থ এখানে "ভৌত" এবং " থেরাপিস্ট" শব্দের অর্থ " চিকিৎসক"। সুতরাং "ফিজিওথেরাপিস্ট" অর্থ ভৌত চিকিৎসক। এখন আপনার মনে না মানলে চিকিৎসা শাস্ত্রে থেরাপিস্ট আর ডক্টর যে সমার্থক, তা আগে জেনে নিন।
এবার আসুন যারা বলেন এমবিবিএস বিডিএস ব্যতীত কেও ডাঃ লিখতে পারবে না, তাদের মত নিয়া কথা বলি।
আচ্ছা ভাই, এমবিবিএস ও বিডিএস কিসের ভিত্তিতে ডাঃ লিখে? তো সহজ উত্তর "বিএমডিসি আইন ২০১০" এর ভিত্তিতে। এই আইনটি কাদের জন্য, ভাই? যারা এ্যালোপ্যাথিক সিস্টেম অব মেডিসিন প্র্যাকটিস করে, তাদের জন্য। ফিজিওথেরাপিস্টরা কি এ্যালেপ্যাথিক সিস্টেম অব মেডিসিনে প্রাকটিস করে?মোটেই না।
ফিজিওথেরাপি হলো ভৌত চিকিৎসা পদ্ধতি যেখানে বল, তাপ, চাপ, গতি, তরঙ্গ, শক্তি, জল, শৈত্য, বিদ্যুৎ ইত্যাদি বিভিন্ন ভৌত উপাদান ও পদ্ধতি দিয়ে চিকিৎসা করা হয়। আর এ্যালোপ্যাথি সিস্টেম অব মেডিসিন হলো এ্যালোপ্যাথিক ড্রাগ দিয়ে চিকিৎসা করা হয়। আরো সোজা কথায় এ্যালোপ্যাথি, হোমিওপ্যাথি এসব হলো ফার্মাসিউটিক্যাল চিকিৎসা পদ্ধতি, আর ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা পদ্ধতি হলো নন-ফার্মাসিউটিক্যাল চিকিৎসা পদ্ধতি।
শুধু তাই নয়, এ্যালোপ্যাথিক প্রেসক্রিপশন এবং ফিজিওথেরাপি প্রেসক্রিপশনও সম্পূর্ণ পৃথক ধরনের। কাজেই ফিজিওথেরাপি কখনোই বিএমডিসি আওতাভুক্ত ছিলো না। তারপরও জাস্ট হয়রানি করার যে দূরাভিলাষ কিছু কুচক্রী লোকের ছিলো "বিএমডিসি আইন-২০১০" এর ২৯ নং ধারা দিয়ে, তাও মহামান্য হাইকোর্ট ফিজিওথেরাপিস্টদের উপর প্রয়োগমূলক নয় বলে স্হগিত করে দিছে।
এবার আসুন পরের কথায়। যখন আইনুকানুন ছিলো না, তখন লোকে কিসের ওপর ভিত্তি করে ডাঃ হতো বা লিখতো? নিশ্চয়ই তার অর্জিত নলেজ এবং সেই নলেজ রোগীর সমস্যা নির্ণয় করে সমাধানক্ষম কি না, তার উপর ভিত্তি করেই লিখতো। সেই হিসেবেও ফিজিওথেরাপিস্টদের ডাঃ বলতে হবে। কারণ ফিজিওথেরাপিস্টদের অর্জিত নলেজ পর্যাপ্ত এনাটমি, ফিজিওলজি, বায়োকেমিস্ট্রি, অর্থোপেডিক্স, কাইনেসিওলজি, প্যাথলজি, রিউম্যাটোলজি, মাইক্রোবায়োলজি ও ফার্মাকোলজি সমৃদ্ধ। যার বিশ্বাস হবে না, তিনি বিপিটি কারিকুলাম পড়ে দেখতে পারেন। আর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা তার "ক্লাসিফিকেশন অব হেলথওয়ার্কার" এ বলে দিছে যে, ফিজিওথেরাপিস্টরা সমস্যা নির্ণয় এবং সমাধান পরিকল্পনা প্রণয়নে সক্ষম। সুতরাং এর পরেও অবিশ্বাসের কারণ থাকতে পারে না।
