03/06/2025
( #সত্য_ঘটনা_অবলম্বনে)
ভদ্রলোকের বয়স পঁয়তাল্লিশের উপর। জানতে পারি, পনেরো বছর আগে তিনি তার স্ত্রীকে ডিভোর্স দিয়েছিলেন। সমস্যা ছিল বউ-শাশুড়ির দ্বন্দ্ব। ভদ্রলোক পরিবারের ছোট সন্তান, স্বাভাবিকভাবেই মায়ের প্রতি ছিল সবচেয়ে বেশী টান। বিয়ের প্রথম দিকে সবকিছু ভালোই চলছিল। সমস্যা শুরু হয়, যখন তিনি জীবিকার তাগিদে দুই কন্যা সন্তানকে রেখে বিদেশে পাড়ি জমান।
দেশ থেকে একের পর এক ফোন আসতো মায়ের। সারাক্ষণ বউ নিয়ে কতো অভিযোগ! কতো রাগ-ক্ষোভ! মায়ের কথা শুনে তিনিও স্ত্রীকে ঝাড়তেন। উনার মাথায় গেঁথে গিয়েছিল স্ত্রী মানেই নিজের মায়ের সেবিকা। যদিও উনার স্ত্রী শাশুড়ীকে যথেষ্ট শ্রদ্ধা করে চলতেন। তারপরেও অভিযোগের শেষ ছিল না।
ভদ্রলোক কখনোই স্ত্রীকে যাচাই করেন নি। একটাবারও জিজ্ঞেস করেন নি। স্ত্রীর কথা শুনতে চান নি। ফলশ্রুতিতে ডিভোর্স। একপাক্ষিক শ্রবণ ধ্বংস করে দিয়েছে আট বছরের সংসার। ডিভোর্সের পর উনার স্ত্রীর পুনরায় বিয়ে হয়। বর্তমানে তিনি খুব সুখে আছেন।
কিন্তু, সমস্যা হয় ভদ্রলোকের জীবনে। সন্তানের কথা ভেবে দেশে ফিরে আসেন। মায়ের পছন্দে পুনরায় বিয়ে করলেও সুখকর হয় নি। চোখের সামনে নিজের মায়ের করা অত্যা"চারে দ্বিতীয় স্ত্রী চলে গেছে। এরপর উনার মেয়ে দু'টি চলে যায় নিজের মায়ের কাছে। সেখান থেকে নানাবাড়িতে তাদের ঠাঁই হয়। তারা কোনোভাবেও দাদীর কাছে থাকতে চায় না।
সময় গড়ালো, ভদ্রলোকও বুঝলেন সমস্যাটা কার মধ্যে ছিল! জীবনের সমস্ত ব্যর্থতার দায়ে মায়ের থেকে সরে যেতে চাইলেন। তখনই মা উল্টো ছেলের নামে গ্রামে সালিশ বসান। অভিযোগ করেন, পুত্র তাকে বের করে দিতে চায়। মাথায় হাত পরে বিচারকদের! কি অবাধ্য সন্তান! যে-ই মা দশমাস গর্ভে ধারণ করলো, সে-ই মা'কে বের করে দেবে? কতো বড় দুঃসাহস!
ভদ্রলোক কাউকেই নিজের পরিস্থিতি বুঝাতে পারেন নি। তিরস্কার ও ধিক্কারের বোঝা মাথায় নিয়ে তাকে গ্রাম ছাড়তে হলো। কারণ, পৈত্রিক যে জায়গাটায় তিনি বাড়ি তৈরী করেছিলেন, সেটি ছিল তার মায়ের নামে। আসলেও কি মায়ের নামে ছিল? এটা তিনি জানেন না। অথচ, শৈশব থেকেই শুনে আসছেন সমস্ত জায়গা ছেলে-মেয়েদের নামে। বাকি সবাই নিজেদের অংশ অনেক আগেই বুঝে নিলেও ভদ্রলোক নেন নি। তিনি মায়ের সঙ্গে ছিলেন এবং থেকেছেন।
নিজের জায়গা জেনে গড়া বাড়িটির মালিক এখন তার মা। সেখানে ভাই-বোনেরা দলবেঁধে আসছে, শুধু তাকে কেউ ডাকছে না। বেলা শেষে উনার কাছে একটি পাসপোর্ট ছাড়া আরকিছুই রইলো না। নিজের বড় মেয়ের বিয়েতেও তিনি আমন্ত্রণ পান নি। মেয়েরা তাকে দেখতেই চায় না।
এক অন্ধ বিশ্বাস শুধু তার স্ত্রী-সংসার নয়, বরং নিজের সন্তানদেরকেও অনেক দূরে সরিয়ে দিয়েছে। পুরো জীবনটাই গেল মিথ্যের উপর। তার-ই জন্মদাত্রী মা যে তার স্ত্রী ও সন্তানের বেলায় এতোটা বিষাক্ত হবে, তা তিনি কল্পনাও করেন নি। আজ তিনি নিঃস্ব, বেঁচে থাকার কোনো যৌক্তিকতা খুঁজে পান না। তবুও বেঁচে আছেন, শুধুমাত্র একটিবারের জন্য মেয়েদেরকে দেখতে। তাদের মুখে ‘বাবা’ ডাকটা শুনতে।
জীবন কতো বৈচিত্র্যময়! কি নিদারুণ অপেক্ষা! কতো আক্ষেপ জড়িয়ে আছে বেঁচে থাকার প্রতিটা মূহুর্তে!
আপনার শ্রদ্ধাভাজন মা আপনার জন্য কল্যাণকর হলেও, আপনার স্ত্রীর জন্য সেটা না-ও হতে পারেন। এটা আসলে আমাদের সবার-ই জন্য মেনে নেওয়া খুব কঠিন। যে মা'কে আমরা চোখে হারাই, যার মমতায় বেড়ে ওঠি, সে-ই মা অন্যের জন্য বিষাক্ত! এটা ভাবতেই ভয়ংকর লাগে। মন-মস্তিষ্ক কোনো যুক্তিতেই বিশ্বাস করতে চায় না। এরপরেও বিশ্বাস করতে হবে। অপর একটি প্রাণের জন্য হলেও মানতে হবে।
কেউ কেউ মেনে নিয়েও মুখে তা স্বীকার করেন না। কেবল মায়ের দিকে তাকিয়ে। কিন্তু, আপনার মায়ের পাশাপাশি নিজের সন্তানের মা'কেও বিবেচনায় রাখতে হবে। তার কথাও ভাবতে হবে। যতো যা-ই হোক, নিজের মায়ের সম্মান ধরে রাখতে নিজের সন্তানের মায়ের জীবন বিপন্ন করে তুলবেন না। কারণ, এতে আপনার সন্তানও বিপর্যস্ত হবে।
টক্সিক মাদার বা শাশুড়ী কিংবা অন্য কেউ, বরাবরই ভয়ংকর রূপ। তারা যতোই মায়াবী হোক না কেন বেলা শেষে এক স্বর্থপর মুখ।