29/05/2025
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ছিন্নপত্র' নিয়ে কিঞ্চিৎ গবেষণা।
“এই আঁকাবাঁকা ইছামতী নদীর ভিতর দিয়ে চলেছি। এই ছোটো খামখেয়ালাই বর্ষাকালের নদীটি-এই-যে দুই ধারে সবুজ ঢালু ঘাট, দীর্ঘ ঘন কাশবন, পাটের ক্ষেত, আখের ক্ষেত আর সারি-সারি গ্রাম-এ যেন একই কবিতার কয়েকটা লাইন, আমি বারবার আবৃত্তি করে যাচ্ছি এবং বারবারই ভালো লাগছে। পদ্মার মতো বড়ো নদী এতই বড়ো সে যেন ঠিক মুখস্থ করে নেওয়া যায় না, আর এই কেবল ক’টি বর্ষা-দ্বারা অক্ষর-গোনা ছোটো বাঁকা নদীটি যেন বিশেষ করে আমার হয়ে যাচ্ছে।
পদ্মানদীর কাছে মানুষের লোকালয় তুচ্ছ, কিন্তু ইছামতী মানুষ-ঘেষা নদী; তার শান্ত জলপ্রবাহের সঙ্গে মানুষের কর্মপ্রবাহের স্রোত মিশে যাচ্ছে। সে ছেলেদের মাছ ধরবার এবং মেয়েদের স্নান করবার নদী। স্নানের সময় মেয়েরা যে-সমস্ত গল্পগুজব নিয়ে আসে সেগুলি এই নদীটির হাস্যময় কলধ্বনির সঙ্গে এক সুরে মিলে যায়। আশ্বিন মাসে মেনকার ঘরের পার্বতী যেমন কৈলাসশিখর ছেড়ে তাঁর বাপের বাড়ি দেখে শুনে যান, ইছামতী তেমনি সম্বৎসর অদর্শন থেকে বর্ষার কয়েক মাস আনন্দহাস্য করতে করতে তার আত্বীয় লোকালয়গুলির তত্ত্ব নিতে আসে। তার পরে ঘাটে ঘাটে মেয়েদের কাছে প্রত্যেক গ্রামের সমস্ত নূতন খবর শুনে নিয়ে, তাদের সঙ্গে মাখামাখি সখিত্ব করে আবার চলে যায়”।
পাবনা জেলার মাঝ দিয়ে বয়ে যাওয়া আঁকাবাঁকা ইছামতী নদী নিয়ে উপরের এই অসাধারণ চিঠিটির লেখক কিন্তু কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এটি তাঁর বিখ্যাত ‘ছিন্নপত্র’ গ্রন্থখানির ১৪৬ নম্বর পত্র। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নজনকে এবং বিভিন্ন স্থান থেকে লেখা কবিগুরুর চিঠিপত্রের সংকলনই ‘ছিন্নপত্র’। এর প্রথম প্রকাশকালে ১৫১ খানি পত্র ছিল, অথচ এখন পত্র সংখ্যা ১৫৩। যদিও মূলগ্রন্থে আরো দুইখানি নূতন পত্র সংযোযিত হয়েছে। অবশ্য বহু চিঠিই গ্রন্থভুক্ত করা হয়নি।
ছিন্নপত্রের চিঠিগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে যে, তিনি মোটামুটি ২২টি স্থান থেকে চিঠি লিখেছেন। সবগুলো স্থানের নাম পেশ করা যেতে পারে। যথাঃ বন্দোরা সমুদ্রতীর, সোমপুর, দার্জিলিং, শিলাইদহ, কলিকাতা, সাজাদপুর (এখনকার শাহজাদপুর), লন্ডন, পতিসর, কালিগ্রাম, চুহালি (চৌহালি), কটক, তিরন, বোলপুর, গোয়ালন্দ, বোয়ালিয়া, নাটর, বালিয়া, পুরী, ইছামতী, কুস্টিয়া, দিঘাপতিয়া, পাবনা। ২২টি স্থানের মধ্যে সবচেয়ে বেশী চিঠি লিখেছেন যে সকল স্থান থেকে সেগুলো হলো যথাক্রমে, শিলাইদহ-৫৬টি, সাজাদপুর-২৬টি, পতিসর-১৩টি, কলিকাতা-১১টি, বোলপুর-৯টি। এই গ্রন্থে ৬টি চিঠি আছে যেখানে স্থানের নাম উল্লেখ নেই।