এবার আসুন একদল লোক মনে করে যে, ফিজিওথেরাপিস্টরা ফিজিক্যাল মেডিসিন এন্ড রিহ্যাবিলিটেশনের অন্তর্ভুক্ত। এটিও স্বল্প নলেজের বহিঃপ্রকাশ। ফিজিক্যাল মেডিসিন একটি আলাদা ধারা। আর রিহ্যাবিলিটেশন একটি টিম এপ্রোচ, সেখানে বহু পেশাজীবি কাজ করে। ফিজিওথেরাপির কাজটুকু ফিজিওথেরাপিস্টরা করে। এটার মানে এটা নয় যে, ফিজিওথেরাপি মানেই রিহ্যাব। একজন এনেস্থেলজির ডাক্তার অপারেশন থিয়েটারে টিম মেম্বার হিসেবে থাকেন বলে এটা নয় যে, পেইন ম্যানেজমেন্টে তাদের পৃথক সত্তা নাই। রিহ্যাবের বাইরেও ফিজিওথেরাপির স্বাধীন সত্তা আছে মাস্কুলোস্কেলটাল মেডিসিনে, আছে নিউরোলজিতে, আছে ইউরোলজিতে, আছে স্কিন ভিডিতে, আছে ওমেন হেলথে, আছে ফিটনেস কেয়ারে, আছে পিডিয়াট্রিক্সে। এত বিস্তৃত একটা বিষয়কে রিহ্যাবের ভিতর চাপিয়ে দেওয়াও এক ধরনের মূর্খতা। দুর্ভাগ্য এই মুর্খতার শিকার অনেক শিক্ষিতরাও। এরপরও কিছু লোক নানান কথা দিয়ে প্যাচাঁবে। তাদের জন্য একটু ইতিহাস বলি। ১৯২৯ সালের আগে ফিজিক্যাল মেডিসিন বলে কিছু ছিলো না। তখনও ফিজিওথেরাপি ছিলো। ম্যাকেন্জি সাহেব ১৯০৪ সালে পেনসেলভেনিয়া ইউনিভার্সিটিতে ফিজিওথেরাপি পড়াতেন মেডিকেল স্টুডেন্টদের। তিনি তখন "দ্যা হ্যান্ডবুক অব ফিজিক্যাল থেরাপি" নামক টেক্সটবুক লিখেন। তার সেই বই পড়া ছাত্রদের একজন 'জন স্ট্যানলি' ফিজিক্যাল মেডিসিন স্পেশালিটি তৈরির চেষ্টা শুরু করেন। তখন আমেরিকায় ছিলো "আমেরিকান কলেজ অব রেডিওলজি এন্ড ফিজিওথেরাপি"। ১৯২৩সালে এটারই নামকরন করা হয় "আমেরিকান কংগ্রেস অব রিহ্যাবিলিটেশন মেডিসিন", যেটার সদস্য ছিলো ফিজিক্যাল থেরাপি ফিজিশিয়ান (যারা পরবর্তীতে ১৯৩৮ সালে নিজেদের ফিজিয়াট্টিস্ট বলা শুরু করে এবং লোকে যাদের ফিজিক্যাল মেডিসিন বলে জানে), ফিজিক্যাল থেরাপি টেকনিশয়ান (এরা কিন্তু ফিজিওথেরাপিস্ট ছিলো না) এবং রেডিওলজিস্টরা। পরবর্তীতে ১৯৩৮ সালে এই ফিজিক্যাল থেরাপি ফিজিশিয়ানরা মনে করেন তাদের ভিন্ন ধারায় মেডিকেল স্পেশালিটি হিসেবে বেড়ে ওঠা উচিৎ। সেই হিসেবে ১৯৩৮ সালে তারা "আমেরিকান এ্যাসোসিয়েশন অব ফিজিক্যাল মেডিসিন" এর যাত্রা শুরু করেন। তারও বহু আগে ১৯২১ সালে ম্যারি ম্যাকমিলান কতৃক "আমেরিকান ফিজিক্যাল থেরাপি এ্যাসোসিয়েশন" গঠিত হয়। তারও আগে ১৮৯৪ সালে "চার্টার্ড সোসাইটি অব ফিজিওথেরাপি" লন্ডনে গঠিত হয়। সুতরাং বুঝা গেলো, ফিজিক্যাল মেডিসিন থেকে ফিজিওথেরাপি আসে নাই। বরং ফিজিওথেরাপি থেকে ফিজিক্যাল মেডিসিন জন্ম নিছে।
আজও আমেরিকায় ফিজিক্যাল মেডিসিন আছে, আছে ফিজিওথেরাপিস্টরাও। কিন্তু কেউ কারো অধীন নয়। ফিজিক্যাল মেডিসিন আলাদা রোগী দেখে, ফিজিওথেরাপিস্টরাও আলাদা বিভাগে রোগী দেখে।
এবার বাংলাদেশের কথায় আসি। বাংলাদেশেও ফিজিওথেরাপি ১৯৫৮ সালে আসছিলো। ১৯৬০ সালে ঢাকা মেডিকেলে ফিজিওথেরাপি বিভাগ চালু হয়। এই ঢাকা মেডিকেলে ইলেক্ট্রোথেরাপিরও আলাদা বিভাগ ছিলো। চট্টগ্রাম মেডিকেলসহ আরো কয়েকটি মেডিকেলে পরে ফিজিওথেরাপি বিভাগ চালু করা হয়।
১৯৬৯ সালে ঢাকা মেডিকেলের সেই ফিজিওথেরাপি বিভাগটি দখল করে "ফিজিক্যাল মেডিসিন" বিভাগ নামে এদেশের ফিজিক্যাল মেডিসিন এর যাত্রা শুরু হয়।
সুতরাং আজকে এদেশে ফিজিওথেরাপিস্টরা ডাঃ নয় বলার আগে ইতিহাসটা জেনে বলুন। তাহলে মনুষ্যত্ব থাকলে নিজের কিছুটা হলেও লজ্জা পাওয়ার কথা।
সবশেষ কথা বলি ইংল্যান্ডে এ্যালোপ্যাথিক ফিজিশিয়ানরা ডাঃ লিখে। ডাঃ লিখে না সার্জনরা। তাই বলে সার্জনরা চিকিৎসক নয়?
সার্জনদের সবচেয়ে বড় শক্তি এনাটমি। (সার্জারী কোনও প্যাথির অন্তর্ভুক্ত নয়, এটি পৃথক সিস্টেম অব ট্রিটমেন্ট)। সার্জনরা তার এনাটমির নলেজ শরীর কেটে প্রয়োগ করে, আর ফিজিওথেরাপিস্টরা খালি চোখে শরীর না কেটে এনাটমির নলেজ প্রয়োগ করে। সেই বিচারে ফিজিওথেরাপিস্টরা সার্জনদের আগে ডাঃ লিখার ও চিকিৎসক হওয়ার যোগ্যতা রাখে।
উপমহাদেশের সার্জনরা ইংল্যান্ডকে ফলো করলেও ডাঃ লিখার বেলায় উপমহাদেশের ট্রেন্ডকে আইন বানিয়ে তা ফলো করে। আর পুরো উপমহাদেশে ভারত, পাকিস্তানে ফিজিওথেরাপিস্টরা ডাঃ লিখে প্র্যাকটিস করলেও বাংলাদেশের বেলায় অনেকের মানতে কষ্ট লাগবে। তা লাগারই কথা। কারণ দীর্ঘদিন আয়া বুয়াকে ব্যায়াম শিখায়া রোগীদের কাছে যারা বলেছে এরাই "ফিজিওথেরাপিস্ট"। হঠাৎ করে বিপিটি ডিগ্রিধারীদের রোগীদের কাছে ডাঃ বলতে তাদের জ্বলে বৈকি।
এইদেশে এই ডাঃ বিভ্রান্তি দূর হয়ে সকল চিকিৎসকদের মানুষ তার জেনেরিক নেম যেমন ইউরোলজিস্ট, নেফ্রোলজিস্ট, ফিজিশিয়ান, জেনারেল সার্জন, হাকীম, কবিরাজ, ফিজিওথেরাপিস্ট, ডেন্টিস্ট ইত্যাদি নামে জানুক; প্রতারিত না হোক, এই প্রত্যাশায় এখানেই শেষ করছি।
© ডাঃ মোহাম্মদ আলাউদ্দিন।