সমস্ত চিঠি বিশ্লেষণ করে আরো জানা যায় যে, চিঠির সিংহভাগ তিনি বাংলাদেশের মাটিতে বসে লিখেছিলেন। এর অন্যতম কারণ কবির পারিবারিক জমিদারী দেখাশোনা। ১৮৯০ সালের জানুয়ারি মাসে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার বাবার নির্দেশে শাহজাদপুরে এসে জমিদারির দায়িত্ব নেন। রবীন্দ্রনাথ শাহজাদপুরে প্রায় আট বছর জমিদারির দায়িত্ব পালন করেন।
যাইহোক, রবীন্দ্রনাথের ছিন্নপত্র পড়াটা এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা। ছিন্নপত্র-এর মতো এত সুন্দর বর্ণনায় বাংলাদেশের আকাশ-নদী-মাঠ-দুপুর-সন্ধ্যা-রোদ-আলো-হাওয়া-বর্ষা-রাত ও অন্ধকারকে চোখের সামনে ভেসে উঠতে, জেগে থাকতে অথবা মিলিয়ে যেতে আর কোথাও দেখিনি। প্রকৃতির ‘বৃহৎ উদার বাক্যহীন স্পর্শ’ আর কোনো বর্ণনায় পাইনি। প্রকৃতি যখন আমাদের অনুভবের ভেতরে জায়গা করে নেয়। তখন আমরাও এক গভীর পুলকে বলতে পারি ‘কী শান্তি, কী স্নেহ, কী মহত্ত্ব, কী অসীম করুণাপূর্ণ বিষাদ’। অথচ এসব থেকে কত যোজন দূরে আমরা ঘুরে বেড়াই।
ছিন্নপত্র না পড়লে, এর জাদুবিস্তারি ভাষায় জড়িয়ে না পড়লে আমাদের প্রকৃতি পাঠ হয়তো অনেকটাই অসম্পূর্ণ থেকে যায়। ছিন্নপত্রকে বলা যায় জীবনানন্দ দাশের রূপসী বাংলার পূর্ববর্তী চিঠির সংস্করণ। ছিন্নপত্রে আছে বাঙলাদেশের প্রকৃতি, নেই বাঙলাদেশের মানুষের জীবন-মরণের সংগে সম্পৃক্ত টানাপড়েন। ছিন্নপত্রে আছে প্রকৃতির বর্ণনার ঠাসবুনন, রয়েছে অজস্র উপমা রূপকের ব্যবহার, তুচ্ছাতিতুচ্ছ বিষয়বস্তু, প্রাণি-উদ্ভিদের নিখুঁত বর্ণনা; মনে হবে কবির চোখে কিছুই এড়ায়নি; ছোট্ট তৃণটি থেকে বৃহদাকার হাতি, বর্ষার পদ্মার স্রোত থেকে ঝিলের এক টুকরো নিস্তব্ধ জল, কোলকাতার কোলাহল থেকে শিলাইদহের চরের নির্জনতা-সব কিছুর অনুপঙ্খ বর্ণনা পাওয়া যায় ছিন্নপত্রে। আরো পাওয়া যায় মনের অবস্থা, হৃদয়ের ব্যাকুলতা, ভালোবাসার আধিক্য, হৃদপিণ্ডের গান, দৃশ্যের সৌন্দর্য, কবিতার প্রাবল্য, প্রকৃতির ঘাত-প্রতিঘাত।
রবি ঠাকুর সাজাদপুর আসতেন আমাদের ইছামতী নদীর ভেতর দিয়েই। আরো বেশ কয়েকটি চিঠিতে তিনি এই নদীর নাম উল্লেখ করেছেন। এমনটি ৮৯ নং চিঠিখানি তিনি ইছামতী নদীবক্ষে বসেই লিখেছিলেন।